সমসাময়িক রুচি রসের ভাবনা

* রূচি > √রুচ্ + ই।  ই > সক্রিয়ন/গতিশীল/আধেয়/পুরুষ। রূচি প্রবাহিত/চলমান।

* রূচী > √রুচ্ + ঈ।  ঈ > সক্রিয়/গতিশীলতা/আধার/প্রকৃতি। রূচী বদ্ধ/অপ্রবাহিত/অচলমান।

 

রক্ষণ কিংবা রহন অথবা ভক্ষণের নবোদ্দীপ্ত চয়নের সক্রিয়ন/গতিশীল-ই হৈল রুচি। আবার বঙ্গীয় শব্দকোষ বলিতেছে, রুচ্ + ই – (দিপ্তী + সক্রিয়ন) > প্রকাশ, রুচি > রুচী– দিপ্তী, প্রকাশ। আবার রক্ষণ বা ভক্ষণের নবোদ্দীপ্ত চয়নের গতিশীলতা/সক্রিয় হৈল রুচী।

 

বস্তুতঃ আপনার উদ্দীপ্ত রক্ষণ বা ভক্ষণ যেখানে চয়নকৃত হৈয়ে গতিশীল রূপে দীপ্যমান বা প্রকাশিত সেইটাই আপনার রুচি। রুচির সাথে সংস্কৃতি যেমন সম্পর্কযুক্ত তেমনি রুচির সাথে রসেরও যোগাযোগ আছে। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ অনুযায়ী বলা যায় চয়নকৃত গতিশীল রস ভক্ষণের দুর্ভিক্ষৈ রুচির দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষ কিন্তু হঠাৎ করে আসেনি। পণ্যবাহী এই সমাজে শিক্ষা থেকে বিনোদন, ধর্ম্ম থেকে আদর্শ সবকিছুই যক্ষণ পণ্যের প্যাকেটে ঢুকেছে তক্ষণ থেকেই এই দুর্ভিক্ষ সুরু হৈয়েছে।

 

সেকালে গোলা-ভরা-ধান, পুকুর-ভরা-মাছ সকলের সমান ছিল না বটে কিন্তু গলা-ভরা-গান ও গতর-জোড়া-নাচ সকলেরেই ছিল। জীবনের ঐ রস-রসদে ডুবে থাকিত সে’কালের গ্রাম-বাঙ্গালার মানুষ।

 

বঙ্গসংস্কৃতির সে’টা ছিল প্রাগাধুনিক পর্ব্বের শেষ যুগ। ‘শিল্পী’ কথাটার তক্ষণো তেমন প্রচলন হয়নি। তক্ষণো সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্ম্মীর সাধারণ পরিচয় ছিল রস ও রসিক হিসাবে। রসকেন্দ্রসমূহের রস তক্ষণো ব্যাপকভাবে পণ্যে পরিণত হয়নি। যতটুকু হৈত, রসিকেরা সে’সব গ্রামে গ্রামে ও সহরে বাজারে ফ্রীতে ফেরি করিতেন। ঐসকল রসিকদের মোট সংখ্যা কত ছিল, কেউ জানে না। তাঁহাদের নামের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদের সৃষ্টিসমূহ-ও বিলুপ্ত প্রায়। তবে তাঁহারা প্রায় সবাই যে নিম্নবর্গের মানুষ ছিলেন, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

 

গ্রামবাঙ্গালার রসের আশ্রয় ছিল বটতলা হাঠখোলা …। কিন্তু প্রাগাধুনিকে গজিয়ে ওঠা তথাকথিত ইংরেজী পড়ুয়ারা এই রস অশ্লীল বলে ঘেন্না করিতে শুরু করিল। এরমধ্যে বাঙ্গালীর নিজস্ব শিল্প বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিলেন কলকাতার ঠাকুর পরিবারের দু-একজন জ্ঞানকর্ম্মযোগী। তাহার থেকেই বাঙ্গালীর নিজস্ব আধুনিক সংস্কৃতি নিয়ে উদ্ভূত হৈলেন রবীন্দ্রনাথ।

 

গ্রামবাঙ্গালা আবার রবীন্দ্রনাথের পরিপূরক রূপে তৈয়ার করিল নজরুলকে। নোবেল পাওয়ার আগে পর্য্যন্ত রবীন্দ্রনাথ, বটতলার রসিকদের মতৈ ক্ষমতার চোখে ছিলেন অপাংক্তেয়। দোঁ-আশলা বাংরেজী সংস্কৃতি তাঁহাকে ঘেন্না করিত বড়লোকের ছেলের বাউণ্ডুলেপনা হিসাবে। সেকালের প্রাগাধুনিক রসিকদের কাহারোই প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বালাই ছিল না। ছিল না রবীন্দ্রনাথের, নজরুলেরো। সম্পন্ন অভিজাত বাঙ্গালী পরিবারগুলাতে নজরুলের কিংবা রবিঠাকুরের বই-এর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। অথচ সেই বর্ণচোরারাই রবি আর নজরুলের মেকী বন্দনায় কাতর হয়েছে পরে পরে। তক্ষণো পর্য্যন্ত সমস্ত ব্রিটিশ বিরোধী দলটাই অধিকাংশ বাবুদের দৃষ্টিতে ছিল ‘ছোটলোকদের দল’ আর এই দলের কর্ম্মীরা ছিল ‘ঘৃণ্য জীব’। ইংরেজী ছত্রছায়ায় গজিয়ে ওঠা নব্য বঙ্গ-সংস্কৃতির সরকারী ক্ষমতা ছিল দো-আঁশলা আমলাদের হাতে। ‘রস’ কথাটা নিন্দনীয় ও ছোটলোকদের অপ-কুলাচার এবং সংস্কৃতি কথাটা প্রশংসনীয় এবং ভদ্রলোকদের কালচাররূপে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল।

 

গ্রামবাঙ্গালায় তক্ষণো পর্য্যন্ত প্রাগাধুনিক বঙ্গরসের চর্চ্চাই ছিল মূল কুলাচার (কালচার) এবং কমবেশী প্রাণবন্ত। তক্ষণো তাকে ‘লোকসংস্কৃতি’ বলে করুণা করিবার নষ্টামি শুরু হয়নি। তাহাতেই সেকালের মানুষ থাকিত রসে বশে। ভেদাভেদ, পীড়া-পীড়ন, অমর্য্যাদা-হেনস্থা যতৈ থাক। লোকে নাচ গান কথকতার কেবল উপভোক্তাই ছিলেন না, প্রায় সবাই ছোট বড় পারফর্মার-ও ছিলেন। গ্রামবাঙ্গালার শতকরা ৮০/৮৫ জন মানুষ প্রাগাধুনিক বঙ্গসংস্কৃতির অজস্র শাখা প্রশাখার একটা না একটা জানতেনই। কেউ কেউ অনেকগুলা শাখাতেই পারঙ্গম ছিলেন।

 

এবার একটু ইতিহাসের বেশ খানিকটা পেছনে যেতে চাই। ধরুন বৌদ্ধযুগীয় বাঙ্গালার সাম্যবাদী সমাজ-ব্যবস্থায়। তক্ষণো আমরা দেখতে পাই, যে মানুষ ধান উৎপাদন করিত, সে গান-ও উৎপাদন করিত। মজুরের যেই হাত হাতুড়ি ধরিত, সেই হাতেই এঁকে দিত ছবি। বানাত ভাস্কর্য্য শিল্প। যেই পা পিঠের বোঝার ভার বহিত, সে-ই পা-ই নাচ দেখাত। যেই দাঁত খাদ্য চিবাত সেই দাঁতৈ বিলোত মিষ্টি হাসি। যেই মুখ গ্রাস করিত খাবার, সেই মুখৈ দিত সুমধুর বাণী। শোনাত মনভোলানো গান। তক্ষণ ভাত ও ফেনের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। ভাতের ফেনের ফেলনা মণ্ডের উপাদেয়তা নিয়ে কাহারো সংশয় ছিল না। সামাজিক উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞ থেকে উত্থিত হয়ে কালচার ও ইকনমিকসের ঐ মণ্ড হাজির হৈত ‘মণ্ডপ’গুলাতে, মণ্ডলগণ সেগুলার রক্ষণাবেক্ষণ, ভাগবন্টন করিতেন। সকল মানুষ রসে বশে ডুবেই থাকিত।

 

কিন্তু একদিন সমস্যা দেখা দিল। মণ্ডে সকলের সমানাধিকার থাকিল না। মণ্ড দিশাগ্রস্ত হয়ে যেতে থাকিল। মণ্ড বা খিচুড়ি জগাখিচুড়িতে পরিণত হৈল। তাহার গৌরব গ্লানিতে পর্য্যবসিত হৈল। ফলতঃ সমাজে কাহারো অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়ে বিলুপ্তপ্রায় হৈল। কাহারো হৈল উচ্চ মর্য্যাদা, কেউ বা নিম্ন শ্রেণীর। এই গ্লানির হাত থেকে বাঁচার জন্য, সমাজ-ই সিদ্ধান্ত নিল সমাজের খোলনলচে পাল্টানো হৈবে। উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞে নানারকমের পদের সৃষ্টি হৈল। জ্ঞান কর্ম্ম পৃথক হৈল। মোট কথা, উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞে মানুষ যতৈ বিচিত্র মাত্রায় ধাবিত হৈল, মানুষে মানুষে বিভাজনটাও বেড়ে গেল। নানা পদ ভোজনে, নানান মাত্রা যাপনে-জীবনে। পৃথক হয়ে গেল ফেন ও ভাত। আলাদা হৈল কালচার ও অর্থনীতি। ক্রমশঃ ফেন কিংবা সংস্কৃতি হল অন্ত্যজ। বিপরীতে দানা-দানা স্বতন্ত্র স্বাধীন কৃতিত্বের ভাত উচ্চ পদ পেল। রুটি রুজীর ধান্ধাই স্বীকৃতি পেল সর্ব্বাগ্রে। মানুষের জীবনের রসের স্বাদ চলে গেল। ক্রমে ক্রমে মানুষের রুচী নষ্ট হয়ে গেল। মানবসভ্যতার আধুনিক যুগ এ প্রক্রিয়াকে পৌঁছে দিল চূড়ান্তে। মানুষ তক্ষণ কেবল ফেন ফেলে ভাত খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠিল। তাহার মানে মানুষ তাহার যমজজীবন, দ্বৈতাদ্বৈত জীবন থেকে রস-সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক জীবনটাই শুধু রাখিল। নৈতিক অর্থের জীবন ফেলে দিল। যুক্তির জীবন রেখে আবেগময় জীবন ফেলে দিয়ে, হোমো স্যাপিয়েন্স থেকে সম্পূর্ণরূপে হোমো ইকনমিকাসে পরিণত হৈল মানুষ।

 

এই মানুষ এক্ষণ মনমরা এক মানুষ। হাঁটে, খাটে, কথা বলে, যন্ত্রের মত। তাহার মন নেই। এমনকি মনের জন্য হাহাকারো নেই। বিস্বাদ-জীবনের অধিকারী সেই কলিযুগের বা কলের যুগের যান্ত্রিক মানুষরা নষ্ট রুচীর মানুষে পরিণত হৈল। ঠিক রবীন্দ্রনাথের নাটক ‘তাসের দেশ’ ও ‘রক্তকরবী’র চরিত্রগুলার মত। একালের কোটি কোটি মানুষ এক্ষণ কলের যুগের মানুষ। যাহারা যন্ত্রে চালিত। মুক বধির, হতাশ, মনমরা, মাঝিহীন নৌকার মত ভাসমান। দড়িবাঁধা গতি। এমন মানুষেরো আজকাল দেখা মেলে, যাহারা বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি ভাড়া করে জীবনের স্বাদ ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন। যে যেমন বোনে, সে তেমন কাটে। আধুনিক সভ্যতা যেমন প্রজা চেয়েছিল, তেমন প্রজাই আজ পেয়েছে। ট্যাঁকে গোঁজা ছুরিই এক্ষণ পেট কাটে।

 

বৌদ্ধযুগ পরবর্ত্তী সামন্ত শাসকদের মর্জি মত সংস্কৃতি এল। এল তদনুসার মানুষ। তাকে সেকেলে ঘোষণা করে দিয়ে অতঃপর তাহার স্থান দখল করে নিল আধুনিক বুর্জোয়াতন্ত্র। বুর্জোয়া পণ্য ও বুর্জোয়া কালচার। এক্ষণ চলছে নিউ এজ মালটিন্যাশনালদের কর্পোরেট কর্ম্মযজ্ঞ। এসেছে কর্পোরেট মানুষ। কলের মানুষ। আরো এসেছে নব নব উন্মাদনায় ক্লান্তিকর ভোগবাদের আগ্রাসন। বাজার সংস্কৃতির বেণিয়াপনা। কেউ বলিতেছেন— সঙ্কট উপস্থিত। কেউ বলিতেছেন, ভয়ের কিছু নেই। নেই কি আছে, সেটুকু চিন্তা করার মত খেইও আজ আমরা হারিয়েছি। ধান আগুনের তাপে ফুটে যে খৈ হয় সে কথাও আমরা জানি না। শুধু মুড়মুড়িয়ে মুড়ি খাই। কিন্তু অধুনা আধুনিকতার আলোকপ্রাপ্তরা আসলেই কি জানেন কেমন রসে বশে আছে বাঙ্গালী সংস্কৃতি? …

 

শান্তিনিকেতনী পাঞ্জাবী পরে ও ঝোলা কাঁধে সুললিত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করিলে কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিলেই সংস্কৃতি চর্চ্চা বোঝায় না। সকল মানুষের সমগ্র জীবনচর্য্যাই সংস্কৃতি পদবাচ্য। বাঙ্গালীদের কাছে এই সংস্কৃতিই ছিল রস। আজকে যাহাদের সভ্যতার আলোকে আমরা নিজেদের আলোকিত করার উদ্ভ্রান্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাও বলিতেছেন— সংস্কৃতি হল ‘a whole way of life’… অথচ সেই জীবন রস-সংস্কৃতি চুর্ণ বিচূর্ণ হৈতে হৈতে দেশ কাল পাত্র ভেদে আজ অজস্র বিচিত্র আকার ধারন করেছে। যে মানুষ, সমাজ, সামাজিক কর্ম্মযজ্ঞ ও মননযজ্ঞের সংস্কৃতিকে আজ আমরা দেখিতেছি, তাহার আদি ও মূল-রূপ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আর তাই এই সংস্কৃতির বর্ত্তমান প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে তাহাদের আদিপুরুষকে শনাক্ত করা রীতিমত কঠিন।

 

তবুও আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আজ সেই ইতিহাসেরই পুনরাবর্ত্তন দেখিতে পাই, কর্পোরেট বোর্ড মিটিংয়ে বসে যেই মানুষ পৃথিবী খুঁড়ে ফেলার মতলবে গাঁইতিতে শান দেয় ন্যাচারাল গ্যাসের প্রত্যাশায়। তাহারি আদিম পূর্ব্বপুরুষ হয় ত পাথুরে ছুরি হাতে মাটী খুঁড়িত কন্দমূল খাবে বলে। কিংবা সে’দিন যাহারা মাটীর ওপর ফেলে যাওয়া পূর্ব্বসূরীর পদচিহ্ন অনুসরণ করে নিজেদের কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য নিরূপণ করিত, আজকে তাহারি উত্তরসূরীরা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ কম্পিউটারের সামনে বসে জগতের পদচিহ্ন অনুসরণ করিতেছে। হয় ত এ’সব-ও রসের বশের কায়-কারবার। সবি মানুষের আদিকালের কর্ম্মযজ্ঞস্বভাবের অধীন। সেই অধীনতার গ্রামীণ স্বরূপ থেকে আন্তর্জাতিক স্বরূপ এক্ষণ আমাদের বুঝে নিতে হৈবে।

 

এই রস-সংস্কৃতিকে পণ্য করে তথাকথিত সাংস্কৃতিক বুর্জ্জোয়ারা যক্ষণ কৃত্রিম রসের সঙ্কট তৈয়ার করে তবেই তথাকথিত অপ-রসের আধিপত্য বিস্তার হয়। কেননা জীবন ধারার ভ্যাকুয়াম পূর্ণ করাই প্রকৃতির কাজ। আর এই ভ্যাকুয়ামের ঘূর্ণাবর্ত্তে পড়ে কক্ষণো কক্ষণো আলমরাও হিরো হয়ে যায়, এ আর বিচিত্র কি মামুন স্যার! …

 

তথ্য সূত্রঃ ‘দিশা থেকে বিদিশায়: নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশ বার্তা’ – কলিম খান।

 

 

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, রুচি রসের ভাবনা — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *