তেপান্তরের পাথার পেরোই রুপকথার…
বাড়িশুদ্ধ সবার মন খারাপ, ক্ষেতের ধান পেকে আসছে, অথচ বৃষ্টি থামার নাম নেই। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ বড় চাচার। বড় চাচা মুখ ভার করে বারান্দায় পিঁড়ি পেতে হুক্কা টানছে।
হুক্কার বিষয়টি তন্ময়ের বেশ লাগে, ছিলিমের ভেতর কালো টিক্কায় আগুন ধরিয়ে টানতে থাক। তন্ময় একদিন টেনে দেখেছে, গলায় পানি চলে আসে, কী বিদঘুটে স্বাদ রে বাবা! কেবল বকুলের মন খারাপ হয় না। সে ঠেলা জাল নিয়ে বৃষ্টিতে টইটুম্বুর জলে নেমে পড়ে। জাল ঠেলে ছোট ছোট মাছের পোনা ধরতে থাকে। তন্ময়কে ডাকে, তন্ময় নামে না। কেবল বারান্দায় দাড়িয়ে দেখে যায়। ও পাড়ার ছেলেপুলেরাও আসে। সবাই মিলে সেই পানিতে দাপাদাপি করে, জল ঘোলা করে।
রাতের বেলা বাড়ীর ঘরে ঘরে লেমবাতি জ্বলে। লেমবাতীর সলতে জ্বলতে থাকে, আর ধোয়া উড়তে থাকে। বেশ উপরে ছাউনির মত দেওয়া, যেন ধোয়াটা সারা ঘরে ছড়িয়ে না যায়। দাদীমা ওটাকে বলেন গাছা, গাছার উপরে চমৎকার করে বাঁশের তৈরী খুপরির মত, লেমবাতী ওখানেই রাখা হয়। ছোটচাচার মেয়ে হয়েছে। বড়আম্মা কলাপাতায় সর্ষে তেল লাগিয়ে লেমবাতীর উপরে ধরে রাখেন, কালি জমতে থাকে। ওই কালি দিয়ে কাজল বানাবেন বড়আম্মা, যা ওই পিচ্চি বাবুর চোখে, কপালে লাগানো হবে।
তন্ময়রা ঢাকা থেকে এসেছে, কাজেই ওদের ঘরে হারিকেন জ্বলে, রাতে ঘুমানোর সময় হারিকেনের সলতে নামিয়ে দেওয়া হয়। মৃদু আলোয় হারিকেন জ্বলে, এখানে কারেন্ট নেই। রাত বাড়তে থাকলে কবরস্থানের শেয়ালগুলো একসাথে ডাকতে থাকে। তন্ময়ের তখন কেমন ভয় ভয় লাগে।
করবস্থানে খুব কি শাস্তি দেওয়া হয়? ওখানে অন্ধকার নেই?
কীভাবে থাকে মানুষ ওখানে?
তন্ময়ের মাঝেমধ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া পায়। কাউকে বলে না, চুপটি করে আগল খোলে বের হয়ে আসে ঘর থেকে। তখন আর ভয় থাকে না, কোথায় যেন পালিয়ে যায়। তন্ময় নেশাগ্রস্তের মত হাঁটতে থাকে। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, সব কেমন ভূতুড়ে লাগে। তন্ময়ের হাতে হারিকেনটা থাকে। হারিকেনের মৃদু আলোয় দেখা যায় তাদের পুরো বাড়ীটা দেখে সে, কেমন প্রাণহীন দাড়িয়ে আছে, রাত্রির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ যেন নাই। সেই শব্দ তন্ময়কে ঘোর লাগিয়ে দেয়, তন্ময় বাড়ী ছেড়ে হালটে পা রাখে। দূরের খালে যেন আলো জ্বলতে দেখা যায়। এত রাতে ওখানে আলো!!
আলোটা যেন তাদের বাড়ীর দিকেই এগিয়ে আসছে। তন্ময়ের বেশ ভয় লাগছে, আবার কৌতুহলও হচ্ছে। কিন্তু ভয়ের চেয়ে কৌতুহলই বেশি, তাই সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে এগিয়ে আসা আলোটার দিকে।
একহাতে পাম্পলাইট, আরেক হাতে ঝোলানো বেশ বড় একটা শোল। গল্পদাদু হনহন করে হেঁটে আসছেন। উঠোনে আলো দেখে গল্পদাদু থেমে গেলেন, “তন্ময়! এত রাতে তুমি?” দাদু এদিক ওদিক তাকান, না আর কেউ নেই, তন্ময় একাই দাঁড়িয়ে।
“দাদু হিসি পেয়েছিল।”
“তা একা কেন? ভয় পাবে তো।”
“গল্পদাদু! তুমিও তো একা, তুমি কোথা থেকে এলে? তুমি কি মাছ ধরতে গিয়েছিলে?”
গল্পদাদু বলেন, “সে অনেক গল্প, এখানে রাতের বেলা দাঁড়িয়ে গল্প চলবে? যাও, কাল তোমাকে আজকের গল্পটাই বলব।”
গল্পদাদু তন্ময়কে ঘরে ঢুকিয়ে চলে নিজের বাড়ীর দিকে রওনা হন।
পাশাপাশি বাড়ী, যাকে বলে এক উঠানে বাড়ী।
হারিকেনটার আলো কমিয়ে একপাশে রেখে তন্ময় বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসছে না। গল্পদাদুর কথাই ভাবছে। মা বলেছেন, গল্পদাদু এই উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশরা যাবার বহু আগে এম.এ পাশ করেছেন। তখন এই এলাকায় মেট্রিক পাশ মানুষই ছিল না। দাদুর জন্য অনেক চিঠি আসত, চাকরীর চিঠি, দাদু সেই চাকরী করেন নাই তবে চিঠিগুলো জমিয়ে রেখেছেন আলমারীর কোনায়। গল্পদাদু বিয়ে করেন নাই, তবে লোকজন তাঁকে ধরে বেঁধে চ্যায়ারমেন বানিয়েছিল। দাদু বই পড়েন, ভ্রমণ করেন। দাদুর বাড়ীতে তাঁর বিধবা বোন থাকেন, আর থাকে সবকিছু দেখাশোনার জন্য মানুষ। গল্পদাদুর মত তন্ময়ও দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াবে, এসব ভাবতে ভাবতে তন্ময় কখন ঘুমিয়ে পড়ে।
বড়’পার ডাকাডাকিতে তন্ময়ের ঘুম ভাঙে। বড়’পার চোখে মুখে হাসি, “তন্ময়, দেখবি আয়, ফুল দাদু তোর জন্য ইয়া বড় মাছ পাঠিয়েছে।”
তন্ময় চোখ রগড়ে তাকায়, বেশ বেলা হয়ে গেছে। বারান্দায়, উঠোনে বেশ লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। তন্ময় বেশ খেয়াল করে দেখেছে, বাড়ীর লোকজন অনেক সকালে উঠে। ফুফু বলে ‘কালি আন্দাইর’ আবার বড়চাচা বলে ‘কালাঞ্জি বেলা’। সব নতুন নতুন শব্দ তার কানে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। সবগুলোর মানেও সে বোঝে না।
গতরাতে ভাল করে খেয়াল করেনি, তন্ময়ের গলা অবধি আসবে শোল মাছটা। কালো রঙ, চিকচিক করছে। গল্পদাদুর শক্তি আছে বটে, এত বড় শোলটা একাই বয়ে নিয়ে এসেছে। গল্পদাদু তাঁর ভাইদের সবার ছোট, কাজেই সবাই ফুলদাদু ডাকে, কিন্তু উনি তন্ময়ের কাছে গল্পদাদু। বড়চাচা মাছ টুকরো করে দিচ্ছেন, আজ গল্পদাদুর বাড়ীর সবাই দুপুরে এখানেই খাবেন।
গতকালের বৃষ্টি থামার পর আর শুরু হয়নি, বরং এখন প্রচণ্ড রোদ। ছোট ভাইবোনেরা উঠানে লাফিয়ে ছড়া কাটছে, উঠান ফাটিয়ে নাকি রোদ উঠেছে। তন্ময় ভেবে পায় না উঠান কী করে ফাটে।
ধান কাটা শুরু হয়েছে, বাড়ীর কামলা লোকজন ধান কেটে গরুর গাড়ীতে করে আনছে, একটার পর একটা উঠানের কোনায় সাজিয়ে রাখছে। হলুদ সবুজ ধানের গাছের মুঠো থেকে কেমন পাগলপারা গন্ধ আসছে। বড়চাচা মাছ কুটা শেষে তাই দেখাশোনা করছেন। ধানের আঁটি যেভাবে সাজিয়ে রাখছেন, বড়চাচা ওটাকে বলছেন পাড়া। আবার রাতে সেগুলো মাড়া দেওয়া হবে। বাড়ীটা যেন জেগে ওঠেছে।
তন্ময় গরুর গাড়ীর পিছু হাঁটতে শুরু করে। গাড়ী যেখানে যাবে, সেটাকে বন্দ বলে। বন্দে যেতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু মাটির রাস্তায় প্রচুর কাঁদা। তন্ময় যেতে চেয়েছিল কিন্ত বাড়ীর বড় কামলা পাল’দা নিষেধ করল, পথে অনেক প্যাঁক, কাজেই তন্ময় বন্দের দিকে দুলে দুলে যাওয়া গরুর গাড়ীর দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর বাড়ী ফিরে আসল।
বড়আম্মা গোবর দিয়ে উঠান ঝাড়ু দিচ্ছেন, পানির সাথে গোবর মিশিয়ে এত যত্নের সাথে, তাঁর সাথে কাজের মহিলারাও আছে, কিন্তু বেশি কঠিন কাজটা বড়আম্মাই করছেন। তন্ময় কিছু হিসেব মেলাতে পারে না, সে বাসায় বা বাসার বাইরেও দেখেছে, যে যত বড় তার কাজ করতে হয় কম, কিন্তু বাড়ীতে ঠিক তার উল্টো। বড়চাচা, বড়আম্মা সারাক্ষণ কাজ করছেন। তন্ময় ঝাড়ুর বাড়ীর সাথে গোবরপানির ছিটকে যাওয়া দেখছিল আপনমনে, আর ভাবছিল গোবর দিয়ে কেন উঠান ঝাড়ু দেয়, গোবর দিয়ে ঘর, চুলা লেপা হয়, গোবর দিয়ে পাটকাটির লাকড়ি বানায়, চটা দেয়। গোবর কি গরুর পায়খানা নয়? ওটা কেমন করে সবাই হাত দিয়ে নাড়ে? তন্ময় কেবল ভাবতেই থাকে।
বড়চাচা যে ঘরে থাকেন, সেই ঘরকে সবাই বড় ঘর বলে। এই ঘরে দুটো গোলা আছে ধানের, চালের মটকা আছে ছয়টা, ধান রাখার টাইল আছে চারটা। সিলিং এ ঝুলানো পেঁয়াজ রসুন আলু, সিক্কায় আছে গরুর ঘি, মধু, আচারসহ আরও কত কিছু। সেই বড় ঘরে চাচা কামলাদের নিয়ে খাবার খান, অতিথি আসলেও এখানেই খাওয়া হয়। পিঁড়ি পেতে কামলারা বসে, পাটি পেতে চাচা অতিথিসহ বসেন। রান্না যা হবে, সবাই একই সমান পাবে। আজও গল্পদাদুসহ সবাই পাটি পেতে বসেছেন, কেবল শোল রান্না হয়েছে তা নয়, বেশ বড় একটা মোরগা জবাই হয়েছে, সাথে কবুতরের মাংস, ডিম, ঘি, দুধ, বিন্নি চালের ভাত। চাচা সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন, বড় আম্মা সবাইকে পরিবেশন করছেন, বড়’পা এগিয়ে দিচ্ছেন। অপরপাশে বাড়ীতে যে কামলারা আছে, তারাও বসে গেছে। হাত ধোয়ার জন্য কাঁসার জামবাটিতে হাত ধোয়ে বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করলেন দাদু। পাশে তন্ময়, দাদু চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছেন, আর তন্ময়ের ভাত মুখে যাচ্ছেই না, দাদু কী করে এত বড় শোলটা ধরে আনলেন, সে গল্প না শুনলে কী করে হয়! যদিও একটু একটু করে সে গল্প একবার হলেও বলেছে, কিন্তু তন্ময়ের দাদুর মুখে শোনা চাই।
গল্পদাদু শোলমাছের চচ্চড়ি তন্ময়ের পাতে তুলে দিয়ে বলেন, “খাও দাদু, এ হচ্ছে পোক্ত শোল।”
তন্ময় সুযোগ পেয়ে বলে, “দাদু! তুমি এত বড় শোলটা ধরলে কী করে! তুমি এত রাতে মাছ ধরতে গিয়েছিলে? আমাকে তো নিলে না!”
“বলব দাদু, খাওয়া শেষ কর” গল্পদাদু বলেন মৃদু হেসে।
খাওয়া শেষ হলে গল্পদাদু মস্ত এক পান মুখে পুরেন।
দেখতে দেখতে উঠানের এক পাশ ধানের আঁটি দিয়ে ভরে গেল।
দাদু একপাশে চেয়ার পেতে বসেন। তন্ময় দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দাদু বলতে থাকেন, “আমাদের এই গ্রাম থেকে কয়েকগ্রাম পরে নীলপুর গ্রাম। সেই গ্রামে এক সালিশ ছিল, সালিশে আজকাল যেতে চাই না, তবু লোকজন ধরে নিয়ে গেল। গ্রামের সালিশ শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়, ওই গ্রামের যাওয়ার রাস্তা নেই, জমির আইল দিয়ে যেতে হয়, এখন এখানে ওখানে কিছু জল কিছু কাঁদা, তাই ঘুরপথে নৌকা দিকে যেতে হয়। সালিশ করে আসতে আসতে বেশ রাত হল। সাথে লোকজন ছিল, পথে যে যার বাড়ী নেমে গেল, এই খালের মুখে ঢোকার সময়, লাইট দেখে শোলটা লাফিয়ে নৌকায় উঠে গেল। শোলটা লাফাচ্ছিল খুব। মাঝি আর আমি জোরে ধরে বেঁধে রাখলাম নৌকার পাটাতনে।”
“ভয় পাওনি? আমি শুনেছি এই শোলগুলোতে ভূত-পেত্নী থাকে “
দাদু হেসে ওঠেন, “কই! দেখেছ দাদু ভূত! খেলাম তো আমরা।”
“দাদু! সালিশ কী? আরেকটা প্রশ্ন, আমাদের এই গ্রামের নাম নয়াগ্রাম আবার ওই গ্রামের নাম পুর কেন?”
“সব বলব দাদু, আগে আরেকটা পান নিয়ে আসো দেখি, পান খেতে খেতে গল্প বলি তোমায়।”
দাদীমার পিতলের পানদানে পান আসে, দাদু আয়েস করে পান মুখে দিয়ে শুরু করেন।
“দাদু, সালিশ হচ্ছে কোন কিছুর মধ্যস্ততা করা। দুটো পক্ষ থাকবে তুমি থাকবে মাঝখানে, তারপর তাদের বিবাদ মীমাংসা করা। গ্রামের লোকজন ঝগড়া-বিবাদে নিজেরাই বসে সমাধান করে, একটু বড় ধরণের বিবাদ হলে পাঁচ গ্রামের মুরব্বী যারা তাঁরা বসে একটা মীমাংসা করেন। আদালতে এরা যায় না।”
তন্ময়ের কৌতুহলী দৃষ্টি দেখে দাদু আবার বলেন, “আদিতে মানুষেরা যৌথসমাজে বাস করত, তারা যা উৎপাদন করত সবাই মিলেই তা ভোগ করত। ভাগ-বাটোয়ারা সমান হত। যখনই মানুষের মধ্যে ব্যাক্তি মালিকানাবোধ চলে এল, তখনই ভাগ-বাটোয়ারায় সমস্যা শুরু হল। মানুষে মানুষে ভাগ বণ্টনের যে সমস্যা, তা সমাধানে বিচার সালিশ শুরু হল। যারা জ্ঞানী ছিলেন, যাদের সবাই মানত, তাঁরাই নিজেদের বিবেক খাটিয়ে সমাধান দিতেন।”
“দাদু, তুমি কঠিন কথা বলছ। বিবেক কী?”
“কঠিন, আবার বুঝলে সহজ। যেমন তোমার স্কুলের ব্যাগ কয়েকটি। দুয়েকটা নতুনের মত, দুয়েকটা কিছু পুরনো। সবকটিতে একরকম সুবিধা নাই। একেকটিতে একেকে সুবিধা, কোনটিতে ব্যাবহারে একটু বেশি অসুবিধা। তখন তুমি একজনকে একটি ব্যাগ দিতে চাও। তুমি কোনটি দিবে? তোমার জন্য, তোমার কাছে যেটি ভাল মনে হয়, তুমি তো সেটাই বেছে নেবে। এই যে তুমি বেছে নিলে, তুমি চিন্তা করে বিশেষভাবে একটিকে বেছে নিলে। এই বেছে নেওয়াতে তোমাকে সাহায্য করল তোমার বিচারবোধ— ঠিক অঠিক, উচিত অনুচিত বিষয়ে তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে যে সাহায্য করল— সেই হচ্ছে তোমার বিবেক। বুঝতে পেরেছ দাদু!”
তন্ময় হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলে, “আর বিচার?”
“বিচার হল তুলনা করে দেখা। যেমন একজন কারও গাছের ফল না বলেই নিয়ে গেল, তখন দেখতে হবে এখানে প্রচলিত নিয়মে সবার কাছে উত্তম বিষয়টা কি! কিছু আদিবাসী আছে যারা মনে করে গাছের ফল খাওয়া সবার অধিকার, তারা অনায়াসে যে কোন গাছের ফল খেতে পারে, কেউ বলবে না চুরি করছে। কিন্তু আমাদের সমাজে কারও গাছের ফল অন্যে না বলে নিয়ে গেলে বলবে এটা চুরি। আমরা আমাদের নিয়মে চুরি ধরেই এর বিচার করব। সোজা কথা কোন লোক যে কাজ বা আচরণ করবে, তার সাথে তুলনা করব তার বিকল্প কাজ বা আচরণের সাথে যা সবচেয়ে উত্তম। এই তুলনা করাই হল বিচার, এতে বিবেক সাহায্য করে।”
তন্ময় দাদুর কথাগুলো গিলতে থাকে। এ বিষয়গুলো দাদু ছাড়া এত সুন্দর করে আর কে বুঝাবে!
দাদু বলতে থাকেন, “তোমার জানার ইচ্ছা আছে, তাই তুমি জিজ্ঞাসা কর, সেজন্য তুমি জিজ্ঞাসু, তোমার জানার বিষয়টি হচ্ছে জিজ্ঞাস্য, তাই না দাদু!”
তখন মাথা নাড়ে।
“তেমনি কারো পরিবারে তিন ভাই, একটা আম তারা তিনজন ভাগ করে খাবে, তারা প্রত্যেকেই ওই আমের অংশী। তারা সবাই ওই অংশ পেতে চায়। অংশীর অংশ লাভের ইচ্ছাই মীমাংসা। ওই আম একজন হয়ত গাছ থেকে পেড়ে এনেছে, আরেকজন কেটেছে, আরেকজন কিছুই করে নাই। আমটি পেতে যার যার কাজ অনুযায়ী সে ভাগ পাবে। তবে তন্ময় দাদু, বিচার করাটা কঠিন হয়ে পড়ে কখনও। অনেক বিষয় আছে, যা তুমি হয়ত বড় হলে বুঝবে।” তন্ময় মাথায় শব্দগুলো ঘুরতে থাকে। এগুলো তার বইয়ে লেখা নাই।
গরুর গাড়ী আরেক খেপ নিয়ে এসেছে, ধানের গন্ধ বাড়ীটা মৌ মৌ করছে।
তাদের বাড়ীর যে বড় কামলা, তাকে সবাই রাজকামলা বলে। সে সবার তদারকি করে। সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করে অন্য কামলাদের সাথে। ধানের পাড়া ঠিকমত না রাখায় সে অন্যদের বকছে। গল্পদাদু সেদিকে তাকিয়ে বলেন, “দাদু, এক মাছ আরেক মাছকে গিলে খায় তা জানো তুমি?”
তন্ময় তাদের বাসায় আনা বোয়াল মাছের পেটে অন্য ছোট মাছ দেখেছে, বোয়াল ছোট ছোট মাছ খেয়ে ফেলে। তন্ময় বলে, “হ্যাঁ, দাদু।”
“মানুষের মাঝের এটা আছে। বড় মানুষ, ছোট মানুষকে গিলে খায়!”
“কী রকম!”
“বড় মানুষ বলতে পদে বড় আর কি! ওই দেখছ না, রাজকামলা কাজ তেমন করে না, কিন্তু তার বেতন বেশি, সে চেঁচায়ও বেশি। বড় মানুষ বলতে পদে বড় বুঝিয়েছি।”
“দাদু, বল না প্লিজ!”
“বলব, এ নিয়ে অনেক শব্দ আছে, সে গল্প তোমাকে বলব। তবে আজ নয়। এখন উঠতে হবে, বেলা শেষ হয়ে এল।”
গল্পদাদু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ান। ধীরে ধীরে নিজের বাড়ীর দিকে হাঁটতে থাকেন।
উঠানের মাঝখানে হ্যাজাক লাইট জ্বলছে, সমস্ত বাড়ীটা আলোয় যেন হেসে ওঠেছে। বাড়ীর ছোটরা জটলা পাকিয়ে গল্প করছে। বড়রা সবাই ব্যাস্ত, আজ প্রথম মাড়াই হবে। রাজকামলা পাল’দা সবাইকে নির্দ্দেশ দিচ্ছে, অন্যরা আঁটিগুলো কাস্তে দিয়ে কেটে এমনভাবে ছিটিয়ে দিচ্ছে ডামের উপর, তন্ময়ের মনে হচ্ছে সবটাই আস্ত কবিতা বা গানের ছন্দ। বড়চাচা বেঞ্চিতে বসে হুঁকো টানছেন আর গ্রামের কয়েকজন মুরব্বীর সাথে গল্প করছেন। উনারা মাড়াই দেখতে এসেছেন। ঘরের তাজা গরুগুলোর মুখে খোপা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যেন ধানের গোছায় মুখ দিতে না পারে। এবার ধানের গোছার উপর গরুগুলো ঘুরছে। কামলাদের হাতে বাঁশের লাঠি, গরু হাঁটতে না চাইলে পিঠে দু’ঘা বসিয়ে দেয়। এই যে গরুগুলো ঘুরছে, কামলারাও ঘুরছে এ যেন এক বৃত্ত। ধানগুলো গোছা থেকে আলাদা হয়ে ঝরে পড়ছে, মাঝে মাঝে খড়গুলো ঝেড়ে একপাশে সরিয়ে রাখা হচ্ছে, আবার আঁটি কেটে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরই মাঝে তাদের হৈচৈ, কত গানের সুর। তন্ময় এগুলোই দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তন্ময়ের একটা বিষয় হচ্ছে, সে সবার সাথে মন খুলে ঠিক মিশতে পারে না, কারণ সে যে কোন বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করে, যা অন্যদের সাথে মিলে না। কাঁধে হাত, তন্ময় চমকে তাকায়, গল্পদাদু।
গল্পদাদু চেয়ার টেনে বসে পড়েন।
তন্ময়ও একটা টুল এনে দাদুর পাশে বসে, জানে দাদু আবার গল্প বলবেন।
সত্যিই তাই, দাদু গল্প শুরু করেন।
“জানো দাদু, জল বলতে জনগণ বোঝায়!”
তন্ময় এ কথা শুনে নাই, বড় অদ্ভূত কথা তো!
“পুকুর, হৃদ, নদী সমুদ্র যেমন পৃথক পৃথক জল, তেমনি মানুষেরও আছে পৃথক পৃথক জল বা জনগোষ্ঠী। সব জল মিলে যেমন সমুদ্র হয়, তেমনি সব গোষ্ঠীর মানুষ মিলে হয় জনসমুদ্র। জলাশয়ে যেমন জলস্রোত বয়, জনসমুদ্রে জনস্রোত বয়। কথাটি তুমি নিশ্চয় শুনেছ। যেমন কোন জনসভায় অনেক লোকের সমাগম বুঝাতে জনসমুদ্র কথাটি ব্যাবহার করা হয়। আবার শহরের রাস্তায় অনেক ভীড় হলে বলে জনস্রোত। সাধারণ মানুষেরা হল জল, জল যেমন জলীয়বাষ্প হয়ে আকাশে মেঘরূপে থাকে, তেমনি যারা সমাজে নেতৃত্ব দেয়, তারাও আর জল থাকে না, জলের রূপান্তরিত রূপ মেঘে পরিণত হয়, এই মেঘ গর্জ্জন করে; যেমন উবে যাওয়া জল মেঘ হয়ে গর্জ্জন করে। আবার জল জমে গিয়ে বরফ হয়, অনেক জমাট বরফ মিলে হয় হিমালয় পর্ব্বত, বড় শক্ত, বড় কঠিন, নড়ে চড়ে না। জল রূপ মানুষের মাঝেও কিছু সংখ্যক যারা হিমালয়ের মত কঠিন হয়ে জমে যায়। আর সাধারণ মানুষ হল এই কামলাদের মত, সাধারণ জল এরা।
জল একটা ক্রিয়ামূল, √জল (জীবন) + অন্। যার অর্থ আচ্ছাদন করে যে, ঢেকে দেয় যে। কিন্তু জল অর্থ তো আমরা জানি পানি, সলিল, বারি— এসব। জল কীভাবে ঢেকে দেয় শোন— মাঝে মধ্যে শোনা যায় অমুক ডাকাত ডাকাতি শেষ জনসমুদ্রে মিশে গেছে, হারিয়ে গেছে। তাকে আর খু্ঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মানে হল জনগণ তাকে ঢেকে দিয়েছে, জনগণের মাঝে সে এমন ভাবে লুকিয়েছে যে তাকে আলাদা করে খুঁজে বের করা যাচ্ছে না। আবার জল যেমন মাছ জীবিত থাকে তেমনি মানুষও জনগণের মাঝে জীবিত থাকে। এজন্য বলা হয়— জলজ্যান্ত মানুষটা কোথায় গেল!
আবার জল থেকে জাল হয়, জাল দিয়ে মাছ ধরে, জালের সুতো ভেদ করে মাছেরা বের হতে পারে, আবার পারেও না, যে মাছ পারে না, না সেই মাছ জালে ধরা পড়ে। তেমনি মানুষ ধরার জন্যও জাল পাতা হয়। সেই জাল ভেদ করে কেউ বেরিয়ে যায়, আবার কেউ ধরা পড়ে। মানুষ ধরার জাল কিন্তু সূতোর নয়, সে অনেক রকমের আছে, কথার জালও হতে পারে। কোন কোন মাছ পর্য্যন্ত পৌঁছাতে পারে না, এরা হল গভীর জলের মাছ, কোন কোন মানুষও এমন আছে, যাদের কাছে কিছুতেই তুমি পৌঁছাতে পারবে না, এরা সহজে ধরা দেয় না, এরা হল গভীর পানির মাছ।”
চা সামনে, দাদু কথা থামিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নেন। তন্ময়রা বাড়ী আসলে বড়চাচা চাপাতা কিনেন, তন্ময়ের আম্মু চা খান, তাই যতদিন তারা বাড়ী থাকবে ততদিন বাড়ীতে চা হবে।
চা শেষে দাদু পান মুখে দিয়ে আবার শুরু করেন,
“জলে থাকে মাছ, মানুষের মাঝেও মাছ থাকে, যে বলে এটি আমার। অর্থাৎ আমিত্ব এই বোধ বা মালিকানা বোধ। যার সামান্য কিছু সম্পদ সে হল কেবল মাছ, যার এর চেয়ে বেশি সে হল চুনোপুঁটি, যাদের যথেষ্ট সম্পদ তারা হল রুইকাতলা। আর যারা অন্যের সম্পদ হরণ করে, তারা হল রাঘব বোয়াল। জলে যেমন কুমীর থাকে, মানুষের মাঝেও তেমনি অগাধ সম্পত্তি বা টাকাওলা লোক থাকে, তাদের বলে টাকার কুমীর। তাহলে দেখ জলের সাথে মানুষের কত মিল।”
তন্ময় সত্যি অবাক হয়। এই কথা সে কোনদিন শুনে নাই, কোন বইয়ে পড়ে নাই।
“আমাদের শব্দগুলো এমনই, যখন শব্দগুলো তৈরি হয়, তখন তার কিছু মানে ছিল দৃশ্য বা চাক্ষুষ, আর কিছু ছিল অদৃশ্য— যা আসলে বুঝে নিতে হয়।”
তন্ময় মাথা নাড়ে। মাড়াই চলছে, একদল খেতে গেছে বড়ঘরে, তন্ময়েরও ডাক পড়েছে। দাদু দাঁড়ালেন, “যাও তন্ময়, ঘরে গিয়ে খাও, আমার আবার একটু কাজ আছে, কয়টি চিঠি লিখতে হবে।”
তন্ময় দাদুর চলে যাওয়া দেখে। রাত তখন বেশ, কেমন কনকনে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, তন্ময়ের খিদেও পেয়েছে। সে ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে আর ভাবতে থাকে, পুর আর গাঁয়ের পার্থক্যটা তো জানা হল না। গল্পদাদুকে আবার ধরতে হবে।…………….
রুবি বিনতে মনোয়ার রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, তেপান্তরের পাথার — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।