প্রবন্ধ এডগার অ্যালান পো’র অপহৃত চিঠি এবং লাকাঁর ভাষিক নির্জ্ঞান

মার্কিন সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো’র অন্যতম জনপ্রিয় গল্প The Purloined Letter বা অপহৃত চিঠি। বৌদ্ধিক সমাজে গল্পটা এত সাড়া ফেলে যে, বিদ্বজনদের কাছ থেকে এর নানারকম পাঠ উন্মোচিত হৈতে থাকে। ম্যারী বোনাপার্ত, মিশেল ফুকো, জাক লাকাঁ, দেরিদা, জিজেক, হল রবিন্স এমন আরো অনেকেই এই গল্পের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এই প্রবন্ধে আমরা উক্ত গল্পের জাক লাকাঁর বিশ্লেষণ সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলব।

 

এই গল্পের ব্যাখ্যায় জাক লাকাঁ মূলত ফ্রয়েডীয় দুইটা তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তাহার আলোচনা চালিয়ে যান। প্রথমটা হৈল ফ্রয়েডের অবদমন তত্ত্ব (Repression) এবং অন্যটা Repition Compulsion বা পুনরাবৃত্তির বাধ্যতা। ফ্রয়েডের অন্যতম জনপ্রিয় লেখা Beyond the Pleasure Principle-এ এই নিয়ে বিস্তারিত বলা আছে এবং এই তত্ত্বগুলার সাথে যুক্ত হয় ফার্দিনান্দ সস্যুরের ভাষাতাত্ত্বিক চিন্তা।

 

এই গল্পের লাঁকানীয় বিশ্লেষণে যাবার আগে গল্পটার একটা সারাংশ তুলে ধরা যাক।

 

গল্পে চরিত্র-সংখ্যা একেবারেই কম। রাজা, রাণী, মন্ত্রী, পুলিশ ইন্সপেক্টর, গোয়েন্দা দ্যুপাঁ এবং গল্পকথক ( ন্যারেটর)। রাণী একটা চিঠি পাঠ করছিলেন। চিঠির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে লেখক আমাদের কিছুই বলেন না। তবে চিঠিটা যে অত্যন্ত গোপনীয় এবং এর বিষয়বস্তু ফাঁস হওয়া-না-হওয়ার সাথে যে রাণীর সম্মান জড়িত তা বোঝা যায়। রাণী যখন নিমগ্নচিত্তে চিঠিপাঠে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়েই রাজার প্রবেশ। রাণী তড়িঘড়ি করে চিঠিটা টেবিলের ওপর উলটে রাখেন। কিন্তু তাতে প্রাপিকার নাম দৃশ্যমান থেকে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রীর প্রবেশ ঘটে। মন্ত্রী চিঠিতে প্রাপিকার নাম এবং হস্তাক্ষর দেখে বুঝে গেলেন এর রচয়িতা কে এবং সেই সাথে রাণীর উদ্বেগমূলক এক্সপ্রেশন তার ধারণাকে আরো জোরদার করে তোলে। ফলে সে বুঝতে পারে রাণীকে ব্ল্যাকমেইল করার এটাই মোক্ষম সুযোগ। এসব কোনকিছুই রাজার চোখে পড়ে না। মন্ত্রী বরং রাজার সাথে কথা বলার এক ফাঁকে টেবিলের চিঠিটা সরিয়ে সেখানে তার হাতে থাকা একটা সরকারী চিঠি রেখে দেন। রাণী সবকিছু দেখেও কিছু বলার সাহস পেলেন না রাজার কাছে সব ফাঁস হয়ে যাবে এই ভয়ে। ফলত রাণী শরণাপন্ন প্যারিসের চিফ পুলিশ ইন্সপেক্টরের কাছে। ইন্সপেক্টর মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার সারা বাড়ী ঘর, আসবাবপত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও চিঠির হদিস পেলেন না। অবশেষে পুলিশ গেলেন গোয়েন্দা দ্যুপাঁর বাড়ী। সবকিছু শুনে এবং মন্ত্রীকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে  দ্যুপাঁ বুঝলেন যে ধূর্ত মন্ত্রী এমন কোন গোপনীয় জায়গায় নিশ্চয়ই চিঠিটা রাখবে না যেখানে সবাই খুঁজতে যাবে। অতঃপর এই চিন্তানুযায়ী একদিন দ্যুপাঁ মন্ত্রীর অফিস থেকে চিঠিটা সরিয়ে আনেন এবং ঠিক একই রকম একটা কাগজে ক্রেবিঁয়রের দুইটা পঙক্তি লিখে দিয়ে জানান দিয়ে আসেন চিঠিটার দ্বিতীয় অপহারককে।

