রবি চক্রবর্ত্তী
রবি চক্রবর্ত্তী, বাংলা ভাষাতত্ত্বের প্রায় শতবর্ষস্পর্শী এক নিঃসঙ্গ বনস্পতি স্থানীয় সময়, ৩ জানুয়ারি ২০২৫-র মধ্যাহ্নে পাড়ি দিলেন অগস্ত্যযাত্রায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, হুগলি জেলার কোন্নগর শহর নিবাসী রবি চক্রবর্ত্তী (জন্ম: ২৪ অক্টোবর ১৯২৯) যাঁর জ্ঞান ও স্নেহসান্নিধ্যে আমি ধন্য হয়েছি ও সন্ধান পেয়েছি বাংলাভাষা-সংস্কৃতির অমৃতকুম্ভের— আজ পৃথিবীর অপর গোলার্ধে বসে তাঁর কথা বিষাদ অন্তরে স্মরণ করছি।
বয়সে বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও, রবি চক্রবর্ত্তীকে রবিদা বলে ডাকতাম এবং তাঁর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল আরেক মনীষী, ভাষাতাত্ত্বিক প্রয়াত কলিম খানের (জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯৫০) মাধ্যমে যিনি উন্মোচন ও বিস্তার করেছিলেন বাংলাভাষার বিস্মৃতপ্রায়, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির এবং তাঁকে আমি সম্বোধন করতাম ‘কলিম ভাই’ বলে। এই দুই মহৎপ্রাণ জ্ঞানতাপসের সাথে আমার পরিচয় ও সখ্য, প্রাচীন বাংলা ও ভারতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে আমার অনুসন্ধিৎসাকে বহুগুণে সমৃদ্ধ ও নতুন মাত্রা দান করেছে। কলিম খানের প্রথম গ্রন্থ ‘মৌলবিবাদ ও নিখিলের দর্শনে’ পড়ে আমি বিস্মিত হই এবং জানতে পারি যে সুদূর অতীতে মানুষের ছিল একভাষা, তারপর যা বহুভাষায় বিচূর্ণীভূত হয়ে যায়। ঐ আদিভাষার স্বভাব ছিল বহুরৈখিক (dynamic) এবং ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি (verb-based and Letter-based meanings) দ্বারা শাসিত, অর্থাৎ শব্দের ভিতরে থাকে শব্দের অর্থ এবং এক ক্রিয়াজাত অনেক শব্দের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সভ্যতার যাত্রাপথে, বিশেষত পণ্যবাহী সমাজ ব্যবস্থা বিকাশের সাথে সাথে, সেই ভাষা বিচূর্ণীভূত হয়ে পৃথিবীর সকল প্রচলিত প্রতীকী (logo-cen-tric) ভাষাগুলির সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ একটি শব্দে অনেকগুলি বস্তুকে বোঝালে সেই dynamic ভাষায় পণ্য বিনিময় চলে না। একারণে সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের ব্যবহৃত ভাষা প্রতীকী (logo-cen-tric) হয়ে যায়। স্বর্গীয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’(১৯৩৩) হচ্ছে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষার পথপ্রদর্শক, যেখানে একই শব্দের বহু অর্থ সন্নিবেশিত হয়েছে, যে-অর্থগুলো প্রসঙ্গের (context) উপর নির্ভরশীল। হরিচরণ প্রণীত অনালোকিত রত্নভাণ্ডার (বঙ্গীয় শব্দকোষ) উন্মোচনের মাধ্যমে কলিম খান ভাষাতত্ত্বের যে নতুন দিগন্তের সূচনা করেন এবং একে আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সমাজ ব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটনে ব্রতী হন, তার সন্ধান পেয়ে রবি চক্রবর্ত্তী অভিভূত হয়ে যান ও ঐক্যমত পোষণ করেন। রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ যে শুধুমাত্র রূপকথা বা গল্পগাছা নয়, বরং এর মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বলে রবীন্দ্রনাথ যে ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন, কলিম খান ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থের প্রয়োগ করে তার আবিষ্কার শুরু করেন। তাঁর এই ভাষাতাত্ত্বিক অর্জনকে বহু পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার অভিপ্রায় থেকে রবি চক্রবর্ত্তী তাঁর ‘India Rediscovered : Kalim Khan and His Verb-based Sematics’ গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিজগতের অভিভাবকেরা শুরুতে কলিম খান সম্পর্কে যেমন, একইভাবে রবি চক্রবর্ত্তীর সম্পর্কেও উপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় দুই মনীষীর যৌথযাত্রা। তাঁরা যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। ভাষাতত্ত্বের নিত্য নব আবিষ্কারের ধারা প্ৰধানত কলিম খানের মাধ্যমে উৎসারিত হলেও, রবি চক্রবর্ত্তী তাঁর বহু ভাষার পাণ্ডিত্য এবং ইতিহাস-দর্শনের অধিকৃত জ্ঞানের মাধ্যমে তা পরিশুদ্ধ করে পাঠকসমাজে প্রকাশের উপযুক্ত করে তোলেন এবং এভাবে সেসব যৌথ রচনার মর্যাদা প্রাপ্ত হয়। তাঁদের এই মননগত সম্পর্ককে একটি মেটাফোরের মাধ্যমে তাঁরা বর্ণনা করতেন এভাবে যে, হিমালয় থেকে সহস্র ধারায় গঙ্গা যখন মর্ত্যে অবতরণ করেন, তখন তার তীব্র বেগকে ধারণ করতে শিব পেতে দেন তাঁর জটাজুটধারী মস্তক। এই জ্ঞান প্রপঞ্চের ধারায় কলিম খান গঙ্গা এবং রবি চক্রবর্ত্তী শিব রূপে তুলনীয়। তাঁদের মনীষালব্ধ সর্বোচ্চ সৃষ্টি হচ্ছে : দুই খণ্ড, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান, ১ম খণ্ড : আশ্বিন ১৪১৬ এবং ২য় খণ্ড : পৌষ ১৪১৭) এবং সরল শব্দার্থকোষ (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান, জুলাই ২০১৩)।
২০১২ সালে কলিম ভাই এবং রবিদার ভাষাতাত্ত্বিক অর্জনকে পাঠকের সামনে সহজভাবে তুলে ধরার জন্য আমি একটি প্রস্তাব করেছিলাম। প্রস্তাবনাটি ছিল এরকম যে তাঁদের রচনাকর্মের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ পাঠক বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন করবেন এবং সেসবের ভিডিও/চলচ্চিত্র রূপে ধারণ করা হবে ও পরে ধারণকৃত ভিডিও/চলচ্চিত্র ইউটিউবে অবমুক্ত করা হবে। সেই উদ্দেশ্যে আমি ২০১২ সালে বাংলাদেশে যাওয়ার পথে কলকাতা ভ্রমণ করি এবং রবিদার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় তাঁর কোন্নগরস্থিত বাসায়। কলিম ভাই এবং রবিদাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও চলচ্চিত্রকারের যে ঘনিষ্ঠ বৃত্ত ছিল, তাঁরা সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন রৌদ্র ওঠা শীতের সকালে মৃদু কুয়াশা জড়ানো ছোট্ট সবুজ মাঠে। সেখানে সবাই গোল হয়ে বসে, দুদিন ব্যাপী প্রশ্নোত্তর পর্বের চলচ্চিত্র রূপ ধারণ করা হয়েছিল। গ্রামীণ পটভূমিতে বাংলাভাষার বিস্মৃতপ্রায় ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের উন্মোচন ও মনীষীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, শীতের হাওয়া ও রৌদ্রের মিঠেকড়া বুনট এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়ে রয়ে গেছে স্মৃতিতে। তখন রবিদাকে দেখেছি কাছ থেকে, ধীর-স্থির-প্রজ্ঞাবান রূপের জ্ঞানতাপস এবং পাশে উপবিত কলিম ভাইয়ের জ্ঞানচ্ছটার তীব্রধারা। অনেক বছর হয়ে গেল, সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সবার নাম আমার মনে নেই। তাই স্মৃতিতে থেকে যাওয়া অন্যদের নাম আর উল্লেখ করছি না।
কলিম ভাই বয়েসে ঢের কম হলেও, রবিদার আগেই প্রয়াত হয়েছেন এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় প্রথমে আহত ও তার প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু— ১১ জুন, ২০১৮। তাঁর সতীর্থ, বয়োজেষ্ঠ্য রবিদা চলে গেলেন গতকাল। এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের দেহগত পরিসমাপ্তি হলো, তবে তাঁদের কাজ রয়ে গেল আমাদের ক্রমাগত পাঠ ও আবিষ্কারে মগ্ন হবার দায়িত্ব অর্পণ করে। তার প্রতি কোনো অবহেলা আমাদের জন্য হবে আত্মঘাতের সমান।
আমি রবিদার আত্মার শান্তি কামনা করি এবং আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছি!
— তুষার গায়েন
টরন্টো, ০৪ জানুয়ারি ২০২৫।
তুষার গায়েন রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, বাংলা ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্তে উদিত রবির প্রয়াণে শ্রদ্ধাঞ্জলি — লেখক নির্দ্ধারিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।