শিক্ষা শব্দটা আমাদের জীবনযাত্রার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কারণ শিক্ষাই মানুষের বৌদ্ধিক ও কৃষ্টিগত ঐতিহ্যকে সৃজনশীল ও গতিশীল করে তোলে। মানুষের মন, বুদ্ধি ও রুচিকে সুবিন্যস্ত করে এই শিক্ষা। শিক্ষা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু থেকে। সাধারণভাবে বলা যায় মানুষের আচরণের কাঙ্খিত, বাঞ্চিত এবং ইতিবাচক পরিবর্ত্তন হৈল শিক্ষা। যুগে যুগে নানা মনীষী নানাভাবে শিক্ষাকে সজ্ঞায়িত করেছেন। আবার সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার সংজ্ঞা বা ধারণাও পরিবর্ত্তন এসেছে। শিক্ষা হৈতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আবার প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্যান্য উৎস হৈতেও পাওয়া যেতে পারে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
এইবার আসা যাক নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে। সাধারণত নারী শিক্ষা বলিতে আমরা বুঝি নারির সার্ব্বিক অধিকার, জীবনযাপন পদ্ধতি ও ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জ্জন। এইখানে অধিকার এবং ক্ষমতায়ণের বিষয়গুলি আলাদা করে আসার কারণ প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞান কাঠামোর উপস্থিতি। সার্ব্বিক জ্ঞানের সাথে তাহার প্রজাতিগত জ্ঞানের বোঝাপড়া এবং জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নততর জীবনযাপনের সক্ষমতা অর্জ্জনকে বলা যেতে পারে শিক্ষার প্রায়োগিক দিক্। শিক্ষাকে বাস্তব জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে নিতে না পারিলে শিক্ষা অর্জ্জনের উদ্দেশ্য ব্যহত হয়।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাঙ্গনে নারিদের অংশগ্রহনের ইতিহাস অতি দীর্ঘ। প্রাচীন বাঙ্গালায় শিক্ষা ব্যবস্থার ঐতিহাসিক পটভুমী ছাড়া বঙ্গীয় নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব হৈবে না। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন যুগের নারিরা ছিল স্বাধীন এবং স্বাভবিক জীবনের অধিকারী। উপমহাদেশের প্রাচীন দর্শন ও পৌরাণিক ইতিহাস ঘাটিলে নারী স্বাধীনতার এমন রূপটিই দেখিতে পাই। তন্ত্র এবং সাংখ্যদর্শনের কথা এইখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, ‘সমস্ত শাস্ত্রের মধ্যে একমাত্র তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারেই মেয়েদের পক্ষে গুরু হ্ওয়া সম্ভব, এমন কি মেয়েদের কাছে দীক্ষা নেওয়াই উত্তম।’ তাহা ছাড়া প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজ মাতৃতান্ত্রিক হওয়ায় উর্ব্বরা শক্তির বন্দনা এবং খাদ্যদায়িনী শক্তিকে শ্রদ্ধা করার রীতি প্রচলিত ছিল। সাংখ্যদর্শনে প্রকৃতি ও পুরুষের যেই অবস্থান সেইখানে প্রকৃতির অর্থ শুধু জড়বস্তু নয়, প্রকৃতি মানে অন্নদায়িনী শক্তি। তাই নারীকে প্রকৃতির মতৈ অপার শক্তির আধার হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হৈত। পরবর্ত্তীতে বাঙ্গালায় বেদ অনুসারীদের প্রবেশের ফলে বিভিন্ন যুগে সমাজে নারির মর্য্যাদার হ্রাস বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষাক্ষেত্রেও দেখা যায় একৈ ধরনের চিত্র। বৈদিক যুগের শুরু থেকে মধ্যযুগ পর্য্যন্ত নারী শিক্ষার কোন গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু তাহা সত্বেও সেই যুগের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নারী ধর্ম্মীয় ভাবধারায় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তাহারা হৈলেন— অপালা, ঘোষা, লোপামুদ্রা, বিশাখা, মমতা, গর্গী, মৈত্রেয়ী, খনা প্রমুখ বিদুষী নারী। প্রাচীন বাঙ্গালায় শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস ঘাটিলে দেখা যাবে যে, প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিকতা ও পাশ্চাত্য ভাবধারা আমাদের জ্ঞানচর্চ্চায় এক্ষণো বিদ্যমান রয়েছে। কারণ প্রথম দিকে প্রাচীন ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ধর্ম্মীয় অনুভুতি দ্বারা আচ্ছন্ন। পরবর্ত্তীতে উনিশ শতকের দিকে ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য একটা শিক্ষিত শ্রেণী তৈয়ার করার পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনা থেকেই ১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা এবং ১৭৯১ সালে জোনাথন ডারকান কাশীতে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন। পরবর্ত্তীতে লর্ড ওয়েলিসলী ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ব্রিটিশ শাষিত ভারতে তক্ষণ থেকেই উচ্চশিক্ষার গোড়াপত্তন হয়। মিশনারিদের উদ্যোগে ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর কলেজ এবং ১৮২০ সালে কলকাতা বিপস কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮২৪ সালে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ এবং ১৮৩৬ সালে মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮৩৫ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় সরকারী বিদ্যালয় যাহা কলেজে উন্নীত করে নাম দেওয়া হয় ঢাকা কলেজ। ইংরেজদের উদ্দ্যেশ্য ছিল তাহাদেরি ভাবধারা নিয়ে উপমহাদেশের এক শ্রেণির লোকেরা শিক্ষিত হৈবে। ১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলে কর্ত্তৃক প্রবর্ত্তিত শিক্ষানীতিতে উল্লেখ থাকে, এই দেশের শিক্ষাব্যাবস্থা এমন এক শ্রেণী তৈয়ার করিবে যারা চিন্তা চেতনা ও রুচিতে পুরোপুরি ইংরেজ হৈবে আর রক্তেমাংসে থাকিবে ভারতীয়। পরবর্ত্তীতে অনেক সমাজ সংস্কারক এই শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং এই দেশের মানুষকে তাহাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন।
যদিও ইংরেজদের প্রবর্ত্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল তাহাদের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য, তাহারপরেও বলা যায় ব্রিটিশ ভারতেই যথাযথ নারী শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। প্রথমে ইংরেজ মিশনারিদের উদ্যোগে বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বাঙ্গালাদেশে রবার্ট মে নামে একজন ইংরেজ মিশনারী ১৮১৮ সালে সর্ব্বপ্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মেরি এন কুক ১৮২৩-১৮২৮ সালের মধ্যে ৩০টা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে চার্চ মিশনারী সোসাইটির পৃষ্ঠপোষকতায়। কিন্তু সেই সময় ধর্ম্মীয় গোড়ামি, সমাজের নানান কুসংস্কার উপেক্ষা করে মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা ছিল কল্পনাতীত। ধর্ম্মীয় ভাবধারায় শিক্ষা প্রদান করা হৈত এ কারণেও ধর্ম্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কায় সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা বিদ্যালয়ে যেত না। পরবর্ত্তীতে জন ইলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে মেয়েদের জন্য বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যাহা বেথুন কলেজ নামে খ্যাত। যেই প্রতিষ্ঠানটা নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন। তৎকালীন কলকাতায় মুসলমান মেয়েদের বেথুন কলেজে পড়িবার সুযোগ ছিল না। বাঙ্গালাদেশেও ছিল একৈ অবস্থা। ১৮৬৮ সালে রাজশাহীতে দুইটা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপণের নযীর পাওয়া যায়। একটা মিশন কর্ত্তৃক পরিচালিত অন্যটী সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত। সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ের নাম পাওয়া গেছে যাহার বর্ত্তমানে পিএন গার্লস স্কুল নামে পরিচিত। ১৮১৭ সালে ঢাকায় মিশনারিদের উদ্যোগে প্রথম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হৈলে সেইখানে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও পড়িতে যেত। ১৮২৫ সালে মেয়েদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় খোলা হয়। এই সালেই ঢাকায় বালক-বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১টা এবং ৫২১ জন ছাত্রের বিপরীতে ছাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৯ জন। নারী শিক্ষা প্রসারে যুগান্তকারী অবদান রাখে ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইডেন গার্লস হাই স্কুল। বাঙ্গালার গভর্নর স্যার এ ইডেন ঢাকায় এই বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯৯২ সালে আম্বিয়া খাতুন নামে এক মহীয়সী নারী চন্দনপুর মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় নামে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যাহা পরবর্ত্তীতে গুলজার বেগম গার্লস হাইস্কুল নামে পরিচিতি লাভ করে এবং এইখান থেকেই চট্টগ্রামে আধুনিক নারী শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়।
বাঙ্গালার নারী জাগরণ ও নারী শিক্ষা প্রসারে বেগম রোকেয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য। বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের অবরোধবাসিনী নারিদের কাছে আলোর দূত হিসেবে তাঁহার আবির্ভাব। নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচনের পাশাপাশি চিন্তাশীল রচনার মাধ্যমে জাগরণ ও মুক্তির বার্ত্তাই রোকেয়া এই দেশের নারিদের শুনিয়েছেন। তাঁহার ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল কলকাতায় মুসলমান মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত তৃতীয় মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়। কলকাতায় প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়টি ১৮৯৭ সালে মুর্শিদাবাদের নবাব বেগম ফেরদৌস মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত হয়েছিল। ১৯০৯ সালে মেয়েদের জন্য সোহরাওয়ার্দী বালিকা বিদ্যালয় নামে দ্বিতীয় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন খুজিস্তা আখতার বানু।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গীয় সমাজে নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হৈলেও মুসলিম নারির ক্ষেত্রে এই পথ সহজ ছিল না। ধর্ম্মীয় অনুশাষন, অবরোধর প্রথা ও সামাজিক কঠিন শৃঙ্খলকে ভেঙ্গে নারিদের শিক্ষাগ্রহণ করা ছিল কষ্টসাধ্য। অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বর্ত্তমানে নারিদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রসরতা বেড়েছে বহুগুণ। এই দেশের নারিরা বারবার প্রমাণ করিতেছে তাহারাও একজন পরিপূর্ণ মানুষ এবং মানুষ হিসাবে সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার তাহাদেরেও আছে।
নারী শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক অভিযাত্রার এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর, আসুন এইবার ফিরে তাকানো যাক নারিদের মানসিক শিক্ষা ও মুক্তির দিকে। বাঙ্গালাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরে নারিরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে এবং এই ধারা চলমান থাকিবে বলেই আশা করা যায়। বর্ত্তমানে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকৈ কিন্তু মানসিক ও বৌদ্ধিক ভাবে কি এদেশের নারিরা মুক্ত হৈতে পেরেছেন? সম্ভবত সত্যিকার অর্থে মুক্ত হৈতে পারেনি। কারণ মুক্তির নামে আমাদের দেশের মেয়েদের পায়ে মুক্তির শেকল পড়ানো হয়। নানান উপমায় উপমিত করে নারির অস্তিত্বকে ঐশ্বরিক করে তাদের বন্দী করা হয় চার দেয়ালে। শৈশবের সাথে এদেশের মেয়েদের মাথায় পিন-আপ করে দেয়া হয় লক্ষ্মী মেয়ে শব্দটী। সাধারণত প্রত্যেক বাবা-মা রাই তাদের প্রিয় মেয়েকে বলে— লক্ষ্মী মেয়ে ওদিক যেও না, লক্ষ্মী মেয়ে দুষ্টুমি কর না, লক্ষ্মী মেয়েরা কক্ষণো বাইরে যায় না। লক্ষ্মী শব্দটীর মাতামাতিতে মেয়েদের ভেতর লক্ষ্মী হবার এক বিভ্রান্তি চলে আসে এবং এই লক্ষ্মী সম্পর্কিত বুলিগুলিই এক নারির জীবনকে করে ফেলে আবদ্ধ জলাশয়। সে আবদ্ধ জলাশয়ে জীবন পচে কেবল লক্ষ্যহীন চোখ, মাথা, যুক্তি এবং আবেগেরেই জন্ম হয়!
এ’ক্ষণ প্রশ্ন হচ্ছে নারিরা কি তাহাদের সার্ব্বিক অধিকার, জীবন পদ্ধতি ও তাহাদের ক্ষমতায়ন সম্পর্কে অবগত নয়? শিক্ষা ক্ষেত্রে নারিদের অংশগ্রহণ বাড়িলেও কেন সমাজে নারিরা এক্ষণো পিছিয়ে রয়েছে? কেন প্রতিনিয়ত নানান প্রতিবন্ধকতা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে দিতে গেলে এইটাই বলিতে হয় যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং বর্ত্তমান শিক্ষা ব্যাবস্থার জন্যেই নারিদের এক্ষণো মানসিক ও বৌদ্ধিক মুক্তি মেলেনি। প্রাচীন বাঙ্গালার ইতিহাস ঘাটিলে দেখা যাবে যে, সেই সময় সমাজ ব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কৃষি ও পশু পালনের পর যক্ষণ শ্রম বণ্টনের ব্যপারটা শুরু হৈল তক্ষণ থেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আবির্ভাব ঘটে। তৈয়ার হৈল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থার যাহা আজো আমাদের সমাজে বিদ্যমান রয়েছে ভয়াবহ ভাবে। প্রাচীনকাল থেকে এই যাবৎ বহু মনীষী, মহারথী, পণ্ডিত, শাস্ত্রকারের জন্ম হয়েছে কিন্তু এদের ভেতর নারির কোটা অতি সামান্য। কারণ পুরুষতন্ত্র আমাদের মগজের ভেতর ঢুকে মন্ত্রের মত বাসা বেঁধেছে। যেসব নারিরা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছে সমাজ তাহাদের করেছে হেয় প্রতিপন্ন, কক্ষণো করেছে নির্ব্বাসিত, এমনকি বুদ্ধি বিদ্যার কথা যেন নারী কক্ষণো প্রকাশ করিতে না পারে সেটার জন্যেও কেটে দেয়া হয়েছে নারির জিহ্বা। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থার বিভিন্ন পদ্ধতিতে মানসিক ও শারীরিক নির্য্যাতন নারিদের বেঁচে উঠাকে করেছে দূর্ব্বীসহ। নারির মানসিক ও বৌদ্ধিক মুক্তির প্রধান বাধা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা প্রচলিত শক্ত শৃঙ্খল।
এইবার দেখা যাক বর্ত্তমান শিক্ষা ব্যাবস্থা ও নারী শিক্ষার অবস্থা। আমাদের দেশে ইয়োরোপীয় শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রভাব অতিমাত্রায় থাকার কারণে এই দেশের মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে বিভ্রান্তের শিকার হচ্ছে। তাহারা না পারিতেছে এইদেশের ভৌগোলিক পরিণ্ডলের ভাবধারাকে গ্রহণ করিতে, না পারিতেছে ইউরোপীয় ভাব ধারাকে অস্বীকার করিতে। বর্ত্তমানে শিক্ষার্থিরা ডিগ্রী অর্জ্জন করে একটা চাকরির আশায়। আমরা অধিকাংশৈ জানি না যে শিক্ষাকে জীবনের অনুগত করিতে হয়, জীবনকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আবদ্ধ করিলে মানসিক মুক্তি মেলা কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে জ্ঞানচর্চ্চায় নিজেদের যুক্ত করিতে অনিচ্ছুক হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা সৃষ্টিশীল হৈতে পারিতেছে না, গবেষণার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করিতে পারিতেছে না। অন্যদিকে শিক্ষাকে জীবন সংলগ্ন করিতে না পারার কারণেও এই দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যপারে কোন সিলেবাস নেই। সঠিক শিক্ষার অভাবে অধিকাংশ তরুণ-তরুণী নিজের অস্তিত্বকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করিতে না পেরে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। এই আত্মহনন কক্ষণো কক্ষণো শারীরিক হৈলেও অধিকাংশ সময়েই মানসিক, যাহার ফলে বাইরে থেকে সহজে তাহা ধরা যায় না। বর্ত্তমানে শিক্ষাকে করা হয়েছে বাণিজ্যিক। ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বেসরকারী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বৈ/বই পুস্তকের জ্ঞান নিয়ে দেশে তৈয়ার হচ্ছে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। আমরা সকলেই জানি বেকারত্ব জীবনের অভিশাপ কিন্তু এই জীবনের দায়ভার কাহার? আমাদের নয় কি?
আর নারী শিক্ষার কথা বলিতে গেলে এইটাই বলিতে হয়, নারিদের শুধু নামে মাত্র শিক্ষিত করা হচ্ছে এবং সেই শিক্ষার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। যেইখানে মানসিক দিক দিয়ে এই দেশের নারিরা এক্ষণো মুক্ত হৈতে পারেননি সেইখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চ্চার কথা বলা খুবি আজগুবি ব্যাপার। এই দেশের নারিরা মানসিক শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চ্চার ক্ষেত্রে এতৈ পিছিয়ে রয়েছে যাহার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিদিনের বিভিন্ন সংবাদ পত্র-পত্রিকার পাতায়। এই দেশের নারিদের ভেতর এক্ষণো নিজেদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান নেই। এইজন্যে অনেক নারী সন্তান জন্মের সময় মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে, জন্ম দিচ্ছে খর্ব্বাকায় শিশু। এই দেশে প্রতিনিয়ত সহিংসতার শিকার হচ্ছে অসংখ্য নারী। পারিবারিক নির্য্যাতন, যৌতুক প্রথা, ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধগুলি এদেশের নারির জীবনের সাথে লেগেই আছে। এত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার পর একজন নারির ঠিক কোথায় গিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চ্চা করিবে? নারিরা কি চায় সকল বাঁধা ভেঙ্গে নিজেদের মুক্ত করিতে? সম্ভবত চায় না কারণ পুরুষতন্ত্র আমাদের মনে শক্তভাবে বাসা বেঁধেছে যাহাকে তাড়াতে চাহিলে পুরুষ নারী উভয়কেই সচেতন হৈতে হৈবে। এমনকি এই দেশের মেয়েরা বেড়ে উঠিতেছে, শিক্ষিত হচ্ছে এবং কর্ম্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়িতেছে ঠিকি কিন্তু সেইটী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থার আদলেই। আমাদের এক্ষণো বুদ্ধির মুক্তি হয়নি। আমরা এক্ষণো প্রাচীন কাল থেকে অর্জ্জিত ও লালিত বিশ্বাস, কুসংস্কার, আচার-আচরণ মুছে ফেলে নিজেদের শুভ বুদ্ধিকে মুক্তি দিতে পারিনি। এইখানে বেগম রোকেয়ার শিক্ষা সম্পর্কিত ধারণাটি উল্লেখ না করিলেই নয়। বেগম রোকেয়ার ভাষায়, ‘শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি; গোটা কত পুস্তক পাঠ করিতে বা দু-ছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সেই শিক্ষা— যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে… শিক্ষা মানসিক ও শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই। তাহাদের জানা উচিৎ যে, তাহারা ইহজগতে কেবল সুদৃশ্য শাড়ী, ক্লিপ ও বহুমূল্য রত্নালঙ্কার পরিয়া পুতুল সাজিবার জন্য আসে নাই; বরং তাহার বিশেষ কর্ত্তব্য সাধনের নিমিত্ত নারী-রূপে জন্মলাভ করিয়াছে। তাহাদের জীবন শুধু পতি-দেবতার মনোরঞ্জনের নিমিত্ত উৎসর্গ হইবার বস্তু নহে। তাহারা যেন অন্নবস্ত্রের জন্য কাহারো গলগ্রহ না হয়।’ অর্থাৎ রোকেয়া এই দেশের নারিদের মানসিক বিকাশের জন্য ও আর্থিকভাবে নিজেদের স্বাবলম্বী হৈবার জন্যেই নারীশিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।
শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু ভুল ও জীবন অসংলগ্ন শিক্ষা আমাদের সমাজকে বিপথে পরিচালিত করে। নরবাদ বা নারিবাদ নয় আমাদের সমাজ ব্যাবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি ও সামগ্রিক গতিশীলতা নিশ্চিত করিতে হৈলে প্রথমেই আমাদের মানুষ হৈতে হৈবে। এবং এর জন্য নারী পুরুষ উভয়কেই নিজেদের মরিচা পড়া পুরানো চিন্তা এবং একপেশে ভাবধারা ও দৃষ্টিকোণকে পরিবর্ত্তন করতে হৈবে।
সহায়ক গ্রন্থাবলী:
১. আহমদ শরীফ (২০১১), শ্রেষ্ঠ রচনা, কথাপ্রকাশ, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।
২. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৪১৬) লোকায়ত দর্শন, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
৩. নারীবিশ্ব (২০০২), গাঙচিল, মাটির বাড়ী, ওঙ্কার পার্ক, ঘোলাবাজার, কলকাতা।
৪. যতীন সরকার (২০১০), প্রাকৃতজনের জীবন দর্শন, শোভা প্রকাশ, বাংলা বাজার, ঢাকা।
৫. সুপর্ণা গুপ্ত (২০০১), ইতিহাসে নারী, শিক্ষাপ্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা।
৬. স্বপন বসু (১৪১২), উনিশ শতকের স্ত্রী শিক্ষা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা।
জবা রায় রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, বঙ্গীয় নারী শিক্ষা ও বর্ত্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নারির জীবন — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।