ইতিহাসে দেকার্তের স্থান
পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দার্শনিক আর ঐতিহাসিক এক বাক্যে মেনে নেবেন যে দেকার্ত আধুনিক দর্শনের জনক— অন্ততপক্ষে এ-সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক। ‘দর্শন জ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রে অগ্রসরমানতার পথ দেখায়’— এই আপ্তবাক্য মেনে নিলে, খুব স্পষ্টভাবে সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাকে ডিঙ্গিয়ে দেকার্তের চিন্তাকে গ্রিসে জ্ঞানের উন্মেষ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেকার্ত বিষয়ে কোনো আলোচনা যথাযথভাবে শুরু করা যেতে পারে যদি তাঁর সুখ্যাতির কারণগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, আর স্থির করা যায় কোন অর্থে আর কতটুকু পরিমাণে সেগুলো যুক্তিপূর্ণ।
দেকার্ত ছিলেন এমন সময়ের মানুষ যখন পৃথিবীতে বৃহৎ সব পরিবর্তন ঘটে চলেছে, মধ্যযুগিয় সমাজে ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া চলছে আর খ্রিস্টিয় পুরোহিততন্ত্র শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে টুকরো হতে হতে গোষ্ঠিগুলো পরস্পরের বিপরিত অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। টমাস একুইনাস, ডুন স্কোটাস, উইলিয়ম অব ওকাম প্রমুখ আরো অনেকে বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রবল আকর্ষণের ফলে প্রকৃতপক্ষে চার্চের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহে নেমে পড়েছেন। প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের উত্থানে চার্চ-সাম্রাজ্যের একাংশ ভেঙে পড়েছে, রেনেসাঁসের অভিঘাতে পুনর্জাগরিত হচ্ছে হেলেনিক গ্রিক দর্শনের অনেক ধারণা, নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে পরলোকের চাইতে ইহ-জগতের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে এবং মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে জ্ঞানের প্রসার আগের যেকোনো সময়ের চাইতে ব্যাপকতর হচ্ছে।
দেকার্ত কিংবা সপ্তদশ শতকের শুরুর সময়ের অন্যকোনো শক্তি-সমাবেশ মধ্যযুগের পতনের একক কারণ নয় বরং এই যুগের অন্তর্গত সংকটেই তা বিলুপ্ত হয়েছে আর এই সংকটের শুরু হয়েছে বেশ কয়েক শতাব্দি আগে থেকেই।
দেকার্তকে যদি পুরোনো ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য দায়ি করা না যায়, তবে নতুন সৃষ্টির জন্য কৃতিত্বও তাঁকে দেয়া যায় না। অনেক ঘটনা-পরম্পরা আর মনিষা স্থির করেছে মধ্যযুগের অবসানের পরে ইউরোপিয় সভ্যতা কোন পথ নেবে : রজার বেকন, ফ্রান্সিস বেকন, হব্স, ম্যাকিয়াভেলি এবং মন্টেইগের মতো দার্শনিক; কোপারনিকাস, ব্রুনো, কেপলার এবং গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানি; ওয়াইক্লিফ, লুথার কেলভিন প্রমুখ ধর্মসংস্কারকদের সাথে নতুন নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের মতো ঘটনা, চিত্রকলা এবং মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার, তার সাথে হেলেনিক সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ একসাথে প্রভাবিত করেছে ভবিষ্যৎ ইউরোপিয় চিন্তাকে। এতসব ঘটনাকে দেকার্তের সুবিশাল অবস্থানের কাছে খাটো করা উচিত নয়। এসব স্বীকার করে নিলেও এটা সত্য যে, আধুনিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে দেকার্তের অবদান এক্ষেত্রে অসামান্য। দেকার্তের অবদান এমন যে, তা যেকোনো একক ব্যক্তি, কোনো ক্ষুদ্রগোষ্ঠি বা কোনো ঘটনাবলির অবদানকেও বহু পেছনে ফেলে যায়। দেকার্তের প্রভাবকে প্রধানত ছয়টি মূলধারায় সংবদ্ধ করা যায়।
প্রথমত তাঁর সমসাময়িক অনেকের মতো দেকার্ত কর্তৃত্ববাদকে (Authoritarianism) অবিশ্বাস করতেন এবং সত্যানুসন্ধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষের নির্ভুল যুক্তির ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। অন্যদিকে নেতিবাচকভাবে বলতে গেলে দেকার্ত আংশিকভাবে রোমান ক্যাথলিক কর্তৃত্ববাদের পড়ন্ত অবস্থার জন্য এবং মূলত ফ্রান্সে খ্রিস্টিয় পুরোহিততন্ত্রের বিরোধিতার জন্য দায়ি। আরেক ইতিবাচক দিকে তিনি প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদকে সমর্থন করেছিলেন যা সর্বোচ্চ অবস্থানে বসিয়েছিল মানুষের বিবেককে, যেটা আজকের গণতান্ত্রিক তত্ত্বের মূলনীতি। লক যেমন দেকার্তের গণতান্ত্রিক প্রবণতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন বাদ দিয়েছেন সহজাত ধারণার তত্ত্ব, একমাত্র যা থেকে উৎপত্তি হতে পারে অতিপ্রাকৃত নীতিতত্ত্ব বা এথিকস। হিউম লকের এথিক্যাল বিশ্বাসের ধারণাকে গ্রহণ করেছেন যা পরবর্তীকালে বিকশিত হয়েছে বেনথামের নৈতিকতা, রাজনীতি ও অর্থনীতির তত্ত্বে। নরথর্প The meeting of East and West-এ বিস্তৃত আলোচনায় বলেছেন যে আধুনিক আমেরিকাকে দেখা উচিত লকের দৃষ্টি দিয়ে আর আধুনিক ইংল্যান্ডকে মূলত বেনথামের দৃষ্টিতে। তেমনি ফরাসি রাজনৈতিক দর্শনও একইভাবে আলোকপ্রাপ্ত যুগের ফরাসি দার্শনিকদের চিন্তা দিয়ে প্রবলভাবে প্রভাবিত ও আলোড়িত হয়েছে। এই দার্শনিকরা আবার দেকার্তের দর্শন এবং আংশিকভাবে ইংরেজ দর্শন দিয়ে দারুণভাবে প্রভাবিত।
দ্বিতীয়ত আমাদের তালিকায় রয়েছে দেকার্তের যুক্তিবাদ (Rationalism) এবং বৈজ্ঞানিক আশাবাদ (Scientific Optimism)। তিনি নিশ্চিত, পৃথিবী মূলগতভাবে যৌক্তিক এবং বোধগম্য। সেকারণে একজন দার্শনিকের সঠিক প্রচেষ্টায় দর্শনের লক্ষ্য নিঃসন্দেহে অর্জন করা সম্ভব। সেজন্যই পরবর্তীকালে প্রায় আড়াই শতাব্দি ধরে দার্শনিকরা এমন সব ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন যা তাঁরা মনে করতেন পরম সত্যের (Absolute truth) কাছাকাছি। এভাবেই বিজ্ঞানের লক্ষ্য অর্জিত হবে এবং পৃথিবী একটা নিখুঁত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হবে বলে বিশ্বাস করা হত। দেকার্ত বিশ্বাস করতেন তাঁর জীবদ্দশাতেই এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। বিজ্ঞানের মাধ্যমে পৃথিবীর পুনর্জন্ম সম্ভব এই ধারণা ইতিহাসের আধুনিক পর্যায়ের পুরোটা সময় ধরে ক্রিয়াশিল ছিল। ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত মনে করা হত বিজ্ঞানের সর্বশেষ সাফল্য প্রায় নাগালের মধ্যে।
এমনকি দেকার্ত আধুনিক বিজ্ঞানের কয়েকটি পদ্ধতিও প্রচার করেছিলেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলতেন পৃথিবীর সমস্ত নিয়মকেই সার্বজনীন হতে হবে এবং একটি সাধারণ মৌলিক নিয়ম থেকে তা উৎসারিত হতে হবে। এর মানে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সাধিত হবে নতুন তথ্য বা উপাত্ত জানার মাধ্যমে নয়, ইতিমধ্যেই অন্যান্য ক্ষেত্রে যে জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তা আত্মিকরণের মাধ্যমে। যেমন নিউটন গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্রের সাথে যুক্ত করেছিলেন কেপলারের গ্রহসংক্রান্ত গতির সূত্র। তবে জ্ঞানের সূত্রগুলোর জোড়া দেয়ার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে যুগান্তকারি উদাহরণ হচ্ছে দেকার্তের নতুন বৈশ্লেষিক জ্যামিতি (Analytic Geometry)-যেটা তৈরি হয়েছে বীজগণিত এবং জ্যামিতিকে যুক্ত করে। এই অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম কেননা এই পদ্ধতি শুধুমাত্র অমিত বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার দুয়ারই খুলে দেয়ার উদাহরণ নয়, একই সাথে তা আধুনিক গণিতেরও ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে। বৈশ্লেষিক জ্যামিতি থেকে পরবর্তীকালে লাইবনিজ আর নিউটন যুগপৎ ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন এবং ক্যালকুলাসের ভিত্তির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক গণিতের কাঠামো যা এ যুগে প্রকৃতিকে জানার কাজে যুক্ত হচ্ছে।
দেকার্তিয় প্রভাবের তৃতীয় ক্ষেত্র হচ্ছে অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দর্শনশাস্ত্রের অগ্রসর হওয়া। আমাদের কাছে অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণের পদ্ধতি এত সহজাত যে, এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়নি সেটা বিশ্বাস করাই কষ্টকর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সংশয়বাদিদের বাদ দিলে গ্রিক এবং রোমানরা এই পদ্ধতিকে সামান্যই দার্শনিক মূল্য দিত। অন্যদিকে দেকার্তের পরে এই দেকার্তিয় পদ্ধতি ইংল্যান্ডে মনোবিদ্যার সাথে যুক্ত হল এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে ইংল্যান্ড তথা পাশ্চাত্যের দর্শনসমূহে তার উপস্থিতি দেখা যেতে লাগল। শিল্পরূপে তার প্রকাশ ঘটল Pointillism-এ, সাহিত্যরূপে এর স্ফুর্তি দেখা দিল ব্রাউনিংয়ের কবিতা আর জেমস জয়েসের উপন্যাসে। এই তালিকা ইচ্ছেমতো দীর্ঘ করা সহজ কেননা গত কয়েক শতকের চিন্তার জগতে সংখ্যাতীত ধারণা আর সৃষ্টিকর্মের পেছনে পাওয়া যাবে যুক্তিবাদ বা Reason।
চতুর্থত দেকার্তের দেয় সত্তার (self) অস্তিত্বের প্রমাণ এ প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এল যে সেই ‘নিশ্চিতভাবে অস্তিত্বময়’ সত্তার প্রকৃত রূপ কি? দেকার্তের যুক্তিতে কোনো স্পষ্ট প্রমাণ ছিল না যে এই সত্তা অমর এবং এর ফলে অমরত্বের যৌক্তিক অথবা অভিজ্ঞতা-নির্ভর প্রমাণের সেই পুরোনো আগ্রহ আবার সামনে চলে আসে। ঐতিহাসিকভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘সত্তার’ তো কোনো পূর্ণ নিশ্চয়তা নেই যে, পুরো জীবনকালে সত্তার প্রকৃতি একইরকম থাকে অথবা একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটি মাত্র সত্তাই অস্তিত্বময় থাকে। দেকার্তিয় দর্শনের এই মৌলিক অসঙ্গতির ফল তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ পায়নি যেহেতু মানুষ সাধারণত তার পূর্ব অভ্যাসগত ধর্মিয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশ্নহীনভাবে দেকার্তের দর্শনকে গ্রহণ করেনি। কেবলমাত্র বিংশ শতাব্দির শুরুতে স্মৃতিহীনতা বা দ্বৈত ব্যক্তিত্বের প্রমাণ আমাদের অভ্যাসগত চিরায়ত ধারণার মূলে আঘাত করল এবং ব্যক্তিত্বের প্রকৃতি এবং অস্তিত্বের পরিচয় আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে পৃথিবী অগ্রসর হল।
দেকার্তের পঞ্চম প্রভাব হচ্ছে অধিবিদ্যক (metaphysical) দ্বৈততার ধারণার প্রকাশের ক্ষেত্রে। এটা প্রবলভাবে আমাদের মানস-ঐতিহ্যে এমনভাবে লগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে দর্শনের শিক্ষা নেই এমন মানুষও মনে করতে লাগল দেকার্তিয় দর্শনই একমাত্র সত্য এবং অন্য সব দার্শনিক চিন্তা বরং স্বতঃসিদ্ধ সত্যকে অস্বীকার করছে। প্রাতিষ্ঠানিক দর্শনশাস্ত্রের কাছেও এই দেকার্তিয় দ্বৈততা তার দুর্বোধ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে মৌলিকভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই সত্তা এই বিশ্ব সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে এই বিশ্ব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে সুসংহত? বিশেষত যখন প্রায় সকল দার্শনিক এবং বিজ্ঞানি এ প্রসঙ্গে একমত যে অনেক অসংলগ্ন ঘটনার ভিড়ে, সকল ঘটনাই এক রকম? এবং কিভাবে ‘মন’ যা কোনো বিশেষ স্থানে অবস্থান করে না তা কোনো বস্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত করতে পারে? বা কিভাবে একটা বস্তুকণা যা নিজে থেকে কিছুই করতে পারে না তা মহাশূন্যে ঘুরে বেড়ায়, ধারণা তৈরি করে? এই জটিল সমস্যার উত্তর খোঁজা হয়েছে তিনটি মাত্রায় : বিজ্ঞানে, মহাকাশ বিদ্যায় এবং Ontology-তে (the branch of metaphysics, treating of the nature and essence of things) যদিও এই তিনটি বিষয়ই তাদের অগ্রসরমানতার ক্ষেত্রে একে অন্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
বিজ্ঞানের বিষয়ে দেকার্ত বিশ্বাস করতেন, বস্তুর গতির পরিমাণ অপরিবর্তনীয়, কিন্তু মন বস্তুর গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। কিছুদিন পরে স্পষ্টভাবে বোঝা গেল গতিজড়তার সূত্র ছাড়া বস্তুজগতের অন্যান্য সূত্রের সঙ্গে এই তত্ত্ব খাপ খায় না। কারণ গতির পরিবর্তন বলের প্রয়োগ ছাড়া ঘটে না, আবার সকল ক্রিয়ার সমান ও বিপরিত প্রতিক্রিয়া আছে। সেজন্য বিজ্ঞানের জ্ঞান প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বস্তু এবং মনের ক্রিয়ার দার্শনিক ব্যাখ্যা আরো বেশি ব্যাপক এবং তির্যক (Elaborate and indirect) রূপ নিল। কিন্তু মৌলিকভাবে কোনো ব্যাখ্যা তা যতই সূক্ষ্ম এবং জটিল হোক না কেন, এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারেনি কেননা বিজ্ঞানের ধারণায় বস্তুজগতের যেকোনো ঘটনার প্রয়োজনিয় এবং পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিজ্ঞান মনে করত এই প্রয়োজনের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা অবশ্যই যৌক্তিক অর্থাৎ বিশ্ব প্রকৃতির নিয়মই এমন যে, কোনো ঘটনা যৌক্তিকভাবে প্রকৃতি থেকেই উৎসারিত হয়। কিন্তু দেকার্তের মেটাফিজিক্যাল (অধিবিদ্যক) দ্বৈততা যদি সঠিক হয়, তবে একটি ফিজিক্যাল ইভেন্টের যৌক্তিক কারণ অন্য একটা ফিজিক্যাল ইভেন্ট ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এই দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রবলভাবে সমর্থিত হল কেননা একজন বৈজ্ঞানিক যখন আমাদের ইন্দ্রিয়ের পরিবর্ধিত রূপ হিসেবে পরীক্ষণের যন্ত্র ব্যবহার করেন, তা কোনো আধিভৌতিক কিছুর অস্তিত্বকে দেখতে পায় না এমনকি যদি তার অস্তিত্ব সত্যও হয়।
একইভাবে মনে সৃষ্ট ভৌত কার্যকারিতার বিরুদ্ধে কোনো যৌক্তিক সংস্কার কখনো গড়ে উঠেনি কেননা মনোবিদ্যা এবং সমাজবিজ্ঞান মূলত জ্ঞানের জগতে তখনো নবাগত এবং ভৌত বিজ্ঞানের তুলনায় তখনো খুব একটা সম্মানের আসনে ছিল না। তাই আধুনিক বিজ্ঞান বস্তুজগতে স্বর্গিয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং ভৌত ঘটনায় মনের প্রভাবের বিরুদ্ধে এক প্রবল সংস্কার নিয়ে গড়ে ওঠে। টেলিপ্যাথি, দ্বৈতসত্তা এবং সম্মোহনবিদ্যার বিরুদ্ধে বিপুল বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। আরো সোজা ভাষায়, মনের শক্তির তত্ত্ব প্রত্যাখ্যাত হল। মনোবিদ্যায় এর প্রভাবে মানুষের ধারণা এবং ইচ্ছার কোনো কার্যকারিতা থাকল না এবং ‘মস্তিষ্কের অবস্থা’ মনোবিদ্যায় ‘মনের অবস্থা’ বলে বিবেচিত হল। কিন্তু অন্যদিকে এটা আরেক প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। দেকার্তের মনোজগত বস্তুজগতের সমান গুরুত্ব ছিল। এখন ‘মন’ এমন একটা অবস্থায় পড়ল যখন তা নিজেই নিজের অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে অসমর্থ হল। এটা একটা পরিপূর্ণভাবে গুরুত্বহীন বিষয় হয়ে থাকল। Behaviorism (যে মতবাদ মনে করে মানুষের সমস্ত আচরণ বিশ্লেষণসাধ্য এবং কার্যকারণনীতি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে) সহজাত-প্রতিক্রিয়া এবং মনোবিদ্যার উদ্দিপন-প্রতিক্রিয়া অথবা প্রাণিসত্তা ও প্রতিবেশের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে পুনঃসংজ্ঞায়ন। জীববিদ্যার এই তত্ত্ব এমন ধারণার জন্ম দিল যে মনের বৈশিষ্ট্য বংশগত নয়। এ ধরনের সমস্ত ঘটনা উত্তরাধিকারজাত বলে মনে করা হল। আসলে সেটা কিছু অজানা শারীরবৃত্তিয় ঘটনাক্রমের ফল। এটা লক্ষ করা উচিত যে এ সমস্ত সংস্কার আসলে আংশিকভাবে দেকার্তিয় দ্বৈততার অবদান। কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা পদ্ধতিকে এককভাবে এজন্য কৃতিত্ব দেয়া যাবে না। বিজ্ঞানসম্মতভাবে দাবি করা হয় যেকোনো ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে, কারণটা আবশ্যিকভাবে জাগতিক এমন নয়। অধিকন্তু, এর ফলে উদ্ভূত মতবাদ বস্তুবাদ এবং Epiphenomenalism যা সবসময়ই যুক্তিবৃত্তিকভাবে আকর্ষণহীন ছিল, বিংশ শতাব্দির পদার্থবিদ্যার উন্নতির সাথে সাথে তা একেবারেই মূল্যহীন হয়ে পড়েছে।
মহাজাগতিক বিষয়ে মিথষ্ক্রিয়ার সমস্যা সম্পর্কে দেকার্তের উত্তর খুবই সাধারণ এবং তাঁর বক্তব্য স্পষ্টতই অপর্যাপ্ত। কেননা তাঁর বক্তব্য ছিল ‘ঈশ্বর সৃষ্টির প্রারম্ভে এভাবেই ইচ্ছে করেছিলেন’— সমস্যা সমাধানে দৈব সাহায্যের এই বিষয়টি আসলে কোনো কিছুরই ব্যাখ্যা দেয় না। কারণ তা সবকিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে— এই বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে, কোনো বিশেষ সুবিধার জন্য বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ঈশ্বর প্রকৃতির বিষয়ে অযৌক্তিকভাবে কাজ করবেন। দেকার্তের তত্ত্ব গুলিনকস এবং তাঁর অন্যান্য অনুসারিরা বিস্তৃত আলোচনা করেছেন ধর্মিয়ভাবে যাতে ঈশ্বরের ওপর পর্যায়ক্রমিকভাবে আরোপিত হয়েছে। মহাজাগতিক প্রশ্নে আরেকটি উত্তর হতে পারে যে, মিথষ্ক্রিয়ার অস্তিত্বই অস্বীকার করা যার কারণে এর দৃশ্যরূপ আসলে অলিক। কারণ ভৌতজগত এবং মনোজগত নির্ভুলভাবে সমান্তরাল। লাইবনিজ এই ধারণাকে আরও এগিয়ে নেন।
Ontological বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত মহাজাগতিক বিষয়ের সঙ্গে যেখানে দ্বৈততার সমস্যা মুখোমুখি হয় দ্বৈততা অস্বীকারের সঙ্গে। নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদের এক অস্বাভাবিক উপসংহার : ‘মন এবং বস্তু ভিন্ন’ এই তত্ত্বের অস্বীকার। লাইবনিজ এবং স্পিনোজা এটাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এর অনেক পরে আমরা পাই বহুত্ববাদ এবং আধুনিক Realism, যা এই একই সমস্যার উত্তর খুঁজতে উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে আদর্শ উপসংহার হচ্ছে ‘বস্তু অস্তিত্বহীন’ : বার্কলে এই উপসংহারের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিনিধি। এমনকি মলেব্রাশ এবং লাইবনিজকেও তাৎক্ষণিকভাবে ভাববাদি বলা যায় এবং ভাববাদ দ্রুতই দর্শনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা হয়ে উঠল। এভাবে দেকার্তের দ্বৈততা স্বাভাবিকভাবেই পথ খুলে দিল বিজ্ঞানের বস্তুবাদি ধারা এবং দর্শনের ভাববাদি ধারার।
ষষ্ঠ এবং শেষ ক্ষেত্র যেখানে দেকার্তের প্রভাব সহজে লক্ষণিয় তা হচ্ছে জ্ঞানতত্ত্ব। এখানে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব বিবেচনা করা যায়। প্রথমটি সত্যের সঙ্গে ঐক্যের তত্ত্ব। এ-তত্ত্ব অনুযায়ি কমপক্ষে কিছু ধারণা সত্য যতক্ষণ পর্যন্ত তা জগতের বাস্তবতার অবিকল প্রতিরূপ। দ্বিতীয়টি জ্ঞানের ত্রিমাত্রিক উৎস। দেকার্তের মতে অনুমানের মাধ্যমে জ্ঞানের অর্জন সম্ভব, কেননা আমাদের স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট ধারণা আছে কোনটা অবশ্যই সত্য হবে। লক্ষ করুন ধারণা এখানে বিচার্য বিষয়, সংবেদন নয় : জগত সম্পর্কে স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট জ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞান, শুধুমাত্র বস্তুর বাহ্যিক রূপকে গ্রহণ নয়। কিন্তু বাহ্যিক রূপ অথবা অভিজ্ঞতালব্ধ উপাত্ত স্পষ্টভাবে আরেকটি তথ্যের উৎসের সাথে আছে। অন্তর্দৃষ্টি এবং শরীরের ভিতরের অনুভূতি আর বাইরের ইন্দ্রিয়ের সংবেদন। যখন আমাদের কোনো পূর্বজ্ঞান থাকে, অন্যান্য জ্ঞান তা থেকে সংশ্লেষ করা যায়। জ্ঞানলাভের এই তিন পদ্ধতি আবশ্যিকভাবে স্বতন্ত্র নয়। আমরা যদি বিবেচনা থেকে প্রকাশিত সত্য এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে দেকার্তের যুক্তিকে বাদ দেই, যা বিশেষ একটা সমস্যা সৃষ্টি করছে, তাহলে এটা বলা সম্ভব যে অনুমান অথবা স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা সবসময় একট মধ্যবর্তী উপাত্ত অথবা উপসংহার নিয়ে কাজ করে। এভাবে সত্য অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতাবাদি এবং যুক্তিবাদি পথ দেকার্তের যৌক্তিক পদ্ধতির দুইটি ধারা হতে পারে। যদি তা না হয়, তবে অনুমান করা যায় অলৌকিকত্ব এক পূর্ব-অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানতত্ত্বে তা ভয়াবহ যেমন মেটাফিজিকসে সমস্যা সমাধানে দৈব সাহায্যের বিষয়টি (Deus ex mehina)। কিন্তু দেকার্ত এই অলৌকিক প্রজ্ঞাকে বাতিল করুন অথবা না-ই করুন তা কিন্তু তাঁর দার্শনিক তত্ত্বের সরাসরি বিপরিত ছিল এবং চূড়ান্তভাবে দেকার্তকে অস্বীকার করা লকের জন্য অত্যন্ত সহজ পদক্ষেপ হয়েছিল। লক আবার অন্য পথ ধরেছিলেন এবং সমস্ত জ্ঞানকে দেকার্তের চেয়ে এক কঠিন বিপন্ন অবস্থায় ফেলেছিলেন। এ-তত্ত্বে পরবর্তীকালে বার্কলে এবং হিউম স্বচ্ছতা এনেছিলেন। দেকার্তের ‘ঐক্যের তত্ত্ব’ অনুসারে একটি ধারণা কেবলমাত্র আরেকটি ধারণার অবিকল প্রতিরূপ হতে পারে এবং কখনই সম্পূর্ণভাবে এই বস্তুজগত থেকে ভিন্ন কিছু নয়। এজন্যই বার্কলের ভাববাদ একটি যৌক্তিক পরিণতি। আরো বিশ্লেষণে দেখা যায় ধারণাকেও চিন্তাশিল সত্ত্বা অথবা ঈশ্বরের প্রতিরূপ হতে বাধা দেয়া হয়েছে যাতে বার্কলের অবস্থান হিউমের সংশয়বাদি অবস্থানকে পথ করে দেয়। লকের দর্শন দেকার্তের পিছুটানকে পরিত্যাগ করে এই উপসংহারকে অবশ্যম্ভাবি করেছিল। দেকার্ত শুধুমাত্র দাবি করেছিলেন যে কিছু ধারণা ‘ঐক্যের তত্ত্ব’ দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এর সাথে লক হিউমের সংশয়বাদিতার আরো সরাসরি পথ বাতলে দিলেন : যদি ইন্দ্রিয়লব্ধ হয়, তবে স্পষ্টভাবে বলা যায় আমাদের ইন্দ্রিয়ের তথ্য ছাড়া কোনো তথ্য নেই এবং জাগতিক, মানসিক এবং যৌক্তিক তত্ত্বের বাতিল করতে হবে। পরিশেষে সমস্যাটা এখানে এসে এই দাঁড়াল যে, এক্ষেত্রে হিউমের সমস্যা পরিষ্কারভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এটাই পরবর্তীকালে জার্মান ভাববাদের পথ তৈরি করে কান্টের পথে নিয়ে যায় এবং আধুনিক প্রবণতায় বিজ্ঞান এবং দর্শনে অন্যান্য সবকিছুর আগে পদ্ধতির সমস্যা বিবেচনায় নেয়।
দেকার্ত এবং বিজ্ঞান
ইতিহাস দেকার্তকে একজন দার্শনিক হিসেবে এবং আধুনিক গণিতের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সত্যি কিন্তু তাঁকে বিজ্ঞানি হিসেবে স্বীকার করতে ইতিহাস সে পরিমাণে অকুণ্ঠ নয়।
যদিও দেকার্ত নিজেকে ততটুকুই বিজ্ঞানি মনে করতেন, যতটুকু নিজেকে গণিতজ্ঞ অথবা দার্শনিক মনে করতেন। তিনি অন্য যেকোনো পরিচয়ের চাইতে বিজ্ঞানি পরিচয়ে গর্ববোধ করতেন। আমরা তাঁর ‘ডিসকোর্স’-এর প্রকাশ করা সম্পর্কে দেখানোর চেষ্টা করব যে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর গণিত বা দর্শনের মেধার চাইতে কোনো অংশে কম ছিল না। দেকার্তের বিজ্ঞানকর্মকে অনুমান-নির্ভর বলা, অনেক পরীক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়া এবং সামান্য কটি অপ্রমাণিত তত্ত্ব দেয়ার জন্য সমালোচনা করা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সমালোচনাগুলো কিভাবে করা হয়েছিল এবং প্রচুর অপব্যাখ্যার পর কিভাবে তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল সেটা বোঝার জন্য এই সমালোচনাগুলোতে আমাদের জন্য পর্যাপ্ত সত্য নিহিত আছে।
প্রথমত, দেকার্ত তাঁর শরীরতত্ত্বে এবং নিজের আচরণে দেখিয়েছিলেন যে তিনি একজন ভাল নিরীক্ষক। কেউ যদি তাঁর লেখা মাঝে মধ্যেও পড়ে থাকেন তিনি লক্ষ করবেন প্রায়শই কোনো বিশেষ পরীক্ষণের নিখুঁত বর্ণনা এমন যেন পাঠক এইভাবে পরীক্ষাটি করলে ঠিক ঠিক এই সব ফলাফল পাবেন। কিছু ক্ষেত্রে দেকার্ত স্পষ্টভাবে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন যা তিনি পর্যবেক্ষণ করেননি। এই সামান্য কয়েকটি বিষয় ছাড়া দেকার্তের তথ্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভুল। যখন আমরা দেখতে পাই যে, কিছু তত্ত্ব আমাদের কাছে প্রায় নির্ভুল বলে প্রতিভাত হয়, তবে বেশিরভাগ একেবারেই ভুল এবং কয়েকটি অসম্ভব— সেগুলোই অনুমানের মাধ্যমে কোনো উপসংহারে পৌঁছুতে সাহায্য করে এবং পরবর্তীকালে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। সেক্ষেত্রে একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, আমরা অনুমানের মাধ্যমে নয় বরং ব্যাখ্যার মাধ্যমে তা স্থির করেছি। সমস্ত সত্যকে অবশ্যই নিরীক্ষা দিয়ে প্রমাণিত হতে হবে (অনুমেয় যে দেকার্ত নিজের প্রসঙ্গেই একথা বলেছেন কেননা তিনি ষষ্ঠ অধ্যায়ে প্রস্তাবনা করেছেন যে সমস্ত পরীক্ষা অন্যরা করে দেখেন সেগুলো তিনি অবশ্যই নিজে করে দেখবেন) এবং যে সমস্ত তত্ত্ব একটি হাইপোথিসিসের প্রতিনিধিত্ব করে, তা তৈরিই হয়েছে সত্যকে বা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য। তা পূর্ব-অভিজ্ঞতা (a priori) প্রসূত সত্য নয় যা থেকে সত্য অনুমিত হবে।
কিন্তু যদি দেকার্ত সত্যিই একজন অভিজ্ঞতাবাদি এবং নিরীক্ষক হতেন, তাহলেও এটা বলা যায় যে তাঁর অভিজ্ঞতাবাদে র্যাশনালিজমের ছোঁয়া ছিল যা দুই বা তিনভাবে আধুনিক বিজ্ঞানিদের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র করেছে। প্রথমত, দেকার্তের মতে অভিজ্ঞতাবাদি পদ্ধতি সকল জ্ঞানের জন্য যথার্থ পদ্ধতি নয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ থাকলেও, সততার সাথে হোক বা না হোক, চার্চের মতকে বিশ্বাস করতে হবে এটাই ছিল দেকার্তের মত। এরপরে কিছু দার্শনিক জ্ঞান আছে অথবা জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান আছে যা শুধুমাত্র সাধারণ অভিজ্ঞতার ওপরে নির্ভর করে, কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতার ওপরে নির্ভর করে না। সে কারণে তাকে বলা যেতে পারে অভিজ্ঞতা পূর্ব-সংবেদন (sense a priori) এবং যা চরিত্রগতভাবে অনুমাননির্ভর। ‘এভাবেই দেকার্ত যখন বিশেষ-বিশেষ অনুমান করতে গেলেন তখন যেমন ঈশ্বর, রজ ও মনের প্রকৃতিকে জানলেন তেমনি স্থান, কাল ও পদার্থবিদ্যার কিছু সাধারণ সূত্রকেও জানতে পারলেন। এতে বিভিন্ন সম্ভাবনার বাস্তব বিষয় সামনে এল, যা থেকে প্রতীতি হল অনুমানের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।’ প্রয়োজনিয় হয়ে উঠল ‘কার্য’ দেখে কারণ আবিষ্কার করার এবং অনেক নিরীক্ষারও। দেকার্তিয় দর্শন ও বিজ্ঞানের মতে দেকার্তিয় ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে দ্বিতীয় তফাৎ আমরা হয়ত আবিষ্কার করব, তা হচ্ছে ‘যুক্তি’। বেকন এবং মিলের মতো দেকার্ত চিন্তা করেছিলেন যে, কোনো ঘটনার পিছনে কারণের এক দীর্ঘ তালিকা তৈরি করা যায়। কোনটি আসল কারণ তা বের করার জন্য নিরীক্ষার প্রয়োজন। নিরীক্ষাই ভুল কারণগুলোকে বাদ দিয়ে আসল কারণকে বের করে আনবে। যেহেতু কয়েকটি অনুসিদ্ধান্ত এর থেকে বেরিয়ে আসে : সমস্ত সম্ভাব্য কারণ আমরা অনুমান করি। জগৎ যৌক্তিক যেমন আমরা, এবং বিজ্ঞানের নিয়মগুলো সূক্ষ্ম, জ্ঞেয় এবং উপলব্ধিযোগ্য। যখন আবিষ্কৃত, তখন তা সমস্ত সম্ভাবনার মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তাই অবশ্যম্ভাবি। বিজ্ঞানের নিয়ম সম্পর্কে আধুনিক ধারণার কোনো ইংগিত দেকার্ত দেননি। আধুনিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি সত্যের সন্নিকটে যাওয়ার একটা প্রক্রিয়া এবং মানুষের ক্রমাগত অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমে আগের সূত্রকে সত্যের আরো নিকটবর্তী তত্ত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপন করা। একইভাবে, কয়েকটি সম্ভাবনার মধ্যে একটিকে বেছে নিলে নিশ্চয়তা অর্জন করা যায় এবং সেই বিশেষ বিষয় সম্পর্কে আরো অনুসন্ধানের প্রয়োজন ফুরায়। তাই আধুনিক বিজ্ঞানিরা শ্রদ্ধার সঙ্গে দেকার্তের বৈজ্ঞানিক কাজগুলো পড়তে পারেন তাঁর অর্জনের জন্য, তার ভুলগুলোকে মেনেও নিতে পারেন। কিন্তু তাঁরা আশ্চর্য হন তাঁর আত্মবিশ্বাসে। দেকার্ত যেমন করতেন, একজন আধুনিক বিজ্ঞানিও তেমনি তার একটি হাইপোথিসিস শতবার পরীক্ষা করবেন এবং প্রায় ক্ষেত্রেই মানুষের সামনে আরও সুনিশ্চিতভাবে আপাত স্থিরিকৃতরূপে উপস্থাপন করবেন। যখন একক বিজ্ঞানি সম্পর্কে কথা বলা হচ্ছে, দেকার্তের সময় থেকে বিজ্ঞান সেই প্রজ্ঞা অর্জন করেছে যা সক্রেটিস নিজের ওপর আরোপ করেছিলেন।
এই আচরণের আরেক পরিণাম এই ধারণা যে, বিজ্ঞানের দায়িত্ব সসীম এবং তা সম্পন্ন হবে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে। এটাই ছিল বেকনের ধারণা এবং ঊনিশ শতকের মধ্যভাগের পরেও তা প্রচলিত ছিল। উল্লিখিত সময়সীমার অনেক আগেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে বিরাট উল্লম্ফন ঘটেছিল, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত রহস্য ভেদ করার মতো এবং অনুগামিদের সামান্য কয়েকটি ছেঁড়াখোড়া অংশ যোগ করা ছাড়া আর কোনো অর্জনের বিষয় অবশিষ্ট ছিল না। অনুগামিদের এই সান্ত¡না থেকে গেল যে, প্রকৃতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে, সমস্ত বিপদ, রোগবালাইকে পাশ কাটানো গেছে, জীবন আরো স্বচ্ছন্দ আর আয়েশের হয়েছে এবং তা দ্রুততার সাথে পরিচ্ছন্ন এবং অলংকৃত হয়ে এই পৃথিবীতে প্রবহমান। কিন্তু তিন শতাব্দির বৈজ্ঞানিক আশাবাদের মধ্যে দেকার্ত স্পষ্টভাবেই আশাবাদিদের রাজা। তিনি অনুভব করতেন যে, ইতিমধ্যেই তিনি জ্ঞানের সম্ভাব্য সমস্ত ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রেখেছেন এবং তাঁর আশা ছিল বাকি জীবনে তিনি অবশিষ্ট কাজটুকু সেরে যেতে পারবেন। এ কাজের জন্য দরকার ছিল অর্থ যা দিয়ে তিনি প্রয়োজনিয় পরীক্ষাগুলো সারতে পারবেন এবং ১৬৩৭-এ প্রকাশিত যে চারটি লেখা এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত তা আর কিছুই না বরং জ্ঞানের জগতে আগ্রহি সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এক ইশতেহার যেন তাঁরা দেকার্তের এই উদ্যোগে অর্থায়ন করেন। তিনি বলেন, ‘এখানেই পদ্ধতি, যা আমি অপটিকস, ধাতুবিদ্যা এবং জ্যামিতিতে আবিষ্কার করেছি তার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র এবং এটা প্রমাণ করার জন্যই যে এগুলো আমার হাতে কত সার্থক।’
আপনি যদি আমার উদ্যোগকে অর্থায়ন করেন, আমি আপনাকে একই রকমের সফলতার আস্বাদ দিতে পারি; সম্ভবত এটাই প্রকৃতি এবং মানবজীবনের সুখের চাবিকাঠি এবং এভাবেই ‘ডিসকোর্স অন মেথড’ বোঝার জন্য আমরা সকল বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করব।
‘ডিসকোর্স অন মেথড’-এর একটি অংশ নিবেদিত তার পরবর্তী মূল্যবান দর্শনের রূপরেখা বর্ণনায় যার নাম মেডিটেশন অন ফার্স্ট ফিলসফি। আমরা ইতিমধ্যেই তাঁর জ্যামিতির উল্লেখ করেছি যার অবদান অনস্বীকার্য। কারণ এটা শুধু গণিতের এক নতুন ক্ষেত্রের সূচনা বা আধুনিক গণিতের মূলধারা তৈরিতে নয় বরং গ্রিক সভ্যতার পরে গণিতের জগতে আরো অগ্রসর চিন্তার পথিকৃৎ এবং প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এছাড়াও তা গণিতের সম্ভাবনায় অতি প্রয়োজনিয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। উপস্থাপন করেছিল সেই ধারণাকে যে, জ্ঞানের যেকোনো ক্ষেত্রের অগ্রযাত্রা সম্ভব হতে পারে জ্ঞানের ইতোমধ্যেই অর্জিত খণ্ডাংশগুলোর একত্রিকরণের মাধ্যমে। এবং তা গতির বিশেষণের এক অনুপম মাধ্যম হয়ে উঠল।
দেকার্তের বৈজ্ঞানিক অর্জনগুলো ‘ডিসকোর্স অন মেথড’ অপটিকস এবং আবহবিদ্যায় ছড়িয়ে আছে। দুঃখজনকভাবে ডিসকোর্স অন মেথডে তার যে অংশটুকু অন্তর্ভুক্ত সেটা উল্লিখিত তিনটির মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। দেকার্তের এ্যানাটমি যথেষ্ট নির্ভুল কিন্তু তিনি শরীরের উত্তাপকে শারীরিক কর্মকাণ্ডের ফলাফল হিসেবে না দেখে সবকিছুর আদিকারণ হিসেবে দেখেছেন। এতদসত্ত্বেও, দেকার্তকে শারীরিক কর্মকাণ্ডের ভুলভাবে ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট ভুল বোঝা হলেও তাঁর ব্যাখ্যা একেবারে অসম্ভব কিছু নয়, বরং তা স্টিম ইঞ্জিন এবং অন্তর্দহন ইঞ্জিনের ভিতরের দহনকার্যের মূলনীতির পূর্বাভাস দেয়।
অপটিকস-এ দেকার্তের যে মূল অর্জনগুলোর ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা হচ্ছে আলোর তরঙ্গতত্ত্ব, গতির ভেক্টর বিশ্লেষণ, রিফ্রাকশনের sine সূত্র, হ্রস্বদৃষ্টি এবং দূরদৃষ্টির প্রথম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, প্রথম লেন্সের ব্যাখ্যা, প্রথম স্ফেরিকেল বিচ্ছুরণ সনাক্ত করা এবং তা সংশোধনের পদ্ধতি, টেলিস্কোপের আলোক সংগ্রহের ব্যাখ্যা, আইরিস ডায়াফ্রামের নীতি, ড্র-টিউব টেলিস্কোপিক ফাইন্ডার, অনুবিক্ষণ এবং প্যারাবোলিক আয়নার সঙ্গে আলোকোজ্জ্বল করার যন্ত্রের ব্যবহার।
আবহবিদ্যায় তাঁর অর্জনগুলো হচ্ছে : কোনো ঘটনার ব্যাখ্যায় তিনি স্বর্গিয় হস্তক্ষেপের ধারণা পরিত্যাগ করেছিলেন। তাপের গতিসূত্র এবং চার্লসের তত্ত্বের পূর্বাভাস, সুনির্দিষ্ট তাপের ধারণা, তিনিই প্রথম তাঁর বায়ু, মেঘ, বৃষ্টি, তুষারপাত, শিশির এবং শিলাবর্ষণের পদ্ধতি ব্যাখ্যার মাধ্যমে আধুনিক আবহবিদ্যার রূপরেখা তৈরি করেন। তিনিই রংধনুর প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি প্রতিফলনের সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেন। তিনি প্রিজমের মাধ্যমে সাদা আলোর বিশ্লিষ্ট হওয়ার বর্ণনা দেন এবং স্টিস্পেকট্রোস্কোপ নামের এক যন্ত্র তৈরি করেন।
দেকার্ত এবং ধর্ম
দেকার্তের আলোচনায় আমরা আরো একটা মৌলিক সমস্যার মুখোমুখি হই আর তা হচ্ছে : দেকার্ত কতটুকু ধার্মিক ছিলেন? তিনি কি তাঁর সময়ের ক্যাথলিকদের মতো ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন?
উত্তর অত্যন্ত সহজ। দেকার্ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব গ্রহণ করেছেন, তার অস্তিত্বের প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন এবং ঈশ্বরকে তাঁর সমস্ত দর্শনের ভিত্তি করেছেন। ঈশ্বর সৃষ্টির প্রারম্ভে শুধু মন এবং বস্তু সৃষ্টিই করেননি বরং তাকে নিরন্তর অস্তিত্বময় রেখেছেন। দেকার্ত বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ধর্মিয় মতবাদগুলোকে সাধারণ সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে এবং গ্যালিলিওর হাইপোথিসিসের ওপর থেকে তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করেছিলেন যখন তিনি জেনেছেন যাদের বশ্যতা তিনি মেনে নিয়েছেন এবং তাঁর কাজের ওপরে যাদের কর্তৃত্ব তাঁর নিজের চিন্তার ওপরে নিজস্ব বিচারবুদ্ধির চাইতে তা কোনো অংশে কম নয়— তারা গ্যালিলিওকে অনুমোদন করে না। বিপরিততত্ত্ব যে দেকার্ত মূলত নিরীশ্বরবাদি ছিলেন, যুক্তির মাধ্যমে অন্তত তা প্রথম ধারণার চাইতে ভালভাবে প্রমাণের চেষ্টা করা যাবে। এই তত্ত্ব অনুসারে, দেকার্ত ছিলেন খাঁটি প্রকৃতিবাদি এবং এমন একটা সামাজিক অবস্থায় আবদ্ধ, যেখানে বিরুদ্ধবাদির চরম শাস্তি এমনকি মৃতুদণ্ড ভোগ করতে হয়। তাঁর শহিদ হওয়ার কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না এবং সে কারণেই তাঁর বিপদজনক মতামতগুলোকে এক ছদ্মবেশ দিয়েছিলেন আর অন্যগুলোকে অলংকৃত করেছিলেন এক ধার্মিকতা দিয়ে যা আমাদের এক ধরনের বর্ম হিসেবে দেখা উচিত। এই কাজটা সহজভাবে সম্পাদনের জন্য তাঁকে নিজের পদ্ধতিতে জোর করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আরোপ করতে হয়েছে, তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য মধ্যযুগিয় ধর্মতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা ধার করতে হয়েছে এবং ঈশ্বরকে এমন সব কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যা দেকার্তিয় দর্শনের মৌলিক তত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এভাবেই ঈশ্বরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রথমেই বিশ্বসৃষ্টির, মহাবিশ্বের পরিচালনার সমস্ত নিয়ম তৈরির এবং এই অবস্থান থেকে প্রকৃতিকে তাঁর সৃষ্ট নিয়মমতো চলার জন্য শুধুমাত্র সাহায্য করে যাওয়ার। এই নিয়মগুলো ছিল এমনভাবে তর্কাতীত যে, ঈশ্বর যদি একাধিক বিশ্বও সৃষ্টি করে থাকেন তবে সেখানেও এমন কোনো বিশ্ব থাকবে না যেখানে ঈশ্বরের এই নিয়মগুলো পালিত হবে না। দেকার্তের যুক্তির স্বপক্ষে অত্যন্ত অপ্রয়োজনিয়ভাবে ঈশ্বরের ধারণাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই তত্ত্বের প্রথম প্রয়োজনিয় ধাপ হচ্ছে : আমি আমার অস্তিত্বকে পরম নিশ্চয়তার সঙ্গে জানি। দ্বিতীয়, যেহেতু আমি অন্তত একটি বিষয় বাইরের কোনো কিছুর হস্তক্ষেপ ছাড়াই পরিপূর্ণভাবে জানতে পারি, তাই জ্ঞানের অবশ্যই একটা পদ্ধতি থাকবে যেখানে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে না এবং তার ভিত্তি হবে অবশ্যই ধারণার সুস্পষ্টতা। তৃতীয়ত যেহেতু আমার বস্তু এবং মনের সুস্পষ্ট ধারণা আছে, অবশ্যই তা অস্তিত্বময়। দেকার্ত দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপের মধ্যে এক ধরনের পাদটিকা যুক্ত করে বলতে চান (ক) দ্বিতীয় ধাপটি ভ্রান্ত হতে পারে যদি বিশ্ব কোনো অশুভ শয়তান পরিচালনা করে; (খ) এক অসীম ঈশ্বর অস্তিত্বময়; এবং অতএব অন্যতর পরামর্শ (ক) ভুল এবং মূলতত্ত্বের দ্বিতীয় ধাপটি সুতরাং পুনঃপ্রমাণিত। দেকার্তের যুক্তিতে ঈশ্বরের চরিত্র এবং অবস্থান এই ধারণারই জন্ম দেয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর আলোচনা অবিশ্বস্ত।
উপরন্তু, দেকার্ত যে একজন বিশেষ রকম ভিরু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তাঁর লেখা পড়ার সময় সেকথা অনুভব না করে পারা যায় না। তাঁর বক্তব্য কোনো মানুষকে অসন্তুষ্ট করতে পারে ভাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায়শই তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এটা বলার পরমুহূর্তেই কোনো বিষয়ে উল্টো কথা বলেছেন। দেকার্ত নিজের লেখায় এবং পদ্ধতিতে অভিনবত্ব আরোপ করতে গিয়ে ডিসকোর্সের শুরুতেই এই সমস্যায় পড়েছিলেন। তা না হলে ডিসকোর্স লেখার প্রয়োজনই পড়ত না।
আমরা আজকে যেমন দেকার্তকে সহজাত সৃজনী ক্ষমতার অধিকারি বলে মনে করি তাঁর সমসাময়িকদের অধিকাংশই তাই মনে করতেন এবং দেকার্ত নিজেও স্পষ্টভাবেই সেটা মেনে নিতেন। এসব সত্ত্বেও তিনি যথেষ্ট বিনয়ের ভান করতেন। তাই তাঁর রচনায় সবসময় ছদ্মবিনয় আর দম্ভের কৌতূহলের উদ্দিপক সহাবস্থান দেখা যায়। কাউকে অসন্তুষ্ট করার ভয় যেকোনো লেখকের চাইতে দেকার্ত বেশি পেয়েছেন এবং যতবার তিনি উৎকর্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন ততবারই ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ফলে পরস্পর-সংলগ্ন প্যারাগ্রাফেই স্ববিরোধি বক্তব্য পাওয়া যাবে। সেটি গুরুত্বহীন হলেও বিরক্তিকর এবং ডিসকোর্স লেখার উদ্দেশ্যে কমপক্ষে এমন একটি বড় ধরনের স্ববিরোধিতা আছে। ডিসকোর্সের প্রথম অংশে দেকার্ত অনেক বেশি নম্রভাবে নিজের পদ্ধতি আত্মজীবনীর মতো তুলে ধরেছেন, কেননা এর ভেতরে এমন কিছু উপাদান থাকতে পারে যা পাঠক নিজে ব্যবহার করতে পারেন। ডিসকোর্সের শেষ অংশে আমরা নম্র শুভারম্ভের এক কৌতুকপূর্ণ উদ্দেশ্য দেখতে পাই।
দ্বিতীয় বিচারের সময় গ্যালিলিও অসফলভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে, সত্য নয় বরং সম্ভাব্যতা তার লেখার মূল বিষয়। সেজন্য এটা অসম্ভব নয় যে দেকার্ত একইভাবে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করবেন এবং তিনি টুকিটাকি বিষয়গুলো সম্পর্কে তাই করেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমরা কিছুতেই বুঝতে পারি না তিনি চার্চের মতবাদকে কেন সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখছেন এবং এমন একটা সময়ে (তৃতীয় অধ্যায়) যখন ঈশ্বরের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ঈশ্বর পর্যায়ক্রমে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন (পঞ্চম অধ্যায়) তাঁর এই ধারণার সাথে সাদৃশ্য আছে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার। এমনও হতে পারে যে তার ঘূর্ণাবর্তের মতো মতবাদ, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের মতো গ্যালিলির সর্বনাশা তত্ত্বকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যেন তা চার্চের বিরোধিতার নামান্তর না হয়। এটা করতে গিয়ে তিনি গতির আপেক্ষিকতার মতো প্রাচীন মতবাদ আবিষ্কার করেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে এটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয় না যে দেকার্তের ঈশ্বর সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় আসলে দর্শন নয় বরং তা একটি কৌশল।
এ পর্যন্ত যে যুক্তিগুলো আলোচনা করা হল সেগুলো ছাড়াও এটা বলা যায় যে, একজন সচেতন পাঠক ডিসকোর্স পড়ে প্রভাবিত হবেন এটাই সম্ভবত সবকিছুর চাইতে বড় প্রমাণ। দুইটি চরম প্রান্তবর্তী অবস্থার মধ্যে যখন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন হয় সাধারণত তখন অনেকগুলো মতবাদ তৈরি হয়। সাধারণভাবে খ্রিস্টান এবং আরো বিশেষভাবে ক্যাথলিকদের মধ্যে যেখানে দেকার্তের সত্যিকারের প্রত্যয়ের কোনো প্রমাণ নেই। তিনি কি বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর পরে শাস্তি এবং পুরস্কারের, যিশুর অতিমানবিয় গুণাবলিতে, পুনরুত্থানে অথবা কুমারি মাতাকে? এ পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণ দিয়ে এ সমস্ত প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়া সম্ভব বলে মনে হয় না।
কিন্তু অনিশ্চয়তার দুই প্রান্তকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া যায়। যখন দেকার্ত চার্চের অভ্রান্ততার কথা অথবা তাঁর চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারের কথা বলেন তখন স্তুতিচ্ছলে নিন্দার আভাস চাপা থাকে না যার নিহিতার্থ দেকার্ত যা বলেছেন বা করেছেন তার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।
অন্যদিকে প্রায় সমান বিশ্বস্ততার সঙ্গে দেকার্ত অলৌকিক ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। যদিও এই বিশ্বাসের চিহ্ন খুব স্পষ্ট নয় যে তিনি এই অবস্থানের বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে নিঃসন্দেহ ছিলেন। একইভাবে আত্মায় অমরত্ব বিষয়ে দেকার্তের বিশ্বাস গ্রহণ করার জন্য আমরা যথেষ্ট কারণ খুঁজে পাই।
(ভূমিকাংশ)
চারবাক (বর্ষ ৫, সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০০৬)
পিনাকী ভট্টাচার্য রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত অনুবাদ, রেনে দেকার্ত : ‘ডিসকোর্স অন মেথড’ — প্রমিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।