প্রবন্ধ ‘বিনির্মাণ’ একটা প্রত্যয়ের কবিতা

এজাজ ইউসুফী
জন্ম: জানুয়ারী, ১, ১৯৬০। উত্তর আধুনিকতাবাদী কবি, লেখক, সম্পাদক এবং সাংবাদিক। নব্বইয়ের দশকের সমকালীন প্রেক্ষাপটে কবিতা বিনির্ম্মাণের করণ-প্রকৌশলে ইউসুফী বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছেন। সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে উত্তর আধুনিকতাবাদ ধারণার প্রবর্ত্তনে ভূমিকা পালন করেছেন একজন চিন্তার প্রবক্তা হিসেবে। [১] তাঁহার কবিতায় মানুষ, রাষ্ট্র, দর্শন, সাম্যবাদসহ সময়ের বিচিত্র রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। [২] ২০২০ সালের হিসেবে তাঁহার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৭টা। সম্পাদক— লিরিক (লিটল ম্যাগাজিন)। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— স্বপ্নাদ্য মাধুলি (কবিতা), উত্তর আধুনিকতা : নতুন অন্বয়ের পরিপ্রেক্ষিত (গদ্য)।

বিনির্মাণ ।।এজাজ ইউসুফী
(অজিত চৌধুরী-কে)

আমি তো কলোনিয়াল ছেলে
নানাভাবে ফেঁসে গেছি মার্ক্সবাদের মৃত্তিকায়।
আগুন পোহানো লাল কীর্তি, দু’খন্ড পৃথিবী আর
স্থায়িত্বের প্রিয় শর্তে আদ্যোপান্ত সামাজিক।

স্পর্ধিত আদম ও প্রিয়তম ইভের পৌরাণিক পাপ
জন্ম দিলে শ্রমের চাদর সূক্ষ রজঃস্বলা,
অভুক্ত প্রভুর পান্ডুর গ্রীবায় বিচ্ছিন্ন সংলাপ
অনুবাদ করে ফেলি গোলাপী রুটির অনুপ্রাস।
শব্দ থেকে গর্জে ওঠে অস্ত্র, লাল অতিকায়
সোয়েটার বুনে বাণিজ্য যুদ্ধের শেষ।

তত্ত্ব থেকে সংগঠিত মুগ্ধ অসহ্য জার্নাল
সমাজাবিজ্ঞান-ভজনা ও বুড়ো আঙুল খেয়েছে একঝাঁক
বাদামী মানুষ। কালভেদে উল্টে দিলে পৃথ্বি, কেন্দ্রবিন্দু,
বুকে রাখ হাত নতুন পরিশোধন, মৃত্যুহীন অনন্ত জীবন।

কলোনিয়াল শিশুটি কাঁদছে শব্দহীন
পসিটিভিস্ট দ্বিধায় কাঁপছে হেগেল গুরুর রক্ত।
বদলাবে প্রতি মুহূর্ত মানুষ, খন্ড মানুষের গাথা,
বহুরূপে শুনেছি তাহার কথা বহুবার
কী উদ্দেশ্য জগত সংসার।

বিশুদ্ধ অস্তিত্ব ধ্বংস হউক অপার শূন্যতায়।

বিশুদ্ধ অস্থিত্ব —> হাওয়া —> শূন্যতা
: কোথা থেকে আসছ, মানুষ?
মার্ক্স চাঁদের অন্যপিঠ দেখালেন।
আমি বাজার, বাজার থেকে ফিরে যাচ্ছি
বিনিময়ে বিক্রীত সভ্যতার টিকেট সেঁটেছি গায়ে
পারটিকুলারিটির কারুকাজ।

আমরা জন্মেছি পণ্য থেকে, মৃত্যু মানে পণ্যের বিচ্ছেদ।
বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছু আগুন, বাতাস, ফুল, পাখি, নারী
বাজারেই ফিরে আসি।
শুধু এক বিস্মরন ছাড়া মানুষের কেনো সিনোনিম, এন্টোনিম নেই,
অর্থ নেই, মুক্তি নেই, কীর্তি নেই, তবু ভালবাসা
অনন্ত অসীম সত্তা।

হাড় ভাঙ্গা খাটুনির নীলকোট ছুড়েঁ ফেলি দূরে
এই কারখানা, এই গৃহ, তপ্ত আগুনের ভাঁড়।
আমি কমুনিস্ট নই, জানিনা এথিস্ট কিনা,
ফেমিনিস্ট স্বর্গবালা মেনকার বোন।
আমার তরুণীকন্যা স্নান ঘরে পোশাক খুলতে ভয় পায়,
পরমেশ্বর সবটা দেখছেন ভেবে সে মিলনে অনিচ্ছুক
মাথায় ঢুকেছে গিয়ে মগজধর্ষণ ।

অবশেষে প্রাচীন ধ্বংসের স্তুপ থেকে জেগে ওঠে
শীতলা দেবীর পুজা,
শীতলা দেবীকে জিনস্-এ মানিয়ে যায়।
চিরকালীন ভীতির অবশেষে বেদনার ঘনবোধ, প্রাগমিটিজম,
নানাভাবে কলোনির কনক্রিট ভেঙে নতুন জলের ধারাপাত
ধ্বংসের অবিনির্মাণ।
উত্তরণে সব ধারনা বদলে গেছে ক্রমাগত
নীলপথ রেখা বেয়ে।

শুরু হল স্বপ্ন বপনের দিন, কলোনিয়াল ইন্টারভিন।

কোন কবির একক কবিতা নিয়ে আলোচনার মৌলিক ঝুঁকি হৈল আলোচ্য কবিতার কবিকে একটা নির্দ্দিষ্ট ছকে বা তকমায় চিহ্নিতকরণের বিভ্রান্তি যা দুঃখজনকভাবে ঘটেছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে। তাঁর বিদ্রোহী কবিতার জনপ্রিয়তা এবং সেই বীরত্বব্যাঞ্জক স্বগতোক্তির প্রবল উচ্ছাসের ধ্বংসলীলা তাঁর আর সব পরিচয়কে নিদেন পক্ষে প্রচার যোগ্যতায় গৌণ করে রেখেছে। সেই একৈ আশঙ্কা কবি এজাজ ইউসুফীর “বিনির্মাণ” কবিতার আলোচনার ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। যদিও এ’টী অত্যন্ত আত্মগত মনোলগ। উত্তমপুরুষের উপস্থিতি সত্বেও সেই উচ্চকিত ভাব বা উচ্ছাসের আতিশয্য এতে নেই। কবিতার সামগ্রিক যে চলন তার লয় ধীর। এক বাক্যাংশ থেকে অন্য বাক্যাংশে যাবার মাঝখানে পাঠক নিজেই পঠনের সংযোগসূত্র তৈয়ারীর প্রয়োজনে আত্মগত হয়ে পড়বেন। যে’টী জাতীয় কবির বিদ্রোহী কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে কক্ষণোই ঘটবে না। বিদ্রেহী কবিতার অনেক বিপ্লবী উচ্চারণ সত্বেও এর অন্তস্থিত আবেগ পাঠককে তর্ তর্ করে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ফলে কবি এজাজ ইউসুফীর ‘‘বিনির্মাণ’ পাঠ পাঠকের স্বনিষ্ঠ মনোযোগ দাবী করে। যদিও এ’টীকেও পরিবর্ত্তনের আকাঙ্খা জনিত প্রত্যয়ের কবিতারূপে আপাত ভাবে চিহ্নিত করা চলে। তবে এর নির্ম্মাণের পরম্পরা, বাক্যের বিন্যাস এবং শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরাসরি দার্শনিক নানা পরিভাষার ব্যাবহার এবং সর্ব্বোপরি প্রশ্ন উত্থাপনের ধরণ পাঠককে এই কবিতাটীর প্রতি আগ্রহান্বিত করে তুলবে চিন্তার নতুনতর পরিসর খুঁজে নিতে, উপলব্ধির নতুন মাত্রায় উপনীত হৈতে।

চার পংক্তির প্রথম স্তবকে, “বিনির্মাণ’’ কবিতায়, “ফেঁসে গেছি” এই ক্রিয়াবাচক শব্দযুগল কবিতাটীর প্রতি পাঠককে আগ্রহী করে তোলে। প্রথম পংক্তির জোরালো ঘোষণাসত্ত্বেও। কেননা ঐ শব্দ দু’টীর আগে ও পরে ব্যাবহৃত শব্দত্রয় আমাদের বিশ্বাসের বা অনুভবের এমন এক অংশে তীব্র আলোড়ন তৈয়ার করে যে আমরা ভুলে যাই ঐ প্রথম পংক্তির ঘোষণাকে। তক্ষণ পুরা স্তবকটীর পুনর্পাঠ এবং পরম্পরা ক্রমে তার অর্থ উদ্ধার বা এই উপলব্ধির অনিবার্য্যতা উৎঘাটন জরুরী হয়ে পড়ে। এ’টী সম্ভব হৈলে পরে কবিতার শরীরজুড়ে আকৃত আর সব দর্শন, দার্শনিক প্রত্যয়ে নির্ম্মিত পংক্তির বা স্তবকের অভীষ্ট বা উল্লেখের স্বরূপ পাঠক চেতনায় তার আপাত শাব্দিক বিরুদ্ধতা সরিয়ে উন্মোচিত হৈতে থাকে। তাই আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এই ফেঁসে যাওয়ার মর্ম্ম উদ্ধার করতে প্রয়াসী।

“বিনির্মাণ” একটা প্রত্যয়ের কবিতা। দার্শনিক প্রত্যয়ের কবিতা বলাই সমীচিন। যদিও এ’টী দর্শনের মত কোন তাত্ত্বিক কাঠামোয় বাঁধা যুক্তি পরম্পপরায় প্রমাণিত ব্যাপার নয়। কবিতায় অবশ্য তা সম্ভব-ও নয়। এ’টী ‘স্বপ্নের দর্শন’। স্বপ্ন দেখাবার দুঃসাহসের দর্শন। দর্শনের চৌহদ্দিতে “নিজেদের দর্শন” সমেত অনুপ্রবেশের স্বপ্নময়তায় ঘেরা আকাঙ্খার কাব্যিক উচ্চারণ। তাই পুরা কবিতা জুড়ে চলে ক্রম ডরম্পরায় পৌরাণিক পাপ থেকে, দার্শনিকের নামোল্লেখ থেকে দার্শনিক প্রত্যয় ও তার পরিণতির সম্ভাব্যতা সমেত চিন্তাবিশ্ব ভ্রমণ। যেখানে প্রত্ন-প্রতীকী উপস্থাপণা ও সমসাময়িকতার দাবীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

মার্কসীয় দর্শনের স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সব রাষ্ট্রের অবনমনের পর-ও, এই দুর্দ্দিনেও, বলা চলে যে এ’টী মানব প্রগতির জন্য এক্ষণো প্রাসঙ্গিক একটা চিন্তারেখা। যেখান থেকে নতুন ভাবে সুরু হৈতে পারে মানুষের নব অগ্রগমন, অন্যমাত্রিকতায়।

আমরা যারা উপনিবেশের অধিবাসী ছিলাম তাদের কাছে সমস্ত দর্শন বা চিন্তাপ্রবাহ এসেছে উপনিবেশের হাত ধরে। এমন কি আমাদের মনোজগতে বিস্তৃত উপনিবেশ-ও তাঁরাই অঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের। উপনিবেশবাহিত সমস্ত চিন্তাপ্রবাহের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক দর্শন বা জীবনবোধরূপে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছে মার্কসবাদ এবং এও সত্য যে, তক্ষণ আমাদের বাস্তবতায় এই দর্শনের প্রয়োগ যোগ্যতা বা জীবনবোধ রূপে এর চর্চ্চার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করবার মত অবস্থা বা বিবেচনাবোধ কাজ করেনি। ফলতঃ আমরা অগ্রসর, বিপ্লবী, প্রগতিবাদী এই চেতনায় “ফেঁসে” গেলাম নিজেদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা ভুলে। “স্থায়িত্বের প্রিয় শর্তে” মানসিক ভাবে আমরা রয়ে গেলাম “আদ্যোপান্ত সামাজিক”। আর ওপরিকাঠামোয় চালিয়ে গেলাম বিপ্লবী বুলির বলাৎকার, সমন্বয়ের কথা ভুলে। তাতে করে আমরা চারিত্রিক ভাবে না অর্জ্জন করতে পারলাম বিপ্লবীত্ব না তৈয়ার করে নিতে পারলাম নিজস্ব চিন্তার পরিপ্রেক্ষিত। ফলাফল হতাশায়, অন্তসারশুন্যতায় নিমজ্জন। তাই “বিনির্মাণ” কবিতায় এই “ফেঁসে গেছি” এর অর্থ অনন্যোপায় অবস্থার উদ্ভাসন। এজাজ ইউসুফীর এই “বিনির্মাণ” কবিতাটীকে শেষাবধি আমার মনে হয়েছে পূর্ব্বোল্লেখিত অনন্যোপায় অবস্থা থেকে উত্তরণের কবিতা। এই পণ্যায়ীত বিশ্বের বিকিকিনির হাটে নিজের পসরা ব্যতিরেকে আর কোনভাবেই নিজেকে উপস্থাপণের কোন সুযোগ অবশিষ্ট নেই। কোন দার্শনিক প্রত্যয়-ই যেহেতু মানুষকে তার চিরকালীন ভীতি থেকে মুক্তি দিতে পারেনি তক্ষণ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সমগ্রতা সমেত নিজেদের জানান দিতে হবে আমরাও আসছি। তোমাদের ভাবনার সমান্তরালে, সমান তালে না হলেও।

‘‘চিরকালীন ভীতির অবশেষে বেদনার ঘনবোধ, প্রাগমিটিজম,
নানাভাবে কলোনীর কংক্রিট ভেঙে নতুন জলের ধারাপাত
ধবংসের অবিনির্মাণ।

উত্তরণে সব ধারনা বদলে গেছে ক্রমাগত
নীল পথ রেখা বেয়ে।

শুরু হলো স্বপ্ন বপনের দিন, কলোনিয়াল ইন্টারভিন। (বিনির্মাণ, স্বপ্নাদ্য মাদুলি)

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, ‘বিনির্মাণ’ একটা প্রত্যয়ের কবিতা — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *