[দার্শনিক ও মনীষী কলিম খানের সহযোগী এবং ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ ও ‘সরল শব্দার্থকোষ’ সহ আরো বেশ কিছু ভাষাতাত্ত্বিক গ্রন্থের যুগ্ম প্রণেতা, নবতিপর পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীময় রবি চক্রবর্ত্তী মহাশয় রচিত এই নিবন্ধটির প্রথম প্রকাশ ঘটিয়াছিল ‘বঙ্গযান’-এর সহযোদ্ধা, ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এর প্রকাশক সংস্থা ‘ভাষাবিন্যাস’-এর কর্ণধার শ্রীময় পূর্ণেন্দু মিত্র মহাশয় সম্পাদিত সাময়িক সাহিত্যপত্র ‘রবীন্দ্রনাথ-১৮’ সংখ্যায়, ২০০৭ সালে। এই সেই সময়, যক্ষণ কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী উভয়েই ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ সৃষ্টির প্রাকপ্রস্তুতি সারিয়া ১ম খণ্ডের খসড়া রচনায় ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন। এই নিবন্ধটি খান-চক্রবর্ত্তী প্রণীত রচনাবলীতে যুগ্মভাবে বা এককভাবে আজো অগ্রন্থিত হৈয়া পড়িয়াছে। পাঠকদের স্বার্থে নিবন্ধটি আবারো প্রকৃতিপুরুষ-এর বানান রীতিতে প্রকাশ করা হৈল।] — সম্পাদক, প্রকৃতিপুরুষ]।
[“…কিন্তু ব্রহ্মগুণ জিনিসটি কী? আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য এই যে, আদি ব্রাহ্মণ যেমন তাহার প্রকৃত গুণ হারাইয়া ফেলিয়াছে, কালক্রমে ব্রহ্ম শব্দটিও তেমনি তাহার প্রকৃত অর্থ হারাইয়া ফেলিয়াছে এবং ব্রহ্ম শব্দটি তাহার একটা তূরীয় অর্থে সীমিত হৈয়া যায়। ব্রহ্ম বলিতে যেই একরকমের উচ্চাঙ্গের মনন বোঝায়, ব্রহ্ম বলিলে যেই ব্যাপকভাবে অনেক কিছু বোঝায়, সেইটা ভুলিয়া গিয়াছে মানুষ। ব্রহ্ম বলিলে যে, শুধু বাক্য ও মনের অতীত এক সত্যলোক বোঝায় তাহা নহে, ব্রহ্ম বলিলে অব্যক্তের জগৎকে ব্যক্ত করা, দুর্জ্ঞেয়কে জ্ঞেয় করা, অন্ধকার হৈতে আলোয়, মৃত্যু হৈতে অমৃতে, দুঃখ হৈতে আনন্দে উত্তরণ-ঔ বোঝায়, তাহা ভুলিয়া গিয়াছে মানুষ।
এই ব্রহ্ম বলিলে বোঝায় আবিষ্কার ও সৃষ্টির আনন্দ। এই ব্রহ্ম শব্দের দ্বারা যে নানান রকমের উচ্চাঙ্গের মনন বোঝায়, তাহার প্রমাণ রহিয়াছে ‘ব্রাহ্মমুহূর্ত্ত’, ‘ব্রাহ্মীশাক’, ব্রহ্মতালু’, ‘ব্রহ্মবিহার’, ‘ব্রাহ্মী স্থিতি’, ‘ব্রহ্মচর্য্য’ প্রভৃতি নানা শব্দের মধ্যে। আরো একটা কথা বলা যায়; ব্রহ্ম শব্দ বলিলে যদি শুধু উচ্চতম অনুভূতি এবং উপলব্ধির এলাকাই বোঝাইত, তাহা হৈলে ‘পরব্রহ্ম’ শব্দটির-ঔ সৃষ্টি হৈত না”। — রবি চক্রবর্ত্তী]।
লেখক হিসাবে আমি পাঠকসমাজে হাজির হৈয়াছি ছয়-সাত বছর আগে, এবং বলিতে গেলে আমার জীবনের সায়াহ্নে। তাহার ওপর গত কয়েক বছর ধরিয়া যাহা লিখিয়াছি, তাহার বেশী অংশটাই যেন একটা বিশেষ তত্ত্ব যথা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করিবার জন্যে লেখা। অনেকের মনে প্রশ্ন ওঠে, নানান বিষয় লৈয়া লিখি না কেন? এর রহস্যটা কী? দীর্ঘকাল ধরিয়া ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যয়ণ ও অধ্যাপনার সূত্রে পাওয়া মুলধন ত কিছু আছে। তবু কেন এই ঘেরা চৌহদ্দির মধ্যে আটকাইয়া থাকা? এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চলিতেছি এই স্বল্প পরিসরের নিবন্ধে।
অনতিখ্যাত লেখক কলিম খান-এর প্রচেষ্টায় যাস্কমুণির ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের অভিষেক হৈয়াছিল আজ হৈতে বার-চৌদ্দ বছর আগে। তাহারপর হৈতে কলিম খান-এর কলম আর থামে নাই। দেশের বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান এবং বাজারমুখী মিডিয়া উপেক্ষা করিয়া গেল এই উদ্যোগকে। তবু, দুই বাঙ্গালার বহু মানুষের মনোলোক উদ্দীপ্ত হৈল এই ‘নূতন’ তত্ত্বের প্রেরণায়। কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন সাগ্রহে স্বাগত জানাইল শব্দার্থের এই নূতন তত্ত্বকে ও তাহার প্রবক্তাকে।
