‘সাম্রাজ্যবাদ-সাম্রাজ্যবাদে দ্বন্দ্বই যুদ্ধের জন্ম দেয়— লেনিন-এর সেই শতবর্ষাধিক পুরানো সিদ্ধান্তৈ আবার নতুন করে প্রমানিত হল রুশ-উক্রানীয় বর্ত্তমান সংঘর্ষে। চোখের সামনে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি— মুহূর্মুহূ ক্ষেপণাস্ত্রবর্ষণ, ভ্যাকুয়াম বোমা, ক্লাস্টার বোমা, ৬৫ কিলোমিটার লম্বা সামরিক কনভয়ের আগ্রাসণ, প্রবল বিস্ফোরণ, জ্বলন্ত সামরিক ট্রাক, ভাঙা অট্টালিকা, অসহায় মৃত্যু, লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের শরণার্থী হয়ে শুধুমাত্র প্রাণটুকু বাঁচাতে পার্শ্ববর্ত্তী দেশে আশ্রয় খোঁজার মরিয়া চেষ্টা, পাশাপাশি আপ্রাণ লড়াই— যুদ্ধ মানেই মানবতার চরম অবমাননা। তবু যুদ্ধ হয়, বারে বারে তা ফিরে আসে, যেমন এসেছে আমাদের এইমুহূর্ত্তের বিশ্বেও। আপাতত তার কেন্দ্র উক্রাইন। আগ্রাসী ভূমিকায় রাশিয়া।
যুদ্ধ হয় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে লেনিন দেখিয়েছিলেন— আজকের বিশ্বে পুঁজিবাদ তার অবাধ বিকাশের স্তর পেরিয়ে এসে প্রবেশ করেছে সাম্রাজ্যবাদের স্তরে। অর্থাৎ, ক্রমাগত উৎপাদন বাড়িয়ে চলা ও তা বিক্রি করে লাভ করার মত উপযুক্ত অবাধ বাজার আর তার হাতে নেই। অথচ সর্ব্বোচ্চ ‘লাভ’ই হল পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যাবস্থার চালিকাশক্তি। কিন্তু তার উৎস কী? সেই মার্ক্সই দেখিয়ে গেছেন লাভের প্রধানতম উৎসই হল ‘উদ্বৃত্ত শ্রম’-এর মূল্য— মানে কোন একটা দ্রব্য উৎপাদন করতে শ্রমিক যে শ্রম প্রদান করে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তার পুরা মূল্য শ্রমিকের জোটে না। পারিশ্রমিক হিসেবে সেই না পাওয়া অংশটাই লাভ হিসেবে জমা হয় মালিকের ঘরে, পুঁজি হিসেবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা মার খায়, মানে বাজার হ্রাস পায়। অথচ পুঁজির ক্রমাগত লাভ বজায় রাখার জন্য চাই এক ক্রমবর্দ্ধমান বাজার। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রথম যুগে, যখন পুঁজির পরিমাণ ও শক্তি ছিল কম, তখন বাজার নিয়ে তেমন কোনও সংকট ছিল না। কারণ উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করতে গেলে ক্রেতার অভাবে তখন তাদের ভুগতে হত না। কিন্তু নিজেদের বিকাশের স্বার্থেই যত পুঁজি সংহত হতে শুরু করল, শক্তি ও পরিমাণ বাড়তে থাকল তার, আর সেই প্রক্রিয়াতেই বৃদ্ধি ঘটল উৎপাদন শক্তির, দেখা গেল উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির বাজার ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে তার কাছে। উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্যেই আসে লাভ, যার ফলে ক্রমে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে, ফলে ছোট হয়ে আসে বাজার, অথচ লাভ বজায় রাখতে বাজার বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। তাহলে উপায়?— না বাড়াও হাত অন্যের বাজারের দিকে, অন্য দেশের বাজার দখল কর। সাম্রাজ্যবাদের জন্ম এইভাবেই। যুদ্ধ তার স্বাভাবিক ফল।
সে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদের কথা। তারপর থেকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির বাজার নিয়ে কামড়াকামড়ির ফলস্বরূপ পৃথিবী দেখে ফেলেছে দু’-দু’টা বিশ্বযুদ্ধ। এখনও প্রতিনিয়ত পৃথিবীর আনাচে কানাচে হয়েই চলেছে একের পর এক ছোটখাট যুদ্ধ বা প্রায় যুদ্ধ-যুদ্ধ-অবস্থা। সবেরই পিছনে মূল কারণ কিন্তু সেই একই— বাজার দখলের খেলা। আজকের রুশ-উক্রাইন সংঘর্ষের পিছনেও সেই একই খেলাই বর্ত্তমান। যদিও খেলোয়াড় সেখানে অনেক, স্বার্থও তাদের বহুমুখী। সেই খেলোয়াড়দের বহুমুখী স্বার্থ ও লক্ষ্যের দিকে এবার একটু চোখ ফেরানো যাক। যদিও নিবন্ধের আকারের সীমাবদ্ধতার কারণে যথাসম্ভব সংক্ষেপেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে আলোচনা।
অলঙ্করণে হিম ঋতব্রত
উক্রাইন