 

এখানে লক্ষণীয় যে, চিঠির বিষয়বস্তু অজ্ঞাত। জাক লাকাঁর মতে এই চিঠি একটা দ্যোতক বা চিহ্নকারক (signifier)। তবে কিসের চিহ্নকারক? এই ব্যাপারে বলার আগে কিছু বিষয় বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের মনের যেই সমস্ত ইচ্ছাগুলাকে আমরা বাস্তবে রূপ দিতে ব্যর্থ হৈ সেগুলো ঠাই পায় আমাদের নির্জ্ঞানে। কিন্তু নির্জ্ঞানে আপাতভাবে ঠাই নিলেও এরা প্রায়ই বাস্তবে চলে আসতে চায়। এ-ক্ষেত্রে সচেতন মনের বাঁধা বা resistance একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফ্রয়েড অত্যন্ত সুন্দর একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা তুলে ধরেছেন। ফ্রয়েডের ভাষায়ঃ

 

“… যদি আমরা ধরে নিই যে এই সভায় আমার সামনে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীর নীরব মনযোগের প্রশংসার ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না, এবং এখানে এমন একজন, আছেন যার অশোভন হাসি, উচ্চ স্বরে [যঃপ্রা] কথা বলা ও পায়ের খস্‌খস্‌ শব্দ গোলযোগ সৃষ্টি করছে এবং আমার মনঃসংযোগ নষ্ট করছে, তখন আমাকে ঘোষণা করতে হৈল যে আমি আমার বক্তৃতায় আর অগ্রসর হৈতে পারিতেছি না, সেকথা শুনে তিন-চারজন শক্তিশালী ব্যক্তি উঠে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে ঐ গোলযোগ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিকে ঘর থেকে বের করে দিল।

 

তাহা হৈলে ঐ ব্যক্তি এখন অবদমিত ( repressed), এবারে আমি আমার বক্তৃতা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু যাতে আমার বক্তৃতায় আবার বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য যারা আমার এই সুবিধা করে দিয়েছিল তাদের মধ্যে একজন উঠে কিছু চেয়ার দরজার গায়ে লাগিয়ে দেয় যাতে সে আবার ঘরে ঢুকে না পড়ে অর্থাৎ একটা বাধার (resistance) সৃষ্টি করে— যেইটার ফয়সালা হয় অবদমনের মাধ্যমে।” (ফ্রয়েড, মনোবিশ্লেষণ)।

 

Unconscious বা নির্জ্ঞানের সাথে তাহা হৈলে ভাষার কী সম্পর্ক? আমরা অনেক ক্ষেত্রেই কথা বলার সময় ঠিক যেই শব্দটা ব্যবহার করতে চাই ভুল করে অন্য একটা শব্দ ব্যবহার করে ফেলি। যেমন একজন হয় ত কাউকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাইছে ‘আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না’, কিন্তু ভুল করে বলে ফেলিলেন ‘আপনি দুর্নীতি করবেন না’। আমরা একে slip of tongue বলে অভিহিত করে থাকি। ফ্রয়েড এ-ধরণের অনিচ্ছাজনিত ভুলকে বলিতেছেন parapraxis বা অপেচ্ছা। তো সচেতনভাবে কথা বলার সময় সহসাই এরকম অনিচ্ছাকৃত ভুল শব্দ উঠে আসে অবচেতন বা নির্জ্ঞান থেকে। তাহা হৈলে দেখা যাচ্ছে সাবজেক্ট বা বিষয়ীর মধ্যে দুই রকম ভাষণ। একটা হৈল তার সচেতন অহম বা ইগো’র ভাষণ আরেকটা হৈল ‘অন্য’(Other)ভাষণ।

 

EGO/SELF DISCOURSE OTHER DISCOURSE/ THE OTHER’S DISCOURSE
conscious

 

intentional

unconscious

 

unintentional

Source: THE LACANIAN SUBJECT—BETWEEN LANGUAGE AND JOUISSANCE, Bruce Fink,1995

 

এই ‘অন্য’ কিন্তু অন্য বিষয়ীমাত্র নয়। ইংরেজীতে ক্যাপিটাল ‘O’ দিয়ে এই Other লেখা হচ্ছে। লাকাঁ যখন বলছেন ‘The unconscious is the discourse of the Other.” তখন তিনি বোঝাতে চাইছেন এই Other অহমের বাইরের একটা এজেন্সী এবং ফ্রয়েড একেই অবচেতন বলে চিহ্নিত করেছেন। লাকাঁ এই অবচেতনের ভাষিক রূপটা উন্মোচন করেছেন।

 

“It is the Other as the collection of all the words and expressions in a language… Thus, according to Lacan’s interpretation of Freud, when repression takes place, a word, or some part of a word, “sinks down under,” metaphorically speaking. The word does not thereby become inaccessible to consciousness, and it may indeed be a word that a person uses perfectly well in everyday conversation. But by the very fact of being repressed, that word, or some part thereof, begins to take on a new role. It establishes relations with other repressed elements, developing a complex set of connections with them. As Lacan says over and over again, the unconscious is structured like a language;” (Bruce Fink, 1995)

 

ফলে আমাদের অদমিত ইচ্ছেগুলাও মূলত ভাষার আকারেই নির্জ্ঞানে ঠাই পায়। তবে এই ইচ্ছেগুলা কেবল অবচেতনে ঠাই পেয়েই ক্ষান্ত হয় না সেগুলা বাস্তবে তাদের প্রতিরূপ হিসেবে কোন অর্থকারক (signifier) বেছে নেয়। আমাদের আলোচ্য গল্পে উক্ত চিঠিটা হৈল এইরূপ কোন অবদমিত ইচ্ছের অর্থকারক। বারবার একৈ পদ্ধতিতে চিঠিটা চুরি যাওয়ার ঘটনাই ফ্রয়েডের পুনরাবৃত্তির বাধ্যতা যাহা কোন অবদমিত ইচ্ছাকে বাস্তবে প্রকাশ করার ইচ্ছা। গুরুত্বপূর্ণ এই যে, এই অর্থকারক ভ্রাম্যমাণ ফলে সবজায়গায় এর অর্থ এক থাকছে না। চিঠিটার হাত বদলের মাধ্যমে এর অর্থও বদলে যাচ্ছে। রাণীর কাছে চিঠিটা ছিল অত্যন্ত গোপনীয় কোন চিঠি যাহা তিনি যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতে চান, অন্যদিকে এই চিঠির মাধ্যমে রাণীকে বাগে পাওয়া যাবে এমন অর্থৈ যেন প্রকাশ পায় চিঠিটা যখন মন্ত্রীর হাতে যায়, আবার দ্যুপাঁর হাতে চিঠিটা পৌঁছালে দ্যুপাঁ বেশকিছু অর্থ পাবেন এবং সেইসাথে মন্ত্রীর সাথে মিটিয়ে নিতে পারবেন পুরানো কোন হিসস্যা। এই সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রতীকী শৃঙ্খলার প্রতিনিধি এই ভ্রাম্যমাণ  চিঠি। চিঠিটা কেবল নির্দিষ্ট একজনের অবদমিত ইচ্ছার প্রতীক নয় বরং তা কাজ করে যাচ্ছে একটা আন্তর্ব্যাক্তিক ক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হিসেবে। হাত বদল হওয়ার সাথে এর চিহ্নকারক-ভূমিকার বদল ঘটছে সেই সাথে বদল ঘটছে ক্ষমতারো। যার কাছেই চিঠিটা যাচ্ছে সে-ই তার হাতেই ন্যস্ত হচ্ছে এই চিহ্নকারকের ক্ষমতা। এমন চক্রাকার স্থানান্তরের ফলে এক আন্তর্ব্যাক্তিক সম্পর্কের মাধ্যমেই এই প্রতীকী শৃঙ্খলা উক্ত তিন ব্যক্তির (রাণী, মন্ত্রী, দ্যুপাঁ) কর্ম্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে।

 

“If what Freud discovered, and rediscovers ever more abruptly, has a meaning, it is that the signifier’s displacement determines subjects’ acts, destiny, refusals, blindness’s, success, and fate, regardless of their innate gifts and instruction, and irregardless of their character or sex; ..” (Lacan, 1966)

 

 তাহা হৈলে শেষ পর্য্যন্ত চিঠিটার কী হৈল? চিঠিটা কি রাণীর হস্তগত হৈতে পারল? এডগার এলেন পো’র গল্পটাতে তার উল্লেখ অবশ্য নেই। তবে লাকাঁর মতে তাতে কোন সমস্যাও নেই, কেননা “… a letter always arrives at its destination” (ibid) কিন্তু তা কী করে সম্ভব! ভুল ঠিকানায় চিঠি চলে যাবার ঘটনা তো আমরা অনেক শুনেছি তাহা হৈলে লাকাঁর এই কথার ব্যাখ্যা কী? স্লাভোয় জিজেক এর উত্তর দিয়েছেন। তিনি লুই আলথুসেরের Interpellation থিওরীর কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ঠিকানা ভুল কিংবা শুদ্ধ তা মুখ্য নয়, প্রতিটা প্রাপকই রূপকল্পী (Imaginary) স্তরে বিশ্বাস করে নেয় যে, চিঠিটা তার কাছেই এসে পৌঁছেছে।

 

 

ঋণঃ

  • Poe, Edgar Allan. 1983. The Purloined Letter, The Complete Tales and Poems of Edgar Allan Poe. Harmondsworth: Penguin, pp 208-22
  • Lacan, Jacques. 1972. Seminar on ‘The Purloined Letter’ (translated by Mehlman J.):Yale French Studies.
  • Fink, Bruce. 1995. THE LACANIAN SUBJECT—BETWEEN LANGUAGE AND JOUISSANCE :Princeton University Press, USA
  • বন্দ্যোপাধ্যায়, অমল। ২০১১। জাক লাকাঁ বা পিতৃনামের পরাক্রম। উত্তর-আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক। কলকাতা:এবং মুশায়েরা।
  • Žižek,Slavoj. 2006. Empty gestures and performatives:Lacan confronts the cia plot, How to Read Lacan, New York and London: Norton.
  • Blake Nancy. 2012. From the Letter to the Objet petit a: The Evolution of Lacan’s Literary Metaphores. The Literary Lacan: Seagull Books
  • Rabaté Jean-Michel. 2012. Psychoanalysis Applicable and Inapplicable: The Case of Literature. The Literary Lacan: Seagull Books
  • Lemaire Anika. 1970. Jacques Lacan ( translated by David Marcey): Routledge & Kegan Paul Ltd, London

 

 

 

 

তথ্য সূত্রঃ

১. Un dessein si funeste, S’il n’est digne d’Atree, est digne de Thyeste অর্থাৎ a scheme so hateful, if it is not worthy of Atreus, is worthy of Thyestes.

(Atree, Prosper Jolyot de Crébillon)

 

২. “Interpellation শব্দ দ্বারা আলথুসের যা বোঝাতে চান তা হৈল স্বতন্ত্র মানুষের মাঝে সামাজিক বিভিন্ন সূত্রে প্রতিদিন পাওয়া ভাবনা (idea)গুলো কিভাবে প্রতিক্রিয়া করে এবং কিভাবে সেই ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করে চলে তাঁরা। Interpellation একটা ‘প্রক্রিয়া’, যে প্রক্রিয়ায় আমরা বিভিন্ন ভাবনা ও সংস্কৃতি নিজেদের ভেতর প্রবেশ করাই এবং একপর্য্যায়ে সেটা ‘নিজের’ মনে করি”— আলতাফ পারভেজ, ( রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ, লুই আলথুসের, ভূমিকা, ভাবানুবাদ ও পর্যালোচনা) 

 

৩. জাক লাকাঁর মতে তিনটা অবিচ্ছেদ্য স্তরের সমন্বয়ই হৈল মানব জীবনবাস্তবতা— প্রতীকী (Symbolic), রূপকল্পী (Imaginary) ও সত্য (Real)।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, এডগার অ্যালান পো’র অপহৃত চিঠি এবং লাকাঁর ভাষিক নির্জ্ঞান — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *