আকাশ থেকে ঝরছে বেশ অনেকক্ষণ ধরেই শ্রাবণের বৃষ্টি। থামার লক্ষণও নায়। আগামীকাল ঈদ, কিন্তু রসুলপুর গ্রামের একমাত্র বাজারে এখন দু’চারটি দোকান বাদে, আর একটি দোকানও খোলা নায়। আলাল মিয়া বসে আছে একটি দোকানের বারান্দায়, যে দোকানটিতে সারা দিন রাত পরিশ্রম করে সে। বেতনভোগী না হলেও দিনমজুরী করে কোন মতে চলে যায়— এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে একেকটি দিন। অনেক চেষ্টাও করেছে একটা স্থায়ী চাকরীর জন্য, কিন্তু এই গ্রামে নতুন বলে কেউ চাকরী দিতে চায়নি। অনেক বলে-কয়ে এই গ্রামেরেই একজনের পরিত্যক্ত একটি আধা পাকা টিনের ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছে আলাল মিয়া। কোমর সমান পানি পেরিয়ে আসা যাওয়া করতে হয় প্রতিদিন। সেখানেও খুব বেশি দিন থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। রাত প্রায় ৯টা ছুঁই ছুঁই। দোকানের ম্যানেজার মনিন্দ্র পাল হঠাৎ করে ডাক দেন আলাল মিয়াকে।

ঃ আর কতক্ষণ বইস্যা থাকবি! মালিক আজকে আর আইবো না। বাইত্তে চইল্ল্যা যা।
ঃ না বাবু, মালিক তো আমারে কইলো যত রাইতই অউক, আইয়্যা আমারে বখশিস দিবো। আর এই কথা আজকে না, চাইর পাঁচ দিন ধইর‌্যা আমারে কইছে।
ঃ কইছে, দেখগা ভুইল্যাও গেছে। বড়লোকের মনে অইছিলো কইছে। আর তো দেরী করন যায় না। দোকানের সাটারগুলা একটু নামা। বৃষ্টিও কমছে।
ঃ বাবু যদি কিছু মনে না করতেন। আমারে যদি পাঁচশ টেকা দিতেন। তাইলে আমি ঐ দোকান থাইক্যা বউ’র লাইগ্যা একটা শাড়ী, বাচ্চাগো লাইগ্যা কাপড় নিতাম। মালিকে বখশিস দিলে আমি আবার আপনারে দিয়া দিতাম…
ঃ কছ কি! ক্যাশ থাইক্যা টেকা দিলে চাকরী তো থাকবো না বেডা। আর আমার কাছেও টেকা নায়।
ঃ বাবু যদি দয়া করতেন, আমি মালিকের কথা হুইন্যা বউ বাচ্চাগো কইয়া আইছি। কাপড় লইয়া বাসায় যামু।
ঃ ভালোই করছো। টেকা হাতে না আসার আগেই বড়লোকি কথা কইয়্যা আইছো। সাটার লাগাতো, দিকদারি করিস না। ডেইলি খাইতে পারছ না ভালো মতো। ঈদ ঈদ কইরা তো মাথাই আউলা কইরা দিলি। গরীবের আবার ঈদ আছে নি রে বেডা…
দুই
কোমর সমান পানি ভেঙ্গে আলাল মিয়া বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। রাত হয়েছে অনেক। খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছে আলাল মিয়ার। বৃষ্টি আবার আরম্ভ হয়েছে। বুকের কাছে ধরে রাখা শাড়ী জামা যাতে না ভিজে খুব চেষ্টা করছে সে। ভালো ভাবে গায়ের শার্টের ভিতর ঢুকিয়ে প্যঁচিয়ে নিয়েছে সে। আনন্দে চিকচিক করছে মুখ। শাড়ী আর জামা দেখার পর বৌ বাচ্চারা অনেক খুশি হবে। এই ভেবেই আলাল মিয়ার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। টাকাটা শেষ মুহুর্তে কি মনিন্দ্র পাল দিলেন নাকি দোকান মালিক এসে নিজ হাতে দিয়েছেন, এমনও তো হতে পারে কাপড়ের দোকানদারের মায়া হয়েছে, সে বাকীতে জিনিসগুলো দিয়ে দিয়েছে।
তিন
সে রকম কিছুই ঘটেনি। ঘটলে ভালোই লাগতো। বাস্তবে আলাল মিয়া বাড়ী ফিরছে কোমর সমান পানি ভেঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে। বুকের কাছে শার্টের ভিতরে প্যাঁচানো আছে শাড়ী জামা নয়, সারা দিনের আয়ে বাজার করা এক কেজি চাল, দুইটা ডিম, এক প্যাকেট সেমাই, বোতলে একটু খানি দুধ, আর একশো গ্রাম চিনি।
চার
বাসার দরজার কাছে আসতেই আলাল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বসে পড়ে দরজার সামনে। কাঁদতে থাকে চিৎকার করে। কান্না শুনে আলালের বউ মরিয়ম বেরিয়ে আসে…
পাঁচ
ঃ আমি আগেই কইছিলাম, এই বখশিস টকশিস আপনারে দিবো না। খামাখা স্বপ্ন দেইখেন না।
ঃ আমি পোলাপানের সামনে ক্যামনে মুখ দেখামু মরিয়ম।
ঃ অইছে কাইন্দেন না। আমি বুঝাইয়া কইমু নে। টেকা হারাই গ্যাছে। সামনের ঈদে কিইন্যা দিবেন। চাইল আনছেন না।
ঃ আনছি, লগে ডিম আছে, সেমাই দুধ চিনিও আনছি।
ঃ ভালোই অইছে, সকালে দুধ সেমাই রাইন্ধা দিমু। ডিম ভাজা আর ভাত, আর লগে মুরগীর ছাল পাকনা পা গিলা দিয়া ছালন করমু নে। যে বাসায় কাম করি হেরা দিছে।
ঃ (আলাল মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে) গরীবের ঈদ নায় রে, ঈদ নায়… ঈদ থাকতে নায়…

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, বখশিস — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *