প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের শিক্ষা পদ্ধতি ছিল গুরুগৃহ কেন্দ্রীক। শিক্ষার্থীরা গুরুর আশ্রমে দীর্ঘদিন থাকত এবং গুরু শিক্ষার্থীদের জীবন-যাপন থেকে শুরু করে প্রচলিত বিশেষায়িত বিষয় সমূহের উপর অধ্যায়ন করাতেন আগ্রহ এবং মেধা অনুসারে। ঐ সময়ের শিক্ষার ভিতর কৃষিকাজ হাতে কলমে শিক্ষা করা ছিল সব শিক্ষার্থীর জন্য অক্ষরজ্ঞান অর্জ্জন করার মতই মৌলিক এবং বাধ্যতামূলক বিষয়। অক্ষর জ্ঞান প্রদানের সাথে সাথে তাদের প্রত্যেককেই আলাদা আলাদা টুকরো জমি প্রদান করা হত এবং সেই জমিতে গুরুর নির্দ্দেশ মত আবাদ করে ফসল ফলাতে হত।
এই শিক্ষা পদ্ধতির দরুন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রথম পর্য্যায়েই নিজ দেশের মাটি-জল-আবহাওয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জ্জন করতে সক্ষম হত এবং অধীত বিষয়ের সাথে খুব সহজে তার দেশের মাটির সংযোগ স্থাপন এবং প্রয়োগ করতে পারত। ভারতবর্ষে অপ্রায়োগিক/অপ্রয়োজনীয় জ্ঞানের চর্চ্চা কখনো ছিল না। এর ফলে পান্ডিত্যের অসার-অহমিকা তৈরি হওয়ারও কোন সুযোগ থাকত না বরং অর্জ্জিত জ্ঞান কত বেশি মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো যায় সেটাই ছিল শিক্ষা অর্জ্জনের মৌলিক উদ্দেশ্যগত দিক। খুব অবাক করা বিষয় হলো এদেশের অক্ষরজ্ঞানহীন জনসমাজের ভিতর এখনও বিলুপ্ত প্রায় এরকম বিশ্বাস টিকে আছে যে এদেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজ তাদের অন্ধকার ভাগ্যাকাশে কোন একদিন সূর্য্যের মত জ্বলে উঠবে। রাতের অন্ধকারে নিজের শেষ সম্বলটুকু ও বিলিয়ে দিয়ে কেউ কেউ দুঃসাহসে বলে ওঠে “আমরা ওদের প্রদ্বীপের তেল জোগাবো ওরা আমাদের আলো জোগাবে”।
শিক্ষা পদ্ধতির ধারাবাহিক ক্রম-বিবর্তন, সমাজ, রাষ্ট্র, বিজ্ঞান ইত্যাদি পরিবর্ত্তন মারফত কালের ফেরে বর্ত্তমানে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে করে বাংলাদেশের মত দীর্ঘ উপনিবেশশাসিত দেশের ছেলেমেয়েরা সেই অর্থে নিজের আগ্রহই আবিষ্কার করতে পারে না, করতে পারলেও সে বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করার পথ বিভিন্ন কারণে সুগম্য হয় না, পড়ালেখা করতে পারলেও অধীত বিষয়ের জ্ঞান প্রয়োগে এ দেশের মাটি খুজে পায় না।
প্রসঙ্গান্তরে একটু ভিন্নবিষয়ের অবতারনা করতে হচ্ছে…
বাংলাদেশে ষাটের দশকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসাদের প্রায় সবাই ছিল তৎকালিন ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত জমিদার পরিবার থেকে উঠে আসা। ফলে বিপ্লব প্রাসঙ্গিক প্রয়োজনীয়তা তাদের বোধে যতটুকু না ছিল বাস্তবিক তার চাইতে অনেক বেশি ছিল সোভিয়েত-চীন-ভিয়েতনাম-কিউবার তাত্ত্বিক প্রতিফলন।
সামন্ত পরিবারের এই বিপ্লবীরা পারিবারিক ভাবে স্বচ্ছল থাকার কারণে শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্ত্তন আসছে একই সাথে পুজিঁর চরিত্র্য এবং মালিকানার পরিবর্ত্তন আসছে সেটাও বুঝতে পেরেছিলেন। ক্ষমতা এবং ঐতিহ্যের পারায় তারা সর্ব্বহারার স্লোগানের ভিতর নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাইতেছিলেন। খুব সংকীর্নদৃষ্টিতে এমনটাই দেখা যায় অন্তত বর্ত্তমান পরিস্থিতি দিয়ে বিচার করতে গেলে। তবেঁ সেটা ছিল এক ঐতিহাসিক পরিস্থিতি যা ঘটা ছিল অনিবার্য্য।
এসব কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কথায় বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষ স্বাধীনতার পরও ঘর থেকে বের হয়ে গেছে সর্ব্বহারাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তারা মার্ক্স, লেলিন, মাও সে তুং এর নাম মুখস্থ করতে শিখেছিল। তারা আমেরিকা, রাশিয়া, চীনের গল্প রূপকথার মত বিভোর হয়ে শুনতে শিখেছিল সেসময়।