ঘটনাচক্রে আজ হৈতে দশ বছর আগে সেই তত্ত্বের দিকে আমিও আকৃষ্ট হৈলাম। আর, ঘটনাচক্র-ই বা বলি কেন? তক্ষণ হৈতে তিরিশ অর্থাৎ আজ হৈতে চল্লিশ বছর আগে, নামী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পত্রিকায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়া দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বক্তব্য রাখিয়াছিলাম যে, জাতির পুনরুজ্জীবনের স্বার্থেই সংস্কৃত ভাষার ভাবসম্পৎকে আয়ত্তে আনা একান্ত জরুরী এবং তাহার কোন বিকল্প নাই। আমার সেই লেখাটির উল্লেখ করিয়াছি এবং তাহা হৈতে নাতিদীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়াছি আমার ‘ইণ্ডিয়া রি-ডিস্কভার্ড’ (India Rediscovered) গ্রন্থে। অতটা বুঝিয়াও সংস্কৃত ভাষার দূর্গে প্রবেশ করিব কীভাবে এবং দূর্গের কোন প্রকোষ্ঠে দেখা পাইব বন্দিনী রাজকন্যার, তাহার কোন হদিশ পাই নাই দীর্ঘ তিরিশ বছর। সেই প্রতীক্ষার অবসান হৈল ১৯৯৮ সালে, কলিম খান-এর ‘মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে’ গ্রন্থটি হাতে আসায়।
কোন অত্যুক্তি না করিয়াই বলিতেছি, গ্রন্থটি, এবং সেইখানে উপস্থাপিত ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব-ঐ যেন দেশের ভাবসম্পতের রত্নভাণ্ডারে ঢোকার চাবিকাঠিটা একেবারে আমার হাতে ধরাইয়া দিয়াছিল। তাহারপর ধীরে ধীরে এবং একটু একটু করিয়া আমিও নামিয়া পড়িলাম শব্দার্থতত্ত্ব উদ্ধার ও প্রতিষ্ঠার কাজে এবং কলিম খান-এর সঙ্গে সহযোগিতায় আগাইতে লাগিলাম। একে একে তিন চারটা গ্রন্থ-ঔ প্রকাশ হৈল আমার নামে, একক বা যৌথভাবে। ভাসা-ভাসা বিচার করিয়া কেউ প্রশ্ন করিতেই পারেন, শব্দার্থতত্ত্ব কেন কলিম খান আর আমার লেখালিখির মুখ্য বিষয়? এমন ত নয় যে, বৃহৎ জগতের নানা ভাবনায় আমরা আন্দোলিত হৈ না। তবু শব্দার্থতত্ত্ব লৈয়া কেন এত ভাবনা, এত চেষ্টা? আমার প্রেক্ষিত হৈতে বিষয়টা কীভাবে দেখিয়াছি, এইবার সেইটা বলিবার চেষ্টা করিতেছি।
প্রথম দিকে ভাবিতাম, এই শব্দার্থতত্ত্বের চরম সার্থকতা এই যে, এর সাহায্যে আমরা রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থের তাৎপর্য্য বুঝিতে পারিব এবং তাহারপর ক্রমে বুঝিয়া যাইব ভারতের তথা পৃথিবীর মানুষের সামাজিক ইতিহাস ও মানসিক বিবর্ত্তন। কলিম খান ত তাহার প্রথম দিকের লেখাতে দশাবতার তত্ত্বের ব্যাখ্যা করিয়া দেখাইয়াছিলেন, ভারতের মানুষ পুঁজির বিকাশকে কত সূক্ষ্ম পর্য্যায়ক্রমের হিসাবে বুঝিয়া লৈয়াছিল, তাহার সাক্ষ্য বহন করে এই দশাবতার তত্ত্ব।
আরো অনেক লেখায় কলিম খান দেখাইয়াছেন, পুরাণ বা রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী-গুলি আসলে ভারতে পুঁজির বিকাশ এবং বিভিন্ন রকমের বণিক, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও শূদ্র (বা মেহনতী মানুষ)-এর মধ্যেকার নানারকম সংঘর্ষ ও সহযোগিতার ইতিহাস। আমিও আমার মত করিয়া একটা উদ্যোগ লৈলাম। একটা পুরাণের কাহিনী কী করিয়া একি সঙ্গে অনেক রকমের সত্যকে ধারণ করিতে পারে, সেইটি বুঝিবার চেষ্টা করিলাম আমার ‘পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা’ নামের প্রবন্ধে।
ক্রমে বোঝা যাইতে লাগিল, আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাংলা ভাষাটিও ধ্যানধারণার দিক হৈতে কত সমৃদ্ধ। প্রতিটি শব্দের আছে স্বকীয় মহিমা এবং তাহারা আবার সকলেই একে অন্যের আলোয় উদ্ভাসিত। অনেক আগে পৃথকভাবে আমরা দুজনেই বুঝিয়াছিলাম এবং এক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হৈতে লাগিল, ইংরেজ শাসনের সূত্রে ইংরেজী ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠা হ্ওয়ার পর ক্রমাগত চেষ্টা হৈয়াছে আমাদের সকল শব্দের অর্থকে ইংরেজী শব্দের সঙ্কীর্ণ অর্থের মাপে ছাটিয়া নেওয়ার। স্বতঃই এই দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্ত্তাইল, আমাদের মনোজগতের আত্মবিচ্ছেদকে ঘুচাইয়া দেওয়ার স্বার্থেই, যক্ষণ যতটা সম্ভব, আমাদের ভাষার নানান শব্দকে তাহাদের প্রাপ্য মর্য্যাদায় প্রতিষ্ঠা করিয়া দেওয়ার।
এরিমধ্যে আবার প্রকট হৈয়া পড়িল যে, আমাদের শিক্ষাজগতের অভিভাবকরা ভাষাশিক্ষাকে যুগোপযোগী করিবার উদ্ভ্রান্ত চেষ্টায় নানান রকমের হানিকর উদ্যোগ লৈয়া চলিয়াছেন। সুতরাং তাঁহাদের কালাপাহাড়ী কর্ম্মধারার বিরোধিতা করিতে হৈল এবং সেই সূত্রে আমাদের ভাষার নানান সম্পতের উদ্ঘাটনকেও আমাদের কর্ত্তব্য বলিয়া মানিতে হৈল। ‘বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পৎ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে সেই সব প্রচেষ্টা সঙ্কলিত রহিয়াছে।
কিন্তু এইখানে থামিয়া যাওয়াও সম্ভব হৈল না আমাদের পক্ষে। ‘নূতন’ শব্দার্থতত্ত্বের সুবাদে একটার পর একটা নূতন দিগন্ত খুলিয়া যাইতে লাগিল কলিম খান এবং আমার চোখের সামনে; কোনটার উন্মোচনে প্রধান দায়িত্ব কলিম খান-এর এবং কোনটার ক্ষেত্রে বা আমার। সেই নূতন দিগন্ত কক্ষণো ইতিহাসের, কক্ষণো ঐতিহ্যের— কক্ষণো স্বদেশের, কক্ষণো বিদেশের। বৃহৎ সম্ভাবনাময় অনেক নূতন তত্ত্বের আবাহন-ই যে শুধু সম্ভব হৈল তাহা নহে। আরো অনেক কিছু হৈল।
একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ সুপ্ত-অর্দ্ধবিলুপ্ত-প্রায়বিস্মৃত সম্পৎকে পুনরুজ্জীবিত করা যাইতে লাগিল, অন্যদিকে তেমনি অতীত দিনের বিষয়ে অনেক অচল ধারণাকে ধূলিসাৎ করা গেল। কলিম খান আর আমি দুইজনে একে অন্যের শিক্ষাদীক্ষা, ক্রিয়াকর্ম্ম, অনেক দিক হৈতে ভিন্ন রকমের, তবু বোধ করি দুজনে সহযোগী তথা সম্পূরক হৈতে পারিয়াছি মৌলিক অর্থে সমধর্ম্মী বিশ্ববীক্ষার জোরে।
সবকিছুর পুরা বিবরণ এইখানে না দিতে পারিলেও কিছুটা খবর দেওয়া যায়। যাথার্থ্য আনিতে পারিব না এই আশঙ্কায়, এবং অবশ্য-ঐ সময় সুযোগের স্বল্পতায়, কলিম খান-এর মানসিক বিচরণের বিস্তৃত এলাকার কথা প্রথমে আনিতেছি না। যেইখানে আমার ভূমিকা অগ্রণী এমন কয়েকটি প্রচেষ্টার কথাই এক্ষণ বলিতেছি।
‘ভাষাতত্ত্বের নূতন দিগন্ত ও প্রকল্পিত আর্য্য-আগমনতত্ত্ব’ প্রবন্ধে প্রধানত শব্দার্থতত্ত্বের জোরেই দেখাইতে পারিয়াছি, সংস্কৃত ভাষা যেই সংস্কৃতিমণ্ডলের সৃষ্টি, সেই সংস্কৃতিমণ্ডল ভারতবর্ষের মাটী হৈতে উদ্ভূত এবং বহিরাগত আর্য্য জাতির তত্ত্বটি বিভ্রান্তিমূলক এবং ক্ষতিকর। অন্য প্রবন্ধে দেখাইয়েছি, হিন্দু ও মুসলিম এই দুই সংস্কৃতির বিরোধ আসলে অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে দুইটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিণাম। এইখানে একান্ত সহায়ক হৈয়াছিল ‘বরাহ’ শব্দটির তাৎর্য্যকে ভাল করিয়া বুঝিবার চেষ্টা। অন্যত্র দেখানোর চেষ্টা করিয়াছি পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্ব বা পাশ্চাত্যের অলঙ্কারশাস্ত্র যেইখানে তাহাদের ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন অংশের সম্যক ব্যাখ্যা দিতে পারিতেছে না, সেইখানে আমাদের দেশের শব্দার্থতত্ত্ব বিপুল সহায়তা করে সত্য উদ্ঘাটনে। কলিম খান-এর সহিত সহযোগিতা করিয়াছি ভারতবর্ষীয় সমাজের বহিরঙ্গ আচরণের সহিত অন্তর্লীন বিশ্বাসের জগৎ-এর সম্পর্কটি উন্মোচনের চেষ্টায়। আবার পশ্চিম হৈতে পাওয়া রাজনীতি তথা শিক্ষা-আদর্শকে আমাদের দেশের প্রাচীন ধ্যানধারণার মুখোমুখী আনিয়া শিক্ষা তথা সমাজবিকাশের নূতন আদর্শ তুলিয়া ধরিবার চেষ্টাতেও আমি কলিম খান-এর সহযোগী।
বাগাড়ম্বর আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু যথোচিত বিনয়ের সঙ্গেই বলিব, আমরা বারেবারেই সামগ্রিক বিচারে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করিয়াছি ভিতর হৈতে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এক একটা শব্দের অর্থের অনুসন্ধান বিরাট ধাক্কা দিয়াছে আমাদের ভাবনাকে। আর তাহার ফলে আমাদের বিচার হৈয়াছে সুদূরপ্রসারী। ‘লালন-পালন’, ‘শিক্ষা-দীক্ষা’ প্রভৃতি শব্দের রহস্যভেদ প্রভূত সাহায্য করিয়াছিল শিক্ষার আদর্শ রূপকে প্রত্যক্ষ করিতে। তেমনি ‘ব্রহ্ম’ শব্দের উন্মোচন আমাদের অভাবনীয় সাহায্য করিয়াছে ইতিহাসের যবনিকা ভেদ করিতে এবং নূতন সৃষ্টির কল্পনা তুলিয়া ধরিতে।
সোজা কথায় বলিতে গেলে, শব্দার্থতত্ত্বে আমরা লাগিয়া আছি, জগৎসংসার হৈতে বিচ্ছিন্ন কোন শব্দার্থতত্ত্বের জন্যে নয়। শব্দার্থতত্ত্ব হৈল আমাদের সর্ব্বার্থসাধক এক উপায়, যাহার সাহায্যে আমরা জগতেরেই অর্থ খুঁজিয়া পাওয়ার চেষ্টা করি। ইংরেজ কবির পঙ্ক্তি বোধ হয় স্মরণ করা যায়—
I could not love thee dear so much,
Loved I not honour more.
[জগতের অর্থকে এত বেশী করিয়া খুঁজি বলিয়াই না শব্দার্থের সন্ধানে আমরা এমন দিওয়ানা!]
‘ব্রহ্ম’ শব্দের উপলব্ধিতে যেই দিগন্ত খুলিয়া গিয়াছিল, তাহারি সাহায্যে ভিন্নতর এক যুক্তিবিন্যাসে অদ্য আমাদের ইতিকর্ত্তব্য নির্দ্ধারণের চেষ্টা করিয়াছি। এক্ষণ সেকথাই বলি।
আজিকার মত যুগসন্ধির কাল বোধ করি আগে কক্ষণো আসে নাই। গ্রীক-রোমক সভ্যতার পতনের কাল, পশ্চিমী হিসাবে ফিউডাল যুগের অবসান বা আমাদের দেশে পশ্চিমী বণিকের সাম্রাজ্য কায়েম করিবার সময়— এইসবের ত বিবরণ পাওয়া যায়। দেখা যায়, এক দল মানুষ যদি হা-হুতাশ করিতেছে, ত অন্য এক দল মানুষ করিতেছে জয়োল্লাস। কিন্তু আজ সকল দিকে শঙ্কা। একদিকে রহিয়াছে পরিবেশ দূষণ ও পৃথিবীর তাপমাত্র বৃদ্ধি সংক্রান্ত ভীতি; পৃথিবী যদি মানুষের বাসের অযোগ্য হৈয়া যায় তাহা লৈয়া ভাবনা। অন্যদিকে বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসের আতঙ্ক; মৃত্যুর ফাঁদ যেন পাতা আছে সব জায়গায়।
আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সন্ত্রাস। তাই দুঃখের কথা এই, বিজ্ঞান প্রযুক্তি আজ যেই তুঙ্গে উঠিয়াছে, তাহাতে অন্ন বস্ত্র আচ্ছাদন প্রভৃতির সংস্থান লৈয়া সমগ্র পৃথিবীর একটা মানুষেরেও কোন সমস্যা হ্ওয়ার কথা নয়। তবু মানুষ এক্ষণ সবচেয়ে বিপন্ন। আজ একান্ত প্রয়োজন সমগ্র মানবজাতির মিলন, যাহাতে পৃথিবী প্রাণহীন গ্রহ না হৈয়া পরিণত হয় এক বাস্তব স্বর্গে। অথচ আজ চলিতেছে মানুষের হাতে মানুষ মারিবার ব্যাপক ব্যবস্থা আর মানুষের রক্ত লৈয়া হোলিখেলা। বিবদমান ও সংঘর্ষরত সকল পক্ষেই মনে করিতেছে তাহারা নিজেরা ঠিক আর অন্যেরা ভুল।
একবার গত শতকের বিশ বা ত্রিশের দশকের সঙ্গে আজিকার অবস্থা তুলনা করুন, তফাৎটা বুঝিবেন। তক্ষণ পৃথিবী দাঁড়াইয়াছিল যুদ্ধ আর ধ্বংসের কিনারায়। কিন্তু তক্ষণ ছিল সুখসমৃদ্ধির স্বপ্ন, শান্তির আশা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। স্পেন-এ গণতন্ত্র বিপন্ন হৈলে দেশবিদেশ হৈতে সমাজবিপ্লবী, কবি-লেখক-শিল্পী সেইখানে ছুটিয়াছিলেন। চীনের আক্রান্ত মানুষের জন্যে পরাধীন ভারত হৈতেও গিয়াছিল মেডিক্যাল মিশন। তক্ষণ ছিলেন আইনষ্টাইন-রল্যাঁ-রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বিশ্বপথিক, আর ছিল তাঁহাদের কথা ছড়াইয়া দিতে আগ্রহী মিডিয়া। এমনকি পঞ্চাশ-ষাটের দশকেও মিশর, কিউবা বা ভিয়েতনাম লৈয়া মাথা ঘামাইয়াছিল ইয়োরোপ বা আমেরিকার যুবশক্তি, অন্যায় আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হৈয়াছিলেন রাসেল বা সার্ত্র-এর মত লেখক বা দার্শনিকরা।
আর আজ, নানান অজুহাতে ইরাক বা আফগানিস্তানের ওপর নেকড়ের মত ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে এবং তাহারপর তাহাদের ক্ষতবিক্ষত করিয়া চলিতেছে আমেরিকা, অথচ কোথাও কোন প্রতিবাদ নাই। লণ্ডন, মাদ্রিদ কি মুম্বাইয়ে বহু সাধারণ মানুষের অপঘাত মৃত্যুর মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বটে, কিন্তু তাহাতে কোন পুনর্গঠনের বীজ থাকে না, থাকে শুধু ধ্বংসলীলা। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কোন ভরসাস্থল আজ নাই; সমাজতন্ত্রের দূর্গ বলিয়া যাহারা নিজেদের পরিচয় দিত, সেই রুশ বা চীনে সমাজতন্ত্রের পতাকা নামাইয়া ফেলা হৈয়াছে।
আজ চারিদিকে হতাশা। কোন দিকে নাই আশার বাণী। শিল্পায়নের কল্পনা বা উদ্যোগ কোন উদ্দীপনা আনিতেছে না। সবাই বুঝিতেছেন, শিল্পায়ন লৈয়া আসিতেছে বাজার অর্থনীতির বিশ্বায়ণ বা গোটা বিশ্বের এক বাজার হৈয়া যাওয়া। চকচকে বাড়ী, রাস্তা আর থরে থরে পসরা সাজানো দোকান— মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশের সংখ্যালঘু কিছু মানুষের অতুল বৈভব আর স্থূল আনন্দমত্ততা। আর অন্যদিকে অন্নাভাবে বা অস্ত্রাঘাতে অগণিত মানুষের মৃত্যুর মিছিল— এই হৈল বিশ্বায়ণের অবদান। আর সব কিছুকে ঘিরিয়া সন্ত্রাসের পরিমণ্ডল। এই পৃথিবীকে আবহাওয়ার দিক হৈতে মানুষের বাসযোগ্য রাখার গ্যারাণ্টিও দিতে পারিতেছে না এই বিশ্বায়ণ।
অতীতে যেই সব আদর্শ মানুষকে পথ দেখাইয়াছে তাহাদের কথা দিয়াই আলোচনা শুরু করা যায়। প্রথমে উল্লেখ করিতে হয় ধর্ম্মসমূহের কথা। কারণ, ধর্ম্মের ভাবাদর্শ দিয়া সমাজ তথা রাষ্ট্রের রূপ দেওয়ার চেষ্টা হৈয়াছে বারেবার। নিঃসন্দেহে সেই চেষ্টাগুলি খুবি গুরুত্বপূর্ণ। সেই ধর্ম্মভিত্তিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বিশেষ দেশ ও কালে বড় রকমের সৃষ্টি ও রক্ষার কাজ করিয়া গিয়াছে। কিন্তু কালধর্ম্মে সেই সব আদর্শ গতিশীলতা হারায় আর নানা প্রতিষ্ঠানের কুক্ষিগত হৈয়া পড়ে। তাহাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে নানা উপাদান আমরা পাইতে পারি, কিন্তু তাহাদের যুগোপযোগী করিয়া তুলিবার চেষ্টা ক্ষতিকর পণ্ডশ্রম হৈয়া যাইতে বাধ্য। প্রথমত তাহাদের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের অচলায়তন চাপিয়া বসিয়া রহিয়াছে, আর দ্বিতীয়তঃ বহুশতাব্দীর গতিহীনতা এবং নঞর্থক ভূমিকা পালন তাহাদের একেবারে অকেজো করিয়া দিয়াছে।
সুতরাং যেই রাজনৈতিক আদর্শগুলি এক্ষণো সক্রিয় রহিয়াছে, তাহাদের সম্বন্ধে এক্ষণো আলোচনা প্রয়োজন। যেই দুই রাজনৈতিক ভাবধারা গত দুই তিন শতাব্দী ধরিয়া পৃথিবীর মানুষকে আন্দোলিত করিয়াছে, তাহারা হৈল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ। প্রথমে বলি আধুনিক যুগে রূপায়িত সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা। সেই আদর্শের খামতি প্রকট হৈতে এক শতাব্দী সময়-ও লাগিল না। [এই আদর্শের রূপায়ণ চেষ্টার সূচনা এবং অবসান, বলিতে গেলে দুই-ই বিংশ শতাব্দীর মধ্যে]।
এর কারণ বুঝিতে বেশী দূর যাইতে হয় না। মূলতঃ মানুষের দেহভিত্তিক জীবনের চাহিদা পূরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিয়াছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্যোগ। মানুষের মনোজীবনের চাহিদা এবং তাহার তৃপ্তি সাধনকে যেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, এই রাজনৈতিক আদর্শের রূপকাররা তাহা দেন নাই। সাধারণ মানুষের মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে তাঁহারা মর্য্যাদা দেন নাই। আবার একি রকম চিন্তাভাবনার কারণে এই রূপকাররা নিজেদের বিশুদ্ধি বা সততার সাধনাও করেন নাই।
দশকের পর দশক ধরিয়া সদাচার-ভ্রষ্টতার প্রতিকারের জন্যেই প্রয়োজন হৈয়াছিল ‘কালচারাল রিভলিউশন’-এর ডাকের। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কল্পনার মধ্যেও যথেষ্ট যান্ত্রিকতা ছিল, তাহার দরুণ এই কল্পনা ছিল এমনিতেই দুর্ব্বল। তাহার ওপর যক্ষণ এই ভাবনাটা সামনে আসিল, ততদিনে অনেক পচন ধরিয়াছে ভিতরে ভিতরে। স্বচ্ছতাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত লোভী মানুষদের হাতে রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনার ভার ন্যস্ত হৈলে যে কী দুর্গতি হৈতে পারে, সেটাই প্রমাণ হৈয়া গেল বারে বারে। এই জন্য সিদ্ধান্ত টানা যায়, শুধু বাইরের আইনের বাধ্যবাধকতা বা আইনের কাঠামো দিয়া মানুষের সমাজের ভাল করা যায় না।
আবার, গণতন্ত্র যে ব্যর্থ হৈল তাহার মূলে প্রথমেই আমাদের চোখে পড়িবে দুইটা ব্যবস্থাগত ত্রুটি। এক, পার্টিপ্রথা আর দুই, গোপন ব্যালটপ্রথা। গোপন ব্যালটপ্রথায় প্রতিনিধির সঙ্গে নাগরিকের সরাসরি কোন দেওয়া-নেওয়া বা চাওয়া-পাওয়ার বন্ধন আর থাকে না। অন্য কথায় নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার বা তাহাদের অভিপ্রায়কে মর্য্যাদা দেওয়ার দায় থাকে না প্রতিনিধিদের। আর পার্টিপ্রথায় প্রতিনিধিরা চলিতে বাধ্য হন নিজ নিজ দলের, বিশেষত দলনেতাদের নির্দ্দেশে। ফলে নাগরিকরা এবং তাঁহাদের প্রতিনিধিরা আরো বেশী করিয়া বিচ্ছিন্ন হৈয়া পড়েন পরস্পর হৈতে।
কিন্তু প্রাচীন গ্রীসের গণতন্ত্র ব্যর্থ হৈয়াছিল কেন? সেইখানে ত এই দুই ত্রুটি ছিল না। অবশ্য এই কথা বলা যায় যে, প্রাচীন গ্রীসে বণিকের প্রভূত্ব বাড়িয়া যাওয়ায় সমাজে পুঁজিবাদী শক্তি সক্রিয় হৈয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে সমাজের শৃঙ্খলা ভাঙ্গিয়া যায় এবং ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে আশ্রয় খুঁজিয়া প্রাচীন গ্রীসীয় সমাজ ও সংস্কৃতি আরো কয়েক শতাব্দী টিকিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্যাটির মূল রহিয়াছে আরো গভীরে এবং তাহা লৈয়া কিছু আলোচনা প্রয়োজন।
গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র— দুইটা আদর্শকে পাশাপাশি রাখিয়া অবশ্য-ঐ তাহাদের ত্রুটির খোঁজ করা যায়। সমাজতন্ত্র সকল মানুষের অন্ন-বস্ত্র-আচ্ছাদনকে বা জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদার দিকে নজর দিয়াছে বটে, কিন্তু মানুষের মনের তৃপ্তিকে গুরুত্ব দেয় নাই। গণতন্ত্র মানুষের মনকে গুরুত্ব দিলেও পার্টিপ্রথা ও গোপন ব্যালটপ্রথার দরুণ নিজেকে কার্য্যকরী করিয়া তুলিতে পারে না, এমনকি মানুষের জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর নিশ্চয়তাও নিশ্চিত করিতে পারে না। কিন্তু একটা মূল জায়গায় দুইটা আদর্শেরেই একরকমের ত্রুটি, দুইটা আদর্শ-ঐ একটা বড় প্রশ্নকে এড়াইয়া গিয়াছে । সেই প্রশ্ন এই যে, সমাজের নেত্র বা চোখকে অন্য কথায় নেতৃস্থানীয়দের অবশ্য-ঐ কী কী গুণসম্পন্ন হৈতে হৈবে এই বিষয়ে প্রাচীন তথা প্রাচ্যদেশীয় বিশেষ করিয়া ভারতীয় ঐতিহ্যে নির্ভরযোগ্য কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইয়োরোপে এক্ষণ যেইসব দেশে রাজতন্ত্র রহিয়াছে, সেইখানে রাজাকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন আর্চ্চবিশপ বা প্রধান পুরোহিত। ভারতেও রাজাকে পুণ্যবারিতে অভিসিঞ্চন করে রাজপদের উপযুক্ত করিয়া দেন পুরোহিত ব্রাহ্মণ। এই রীতির মধ্যে দিয়াই উঁকি মারিতেছে অতীতের একটা সামাজিক অভ্যাস বা প্রথা। প্রথাটি এই যে, ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠকে রাজপদে বৃত বা নিযুক্ত করিয়া দেন পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ। এই প্রথার তাৎপর্য্য এই যে, অন্তত মূলনীতি নির্দ্ধারণ করিয়া দেন পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ এবং রাজপদে বৃত বা নিযুক্ত রাজা তাঁহার পরাক্রমী ক্ষাত্রশক্তি প্রয়োগ করিয়া সেই নীতি কার্য্যকরী করেন।
ভারতীয় ঐতিহ্য এই বিষয়ে আরো বেশী দূর যায়। সেই হিসাবে সমস্ত ভূমির যথার্থ অধিকারী হৈল ব্রাহ্মণ এবং তাহারি জের টানিয়া হিন্দু সমাজে অদ্যাবধি ব্রাহ্মণকে ভূমিদান একটা মহৎ কাজ বলিয়া স্বীকৃত হয়। আধুনিকের চোখে স্বভাবত-ঐ এইটি একটা অযৌক্তিক রীতি। কারণ, গোটা জিনিসটির সোজা বা সরলীকৃত ব্যাখ্যাটি ঠিক সেই রকম-ই। একটা অবসরভোগী শ্রেণী বা কিছু চতুর মানুষ আগেই মেহনতী মানুষকে বেদ (অর্থাৎ জ্ঞানচর্চ্চা) হৈতে বঞ্চিত করিয়া রাখিল। তাহারপর মেহনতী মানুষ বা শূদ্রের অজ্ঞতার সূযোগে তাহাকে অতিপ্রাকৃত-এর নানা রকম ভয় দেখাইয়া সমাজের সমস্ত সম্পৎকে নিজের কুক্ষিগত করিবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করিয়া নিল সেই চতুর অবসরভোগী গোষ্ঠী।
এই ব্যাখ্যান অধঃপতিত ভারত সম্বন্ধে প্রযোজ্য মনে করার-ঔ যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে। কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের আলোয় আমাদের প্রাচীন ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের বিচার করিলে আমরা একটু অন্য রকমের ধারণায় পৌঁছাইয়া যাই। প্রথম কথা, ‘ভূমী’ বলিলে ইংরেজীতে যাহাকে ল্যাণ্ড (land) বলে তাহা ছাড়াও আরো বেশী কিছু বোঝায়। যেইখানে কিছু উদ্ভূত হয় সেইটাই ‘ভূমী’ পদবাচ্য। সেই হিসাবে মনোভূমী হৈল শ্রেষ্ঠ ‘ভূমী’, কেননা এইখানে সব ভাবের উদয় হয়। সুতরাং ব্রাহ্মণকে ভূমী দেওয়ার মূল অর্থ সমস্ত ভাবের বা ভাবনার জগৎটাকে ব্রাহ্মণের হাতে তুলিয়া দেওয়া। সেই সমস্ত স্থূল (অর্থাৎ পার্থিব) এবং সূক্ষ্ম (অথবা মনোজগতের) ভূমী লৈয়া ব্রাহ্মণ কী করিবে? ভারতীয় চিন্তা অনুযায়ী ব্রাহ্মণ অবশ্য-ঐ পালন করিতে থাকিবে তাহার স্বধর্ম্ম। সংজ্ঞা অনুযায়ী ব্রাহ্মণের স্বধর্ম্ম হৈল ‘ব্রহ্ম’ গুণের অনুশীলন।
কিন্তু ব্রহ্মগুণ জিনিসটি কী? আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য এই যে, আদি ব্রাহ্মণ যেমন তাহার প্রকৃত গুণ হারাইয়া ফেলিয়াছে, কালক্রমে ব্রহ্ম শব্দটিও তেমনি তাহার প্রকৃত অর্থ হারাইয়া ফেলিয়াছে এবং ব্রহ্ম শব্দটি তাহার একটা তূরীয় অর্থে সীমিত হৈয়া যায়। ব্রহ্ম বলিতে যেই একরকমের উচ্চাঙ্গের মনন বোঝায়, ব্রহ্ম বলিলে যেই ব্যাপকভাবে অনেক কিছু বোঝায়, সেইটা ভুলিয়া গেল মানুষ। ব্রহ্ম বলিলে যেই শুধু বাক্য ও মনের অতীত এক সত্যলোক বোঝায় তাহাই নহে, ব্রহ্ম বলিলে অব্যক্তের জগৎকে ব্যক্ত করা, দুর্জ্ঞেয়কে জ্ঞেয় করা, অন্ধকার হৈতে আলোয়, মৃত্যু হৈতে অমৃতে, দুঃখ হৈতে আনন্দে উত্তরণ-ঔ বোঝায়, তাহা ভুলিয়া গেল মানুষ।
এই ব্রহ্ম বলিলে বোঝায় আবিষ্কার ও সৃষ্টির আনন্দ। এই ব্রহ্ম শব্দের দ্বারা যেই নানান রকমের উচ্চাঙ্গের মনন বোঝায়, তাহার প্রমাণ রহিয়াছে ব্রাহ্মমুহূর্ত্ত’, ‘ব্রাহ্মীশাক’, ব্রহ্মতালু’, ‘ব্রহ্মবিহার’, ‘ব্রাহ্মী স্থিতি’, ‘ব্রহ্মচর্য্য’ প্রভৃতি নানা শব্দের মধ্যে। আরো একটা কথা বলা যায়, ব্রহ্ম শব্দ বলিলে যদি শুধু উচ্চতম অনুভূতি এবং উপলব্ধির এলাকাই বোঝাইত, তাহা হৈলে ‘পরব্রহ্ম’ শব্দটির-ঔ সৃষ্টি হৈত না।
উপরন্তু সেই তূরীয় জগৎ এবং তাহার সঙ্গে সাযুজ্য-ই যদি ব্রহ্ম শব্দের একমাত্র মানে হৈত, তাহা হৈলে ব্রাহ্মণের সংখ্যা হৈত আঙ্গুলে গোনার মত এবং ব্রাহ্মণের লোভহীনতা ইত্যাদি সাত্ত্বিক গুণ এবং যজন-যাজন-অধ্যয়ণ-অধ্যাপন ইত্যাদি সামাজিক কর্ম্মের কথাও বলা হৈত না। জ্ঞানের সৃজন বা আবিষ্কার এবং রক্ষণ হৈল ব্রাহ্মণের প্রাথমিক কর্ম্ম। সেই জ্ঞানের শিখা ব্রাহ্মণ তাহার মাথায় বহন করিবে, তাহারি স্মারক এবং সহায়ক হৈল ব্রাহ্মণের মাথায় কেশ-এর শিখা। দেবাদিদেব মহাদেব হৈলেন আদি শি(খা) ব(হনকারী) ‘শিব’। পাশ্চাত্য পুরাণে এঁর সদৃশ সত্তা হৈলেন ‘প্রমিথিউস’ (Prometheus)।
ব্রহ্মগুণসম্পন্ন অর্থাৎ আবিষ্কারক-উদ্ভাবক মননশীল ও লোভহীন মানুষ বা মহর্ষিদের হাতে সমাজের নেতৃত্ব বা নীতিনির্দ্ধারণের ভার থাকুক, এমন ধারণা শুধু ভারতে ছিল, এমন ভাবিলে ভুল হৈবে। প্রাচীন মিশর, প্রাচীন সুমের, প্রাচীন চীন, এমনকি প্রাচীন মায়া সভ্যতায়-ঔ নেতৃত্ব দিয়াছিল জ্ঞানসমৃদ্ধ বা ব্রহ্মগুণসম্পন্ন মানুষ এবং মিশর, সুমের, প্রাচীন ভারত প্রভৃতি সভ্যতা গণিত, জ্যোতির্ব্বিদ্যা, স্থাপত্য, রসায়ণ, আয়ুর্ব্বেদ, ভাষাবিচার প্রভৃতি বহু বিষয়ে যেই তুঙ্গে উঠিয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
পরবর্ত্তী কালেও জ্ঞানীদের নেতৃত্বে সমাজ ও রাষ্ট্র চলিয়াছে। প্রাচ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষু বা শ্রমণদের ক্রিয়াকলাপ যদি নাও জানা থাকে, পাশ্চাত্যে খ্রীষ্টীয় সন্ন্যাসিদের গৌরবময় ভূমিকা ত অনস্বীকার্য্য। পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীক-রোমক সভ্যতার পতনকাল হৈতে এক হাজার বছর ধরিয়া ইয়োরোপে সভ্যতার বর্ত্তিকা ধরিয়া রাখেন খ্রীষ্টপন্থী সন্ন্যাসীদের সঙ্গঠন খ্রীষ্টীয় চার্চ্চ। মধ্যযুগের গথিক স্থাপত্য, দার্শনিক আকোয়াইনাস, কবি দান্তে প্রভৃতি এই যুগেরই সৃষ্টি। এমনকি রেনেসাঁস যুগের যেই বিরাট পুরুষদের গুণগানে অনেকে মুখর, সেই শেক্সপীয়র, দা ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো প্রভৃতি— তাঁহাদেরেও উদ্ভব সেই মধ্যযুগের চিন্তাভাবনার ভূমীতে।
ওইদিকে ইসলামী জগতেও ঐ সময়ে নেতৃত্ব দিয়াছেন সামরিক শক্তিতে শক্তিমান কেউ নয়, বরং জ্ঞান, চেতনা ও চরিত্রের শক্তিতে সমৃদ্ধ খলিফা। অবক্ষয়ের কালে খ্রীষ্টীয় পোপ এবং ইসলামী খলিফা— দুইটা পদ-ই ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে কলুষিত হৈয়া যায়। কিন্তু অবক্ষয়ের আগের কালে তাহাদের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। এইসব হৈতে আরো প্রমাণ হয় যে, স্বার্থবুদ্ধিহীন জ্ঞানির কত প্রয়োজন ক্ষমতার কেন্দ্রে। গ্রীক দার্শনিক Plato যে Philosopher-King-এর কথা ভাবিয়াছিলেন সেইটি আদৌ অবাস্তব চিন্তা ছিল না।
প্লেটো এমন বলিলেও গ্রীক সভ্যতার নেতৃস্থানীয় এবং পুঁজি-প্রাধান্যে আবিষ্ট এথেনীয় সভ্যতা বোঝেন নাই, নির্লোভ প্রজ্ঞাবানকে সমাজের নেতৃত্বে বসানোর জরুরী প্রয়োজনকে। রোম মারফৎ সেই সভ্যতার উত্তরাধিকার দাবী করিয়া যেই সভ্যতা মাথা তুলিল, তথাকথিত রেনেসাঁস-(=পুনর্জন্ম)-উত্তরকালে, সেই সভ্যতাও একি ভাবে পুঁজি-প্রাধান্যের কারণে বুঝিতে পারিল না উপযুক্ত নেতৃত্বের একান্ত প্রয়োজনীয়তাকে। পুঁজিবাদী বণিক তাহার অস্তিত্বের চাহিদাতেই প্রজ্ঞাবানের নেতৃত্বে পরিচালিত রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণকে অপছন্দ করে ও তাহার বিরোধিতা করে।
প্রাচীন গ্রীসে এবং আধুনিক যুগে দুই বার-ই ভাবা হৈয়াছে, জনগণ বা প্রজাসাধারণকে উচ্চ মর্য্যাদা প্রদান করিলেই বোধ হয় আর কিছুর অভাব থাকিবে না। কিন্তু তাহাদের পরিচালনায় যদি উপযুক্ত নেতৃত্ব না থাকে, তবে চলিয়া আসে অযোগ্য নেতৃত্ব আর তক্ষণ গণতন্ত্র নষ্ট হয় এবং প্রজাসাধারণ বিপন্ন হয়। তাহারা হৈয়া পড়ে দূরভিসন্ধি চালিত সমাজ-পরিচালকের সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উপায় মাত্র। পুঁজির অবাধ বিচরণ কীভাবে হৈতেছে তাহা জনসাধারণকে বুঝিতেই দেওয়া হয় না, ফলে তাহারা গঠনমূলক ভূমিকা পালন করিতে পারে না। শুধু যদি সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালকের মর্য্যাদা থাকে আর প্রজাসাধরণের অমর্য্যাদা, তাহা হৈলে অবশ্য-ই সাধারণ মানুষের বিপৎ।
কিন্তু তত্ত্বগতভাবে প্রজাপুঞ্জ মর্য্যাদাসম্পন্ন হৈয়াও যদি তাহাদের মাথায় আসিয়া যায় মন্দমতি-পরিচালক, তবে সেই পরিচালক বাগাড়ম্বরের কুয়াশা সৃষ্টি করিয়া প্রজাবৃন্দকে বিভ্রান্ত করিয়া এবং ছলে-বলে-কৌশলে তাহাদের নির্ম্মমভাবে শোষণ করে। ভারতবর্ষের পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব দিয়া ব্যাপারটিকে ভাল করিয়া বোঝা যায়। ভারতবর্ষে প্রজাবৃন্দকে বলা হৈত প্রকৃতিপুঞ্জ আর রাজাকে বলা হৈত পতি বা পুরুষ। যেইখানে পুরুষ আর প্রকৃতি দুইয়ের মধ্যে সহযোগিতা, পারস্পরিক সম্মান দান এবং প্রেমের বন্ধন, সেখানেই চলে যথার্থ সৃষ্টির লীলা। অন্যাথায় সৃষ্টি থামিয়া যায় অথবা বিকৃত সৃষ্টি হয়।
পুঁজির বিকাশের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমরা সেই পুঁজিকে এক দানবীয় সত্তায় পরিণত হৈতে দেওয়ার বিরোধী। তাহাকে আমরা চাই মানুষের সেবায় নিয়োজিত কল্যাণমূর্ত্তিতে। আমরা বিশ্বাস করি, সেই অবস্থা সৃষ্টি করা আদৌ দুঃসাধ্য কাজ হৈবে না, যদি সমাজের পরিচালনায় থাকে স্বচ্ছতার নীতি এবং পরিচালকের আসনে থাকেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছ নির্লোভ জ্ঞানী ব্যক্তি, যাহার প্রকৃষ্ট রূপকে ভারত চিহ্নিত করিয়াছিল ব্রহ্মগুণসম্পন্ন ব্যক্তি বা এককথায় ‘ব্রাহ্মণ’ নামে। কিন্তু বিশেষ বংশ বা পরিবারে জন্মের সূত্রে এই ব্যক্তি ব্রাহ্মণ বলিয়া গণ্য হয় না। এই ব্রাহ্মণ পদবাচ্য হয় নিজের গুণে, সাধনা ও অর্জ্জনের জোরে। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ-ঔ ব্রাহ্মণ বলিতে বুঝিতেন সেই ব্যক্তিকে, যেই ব্রাহ্মণত্বের গুণ অর্জ্জন করিয়াছে।
আমরা একথা বলি না যে, সেই ব্রহ্মগুণের বিকাশ হোক শুধু সমাজের কিছু নির্ব্বাচিত অংশের মানুষের মধ্যে। আমরা চাই, সেই গুণের বিকাশ হোক সকল মানুষের মধ্যে, আর সমাজের নেতৃত্বে থাকুক তাহারাই, যাহাদের মধ্যে এই গুণের সর্ব্বাধিক বিকাশ ঘটিতেছে। সকল মানুষকে অমৃতের পুত্র বলিয়াছে ভারতবর্ষ আর মানুষকে বিশ্বপ্রকৃতির অংশ হিসাবে দেখিয়াছে। আধুনিক বিজ্ঞান-ঔ সব কিছুকে মাপিতে গিয়া সবশেষে পদার্থের জগতের চরম গভীরে এমন এলাকা পাইয়া গিয়াছে, যেইখানে কোন স্থূল মাপজোক চলে না। আর বিজ্ঞান-ঔ ক্রমে মানিতেছে যে, সেই অপ্রমেয়ের শ্রেষ্ঠ অধিষ্ঠান মানুষের চেতনায়। তবু মাপজোকের দুনিয়াতেও মানুষ বিভিন্ন বিদ্যায় এমন সব তত্ত্ব পাইয়া গিয়াছে যাহাতে সেই বুঝিয়াছে যে, মানুষ যদি বিশ্বপ্রকৃতির ছন্দের সাথে নিজেকে মেলায়, তবে মানুষ প্রকৃত্র লীলার অংশীদার হৈয়া উঠিতে পারে।
আমরা বিচ্ছিন্নভাবে সমাজ বা রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের কথা বলি না। আমরা বিশ্বাস করি, খণ্ড খণ্ড ভাবে বিচার, সংস্কার বা প্রতিকারের রাস্তায় মুক্তি নাই। চাই সামগ্রিক বিচার এবং সামগ্রিক উদ্যোগ। সেইজন্যে মানুষের শিক্ষা বা নূতন মানুষ তৈয়ারির পরিকল্পনা লৈয়া ভাবিতে হয় এবং রাষ্ট্রিক তথা সামাজিক পুনর্গঠন লৈয়াও আমাদের কল্পনা পাঠক সাধারণের সামনে তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছি। আমরা ভাবি না যে, আমরা শেষ কথা বলিতেছি। আমরা যতদূর পর্য্যন্ত দেখিয়াছি, ততদূর পর্য্যন্ত আলোচনায় আনিয়াছি। নিত্য পরিবর্ত্তন এবং নিত্য সংশোধনের রাস্তা বন্ধ করা ঠিক নয়।
এই রচনার নিরাময় পদ্ধতি যদি-বা স্পষ্ট-নির্দ্দিষ্ট না হৈয়া থাকে, রোগনির্ণয় হৈয়াছে অনেক নিশ্চিত এবং লক্ষ্যণীয় এই যে, পশ্চিমী ভাবনাচিন্তা নয়, আমাদের দেশীয় ধ্যানধারণার জোরেই আমরা অনেক বেশী অগ্রসর হৈতে পারিয়াছি। শেষ কথা নয়, মাঝের কথা বলাই আমার উদ্দেশ্য, এই কথা বলিয়াই এক্ষণ বক্তব্যে ইতি টানিতেছি।
রবি চক্রবর্ত্তী রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত পুনঃপঠন, শব্দের অর্থ থেকে জগতের অর্থে — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।