শুরুতেই এবারের যুদ্ধের মূল মঞ্চ উক্রাইনের দিকে একবার ফিরে তাকানো যাক। ফিরে দেখা যাক তার ইতিহাসে। গত প্রায় হাজার বছর বা তারও বেশী সময়ের মধ্যে সে দেশ প্রায় কখনওই স্বাধীন ছিল না। সেই দ্বাদশ শতাব্দীতে চেঙ্গিস খান-এর আক্রমণের সময়েও এই অঞ্চলে ছিল কিয়েভ রুশদের প্রাধান্য। এর পরে কিছু সময়ের জন্য তারা বিতাড়িত হয় মঙ্গোলদের দ্বারা। সেই মঙ্গোলদের থেকেই আসে তাতাররা। আবার এই অঞ্চলেই ছিল কিপচাক জনগোষ্ঠীর বাস। পরবর্ত্তী কালে তুর্কী জনগোষ্ঠীও এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন প্রভাব বিস্তার করে। মস্কোকেন্দ্রিক রুশ সাম্রাজ্যও সেই দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্দ্ধ থেকেই পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করলে স্বভাবতই তারাও এই অঞ্চলে হাত বাড়ায়। আরো হাত বাড়ায় পোলাণ্ড ও লিথুয়ানিয়াও। জার সাম্রাজ্য পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এই অঞ্চলে কসাকদের বসতী স্থাপন করা হয়। পাশাপাশি ক্যাথারিন দ্য গ্রেটের আমল থেকে জার্মান কৃষকগোষ্ঠীকেও নিয়ে এসে সরকারী মদতেই বসানো হয় এখানে। অবশ্য এসবই প্রাক্-পুঁজিবাদী যুগ ও পুঁজির বিকাশের প্রথম দিকের সময়ের কথা। এই পুরা সময়ই উক্রানীয় জনগোষ্ঠী কিন্তু থেকে গিয়েছিল চূড়ান্ত অনুন্নত, মূলতঃ শাসিত কৃষিজীবী মানুষের সমষ্টি, যাদের এমনকি সাধারণ লিখন হরফ বলেও তেমন কিছু তৈরী হয়নি।
রুশ বিপ্লবের পর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে উক্রাইন একটা পৃথক সোভিয়েত রিপাবলিকের মর্য্যাদা লাভ করে। তাদের ভাষার আলাদা করে চর্চ্চা শূরু হয়, রুশ হরফের ছাঁদে তৈরী হয় তাদের নতুন ঐক্যবদ্ধ বর্ণমালা। বিপুল উর্ব্বর জমী, খনিজ পদার্থ ও যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে দেখতে দেখতে তা মাথা তুলে দাঁড়ায় এক অতি উন্নত কৃষি ও শিল্পকেন্দ্র হিসেবে। উৎপন্ন কৃষিজ দ্রব্যের পরিমাণ হয়ে দাঁড়ায় এত যে তার নামই হয়ে দাঁড়ায় সোভিয়েতের রুটীর ঝুড়ী। ১৯৪১-৪৫ জার্মানদের আক্রমণে অভূতপূর্ব্ব ধংসের পরও মাত্র এক দশকের মধ্যেই তা আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। পরিণত হয় রাশিয়ার পরেই সোভিয়েতের দ্বিতীয় উন্নত রিপাবলিকে। তবে এসবই ঘটে সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে। পুঁজিবাদী বাজারের নাগালের বাইরে থেকে। মোটামুটি ১৯৬৫ পর্য্যন্ত এই হল সেখানের ইতিহাস।
কিন্তু এরপরেই এসে পড়ে বি-স্তালিনীকরণের ধাক্কা। সোভিয়েতের সংশধনবাদী নেতৃত্ব উৎপাদনে উৎসাহ জোগানোর নামে নতুন করে আমদানী করতে শুরু করে বাজারের নানা নিয়ম। মার খেতে শুরু করে উৎপাদন, পিছনে হাঁটতে শুরু করে সমাজ। ১৯৯১-এ সোভিয়েত ভেঙে পড়লে স্বাধীন হয় উক্রাইন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে বসে এক নতুন পুঁজিবাদী শ্রেণী। শুরু থেকেই যাদের আকাঙ্খা সাম্রাজ্যবাদী। সোভিয়েতের পড়ে পাওয়া উন্নত কৃষি, শিল্প ও যোগাযোগ পরিকাঠামো এবং উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারাও নেমে পড়ে বাজার দখলের খেলায়, প্রতিবেশী রুশ পুঁজিবাদীদেরই মত।
১৯৯০-এর দশকে সদ্য ক্ষমতায় ফেরা রুশ সাম্রাজ্যবাদ সোভিয়েতের পুরানো কাঠামোর মধ্যে থাকা দেশগুলোকে নিজেদের প্রভাববলয়ে ধরে রাখতে ও তাদের বাজারের ওপরে নিজেদের কব্জা বজায় রাখতে তৈরী করে কনসলিডেশন অব ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট স্টেটস বা সিআইএস নামক একটা গোষ্ঠী। উক্রাইনও তাতে যোগ দেয়। লক্ষ্য ছিল খুবই সরল। সোভিয়েতের সামরিক শক্তির মূল উত্তরাধিকারী হিসেবে রাশিয়ার সামরিক প্রোটেকশনের আড়ালে থেকে নিজেদের অবস্থানকে মজবুত করা এবং সিআইএস গোষ্ঠীর দেশগুলোর বাজারে রাশিয়ার সাথে থেকেই কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া। পাশাপাশি ছিল আরো একটা কারণ। উক্রাইন নিজে তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাসে খুব একটা সমৃদ্ধ না হলেও তাতে অতি সমৃদ্ধ রাশিয়ার সাথে ইউরোপের যোগাযোগের পথেই তার অবস্থান। অর্থাৎ, রাশিয়া ইউরোপে ঐ প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করতে গেলে ইউক্রেনের ওপর দিয়েই তা নিয়ে যেতে হবে। ফলে ট্রানজিট ফি হিসেবে ইউক্রেন তা থেকে যথেষ্ট লাভই করতে পারবে। কিন্তু তার জন্য রাশিয়ার সাথে থাকাই তার দরকার। তাই সিআইএস-এ শুরু থেকেই উক্রাইন যোগ দেয় অতি উৎসাহের সঙ্গেই। ফলে ওদেসা সহ কৃষ্ণসাগরের বুকে সে দেশের বন্দরগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে। পাশাপাশি সেদেশের ওপর দিয়ে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস ও তেল নিয়ে যাওয়ার পাইপ লাইন তৈরী হয়। ইউক্রেন-এর বর্ত্তমান আয়ের এক বিরাট অংশেরই উৎস এসব।