৯০-এর দশকে এসে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চ্চার ধরনটা পাল্টে যেতে থাকে। সচেতনভাবে দেশে বিরাজনৈতিক চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করার আয়োজন চলে বিভিন্ন মাধ্যমে। যার ফলাফল একবিংশ শতকে এসে বাংলাদেশে তরুণদের ভিতর রাজনৈতিক এনার্কির বর্দ্ধিত সংক্রমন।
কমিউনিস্ট নেতাদের বিপ্লবী আদর্শ এদেশের মাটি-জল-আবহাওয়া পেল না… ফলে আদর্শিক শক্তির বিকৃত প্রকাশ ঘটার ইতিহাস আমাদের সবার জানা। পার্টিগুলোর ভিতর বিভাজন, শ্রেণী শত্রু খতমের নামে খুণ-খারাবি বাড়তে থাকায় একসময় এদেশের মানুষের কাছে তারা গনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিচিতি পেল।
শিক্ষার সীমাবদ্ধতা হল তা জ্ঞাত অর্থে সার্ব্বজনীন হলেও প্রয়োগ অর্থে দেশ-কাল-পাত্র শর্ত্ত মুক্ত হতে পারে না। এই শর্ত্তগত কারণেই শিক্ষা পদ্ধতির কাঠামো এবং বিষয় দেশ বা কালোত্তীর্ণ নয় বরং পুরোটা দেশজ ও কালিক হতে প্রয়োগগত কারণেই বাধ্য।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবী বা উদার গণতান্ত্রিক ধোয়া তোলা শিক্ষিত সমাজের নেতারা এদেশের জনগনের উন্নয়নের জায়গাটা আদতে কোথায় তার শিকড়টাই অনুসন্ধান করার তাগিদ অনুভব করেনি বা করতে চাননি। (চাইলে নদী গুলোর এই অবস্থা হত না, বন জঙ্গল ধ্বংস করে প্রকৃতি পরিবেশের বিপর্য্যয় ঘটাত না, এ দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা বিদেশী কোম্পানি গুলোর নিকট জীম্মি হয়ে যেত না।)
এদেশের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় চলমান বিচার ব্যবস্থা, উৎপাদন-বন্টন তথা সাংস্কৃতিক বোধ সমাজকে পরিচালনা করার জন্য এবং সমাজ প্রগতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পরিবর্ত্তি বৈশ্বিক ব্যবস্থার সাথে তা সমাজ দর্শন এবং রাজনৈতিক দর্শনের নিরিখে বিচার-প্রয়োগ করার কোন দায়ই কেউ নেয়নি।
যারা এসব একটু আধটু বোঝার চেষ্টা করে এরা রাজনীতি বিমূখ দায়হীন শুকনো জ্ঞানের হম্বি-তম্বি করে বেড়ানো বুদ্ধিজীবি গোছের আর যারা এসব বোঝে না কিন্তু এটা বোঝে যে সমাজে ক্ষমতার উপযোগিতা কতটুকু আর সেই ক্ষমতার কেন্দ্র রাজনীতি দ্বারা আচ্ছাদিত। সুতরাং তাদের যেতে হয় ক্ষমতার চর্চ্চা করতে রাজনীতিতে। পুজিঁর সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক যত সমান্তরাল হতে থাকে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সাথে সাথে পুজিঁও কেন্দ্রীভূত হতে থাকে।
এদেশের জনগন কোন রাজনৈতিক নেতাকে বিশ্বাস করতে চায় না এমনকি শিক্ষিত শ্রেণীকেও তারা বিশ্বাস এবং সম্মান কোনটাই করে না। শহুরে বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষগুলো যে ধড়িবাজ তা তারা এখন বুঝে ফেলেছে। এই অবিশ্বাস আর হরিলুটের যুগে দু-একজন যে কর্ম্মযোগী, জ্ঞানযোগী নেই তা সর্ব্বতোভাবে বলা যায় না।
এদেশের জন্য সত্যি সত্যি কিছু করতে হলে এদেশের নদী, মাটি, ফসল, বীজ, বন, পাহাড় বুঝতে হবে আগে। এসব বুঝতে হলে এসবের সাথে যাদের নাড়ীর সম্পর্ক তাদের বুঝতে হবে। দুর থেকে বই পড়ে বোঝার ফলাফল পেয়ে আসছে এদেশ। মাঠে নামলে হয়ত চেয়ারে বসে চুরি করার ইচ্ছেটা আর নাও থাকতে পারে। চোর বা রাজনীতিবিদ বা বিপ্লবী প্রথমে ভিন্ন হয় চেতনাবোধে তারপরে ভিন্ন বা সমগোত্রীয় হয় চেতনা প্রয়োগে।
শুভ বোধের উন্মেষ ঘটুক এবং উন্মেষিত বোধ যথাযথ প্রয়োগের দিশা/কাঠামো পাক।
শামীম রেজা রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, মন রে কৃষি কাজ জান না — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।