কবিতার সঞ্জীবনী শক্তির কথা বলতে গেলে, অবশ্যই পাঠকের অভিজ্ঞতা এবং কবির অভিজ্ঞতাকে আলাদা করতে হবে। একটা কবিতা পাঠকের জন্য এক ধরনের মন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম : বিধ্বস্ততাকে বিন্যাস দিয়ে কোন আকৃতি বা অভিকর্ষ ছাড়াই কবিতা অন্ধকার থেকে তার পাঠককে উদ্ধার করে; অবাধ প্রপতনের জন্য কবিতা দ্বীপের মতন; কবিতা পাঠকের দুঃখের সঙ্গী, পাঠকের ত্রাতা, দুঃখকষ্ট-ও যেই কোন না কোনভাবে অর্থবহ কবিতা তাহার প্রমাণ।
কিন্তু আমার কাছে কবির সাথে তাঁহার রচিত কবিতার সম্পর্ক অন্যরকম।
আমরা এমন একটা সংস্কৃতিতে বসবাস করি যে’টি আশাবাদ বলবৎকরণে প্রায় ফ্যাসিবাদী আচরণ করে। চরিত্র বা সহিষ্ণুতার কঠিন পরীক্ষার ধারণা এবং ঘটনার সাথে এখানে কলঙ্কের ব্যপারটা আরোপিত হয়: সহিষ্ণুতার কঠিন পরীক্ষাকে দমন, অস্বীকার, অথবা অবচ্ছেদন করার প্রণোদনা দু’টা চরম সীমায় স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়— একদিকে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্যের (শারীরিক এবং মানসিক) অর্চনা চলে, অন্যদিকে, যে’টাকে বলা যেতে পারে (ব্যাক্তিগত) ক্ষতের অশ্লীল প্রদর্শণী। আপাতঃদৃষ্টিতে স্মৃতিকথা, কবিতা এবং উপন্যাসের বন্যা বয়ে যায় এই প্রোথিত ধারণায় যে দুঃখবেদনা অবশ্যই যথার্থ ও প্রভাব সঞ্চারী শিল্প তৈরি করে। কিন্তু, বেদনা যদি এত কঠিন হয়, বেদনার প্রকাশ কি সহজ হওয়া উচিৎ? ট্রমা এবং হারানোর বেদনারা নিজেরা নিজেরাই শিল্প নয় : এ’গুলি অর্দ্ধেক রূপক। বস্তুত, যে ধরনের শিল্পকর্মের কথা আমি বোঝাতে চাইছি— শিল্পকর্মের ব্যক্তিগত উৎস যতই সত্য হোক না কেন— এক ধরনের নিজস্ব অধিকার সংক্রান্ত ঔৎসুক্যে এ’ধরণের শিল্পকর্ম কলুষিত থাকে। মনে হয়, সর্বোচ্চ নাটকীয় সীমায় থাকিতে এটি একটু বেশীই তৎপর; মানুষের জীবনে হারানো বিষয়টা যে একটা চলমান, নিত্যকার ঘটনা তাহাও অস্বীকার করতে একটু বেশীই উদ্যমী। বরং এটি একটা ব্যক্তিগত সাফল্যের বিবরণ পেশ করে। এমন একটা বৃত্তান্ত যেখানে ‘বিকাশ’, ‘নিরাময়’ এবং ‘আত্মোপলব্ধি’ বিষয়ক কথায় ভরা থাকে। এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে, আত্মার অকুণ্ঠ অথবা উপলব্ধ সামগ্রিকতা বুঝতে ব্যর্থ হয়, কেননা বেদনাকে তাঁহারা আত্ম-উন্নয়নের অনুঘটক হিসাবে দেখে। কিন্তু, সমূহ ক্ষতির শক্তিকে যেহেতু ছোট করে দেখা বা অস্বীকার করা হয়, কথককেও একিভাবে পুরাপুরি অসত্য, অ-মানবিক বলে মনে হয়।
আমার নিজের তীব্র দুঃখকষ্টের অভিজ্ঞতায়, জীবনে হোক বা কর্মক্ষেত্রে, কষ্টের সময়গুলিতে আমি বেঁচে থাকার চেষ্টা করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করি না, এই যুক্তিতে যে আমি যদি বেঁচে থাকি অন্ততঃ যদি কিছু বদলায় সেগুলি দেখার জন্য আমি থাকতে পারব। পরিবর্তনের ওপর প্রভাব ফেলার চেষ্টা করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি এটাও বিশ্বাস করি না যে, শিল্পীর বিচিত্র প্রাণোচ্ছলতা শিল্পের সঞ্জীবনী শক্তি জোগায়। নিজের কর্ম সম্পর্কে শিল্পীর অভিজ্ঞতা নিদারুণ ভীতিকেও কৃতজ্ঞতায় বদলে ফেলে। যা’কিছু নিত্য, যা’কিছু আমার কাছে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের উৎস বলে মনে হয়, তা হল তীব্র হয়ে, তাড়িত হয়ে সবকিছু শুষে নেওয়ার সক্ষমতা। এই ধরনের শোষন নিজের সত্ত্বা থেকে নিজেকে এক ধরনের বিরাম দেয়; শিল্পীর ভেতরে শিল্পের প্রয়োজনীয়তার এক গভীর বিশ্বাস জোগায়। সারা জীবনজুড়ে পাওয়া এ’রকম অবকাশগুলিতে, শিল্পী জীবনকে গভীর অভিনিবেশে গ্রহণ করেন; তিনি একেকটা সময় এমন দোদুল্যমান হয়ে বাঁচেন যেন এটাও একটা অন্বেষণ, একটা অবকাশ আবার একিসাথে একটা তীব্র যন্ত্রনাও। শিল্পে তাঁহার বিশ্বাস এবং শিল্পে তাঁহার বিনিয়োগ এবং নিজেকে প্রকাশ করার স্বপ্ন তাহাকে ভবিষ্যতের দিকে ছুঁড়ে দেয়— এই প্রকল্পিত মুহুর্তে সমন্বিত অন্ধকার শিল্পের সমস্ত সীমা আর ফর্মকে গ্রাস করে। নস্টালজিয়ার স্থলবর্তী হয় ক্ষুধা ও ত্রাস; পরম প্রত্যার্পণের পরিবর্তে পাওয়া যায় একটা আদর্শ আবিষ্কার। এই লক্ষ্যে, একজন শিল্পী, একজন বিশ্লেষকের মত নিয়মনিষ্ঠভাবে আত্মপ্রবঞ্চনাকে প্রত্যাখ্যান করার চর্চা করেন। একটা নৈতিক অবস্থানের চেয়ে এইটা বরং একটা কার্যসিদ্ধিমূলক কর্ম। কেননা দুঃখদুর্দশার একমাত্র সম্ভাব্য সুবিধা হচ্ছে, দুঃখদুর্দশা অন্তর্দৃষ্টি দানে সক্ষম।
বিখ্যাত রহস্যোপন্যাস লেখক রস ম্যাকডোনাল্ড বলেন, তিনি অনেক লেখকের মতন, প্রত্যক্ষভাবে তাঁহার নিজের অভিজ্ঞতা অথবা অনুভব দিয়ে লিখতে পারতেন না। ম্যাকডোনাল্ডের মতে, একজন গল্পকথককে তাঁহার নিজের আর বিস্ফোরক বিষয়সমূহের মাঝখানে বাঁধা সৃষ্টি করে কিছু বলতে হয়। কবিদের জন্য সময়ের প্রয়োজনে একটা পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তনা করতে হয়। কিন্তু, ঐ সমস্ত শিল্পকর্ম যেগুলি সরাসরি কোন সুনির্দিষ্ট ঘটনার সঙ্গে মেলানো যায়— ঘটনার যত পরেই শিল্পকর্মটা তৈরি করা হোক না কেন— শিল্পীকে ঐ ঘটনাগুলির সাথে একটা বিশেষ সম্পর্কে জড়িত করে। কবিতা হচ্ছে হারানোর পরাজয়ের ওপর প্রতিশোধ, যাহা একটা নতুন ফর্ম তৈরি করতে বাধ্য করেছে, এমন একটা বস্তু যা আগে কক্ষণো পৃথিবীতে ছিল না। সমূহ ক্ষতিরা নিজেরাই তখন যুগপৎ পাওয়া এবং না পাওয়া হয়ে যায়: এই যুগপৎ পাওয়া এবং না পাওয়া ছাড়া কবিতা হয় না, উপন্যাস হয় না, পাথর খুদে ভাস্কর্য তৈরি হয় না এবং অতীতের একটা অদ্ভুত বিশ্বাসঘাতকতার বোধ নিরঙ্কুশ ক্ষতির মত মনে হতে পারে, দ্ব্যর্থক হয়ে পড়ে, যা’কিছু ক্ষতিসাধন করেছে তা-ই হয়ে যায় হিতকর। এমন জটিল দ্বৈততাকে আমার কাছে ক্ষতিপূরণ করার জিনিস বলে মনে হয় না। এবং এই পরিবর্তনের নিমিত্ত, যেকোন ক্ষেত্রেই, হচ্ছে সময়। আর সময়ের সাথে কোন জোরাজুরি চলে না।
হাসিব উল ইসলাম রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, কবিতা ভাবনা, এক : শুশ্রূষার সংস্কৃতি — প্রমিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।