কিন্তু দশক ঘুরতে না ঘুরতেই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। সোভিয়েত পতনের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা উক্রাইনের নবোত্থিত উৎপাদন শক্তি ও বাজারের দিকে নজর এসে পড়ে ইউরোপ (পড়ুন জার্মানী) ও আমেরিকার। সাথে তাদের বাড়তি উৎসাহ জোগায় দ্রুত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে থাকা রুশ সাম্রাজ্যবাদকে রোখা ও সামরিক দিক থেকেও তাকে ঘিরে ফেলার তাগিদ। উক্রাইনের সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের একাংশও এতে নিজেদের সুবিধাই দেখতে পায়। তাদের বাজার মূলতঃ পশ্চিমে, ইউরোপে ও আমেরিকায়। ফলে রাশিয়াকে ছেড়ে তাদের লক্ষ্য ক্রমশঃ পশ্চিমের হাত ধরা। অন্য দিকে উক্রাইনের পুঁজিবাদীদেরই আরেকটা অংশ নিজেদের বাজারের প্রয়োজনেই রাশিয়ারই হাত ধরে। এই দুই শিবিরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমশঃ তিক্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। ২০০৪-এ ইয়ুশচেঙ্কো (ইউরো-মার্কিনপন্থী) ও ইয়ানুকোভিচ (রুশপন্থী) নেতৃত্বধীন রাজনৈতিক দলের লড়াই-এ ইয়ুশচেঙ্কো জয়লাভ করেন। উক্রাইন ক্রমশ ইইউ-মার্কিনবৃত্তের দিকে সরতে শুরু করে। ফ্রান্স-জার্মানী তাদের ইইউভুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ২০০৮-এ ন্যাটো সামরিক জোটেও তাদের অন্তর্ভুক্তির কথা ওঠে। যদিও জর্জিয়ায় রুশ আগ্রাসনের পর পশ্চিম তখনকার মত সবকিছু গিলে নিতে বাধ্য হয়। পরের নির্ব্বাচনে রুশপন্থী শিবিরের সমর্থনে ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতায় আসেন।
কিন্তু উক্রাইনের তথ্যপ্রযুক্তি, গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমের মালিকানাধীন গোষ্ঠীগুলি ইতিমধ্যেই ইইউ-মার্কিন শিবিরের প্রভাবে চলে এসেছিল। এদের সহযোগিতাতেই শুরু হয় নতুন খেলা— গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খেলা। শুরু হয় আন্দোলন— ইউরোময়দান নামে যা খ্যাত। অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকবাজরা শুরু করে হামলা, পশ্চিমের উক্রানীয় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের এই সময়েই পূর্ব্বের রুশভাষী মানুষদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা শুরু হয়। আয়োজিত হয় একধরনের কু’দেতার, অনেকটা লিবিয়ার ধাঁচের, যার ফলে সেখানে প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী নিহত হন। পরিস্থিতি শেষপর্য্যন্ত এমন দাঁড়ায়, নির্ব্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হতে হয়; তিনি পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন। দেশের পার্লামেন্ট ভেরকোভনা রাদার তৎকালীন চেয়ারম্যান ওলেকজান্দর তুর্খিনোভ অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন, ইয়ানুকোভিচকে ইমপিচ করে নতুন সরকার গঠিত হয় ২০১৪-এ। এবার ক্ষমতায় বসেন পেত্রো পোরোশেঙ্কো। কমিউনিস্ট পার্টী নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় (পূর্ব্বতন সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলির মধ্যে একমাত্র উক্রাইনেই); তাদের নির্ব্বাচিত ৩১ জন ডেপুটিকেও বহিষ্কার করা হয় রাদা থেকে। পশ্চিমের মদতে ক্ষমতায় আসা নব্যনাৎসিরা অতি উৎসাহে শুরু করে তীব্র অত্যাচার। লক্ষ্য সংখ্যালঘু রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। ১৯৯১-এ উক্রাইন গঠনের পর থেকে এই দুই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ নিশ্চিন্তে পাশাপাশি বসবাস করলেও এবার সমাজ এই দুই অংশে আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে পড়ে। রুশ ভাষা বিভিন্ন ক্ষেত্রতেই একরকম নিষিদ্ধ বিবেচিত হতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের পূর্ব্বাংশের ওব্লাস্ত বা প্রদেশগুলো বা ক্রিমিয়ায়, যেখানে রুশরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রতিক্রিয়াও হয় সবচেয়ে তীব্র। সুযোগ বুঝে এবার আসরে নামে রাশিয়া।
ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ঐতিহাসিকভাবে ছিল রাশিয়ারই অংশ। এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল রুশ ভাষাভাষী মানুষই। ১৯৫৩ সালে যোগাযোগের সুবিধা ও সোভিয়েতভুক্ত দুই ফেডারেশন-এর বন্ধুত্বের চিহ্নস্বরূপ এই উপদ্বীপকে উক্রাইনের সাথে যুক্ত করা হয়। কিন্তু এখানকার সেবাস্তোপোল সহ বিভিন্ন ঘাঁটীতে রুশ বাহিনী আগে থেকেই মজুত ছিল ১৯৯১-তে হওয়া রুশ-উক্রাইন চুক্তি মোতাবেকই। এদেরকেই কাজে লাগিয়ে রাতারাতি রাশিয়া দখল করে নেয় ক্রিমিয়া। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশ জনগোষ্ঠীও তাদের স্বাগতই জানায়। সেই মুডকে কাজে লাগিয়েই রাশিয়া একরকম তৎক্ষণাৎ একটা গণভোটের ব্যবস্থা করে সেখানে, যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশভাষী মানুষ স্বেচ্ছাতেই রাশিয়াকেই বেছে নেন। ক্রিমিয়া উক্রাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ফলে দেশের উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিক্ততা আরও বৃদ্ধি পায়। পূর্ব্বের প্রদেশগুলোতে রুশভাষীদের দমনকল্পে নব্য নাৎসিরা রীতিমত আক্রমণ শুরু করে। উল্টদিকে রাশিয়ার মদতে রুখে দাঁড়ায় রুশভাষী জনগোষ্ঠীও। পূর্ব্বের দুইটা ওব্লাস্ত— দোনেৎস্ত ও লুহানস্ক (এদেরই একত্রে ডনবাস বলা হয়) ২০১৫-তে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। উক্রাইন এই দুই অঞ্চলে সরাসরি সামরিক অভিযান চালাতে শুরু করে, যার ফলে এ পর্য্যন্ত প্রাণহানির সংখ্যা ১৫ হাজারেরও বেশী (বর্ত্তমানে উক্রাইনের পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন ও ইউরোপীয় নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অতি সক্রিয় হলেও ডনবাস এলাকার এই গণহত্যা নিয়ে কিন্তু তারা আশ্চর্য্যরকমের নিশ্চুপ)। অন্যদিকে রাশিয়ার সহায়তায় প্রতিরোধও বজায় থাকে। এই অবস্থাই বজায় ছিল এই যুদ্ধের পূর্ব্বমুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত।
রুশ সাম্রাজ্যবাদ
রুশ ভাষায় ‘উক্রাইন’ শব্দের অর্থ ‘সীমান্ত’। রুশ সাম্রাজ্যবাদীরা বাস্তবে এই দেশটাকে তাই মনে করে। এই সীমান্ত তাদের কাছ থেকে নানা দিক থেকেই অতি গুরুত্বপূর্ণ— ব্যবসার জন্য, সামরিক দিক থেকেও।
১৯৯১-এ সোভিয়েতের পতনের পর প্রথম দিকের কিছুদিন একটা টালমাটাল অবস্থা ছিল। কিন্তু তা দ্রুত সামলে নিয়েই মাথাচাড়া দেয় রুশ সাম্রাজ্যবাদ। গত শতাব্দীর শেষ দশকেই। তাদের মূলধন ছিল সোভিয়েতের বিপুল পরিকাঠামো, যা এই প্রতিবিপ্লবের সময় নতুন রুশ ধনিক শ্রেণী নানাভাবে তাদের ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে সোভিয়েতের বিশাল অস্ত্রসম্ভার, তার প্রযুক্তিগত উত্তরাধিকার এবং সেনাবাহিনী রাশিয়ার করায়ত্ত হয়। এই দুইকে ভিত্তি করে রুশ সাম্রাজ্যবাদ নতুন করে আসরে নামে। তাদের ব্যবসার মূল ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়— একদিকে রাশিয়ার বিপুল খনিজ সম্পৎ, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস, অন্যদিকে সমরাস্ত্রের ব্যবসা।
রাশিয়ার এই তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল ক্রেতা ইউরোপ। কিন্তু ইউরোপে তা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়াকে উক্রাইনের ওপর ভীষণভাবেই নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। কারণ স্থল পথে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ঐ শক্তি সরবরাহ করতে হলে উক্রাইনকে এড়িয়ে তা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে কৃষ্ণসাগরের জলপথ ব্যবহার করতে হলেও সেখানে মূল সমস্ত বন্দরই সেই উক্রাইনেরই নিয়ন্ত্রণে। ফলে উক্রাইনের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা তার নিজের স্বার্থেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেবাস্তোপোলসহ ক্রিমিয়ার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম এই লক্ষ্যেই এক বড় পদক্ষেপ। ওদেসা, খেরসন ও মারিউপোলও এই একই কারণে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা তার অন্যতম লক্ষ্য। এরফলে কৃষ্ণসাগরের বাণিজ্যের ওপর তার পূর্ণ কর্ত্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ইউরোপে শক্তি সরবরাহের পথ পুরাপুরি নিষ্কন্টক হবে।
নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প
ইতিমধ্যেই ইউরোপের শক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাজারের ৩৫% রাশিয়ার করায়ত্ত। কিন্তু উক্রাইনকে এড়িয়ে যেহেতু এই সরবরাহ সম্ভব নয়, ফলে ট্রানজিট ফি বাবদ উক্রাইনকে তাকে বিপুল খরচ গুণতে হয়। তাই উক্রাইনকে এড়িয়ে এই সরবরাহ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে জার্মানীর সহায়তায় উত্তরে বাল্টিক সাগরের ওপর দিয়ে তারা একটা নতুন পাইপ লাইন তৈরী করে— নর্ড স্ট্রিম-২। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে— এটা আসলে একটা দ্বিতীয় লাইন। প্রথম লাইনটা ইতিমধ্যেই উক্রাইনের মধ্য দিয়ে প্রসারিত। এই দ্বিতীয় লাইনের কাজও ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ। শুধু জার্মান সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমতি মিললেই সরবরাহ শুরু করা সম্ভব হবে। কিন্তু এই লাইন নিয়েই রাশিয়ার সাথে বর্ত্তমানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং অংশত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদেরও স্বার্থের সংঘাত চূড়ান্ত হয়ে ওঠেছে।
ইউরোপের শক্তি সরবরাহের বাকী বাজারের এক বিরাট অংশই এখনও পর্য্যন্ত মার্কিন ও কিছুটা অংশত ব্রিটিশ তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর অধীন। গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষত হাইড্রলিক ফ্র্যাকচারিং বা ফ্র্যাকিং প্রযুক্তির উদ্ভবের ফলে মার্কিন কোম্পানিগুলোর ক্ষমতা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পদ্ধতিতে তৈরী গ্যাস মাইনাস ১৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করে তরলে পরিণত করলে তার আয়তন হ্রাস পেয়ে ৬০০ ভাগের ১ ভাগে পরিণত হয়। সেই তরলীকৃত ঠাণ্ডা গ্যাসকে এলএনজি ক্যারিয়ারে ভরে এরপরে জাহাজে করে চালান করা হয় ইউরোপে। এবং সেখানে কারখানায় আবার তাকে গ্যাস ফার্মে ফিরিয়ে এনে বাজারজাত করা হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় খরচ পড়ে অনেকটাই বেশী। অন্যদিকে রাশিয়া থেকে আসা প্রাকৃতিক গ্যাস তুলনায় অনেক সস্তা। ফলে তার সরবরাহ ঠিকঠাক চালু হলে ইউরোপ তথা মূলতঃ জার্মানীর শক্তির বাজার ব্রিটো-মার্কিন শক্তির প্রায় পুরাটাই হাতছাড়া হয়ে যাবার সম্ভাবনা। ঠিক সেই কারণেই একেবারে প্রথম থেকেই নানা অজুহাতে ইংলণ্ড ও আমেরিকা এই নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্পের ওপর খড়্গহস্ত। যেনতেন প্রকারেই তারা এই প্রকল্পকে বাতিল করতে চায়।
আবার রাশিয়ার মত জার্মান সাম্রাজ্যবাদের কাছেও নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প অত্যন্ত জরুরী। কারণ কিয়োটো চুক্তির বাস্তবায়নের পথে জার্মানী তার নিজের শক্তির বাজারকে এখন পুরাপুরি ট্র্যান্সফর্মের পথে। কয়লা ও পরমাণু শক্তির ওপর ভরসা কমিয়ে তারা এখন নিজেদের জন্য রিনিউয়েবল বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির নতুন প্রযুক্তি গড়ে তুলতে উদ্যোগী। এক্ষেত্রে পৃথিবীতে সেদেশই অগ্রণী। দেশের চালু ১৯টা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রর মধ্যে ১৩টা তারা আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল। গতবছর বন্ধ করেছে আরো তিনটা। কিন্তু এই ট্র্যানজিট পিরিয়ডে নিজেদের প্রয়োজনের শক্তির চাহিদা মেটাতে রাশিয়ার সস্তা গ্যাস তারও চাই। তাই সমস্ত বাধার মুখে দাঁড়িয়েও তারা এই নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে অনড় মনোভাবই দেখিয়ে এসেছে। আপাতত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শেষ অনুমতিটুকু দেওয়া মুলতুবি থাকলেও তা যে নিতান্তই সাময়িক সিদ্ধান্ত তা বোঝাই যায়।
পূর্ব্বদিকে ন্যাটো যুদ্ধজোটের ক্রমবিস্তার
বিগত শতাব্দীর ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ওয়ারশ সামরিক জোটের বিপরীতেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো সামরিক জোটের উদ্ভব। ওয়ারশ জোট আজ অতীত। তাহলে ন্যাটো জোটের প্রাসঙ্গিকতা কী? এই প্রশ্নকে নিয়েও বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে এই সামরিক জোট অতি প্রয়োজনীয়, কারণ একে হাতিয়ার করেই তারা দেশে দেশে হামলা চালায়। ইরাক থেকে সিরিয়া, আফগানিস্তান থেকে সার্বিয়া সর্ব্বত্রই একই কাহিনী। ইউরোপের দেশগুলোকেও নিজের শিবিরে ধরে রাখার জন্য তার কাছে অত্যন্ত কার্য্যকরী অস্ত্র এই ন্যাটো।
১৯৮৯ সালে যখন বার্লিন প্রাচীর-এর পতন ঘটে, তখন আমেরিকার পক্ষ থেকে সোভিয়েতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতী গর্ব্বাচেভকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়— জার্মানীর পূর্ব্ব দিকে ন্যাটো আর এক ইঞ্চিও অগ্রসর হবে না। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে। পূর্ব্বতন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের একের পর এক দেশ, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া আজ ন্যাটোর সদস্য। এর পরের দফায় পূর্ব্বতন সোভিয়েতভুক্ত বিভিন্ন দেশকেও— এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়াকে এই জোটে নেওয়া হয়। এরপরে যখন জর্জিয়া ও উক্রাইনকেও এই জোটে নেওয়ার কথা ওঠে, ২০০৮ সালে জার্মানী ও ফ্রান্স তার বিরোধিতা করে। কারণ সোভিয়েতের পতনের পরও রাশিয়া এখনও সামরিক শক্তিতে ভয়াবহ। পরমাণু শক্তিতেও বাকি সারা পৃথিবীর থেকেও তারা বেশী শক্তিশালী। ফলে তার একেবারে সীমান্তে উপস্থিত হয়ে তাকে খোঁচানো নিয়ে জার্মানী ও ফ্রান্স আপত্তি তোলে। কিন্তু তাকে পাত্তা না দিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই জোট জর্জিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, উক্রাইনকেও কথা দেয়। ঠিক তার পরেই আসে প্রত্যাঘাত। রুশ সাম্রাজ্যবাদও দীর্ঘদিন ধরেই ন্যাটোর এই ক্রমাগত তাদের সীমান্তের দিকে কাছিয়ে আসাকে সন্দেহের চোখেই দেখছিল। বারেবারে তা নিয়ে তাদের অসন্তোষও তারা প্রকাশ করেছে। এবার জর্জিয়ায় তা একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ায় প্রত্যাশিতভাবেই তারা প্রাত্যাঘাত করে। সরাসরি ট্যাঙ্ক নামিয়ে জর্জিয়ার অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ ওসেটিয়া ও আবখাজিয়া তারা দখল করে নেয়। এবারের মত তখনও যুদ্ধ শুরু হতে তার আগের মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত হম্বিতম্বি করা ন্যাটো দেশগুলিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। জর্জিয়ার ন্যাটোভুক্তি ফলে বাতিল হয়। এবারে উক্রাইনের পরিস্থিতিও এখনও পর্য্যন্ত একইরকম।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্ত্তী সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপের তিনটা বৃহৎ শক্তিই— জার্মানী, ফ্রান্স ও ইংলণ্ড— সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আরো পশ্চিমে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কায় জোটবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই জোটের প্রয়োজনীয়তা ছিল দ্বিবিধ— সামরিক ও অর্থনৈতিক। বিশ্বত্রাস নাৎসি জার্মানীর পরাজয়ের পর সোভিয়েতের প্রবল সামরিক শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে একদিকে এই তিন সাম্রাজ্যবাদই— পরাজিত জার্মানী তো বটেই, ঘটনাচক্রে বিজয়ী ইংলণ্ড ও ফ্রান্সও আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতে থাকে। সেই কারণেই মহাসাগরের অপরপারে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে বসে থাকা ও যুদ্ধের ধ্বংসর হাত থেকে সেই দূরত্বের কারণেই একরকম রক্ষা পেয়ে যাওয়া আমেরিকার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ইউরোপের মাটীতে ধরে রাখা তাদের কাছে ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে আমেরিকাও তাতে সুযোগ পেয়ে যায়— ইউরোপের দেশগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন শিবিরে ধরে রাখার। এই পারস্পরিক প্রয়োজন থেকেই তৈরী হয় নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সংক্ষেপে ন্যাটো।
অন্যদিকে সেইসময় ইউরোপের অর্থনীতিও হয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। যুদ্ধে মোটামুটি অক্ষত থেকে গিয়ে সেই সুযোগে নিজেদের ব্যবসাকে ভালমতই বাড়িয়ে নিতে পারা আমেরিকার কাছে সাহায্যের হাত পাতা ছাড়া তখন ইউরোপীয় দেশগুলোর উপায়ও ছিল না। কিন্তু তাদের নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্খা এতটুকুও মরে যায়নি। সেই কারণেই সেই ৫০-এর দশকেই মূলতঃ ফ্রান্স ও জার্মানী কাছাকাছি আসে, নিজেদের মধ্যে একটা বাণিজ্য জোট তৈরী করে একটা যৌথ বাজার তৈরী করার স্বার্থে। এর ফলে একদিকে যেমন পুঁজি সংহত হয়ে পুঁজির উৎপাদন ও প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে বাজারের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় সংকটের মোকাবিলাও সহজ হয়। এরপর ধীরে ধীরে ইতালি, নেদারল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, ইংলণ্ড, স্পেন— প্রভৃতি দেশও এই নতুন বাণিজ্যিক ইউনিয়নের উপযোগিতা বুঝে তাতে যোগ দেয়। ফলে ধীরে ধীরে এই নতুন ইউরোপীয় বাণিজ্য জোট শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করে। উৎপাদনশীলতা ও অর্থনীতির মোট ক্ষমতায় তারা রীতিমতই মহাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু এই বাণিজ্য জোট, যা বর্ত্তমানে রাজনৈতিক জোটও বটে, তা কখনওই মনোলিথিক ছিল না। একাধিক সাম্রাজ্যবাদ তাদের ভিন্ন ভিন্নমুখী স্বার্থ নিয়েই তার মধ্যে ক্রিয়াশিল ছিল। জোটের মূল নেতৃত্ব ছিল জার্মানী ও ফ্রান্সের হাতে। তাদের স্বার্থের মধ্যে বেশ কিছু বিরোধ থাকলেও মোটের ওপর একটা বোঝাপড়াও বজায় ছিল। ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের অন্য দেশগুলো তাদের নেতৃত্ব মেনে চলতেও অনেকটা বাধ্যই হয়। ১৯৯০ দশকের পর থেকে এই ইইউকেও ক্রমশঃ পূর্ব্বদিকে প্রসারিত করার চেষ্টা শুরু হয়। প্রথম দফায় পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরী, চেক প্রজাতন্ত্র, শ্লোভাকিয়া ও পরের ধাপে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলিকে এই জোতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে একদিকে যেমন ইউরোপীয় যৌথ বাজারের আয়তন বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায়, তাকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিও যথেষ্ট পরিমাণেই বেড়ে ওঠে। ফলে এর সদস্যপদও যথেষ্টই লোভনীয় হয়ে ওঠে। উক্রাইন, তুরস্ক, প্রভৃতির কাছেও এর সদস্য হয়ে ওঠা একধরনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু ইইউ’এর মধ্যে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নে দ্বন্দ্বও প্রকট। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে— ন্যাটোর পূর্ব্বদিকে বিস্তার নিয়ে কারুর তেমন কোনও আপত্তি না থাকলেও উক্রাইনের তাতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবে জার্মানী ও ফ্রান্স আপত্তি জানায়। এর পিছনে আছে আসলে ন্যাটোকে নিয়ে এই দুই শক্তির ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। ইউরোপের মূল অর্থনৈতিক ইঞ্জিন হল জার্মানী। অভিন্ন ইউরোপীয় মুদ্রা ইউরোর প্রধান নিয়ন্ত্রক তারাই। ইউরোপের সমগ্র বাজার মূলতঃ তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে গেলে ও পৃথিবীর অন্যান্য অংশে তার বিস্তার ঘটাতে গেলে সামরিক শক্তির এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। কিন্তু এইক্ষেত্রে জার্মানীর একটা মুশকিল আছে— তার ইতিহাস। ফলে সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করে তাদের সরাসরি সামরিকীকরণের পথে পা বাড়ানো খুবই অসুবিধের। তাতে বিশ্ব এবং বিশেষত ইউরোপীয় জনমানসে এত বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরী হবার সম্ভাবনা, যা এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়। তাই তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট যথেষ্ট হলেও এবং সামরিক গবেষণা ও প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত হওয়া সত্ত্বেও নিজস্ব বিশাল সামরিক বাহিনী বা পরমাণু অস্ত্র তৈরীর দিকে সে পা বাড়াতে পারেনি। সেই কারণেই ন্যাটোর আড়াল তার পক্ষে খুবই কার্য্যকর। এতে তার নিরাপত্তা ভালভাবেই রক্ষিত হয়, বিশ্বের নানা স্থানে ন্যাটোর আগ্রাসনের আড়ালে সে ধীরে ধীরে তার নিজের সামরিক বাহিনীকেও তৈরী করতে পারে, সামরিক গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়, সামরিক প্রযুক্তিকে পরীক্ষা ও প্রয়োগ করে দেখাও সম্ভব হয়। যেমন আফগানিস্তানে তারা নিজ বাহিনী পাঠানোর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর পরে তাদের সেনার বিদেশে পা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সাংবিধানিক ও আইনগত বাধা ছিল, তাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়; তাদের রাইনমেটাল কোম্পানীর তৈরী বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন সাঁজোয়া আক্রমণযানের সফল পরীক্ষা ও প্রয়োগও হয় এই আফগানিস্তানের মাটীতেই।
কিন্তু ন্যাটোর এই আড়াল তাদের কাছে এখন কিছুটা অসুবিধারও। কারণ এই সামরিক জোটের মূল নেতৃত্ব আমেরিকার হাতে। ফলে এই জোটের নেতৃত্বে থাকতে হলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইউরোপে এই জোটের বৃহত্তম অংশীদার ব্রিটেনের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্পে নিজ স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েও জার্মানীর অনুমতি ঝুলিয়ে রাখতে বাধ্য হওয়া। তাই ন্যাটোতে থাকলেও তার প্রতি সে খুব একটা আন্তরিক নয়। চুক্তি অনুযায়ী ন্যাটোভুক্ত যে কোনও দেশের মোট বাজেটের অন্তত ২ শতাংশ ন্যাটোর পিছনে খরচ করার কথা। অথচ বিগত বেশ ক’ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে— জার্মানী কখনওই তা খরচ করছে না। গত বছরও সে এই খাতে খরচ করেছে, তার মোট বাজেটের মাত্র ১.৪ শতাংশ। এই নিয়ে আমেরিকার প্রবল ভর্ৎসনার মুখেও পড়তে হয় জার্মানীকে। কিন্তু তাতেও জার্মানীর মনোভাব খুব একটা পাল্টায়নি। এবারও জানুয়ারী মাস পর্য্যন্ত, যখন রাশিয়ার হুমকির মুখে উক্রাইনকে আমেরিকা, ব্রিটেন, এস্তোনিয়া ও অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত দেশ থেকে বিপুল সামরিক সাহায্য পাঠানো হচ্ছে বা তার কথা চলছে, জার্মানীর পক্ষ থেকে সাহায্য হিসেবে পাঠানো হয়েছিল মাত্র পাঁচ হাজার হেলমেট। প্রায় হাস্যকর এই সাহায্যের সাফাই হিসেবে বলা হয়েছিল, জার্মানী বিদেশে নীতিগতভাবে কোনও অস্ত্র সরবরাহ করে না (তাহলে আফগানিস্তান বা সার্বিয়া, বসনিয়াতে কী ঘটেছিল?)।
আসলে জার্মানী অনেকদিন ধরেই তাদের নিজেদের অতি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার ফিকির খুঁজছে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এবং গোটা ইউরোপের অর্থনৈতিক কর্ত্তৃত্বের মূল অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্খা পূরণের প্রশ্নে নিজস্ব শক্তিশালী বাহিনী না থাকা তার কাছে বড় এক বাধা। ইউরোপেও সে শক্তিশালী ফরাসী বাহিনীর কর্ত্তৃত্বকে ঠেকিয়ে রাখতে কৌশলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতিকে ব্যবহার করে। আবার পাশাপাশি একটা আলাদা ইউরোপীয় যৌথ বাহিনীর কথা মাঝেমাঝেই হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে তার আড়ালে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধীন বাহিনী প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। এবারের উক্রাইন যুদ্ধ কিন্তু তার সামনে এক বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। রুশ জুজুর ভয় দেখিয়ে রাতারাতি তারা এবার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওঠে সরাসরি সামরিকীকরণের কথা ঘোষণা করেছে। বুন্দেশ কানৎসলার (চ্যান্সেলর) ওলাফ শোলৎস বুন্দেশস্টাগে (জার্মান পার্লামেন্ট) ঘোষণা করেছেন ১০০ বিলিয়ন ইউরো বা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৮ লক্ষ ৬০ হাজার টাকার সামরিক বাজেটের কথা। ঠিক বিশ্বের একেবারে বিপরীত প্রান্তে জাপানেরই মত। তারাও সমস্ত দ্বিধা ভুলে এবার সরাসরি পরমাণু অস্ত্র তৈরীর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে। অজুহাত সেই একই— রুশ জুজু।
১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েতের পতনের পর থেকে আমরা শুনে এসেছি এক একমেরু বিশ্বের কথা। একমেরু, কিন্তু তাতে যুদ্ধের ঘাটতি ছিল না। ছোট ছোট বহু দেশ সেখানে বারে বারে হয়েছে আক্রমণ ও ধ্বংসের স্বীকার— সে ইরাক থেকে লিবিয়া, সোমালিয়া থেকে সার্বিয়া, তালিকা রীতিমত লম্বা। আজ আবার পৃথিবী হঠাৎই বহুমেরুর মুখোমুখী। আর এই মেরুগুলি সবক’টিই সাম্রাজ্যবাদী। অন্যের ওপর নিজেদের দখল কায়েম করাই তাদের মূল লক্ষ্য। এদের প্রতিটি পদক্ষেপ ভাল করে লক্ষ্য করে তার বিরুদ্ধে দুর্ব্বার গণ আন্দোলন গড়ে তুলে তাকে প্রতিহত না করা গেলে বিপৎ আমাদের সবারই। সেই কাজে আজ এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকেই— সাধারণ মানুষকে, দেশে দেশে। যেমন মানুষ পথে নেমেছে আজ মস্কোতে, বার্লিনে, পৃথিবীর আরও বহু জায়গায়। শান্তির দাবীতে, যুদ্ধ বন্ধের দাবীতে, নিজ নিজ দেশের সরকারকে বাধ্য করতে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে। কঠিন কাজ— অবশ্যই। কিন্তু যুদ্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কবেই বা খুব সহজ কাজ ছিল?
দামিনী সেন রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, রুশ-উক্রাইন সংঘর্ষ ও বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।