এই রাসনগর মৌজায় পূজাতে সকলেই পশু বলি দেয়। পাঁঠা মহিষের বলির সাথে সাথে অন্তরের পশুর-ও নিধন হয় এ’সব শাস্ত্রের কথা নাকি পুরোহিতের বিধান এ’সব নিয়ে তা’রা মাথা ঘামায় না। এ’ছাড়া পুজায় পশু বলি দিয়ে সত্যি সত্যি কা’রোর মনের পশুর বিনাশ হয়েছে কিনা এর কোন প্রমাণ যদিও দৃশ্যমান হয়নি তবু নিরপরাধ পশুদের হত্যা করে নিজেদের মনের পশুকে বলি দিয়েছে ভেবে তা’রা খুবি শান্তি অনুভব করে।

 

রাসনগর মৌজায় প্রাণী বেচাকেনার পাঁচটা হাট আছে।ঈদ এলে সরকারী অনুমতি নিয়ে আরো কয়েকটা অস্থায়ী হাট বসায় লোকজন। এলাকার মোট ছাপ্পান্নটা গ্রামের লোকজন হাটে যাচ্ছে গরু মহিষ ছাগল কিনতে ঐসব হাটেই। তাই এ’ক্ষণ রাতদিন মানুষ ও প্রাণীর পদভারে গ্রামগঞ্জের রাস্তা প্রকম্পিত। বাচ্চা থেকে বুড়া সব বয়সী মানুষের কলরবে রাস্তাঘাট মুখরিত। সবচেয়ে বিরক্তিকর যা’ তা’ হৈল প্রাণীদের শরীর ও মলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠ্‌ছে।

 

এ’বছর ভেলানগর, রাসনগর, বটতলা, বিজয়পুর, দাশরথী, সীতাহরণ, রামপুর ও রাধানগরসহ মোট বিশ পঁচিশটা গ্রামে পূজা হৈবে। লোকজন বলছে আগে যে’খানে এই তল্লাটে মাত্র দু’তিনটা গ্রাম মিলে একটা করে পূজা হৈত এ’ক্ষণ কোথাও কোথাও নাকি একটা গ্রামেই দুইটা তিনটে করেও পূজা হয়। এ’বছর আবার আর বছরের থেকেও এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আবার আগে যে’সব গ্রামে কক্ষণো পূজা হয়নি সেসমস্ত গ্রামেও এ’ক্ষণ পূজা হচ্ছে। কারন কী? সরকারের পক্ষ থেকে পূজার জন্য প্রতিটা মন্ডপকে বেশ ভালো পরিমাণ টাকা সহায়তা দেয়া হয়। সেই টাকাকে অবলম্বন করে উৎসাহী যুবকরা নিজেদের থেকে ও গ্রামের সকলের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। সকলেই খুশী হয়ে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী চাঁদা প্রদান করে। সরকারী অনুদান ও চাঁদার টাকা দিয়ে তা’রা মহাধুমধামে পূজার আয়োজন করে। গ্রামবাসীরা খুব-ই খুসী। এতবড় ধর্ম্মীয় উৎসব সারা বিশ্ব যা’ নিয়ে মাতোয়ারা সেটা তা’দের গ্রামেও হৈবে এরচে আনন্দ আর কী হৈতে পারে? তা’রা যুবকদের উৎসাহ দেয়। উৎসাহ পেয়ে উদ্যোক্তারা কম্পিটিশনে নামে। এ’পাড়ার সাথে ও’পাড়ার বা এই গ্রামের সাথে ঐ গ্রামের কম্পিটিশন হয়। মণ্ডপ সাজসজ্জা, আলোকসজ্জা ও মূর্ত্তির সৌন্দর্য্যের কম্পিটিশন তো চলেই, আরো আছে কে কত বড় মহিষ বলি দেবে এই নিয়ে। তাই চলছে বাজারে বাজারে দৌড়াদৌড়ি।

 

আর ঈদের কোরবানী দেয়ার লোক ত বেড়েই চলেছে বছর বছর। মানুষের দ্রুত ধনসম্পৎ(দ) বাড়ছে। কেউ কেউ আবার রাতারাতি বড়লোক হচ্ছে এবং সম্পদ অনুযায়ী ধর্ম্মীয় বিধান মতে কোরবানী দেয়া যেমন বাধ্যতামূলক তেমনি এর মাঝে গৌরব-ও আছে। কে কত হাজার লক্ষ টাকার গোরু কিনেছে তা নিয়ে বৈঠকী আড্ডায় ও এমনি মানুষের মুখে মুখে অনেকদিন ধরে আলোচনা চলতে থাকে আর এ’ভাবে সে খবর অনেক দূর দূরান্তের গ্রামেও চলে যায়। তাই যা’রা বেশী দামের গোরু মহিষ দিয়ে কোরবানী দেয় এলাকায় তা’দের মান মর্য্যাদা বেড়ে যায় অনেকখানি। তা’ পূণ্যলাভের আশা বা মান মান মর্য্যাদা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় ভেতরের পশুবলিকে কেন্দ্র করে, হোক না সেটা ব্যাক্তির সাথে ব্যাক্তির, পাড়ার সাথে পাড়ার বা সংঘের সাথে সংঘের তাতে প্রতিযোগিতায় প্রাণীর হাট জমে য‘ক্ষণ জমজমাট অবস্থা, ত‘ক্ষণ খবরের কাগজ এবং ইলেকট্রণিক মিডিয়াও প্রাণীর হাটের খবর নিয়ে একেবারে হামলে পড়েছে। তা’রা বিভিন্ন পশুর হাটের খবরাখবর এবং বিষয়টাকে কেন্দ্র করে মানুষের ভাবনা, উৎকন্ঠা এবং আনন্দ ও প্রতিযোগিতার কথা ফলাও করে প্রচার করছে। এক একদিন এক এক এলাকার খবর তা’রা তুলে ধরে। যেমন আজকের খবরে রাসনগর মৌজার কথা। টেলিভিশনে নিজেদের এলাকার নাম শুনে লোকজন কান খাড়া করে খবর শুনছে।

 

ঈদের বাজার জমে ওঠেছে। গরুর হাট ত বটেই গ্রাম শহরের রাস্তাঘাট এবং অলিগলীও গোরু ছাগলে এমন সয়লাব যে মানুষের চলাফেরা দায়। কেউ হাটে যাচ্ছে গোরু নিয়ে ত কেউ হাট থেকে গরু নিয়ে ফিরছে। এই বছর আবার পূজা আর ঈদ একসাথে পড়েছে। অনেক বছর আগে আজকের যা’রা পূর্ণবয়স্ক তা’দের ছোটবেলা এমন নাকি হয়েছিল। তা দুইটা উৎসব একসাথে হওয়ায় এ’ নিয়ে কা’রো কা’রো বেশ আনন্দ কেউবা মহাবিরক্ত। তা’দের মধ্যে ব্যাবসায়ী ক্রেতা সকলেই আছে। হিন্দুদের কেউ কেউ ভাবছে কোরবানীর বর্জ্জের গন্ধে পূজার ফুলচন্দনের গন্ধ না চাপা পড়ে যায়! আর মুসলমানদের কেউ কেউ বলিতেছে মন্ডপের ঢাকের আওয়াজ নমাযের পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য্য নষ্ট করে দেবে। কাজেই ঢাক ঢোল বাজাতে দেয়া যাবে না। তা’ মানুষের ভাবনা মানুষ ভাববে পূজা বা ঈদের তিথি ত আর কেউ পাল্টাতে পারবে না। যা’রা আনন্দিত তা’দের আনন্দের কারণ সচরাচর যা’ হয় না এবার তা’ হচ্ছে— দুইটা প্রধান সম্প্রদায় সারাদেশে একসাথে উৎসবে মেতে উঠিবে এ কি কম আনন্দ নাকি! যদিও আরো দু’একটা ধর্ম্মীয় উৎসব আছে যা’ এইসময় হৈবে না তা-ও।

 

কিছু ব্যাতিক্রম বাদ দিলে এ’দেশে ঈদ আর পূজায় সকলেই আনন্দ উৎসব করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তীব্র আদর্শিক সংঘাত ও অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্য ছাড়া বেশীরভাগ মানুষ এ’ক্ষণো জাতপাতের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। কা’রোর ঘরের দুয়ার আর কা’রো জন্য বন্ধ থাকে না যেমন অনেক আগে থাক ত। হিন্দু সম্প্রদায়ের ছুৎমার্গ বা জাত গেল জাত গেল বলে এ’ক্ষণ আর চীৎকার ছেচামেচি নেই বললেই চলে। ত পূজা আর ঈদ একসাথে পড়ায় বাজারে সবলোক-ও একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কোরবানীর ঈদে আগে এত পোষাক কেনার ধুম ছিল না কিন্তু এ’ক্ষণ দুই ঈদেই সমানতালে কেনাকাটা করে লোকজন। তা’ অন্য যত যাই কেনা কাটা করে করুক কোরবানীর ঈদে আসল  হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড ত গরুর হাটকে কেন্দ্র করে। আর চারদিন পরে ঈদ। তাই বাজারের গরম চরমে। সুপার মার্কেট থেকে শপিং মল, ফুটপাথের বাযার থেকে গ্রামের হাট। অতি উৎসাহীরা আগে থেকেই কেনাকাটা শুরু করে সে পোষাক হোক আর প্রাণী যাই হোক। অনেকে আবার থাকে চানরাতের অপেক্ষায়। বটতলা প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার জহির মিয়া বলেন চানরাতে বাজার করার নাকি আলাদা মজা আছে। কেনাকাটা সহজ ও সস্তা হয়। আবার গিন্নী ও ছেলেমেয়েরা পছন্দ হয়নি বলে বদলে আনিবার যে’ বায়না করিবে সে’ রাস্তাও বন্ধ থাকে। আর প্রাণীর বেলায় আগেভাগে আনলে তা’র জন্য ঘাস কেনা, ঘরে জায়গা দেয়া, তা’র ময়লা পরিষ্কার করা, খাবার দেয়া, গোসল দেয়ার সতের ঝামেলা। কী দরকার বাবা এত হাঙ্গামা করার? তা’র চে’ ভাল আগের দিন নিয়ে এস পরের দিন কোরবানী দাও। ঝামেলা শেষ।

 

ত বাজার জমে উঠেছে ঈদের। বাজার জমে উঠেছে পূজার। বাজার জমে উঠেছে গ্রামের হাট থেকে রাজধানীর হাটে। পথে-ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, নৌকা, লঞ্চে, চায়ের ষ্টলে এমনকি ফেসবুক মেসেঞ্জারের আড্ডাও বাজারের আলোচনায় সরগরম। তবে প্রাণীর বাজার গরম হয় ঈদের জন্য। শুধু পূজার জন্য সেটা কক্ষণোই গরম হয়ে উঠে না। সাধারণ সময়ে পশুর হাটে যে’ রকম সোরগোল থাকে তা’ই হয়। পূজার জন্য লোকজন পশু কিনতে এসেছে না বললে কেউ টের-ই পায় না। এ’বছর-ও কেউ টের পেত না যদি পূজা আর ঈদ একসাথে না হৈত। সে যত সীমিত চাহিদাই থাকুক বাজারে যেতে হচ্ছে আর অনেক চেনাজানা লোকজনের সাথে হাটে দেখা হয়ে যাচ্ছে।

 

গজনফর আলীর সাথে পাশের গ্রামের সুমন কৃষি ফার্মের ম্যানেজার রতন দাসের দেখা হয় বাজারে। খবর কী ভাই? আপনারাও যে এই সময়ে পশুর হাটে?

 

ভাই সামনে ত আমাদের-ও পূজা। আর পূজাতে আামরাও বলি দেই কি না। এসেছি পাঁচটা মহিষ আর পাঁচটা পাঁঠা কিনব।

 

এতগুলো মহিষ আর পাঁঠা একটা পূজার জন্য?

 

সবসময় এতগুলো দিতে হয় না। কিন্তু এইবার মানতের পূজা। আমাদের মালিকের মা নাকি মানত করেছিলেন মায়ের কৃপায় ছেলের ব্যাবসা বাড় বাড়ন্ত হৈলে একবারে পাঁচটা পাঁঠা ও পাঁচটা মহিষ বলি দিয়ে পূজা করবেন। তা মায়ের সেই কৃপায় আমাদের মালিকের ব্যাবসা চাষবাস যা’ কিছুই বলেন এ’ক্ষণ সবকিছুতে বাড়বাড়ন্ত। উপচে উপচে পড়ছে গো ভাই। এবার সেই মানতের পূজা হচ্ছে, তাই এত আয়োজন।

 

তা মহিষের মাংস ত আপনারা খাবেন না তা হৈলে বলি দিচ্ছেন যে! এরপর কি হৈবে?

নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হৈবে।

আর পাঁঠা? সে’টা খাবে ত?

সে’টা খাওয়া হৈবে।

আপনাদের দেবী মা যা’ খান তা আপনারা খান না?

পাঁঠা মহিষ বলি তো দেবী মায়ের খাওয়ার জন্য দেয়া হয় না। তাঁ’র কাছে মনের পশুকে বলি দেয়া হয় মাত্র। মানে আমাদের মনের সকল কামনা উৎসর্গ করা হয়। পশুগুলা শুধু প্রতীক। আপনাদেরই মত। উদ্দেশ্য একৈ শুধু সিস্টেম আলাদা।

ঠিকই বলেছেন। বাজে লোকরাই কেবল গন্ডগোল লাগায়।

 

আজকাল গ্রামের বাজার ত গ্রামের বাজার এমনকি গ্রামের পাড়ার মাঝেও যে একটা দুইটা ঝুপড়ী মত চায়ের ষ্টল থাকে তা’তেও টেলিভিশন রাখে দোকান মালিক। টেলিভিশনের খবর শোনার জন্য লোকজনও হামলে পড়ে দোকানে। এককাপ চা খেতে খেতে আর পাঁচজনের সাথে কথা বলিতে বলিতে টেলিভিশন দেখার যে’ মজা তা’ বুঝি নিজের ঘরে পাওয়া যায়? তা’ ঘরে বসে খবর শোনা যাদের কাছে পানসে লাগে তা’রাই বারোয়ারী মানুষের সাথে বসে খবর শুনতে ভীড় করে চায়ের দোকাণে। খবর শুনতে শুনতে কতজন যে কতরকম বিশ্লেষণ করে, বিশেষ করে যা’রা একআধটু পড়াশোনার সাথে বেশ একটু বুদ্ধি রাখে কিংবা রাজনীতির সাথে যুক্ত লিডারদের সাথে উঠাবসা আছে তা’দের বিশ্লেষনের গুরুত্ব দেয় অন্যরা।দেশ বিদেশের রাজনীতি,খেলাধুলা আর নেতাফে তা’দের কিসসা কেলেংকারির খবরের পর নানারকম রসালো মন্তব্যে আড্ডার মেজাজ সিনেমার থেকেও রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে।তাতে আডডা আরো জমে ওঠে। কক্ষণো তুমুল তর্ক চলে। এর মাঝে ঝগড়াও লেগে যায় কারো কারো মধ্যে।আবার তৃতীয় পক্ষ এসে থামিয়েও দেয়। টেলিভিশনে এ’ক্ষণ প্রাণীর হাটের খবর চলছে।লোকজন মন দিয়ে শুনছে।কেউবা হেসে বলছে গরু গরু আর গরু। এ’ক্ষণ গরু ছাড়া গীত নাইগো।কারন একটু আগে তা’রাও গরু নিয়েই আলোচনা করেছে।কে কেমন কিনছে,বিক্রি করছে এইসব।

 

চায়ের দোকানের পাশেই একটা গরু মহিষের খামার।গত ছ’মাস ধরে খামারি তা’র গরু মহিষগুলোকে অনেক যত্ন করে বড় করেছে।ঠিক তা’র-ই পাশে কতগুলো ছাগল।সেগুলোর মালিক খামারির বৌ। মোটে বিশ পঁচিশটা গোরু মহিষ।এদেরকে তা’রা বড় করেছে এই কোরবানীর হাটকে টার্গেট করেই।কিন্তু তা’র ছেলেটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় একা একা সে এদের হাটে নিয়ে যেতে পারছে না। সে তা’র নিজের ভাই এবং শ্যালককে অনুরোধ করেছিল একটু সাহায্য করতে।কিন্তু তা’রা কেউ সময় দিতে পারেনি। শেষপর্য্যন্ত ছেলেটা মোবাইলে ফেসবুক না কি যেন করে যার সে কিছুই বুঝে না সেই ফেসবুক দিয়ে একটা ব্যবস্থা নাকি করেছে। ছেলেটা সারাদিন এই ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে বলে অনেক বকেছে। অথচ আজ এটাই কাজে লেগেছে। ছেলে বলেছে ওটাতে পোষ্ট না কি যেন দিয়েছিল মোবাইলে গরু মহিষের ছবি দিয়ে। তাই দেখে বাড়ী এসে চারপাঁচজন ছয়টা গরু নিয়ে গেছে। তা’ও ত এ’ক্ষণো ষোলোটা গরু মহিষ আর পনেরোটা ছাগল রয়ে গেল। অথচ এ’ক্ষণ শেষমুহূর্ত্ত চলিতেছে। হাতে আর তিনদিন আছে মাত্র। ছেলেটা একটু সুস্থ হয়েছে বলে কাল হাটে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছে। মনটা একটু হালকা করে সেও চা ষ্টলে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে টেলিভিশনের খবর শুনছিল আর কাল হাটে যাওযার গল্প করছিল।

 

টিভিতে সংবাদ পাঠক তা’র পাঠে জানাচ্ছে এই মুহূর্ত্তে সারাদেশ জুড়ে মোট অত লাখ পশু কোরবানীর অপেক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে। খামারের গরুমহিষগুলাও শুনেছিল সেই খবর। শুনে তা’রা একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকায়। আরে, কিসব বলছে ঐ পাঠক ব্যাটা! আমরা কি নিজেদের বলি দিতে প্রস্তুত আছি? আচ্ছা বল ত, কেন? কিসের জন্য আমরা নিজেদের বলি দেব? খামারে কি সুন্দর কচি কচি ঘাস, পাতা, খড়। বাইরে মাঠভরা সবুজ ঘাস হাতছানি দেয়। বেঁচে থাকার চেয়ে কি আনন্দ আর কিছুতে আছে?

 

আমরা বাঁচতে চাই। আমরা বলি হব না। নিজেদের বলি দিতে দেব না আমরা।

কিন্তু কিভাবে?

খামারী আমাদের ঐ বলির হাড়িকাঠে চাপানোর জন্য এত আদর যত্ন দিয়ে পালন পোষণ করেছে হে! সে কেন আমাদের যেতে দেবে?

তাই ত সে কেন আমাদের ছেড়ে দেবে? সে ত অনেক কষ্ট করেছে। আমাদের পেছনে অনেক খরচ করেছে। লাভের জন্যই ত?

কিন্তু তা’র লাভে যে আমাদের ক্ষতি!

হ্যাঁ সে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু আমরা পালাব।

কোথায়?

কিভাবে?

কেমন করে?

কোথায় এ’ক্ষণো জানি না। তবে আমরা যদি সকলে একযোগে ঐ বাথানের দরযা ভেঙ্গে বেরিয়ে যাই? দেখ এ’ক্ষণ আমাদের বাঁধন খোলা। চল এ’ক্ষণি আমরা একসাথে পালাব।

 

খামার মালিক শেষবারের মত এদের দেখতে এল। এতদিন আদর করে পালন করেছে। কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে সবগুলা গরু মহিষের ওপর। মায়া লাগছে ছাগলগুলার জন্যও। শেষবারের মত এদের গলায় পিঠে হাত বুলিয়ে ঘরের দরযায় তালা দিয়ে সে ঘুমাতে গেল। মালিক চলে যাওয়ার পর গরু-মহিষগুলো একসাথে ঘরের দরযায় গুঁতোতে লাগল। একসময় খুলে গেল দরযা। গরু ছাগল মহিষ মিলে তা’রা একসাথে সারি বেঁধে হাঁটতে লাগল। এ’ক্ষণ রাত গভীর। রাস্তাঘাটগুলা কিছুক্ষণের জন্য জনশুন্য। একজন বলিল হেঁটে নয়, ছুটে চল। ভোর হওয়ার আগেই আমাদের কোথাও লুকাতে হৈবে।

 

তা’রা এ’ক্ষণ ছুটছে।উর্ধ্ধশ্বাসে।

বিজয়পুর গ্রামের একপ্রান্তে একটা আখড়াবাড়ী। লোকে বলে বৈষ্ণব মহাপ্রভূ চৈতন্যদেবের আখড়া। তিনি নাকি একবার এসেছিলেন এই আখড়ায়। মহাপ্রভূর অনুসারীরাও বৈষ্ণব। বৈষ্ণব মতে মাছ মাংস প্রাণীজ আমিষ ত কোন ছাড়, উদ্ভিজ্জ আমিষ মসুর ডাল, কলাই ডাল, পিয়াজ রসুনও বারন। আখড়ার জমী আছে, ফল ফসল সব-ই হয়। তবু বৈষ্ণবদের ভিক্ষে করে মাধুকরী যোগাড় করতে হয়। আখড়াটা গ্রামের একদম প্রান্তে। বিশাল আয়তন নিয়ে বাড়ীটার বিস্তার। এর পশ্চিমে নদী। এই নদীর পাড় ধরেই আখড়া বাড়ীতে প্রবেশ করতে হয় এবং বের-ও হৈতে হয়। উত্তরে দিগন্ত জোড়া ফসলের ক্ষেত। দৃষ্টির শেষ সীমা পর্য্যন্ত সবুজ ক্ষেতের সাথে নীলাকাশ লেপ্টে থাকে। বাড়ীর সামনে বিরাট বন। বন পেরিয়ে উত্তরের মাঠে যাওয়ার পথ। সেই পথ দিয়ে য‘ক্ষণ গ্রামের মানুষেরা মাঠে যায় তা’রা অনেক উকি ঝুঁকি দেয় কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। দক্ষিণে একটা খাল। খালের পাড় জুড়ে বনজ ফলজ এবং ঔষধী বৃক্ষরাজি এই আখড়া বাড়ীটাকে অনেকটাই সুরক্ষিত আবার একইসাথে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আখড়া বাড়ীর পূর্ণদাসী বৈষ্ণবীকে যদি কেউ খুন করেও চলে যায় গ্রামবাসী জানতেও পারবে না। এককালে অবশ্য এই বৈষ্ণবী একা ছিলেন না। সন্তুদাস নামে একজন বৈষ্ণব তা’র সঙ্গে বাস কর ত। এ’ক্ষণ পূর্ণদাসী বৈষ্ণবী একাই এই আখড়া আগলে বসে আছেন। যদিও বয়সের ভারে তিনি খুব বেশী চলাফেরা করতে পারেন না। তবু সারাদিন এই আখড়ার কত কাজ। যা’ তা’কেই করতে হয় একা একা। গোপালের সেবার নানা রকমের কাজ আছে। কাজ করিতে করিতে পূর্ণদাসী ভাবেন লোকে বলে বটে বৈষ্ণব মানে সংসার ধর্ম্ম ত্যাগ করা। কিন্তু সত্যিই কি বৈষ্ণবরা সংসারধর্ম্ম ত্যাগ করে? একজন নারীকে সংসারে যা’ যা’ করিতে হয় সেই মাজাঘষা, ধোয়ামোছা, রান্নাবাড়া সব-ই ত করতে হয় এখানে। সংসারে সব কাজ করতে হয় স্বামী সম্পর্কের একটা জ্যান্ত লোকের নামে আর আখড়ায় সবকিছু গোপাল ঠাকুর মানে এক পুতুলের নামে। সবখানেই রাঁধ বাড় ভোগ লাগাও আর আরতি কর। পার্থক্য শুধু একজায়গায় জ্যান্ত পুরুষের সংসারে নারীর জন্য একটু রং আছে— ঐ হাতে শাঁখা কপালে টিপ আর রঙ্গীন শাড়ী। আর এখানে নিরাভরণ শরীরে সাদা আবরণ। মূলত সেখানে যে রং তা’ যেমন নারী জীবনের যন্ত্রণার এবং বাইরের ও ভেতরের রক্তপাতের গল্প তেমনি এখানকার সাদা আবরণ নারীর সব রঙ শোষে নেয়ার গল্প।

 

কতদিন আগের কথা। গত জনমের গল্প। হ্যাঁ গত জনম-ই ত। বৈষ্ণবেরা বলে পূর্বাশ্রম। সেই পূর্বাশ্রমের নাম নাকি বলতে নেই। এই জীবন নতুন জীবন। সে’ নতুন জীবন-ও আজ পুরানো হয়ে গেছে। প্রায় ষাট-পয়ষট্টি বছরের পুরানো জীবন বয়ে বেড়াতে গিয়েও সেই গত জনমের সব কথা স্পষ্টই মনে পড়ে পূর্ণদাসীর। ত‘ক্ষণ বার তের বছর বয়স। নাম ছিল সর্‌যূ। স্কুলের নাম সুরবালা। ত সুরবালার স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র। সেই স্কুলের হেডমাস্টার তা’র নিজের বাবা অজয়শংকর মৈত্র। স্কুলের সৈরা বলেছে আমাদের পড়াশোনা ত এখানেই শেষ। মা বাবা রাতে আলোচনা করে-ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনেছি, এরপর বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু তুই ত মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে। তোর ভাইয়েরা সহরে থেকে কলেজে পড়ে। তুই নিশ্চয় এ’ক্ষণ হাইস্কুলে পড়বি।

 

সৈদের বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু সর্‌যূ হাইস্কুলেও ভর্ত্তি হৈল না আবার বিয়েও হৈল না। নাইয়র এসে বিবাহিত জীবনের গল্প করে সৈয়েরা। সর্‌যুর মনেও রং ধরে। এইসময় তা’কে অনেকগুলা সোনার চিকন চুড়ী আর বালা গড়িয়ে দিলেন তা’র মা। বাবা খান কয়েক রঙ্গীন শাড়ী এনে দিয়ে বলেন এই শাড়ী ‍ চুড়ী পড়ে আমার সামনে এস ত মা। খুশীতে আটখানা সর্‌যু তক্ষুণি সব পড়ে বাবার সামনে আসে। বাবা বলেন এ’গুলো আর খুল না। এ’ক্ষণ থেকে সবসময় পড়ে থাকবে। সর্‌যূ ভাবে বাবা মা বোধ হয় এইবার তা’র বিয়ে দেবেন। তা’র কল্পনার রং প্রজাপতি হয়ে পাখা মেলে। কয়েকদিন যেতে না যেতে সর্‌যূ দেখে পাড়ার মানুষ তা’র দিকে আড়চোখে চায়। কেউ কেউ কানাঘুষা করে কি যেন বলে। কেউ কেউ করুণ মুখে আহা আহা করে। আহারে কি সুন্দর মেয়েটা! শাড়ী অলঙ্কারে দূর্গাপ্রতিমা যেন লাগছে গো। এমন মেয়েকে সাদা থানের ভেক পরিয়ে কেমনে গো বৈরাগী বানাইব? আড়ে টারে বলা এ’সব কথা সর্‌যূ বোঝে না। সে গিয়ে ঠাকুরমাকে প্রশ্ন করে। আমাকে দেখলে সবাই এমন করে কেন গো?

 

ওরা ভাল না। তুই আর ওদের কা’রো বাড়ী যাস নে।

 

ঠাকুরমার কথায় সে না হয় নাইবা গেল ওদের বাড়ী। কিন্তু ওদের ত আসতে মানা নেই। সর্‌যূর সৈ পার্ব্বতী— এ’ক্ষণো একমাত্র তা’র-ই বিয়ে হয়নি। সেই সৈ পার্ব্বতী এসে জানিয়ে দিয়ে গেল সব কথা। সে তা’দের বাড়ীতে বড়দের মুখে সব শুনেছে। ছোটবেলা অজয়কাকা মাষ্টার মহাশায়ের একদিন মরো মরো অবস্থা হৈলে ঠাকুরদা বিতঙ্গলের আখড়ায় মহাপ্রভূর মন্দিরে গিয়ে ধর্ণা দেয়। আর মানত করে আমাদের সন্তানকে বাঁচিয়ে দাও প্রভূ। তা’র প্রথম মেয়ে সন্তান হৈলে এই আখড়ায় তোমার সেবাদাসী করে দিয়ে দেব প্রভূ। প্রভূ আমাদের অজয়কে বাঁচিয়ে দাও। সেবার অজয় কাকা বেঁচে গেলেন। মহাপ্রভূকে দেওয়া তোর ঠাকুরদার কথামত তুই হৈলি কাকার প্রথম মেয়েসন্তান। তোর বিয়ে দেবেনা রে সর্‌যূ। তোকে সাদা থান পরিয়ে বৈষ্ণবী সাজিয়ে বিতঙ্গলের আখড়ায় দিয়ে আসবে। আখড়ায় গিয়ে তোকে দুইবেলা নিরামিষ খেতে হৈবে, গ্রামে গিয়ে ভিক্ষে করে মাধুকরী যোগাড় করে তাই দিয়ে দূপুরে গোপালের ভোগ রেঁধে তা’রপর প্রসাদ খেতে হৈবে। আর তুই মাছ মাংস খেতে পারবি না। তোর নাম সর্‌যূ থাকবে না। তোর নাম অন্য কিছু হৈবে। যেমন বৈষ্ণবীদের থাকে তেমন কোন নাম। সর্‌যূকে ধরে সেই সৈ কেঁদে আকুল হৈল। কিন্তু সর্‌যূ কাঁদল না। সে বুছিল কেন তা’র বাবা মা তা’কে এই শাড়ী চুড়ী পরতে দিয়েছে। তাই সে আর একটু দেরী না করে সোনার চুড়ী বালা খুলে ছুড়ে ফেলে দিল উঠানে। ঠাকুরমার ঘরে গিয়ে একটানে রঙ্গীন শাড়ী খুলে ফেলে আলনা থেকে একটা সাদা থান নিয়ে পড়তে লাগল।

 

ও কী করছিস বোন বলে ঠাকুরমা থামাতে চাইলেন। এক ঝটকায় ঠাকুরমার হাত সরিয়ে থানকাপড়ের আঁচল পেঁচিয়ে বুকের কাছে এনে সে বলিল দেখ ত ঠাকুরমা ঠিক হয়েছে কি না। দু’দিন পর আমাকে ত এ’সব-ই পরতে হৈবে তাই না? তবে আর দু’দিনের জন্য এ’সব পরে লোভ জাগানো কেন বল? নাতনীর কাণ্ডকারখানায় ঠাকুরমা স্তদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। মা উঠান থেকে স্বর্ণালঙ্কার কুড়াতে কুড়াতে মুখে আঁচল চেপে কাঁদলেন। সারাদিন সারাবাড়ী বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে রৈল। শুধুমাত্র মেয়ের উপলক্ষে রান্না করা পাঁঠার মাংস, আইড় মাছের ভাজা, চিতল মাছের পেটী, রুই মাছের কালিয়া, কাৎলা মাছের মুড়িঘণ্ট আর পাবদার ঝাল হাঁড়ীতে পড়ে রৈল অনাদরে অবহেলায়। সর্‌যূ একটুকরা ছুঁয়ে দেখল না বলে বাড়ীর কেউ আর সেদিন খেল না কিছুই। তবু সর্‌যূকে আখড়ার সেবাদাসী করে পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল হৈল না।

 

না হয় আমার সর্‌যূর নামে পাঁচকানি জায়গা লিখে দাও মহাপ্রভূর নামে। সর্‌যূরে বিয়ে দিলে যে অলঙ্কার দেয়া লাগত তা’র সব-ও দিয়ে দাও। তবু সর্‌যূ আমার সংসারে থাক।

 

একি কথা বলিছ তুমি গিন্নী? আমি ঠাকুরের সাথে প্রতারণা করিব? আমি আমার বাবার কথার খেলাপ করিব? ঠাকুরকে কথা দিয়েছিলেন আমার বাবা। তা’র অঙ্গীকার পূরণ করা সন্তান হিসেবে আমার কর্ত্তব্য।

 

সেদিন বলার মত যুক্তি সাহস বা বুদ্ধি কোনটাই ছিল না সর্‌যূ নামের তের বছরের বালিকার। কিন্তু আজ আটাত্তর বছরের পূর্ণদাসী বৈষ্ণবীর জীবন অনেক অভিজ্ঞতা, যুক্তি, বুদ্ধি ও সাহস সঞ্চয় করেছে। তাই আজ তিনি ভাবতে পারেন। বলেন বাবা গো! পাথরের একটা মূর্ত্তি, যা’র কোন প্রাণ নেই, কা’রোর কথা রাখা না রাখায় যা’র কিছু আসে যায় না, তা’র কাছে তোমার বাবা এমন একজন মানুষকে ভেট দেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন য‘ক্ষণ পৃথিবীতে তা’র কোন অস্তিত্ব-ই ছিল না; এমন কি পৃথিবীতে সে আসবে কি আসবে না তা’র-ও কোন-ই সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু বাবা আমি একটা রক্ত মাংসের মানুষ ছিলাম! আমার প্রাণ ছিল, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা ছিল, সেই আমার কোন মূল্য ছিল না বাবা তোমার কাছে। কোন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মতৈ আমাকে হস্তান্তর করলে কিনা একটা মূর্ত্তির কাছে। বিতঙ্গলের সেই আখড়ায় মহাপ্রভূর মূর্ত্তির বা গোপালের না হয় প্রাণ ছিল না। কিন্তু তা’দের প্রতিনিধি সেই আখড়ার পরিচালক যা’রা, তা’দের কিন্তু প্রাণ ছিল। এমন কি যে কৌপীনদারী বৈরাগী তা’র-ও আমার মত প্রাণ ছিল। তবে তা’দের স্বাধীন ইচ্ছে ছিল। আর তুমি আমার মাষ্টারমশাই বাবা কী মূর্খ কী মুর্খ! যে কিনা ভেবেছিলে আমি কেবল পাথরের মূর্ত্তির সেবা করব? একজন পুরুষ মানুষ হয়ে তুমি কি জানতে না পুরুষের চরিত্র কেমন হয়? তোমাদের পুরুষের মুখেরই ত বাণী— মুণিরও মতিভ্রম হয়! আর এরা ত সামান্য মানুষ বা ভেকধারী বৈরাগী মাত্র! কিন্তু না পাথরের মূর্ত্তির নয় আমাকে সেবাদাসী হৈতে হয়েছিল এইসব প্রাণীদেরই। তোমাদের স্বর্গলাভের লালসার জন্য আমাকে নরকবাস করতে হয়েছিল বাবা! কিন্তু আফসোস, য‘ক্ষণ এই কথাগুলা বলার জন্য আমি তৈরি হলাম ত‘ক্ষণ শোনার জন্য তুমি বেঁচে নেই।

 

পূর্ণদাসীর আজকাল ভোর রাতের আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফেলে আসা দীর্ঘ দিনের কত মানুষ, তা’দের কত জমানো কথা, কত স্মৃতি সামনে এসে ভীড় করে। বেশীরভাগ-ই কষ্ট ও যন্ত্রণার, অপমান ও অবহেলার। সুখস্মৃতি বলতে ত সেই শৈশবের দিনগুলা যা সকালের শিশিরের মতন বেলা একটু বাড়তেই মিলিয়ে যায়! তবে জীবনের পড়ন্ত বেলায় সহজ সরল মানুষগুলোর ভালবাসা তিনি পেয়েছেন। যা’রা অসহায় দীনহীনজন, যা’রা সত্যিকারের ভক্তি ও ভালবাসা নিয়ে আসে আর আসে মিথ্যে স্বান্তনা পেতে। এ’সব ভাবনা রোজ তাকে পেয়ে বসে আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবেন। অবশ্য আজকাল কেউ আর তেমন আসেও না। ভাবনারাই এ’ক্ষণ তা’র সঙ্গী। আগে ত সারাবছর উৎসব হৈত তাই ভীড় লেগেই থাক ত সবসময়। এ’ক্ষণ বিশেষ উৎসব ছাড়া লোকজনের ভীড় হয় না। তবু তো নিত্য সেবার কাজ আছে। কিন্তু গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে কাজের খোঁজে সহরে চলে গেছে মানুষ। মন্দিরের এত কাজ অথচ সাহায্যকারী কেউ নেই। ভোগ লাগালে অবশ্য প্রসাদ খাওয়ার লোকের অভাব হয় না। শুধু বেলা এগারটা বারটায় দীনু নামের বোকাসোকা লোকটা এ’ক্ষণো আসে। এসে উঠান বাড়ী পরিস্কার করে দেয়। কিছু বাসন পত্র ধুয়ে দেয়। তবু তো কত কাজ। পূর্ণদাসী তাই ঘুম ভেঙ্গে গেলে উঠে পড়েন। টুকটুক করে কচ্ছপ গতিতে কাজ করলেও বারটার মধ্যেই দুপুরের ভোগের রান্না শেষ হয়ে যায়।

 

আজো ঠিক একৈ সময়ে ঘুম ভাঙ্গলে পুরানো দিনের কথা ভাবিতে ভাবিতে শুনতে পান বাড়ীর দক্ষিণের খালপাড়ে বা পূবদিকের বনের ভেতর থেকে কা’রো পায়ের নড়াচড়ার শব্দ হচ্ছে। একটু ভাল করে কাণ পাতিলে বুঝিতে পারেন অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ আর একসাথে অনেকের শ্বাস-প্রশ্বাসের ঘোৎঘোতানি ভেসে আসছে। কেমন একটা আতঙ্ক গ্রাস করল বৃদ্ধাকে। দীনু এসে মাঝে মাঝে থাকত আগে। কিন্তু এ’ক্ষণ তা’রও কি যেন সমস্যা বলে আসে না। তাই কিছুদিন থেকে একাই থাকেন। এতদিন ত ভয়ের কোন কারন ঘটেনি। আজ কি হৈল? চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। দেখা যাক না কি হয়? সহসাই সাহস ফিরে এল তা’র। এই আটাত্তুর বছর বয়সে হারাবার মত একটা প্রাণ-ই ত আছে শুধু। এ’টা ত যে’ কোনদিন এমনিতেই যাবে। আজ-ই যদি সেদিন হয় ত অসুবিধা কি? কোন খেদ নেই। তিনি আবার শুয়ে রৈলেন এবং কিছুক্ষণ পর দৈনিন্দন কাজের জন্য উঠে পড়লেন। ঘরের কাজ সেরে তিনি য‘ক্ষণ উঠানে পা দিলেন দেখলেন কোথাও কিছু নেই। তবে দক্ষিণ দিকের জঙ্গল থেকে সেই নড়াচড়া, ঘোৎঘোৎ করে নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। কৌতুহলবশতঃ তিনি সেই জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলেন। গিয়ে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেলেন। একি দেখছেন তিনি? ষোল সতেরটা গরু মহিষ শুয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে এ’খানে ও’খানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই খালপাড়ের যে মাথা পূবদিকের জঙ্গলে গিয়ে মিলেছে সেখানে দশবারটা ছাগল পাতা লতা খাচ্ছে। গরুমহিষগুলা পূর্ণদাসীর দিকে ছলছল চোখে চেয়ে আছে। ওদের সকরুণ দৃষ্টি হৃদয় বিদীর্ণ করে দিল। এতগুলো গরু-মহিষ কা’র? আশেপাশেও কেউ নেই। এরা একা একা কোথা থেকে এখানে এলো? বুঝতে একটু সময় লাগল তাঁ’র। এদের গলা ও শিং এর মাঝে লাল ফিতা জড়ানো, এদের চোখে জল! এরা ক্লান্ত। এরা ভয়ার্ত্ত।

 

হঠাৎ পূর্ণদাসীর মনে পড়ল— অহ হো সামনে তো বকরী ঈদ। তা’র মানে কোরবানীর ভয়ে এরা গেরস্থের বাথান থেকে পালিয়েছে? বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল পূর্ণদাসীর। বুঝেছি, তোরা বলি হৈতে চাস না তাই পালিয়ে এসেছিস? কিন্তু পালিয়ে কদিন বাঁচবিরে বাছারা? এই সংসারে একের লোভের বলি অন্যকেই হৈতে হয়। যতদিন এই নিয়ম না ভাঙ্গবে ততদিন যাদেরকে বলিদানের জন্য তৈয়ার করা হয় আজ হোক কাল হোক বলি তা’রা হৈবেই। তবে পালিয়ে এসে তোরা ভালৈ করেছিস। একটা প্রতিবাদ প্রতিরোধ হৈল ত? থাক তোরা এখানে যতদিন খুসী। আমি বিরক্ত করব না। আসলে তোরা অবলা জীব হয়ে যা পেরেছিস পয়ষট্টি বছর আগে একটা মানুষ হয়ে আমি তা পারিনি রে– থাক তোরা থাক এখানে। …

 

চিত্রকর্ম্ম: অপরূপ দে

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, বলিদান — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *