প্রবন্ধ রাঙা পথের ধূলায়

ধ্বনির থাকে প্রতিধ্বনি। অনেক সময় ঝগড়াঝাটিতে আমরা ব্যঙ্গ করি, ভেংচি কাটি। প্রতিধ্বনি ঋণী আছে ধ্বনির কাছে, সেটা অস্বীকার করতে গিয়ে সে ধ্বনির প্রতি মুখ ভ্যাংচায়, উপহাস করে যেন। এইজন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে / ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।’

ধ্বনি কী?

ধ্ব ক্রিয়ামূল থেকে জাত ধ্বনি। ধ্ব = ধারণ-বাহক। ধরে রয় যে। বঙ্গীয় শব্দকোষ ধ্বনিকে এভাবে ভেঙে দেখিয়েছেন ‘√ধ্বন + ই — ভাববাচ্যে’। ধ্ব বা ধারণা বহন সক্রিয় হলে ধ্বন (ধ্বনিত করা) হয়, ধ্বন গতিশীল যাতে তাই ধ্বনি। এর মানে ধ্বনি ধারণাকে গতিশীল ভাবে বহন করে। যে কোন ধ্বনিই তাই অর্থপূর্ণ। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ যাকে বলেছেন meaningful active sound।

তো ইংরেজগণ এলেন, তাঁরা ইতিহাস বদলে দিলেন তাঁদের মত করে, ভাষার ক্ষেত্র বাদ রইবে কেন! অর্থপূর্ণ সক্রিয় ধ্বনি তখন হয়ে গেল কেবল sound যা কোন ভাবেই বাংলার ধ্বনির ধারণার সাথে যায় না। sound মানে তা কোন ধারণা বা অর্থ বহন করে না, সে কেবলই নিষ্ক্রিয় আওয়াজ। পৃথিবীর কম ভাষাতেই আছে ধ্বনি মানে অর্থপূর্ণ আওয়াজ।

ভাষাবিজ্ঞানী Edgar H. Sturtcvant ভাষার যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সে অনুযায়ী যে অর্থপূর্ণ ধ্বনি মানুষের বাক্-যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত হয় তাই ভাষার মূল উপাদান। এর মানে হল সকল প্রকার ধ্বনি অর্থপূর্ণ নয়। আমাদের ভাষা অনুযায়ী বা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী ধ্বনি যেহেতু ধারণাকে গতিশীল ভাবে বহন করে কাজেই প্রতিটী ধ্বনিই অর্থপূর্ণ।

বিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনি বলেন, প্রত্যেক শব্দের গঠন বিশ্লেষণ করলে তার মূলে একটী ধাতু পাওয়া যাবে। সেই ধাতুটীর একটী মূল অর্থ আছে। ধাতুর এই মূল অর্থের সাথে ঐ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন শব্দের অর্থের যোগ আছে। পাণিনির এই মতবাদ root-theory নামে অভিহিত।

ধ্বনির লিখিত রূপ হল বর্ণ। জগতে ক্রিয়া আছে, ক্রিয়াকারী আছে, ক্রিয়ার ঘটনাবলীও আছে। যেমন গমন একটী ক্রিয়া, কেউ যখন গমন করে তখনই কেবল গমন ক্রিয়াটী বোঝা সম্ভব, ক্রিয়াকারী বা গমনকারীর মাধ্যমে। এই গমন গ বর্ণ দ্বারা অস্তিত্ব লাভ করে। জগতের প্রতিটী ক্রিয়া আধেয় রূপে কোন না কোন ক্রিয়াকারীকে আধাররূপে বরণ করে তার মাধ্যমে সক্রিয় হয়েছে। এইভাবে ক্রিয়ার আধাররূপে বরেণ্য হয়ে গড়ে ওঠেছে প্রতিটী বর্ণ এবং তা প্রাকৃতিক ভাবেই। ক্রিয়াকারী ছাড়া ক্রিয়াগুলি যেন দেহহীন আত্মা।

David Bohm এর তথ্য অনুযায়ী, মানুষ যে সকল ক্রিয়া করে তা সম্পাদন করার জন্য সেই ক্রিয়াগুলি মানুষকে ক্রিয়াকারীকে খুঁজে আধাররূপে বরণ করে নেয়। পণ্ডিতদের মতে এই জগৎ ক্রিয়া (action) ও ক্রিয়াকারীর (actor) এক বিশাল ক্রীড়াক্ষেত্র।

আমাদের চারপাশে কিংবা আমাদের ঘিরে অনেক ঘটনা ঘটে। সেগুলো অন্যদের জানান দিই আমরা। যে ঘটনাগুলো ঘটে, সেগুলো তো ক্রিয়া। ক্রিয়া ছাড়া ঘটনা ঘটবে না। মানুষের বেলায় এই জানান দেওয়াটা চরম সত্য, আমি রাগ করেছি আমি খুশি হয়েছি এগুলো আমার অনুভূতি। আমি একটা কাজ করেছি, আমার একটা ক্ষতি হল আমাদের এই বিষয়গুলোর অংশীদার অন্যদের করি, জানিয়ে করি, তার মতামত নিতে জানাই।

মানুষ তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে, বাকযন্ত্রের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। ধ্বনির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ক্রিয়া ও ক্রিয়াকারী, উভয়কে ভাবটাকে ধ্বনি বা আওয়াজে পরিবর্ত্তিত করে নিতে হয়। আরেকবার মনে করি আমরা, ধ্বনি হল ধারণা সক্রিয় ভাবে বহন যাহাতে, ইংরেজীতে meaningful active sound আর বর্ণ হল ক্রিয়ার আধাররূপে বরেণ্য যে vehicle for meanigful active sound. অর্থাৎ ধ্বনি ধারণাকে বহন করছে সক্রিয়ভাবে আবার বর্ণ দ্বারা ধ্বনি বাহিত হচ্ছে। ধ্বনির বাহন হল বর্ণ। কাজেই প্রত্যেকটী বর্ণের অর্থ আছে। সেই অর্থপূর্ণ বর্ণ যতগুলো শব্দ তৈরী করবে সেগুলোর অর্থ থাকবে। খেয়াল করি মানুষ তার ক্রিয়া বা কাজের ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন শব্দ তৈরী করে চলেছে, ব্যাকরণের এখানে কিছু করার নেই। এ প্রসঙ্গে আমরা আব্রাহাম নোয়াম চমস্কির কাছে যেতে পারি, যিনি রূপান্তরমূলক সৃজনশীল ভাষাবিজ্ঞান প্রবর্ত্তন করেছেন, যেখানে শব্দের অর্থের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

চমস্কি দুই ধরনের ভাষার কথা বলেছেন; একটা ‘ভেতরের ভাষা’ আর একটা মানুষের ‘বাইরের ভাষা’। প্রত্যেক মানুষই সসীম শব্দ দিয়ে অসীম বাক্য বানাতে পারে। এ অসীম বাক্য বানানোর ক্ষমতা মানুষের ‘সহজাত’। তিনি আরো বলেছেন, ‘ভাষার শব্দভান্ডার থেকে চয়িত শব্দগুলো সুসংবদ্ধ গাণিতিক নিয়মানুযায়ী সজ্জিত।’ বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ আমাদের বর্ণমালার বিষয়েও একই কথা বলেছেন, যাকে মানুষ চিনতে পেরেছে প্রাকৃতিকভাবে শব্দজগতে ও রূপজগতে।

আমাদের শব্দজ্ঞানী পূর্ব্বপুরুষেরা মানুষের মুখের ধ্বনিগুলিকে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ এই দুইভাগে ভাগে করে গেছেন। ঋ বর্ণটীকে অনেক ভাষাবিদ অর্ধব্যঞ্জন রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। যদিও এটী স্বরবর্ণের তালিকায় স্থান পেয়েছে। কেন ঋ অর্ধব্যঞ্জন?

ঋ কেন অর্দ্ধব্যঞ্জন সেটীতে যাবার আগে শব্দার্থের বিষয়টীতে আসি। পানি একটী শব্দ, অঞ্চলভেদে একে ফানি, হানি, মানি উচ্চারিত হতে দেখা যায়। কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে পান গতিশীল যাতে তা পানি, পানি এর আধার হল পানী। আমরা যাহা পান করি তাহা পানী/জল; পান হল পা (পাওয়া) অন থাকে যাতে। বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুযায়ী √পা + অন (ল্যুট) — ভাববাচ্যে। বঙ্গীয় শব্দকোষ পান শব্দের অনেকটী অর্থ দিয়েছেন যার কয়েকটী এরকম, দ্রবদ্রব্যের গলাধঃকরণ, পেয়দ্রব্যমাত্র, মদ্যপান, পর্ণ যা সুপারী যোগে খাওয়া হয় ইত্যাদি। বাংলা অভিধান পান করা এর অর্থ দিয়েছেন খাওয়া, পান করা, সেবন করা, টানা, সুরা, মদ, পান, পানীয়, পেয়, সুরাপান, পানীয় দ্রব্য, শরবত, মদ্যপান করা, সুরাপান করা, মাতাল করা, শোষণ করা, পানীয় ইত্যাদি।

কাজেই যে কোন শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অনুসন্ধানই তার সঠিক অর্থ খুঁজে দিতে পারে। অনেক সময় বর্ণগুলো সঠিক উচ্চারণ সম্ভব হয় না। যেমন পণ ও মন। উচ্চারণ করার সময় আলাদা করা খুবই জটিল।

ক্রিয়াভিত্তিক ব্যাখ্যা—

* পণ হল পায়ীর রহস্যরূপের বোধন যাহাতে, সত্তার আপন অভাব পূরণের বোধ যাহাতে।
* মন হল পরিমিত-করণ বা পরিমাপন অনকৃত যাতে, পরিমাপ করে যে, যাহা পরিমিত বা পরিমাপিত হয়েছে।

ঙ, ঞ, ণ, ন, ম এই পাঁচটী হল ং বা ংরূপিনীর রহস্যরূপের পাঁচটী ধ্বনির প্রতীক। ঙ, ঞ, ণ-তে ং-রূপিনী অব্যক্ত, ন-এ আধা-ব্যক্ত, ম-তে সে ব্যক্ত। এজন্য ং, ঙ, ঞ, ণ দিয়ে শব্দ শুরু করা যায় না। ণ হল টঙ্কারী রহস্য। ন হল ন্-অন করে যে। কোন সত্তা যখন থাকে তখন ‘ন’ তাকে না করে, তাড়িয়ে দেয়, বিলুপ্ত করে। যখন কিছুই থাকে না তখন ‘না’ থাকে। ন তখন তাকে হ্যাঁ করে দেয়, যাকে বলে অন করা। অর্থাৎ থাকলে না, না থাকলে হ্যাঁ এজন্য সে একই সাথে নাশকারী ও সৃষ্টিকারী। কাজেই ণ ও ন এর কাজ এক নয়। সেরকম শ, ষ, স এই তিনটী বর্ণের কাজও আলাদা আলাদা।

বর্ণমালায় ঋ-কে স্বরবর্ণে রাখা হয়েছে কারণ সে একাই উচ্চারিত পারে। ঋ-এর মধ্যে ঘূর্ণায়মানতার বা পুনরাবৃত্তিকরণের বা চক্রগতির একটা বিষয় আছে। ঋ গতিমূলক ও উগ্রতেজের আধার। ক্রমাগত আবর্ত্তনের ফলে সে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, অধঃপতিত হয়ে র (পুনরাবৃত্তিকারী) হয়। অমরকোষ মতে ঋ-এর নিকৃষ্ট রূপ হচ্ছে রেফ। অধঃপতিত ‘র’ শীর্ষে সক্রিয় হয়ে রেফ হয়। ঋ-এর পুনরাবৃত্তিকরণের ধারণাই চাকা আবিষ্কারে সহায়ক হয়েছিল।

ভাষাকে সর্ব্বজনীন করার একটা উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়েছে। এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি। ভিনদেশে গেলে ভাষা না জানলে মানুষ ইশারায় ইঙ্গিতে অথবা ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করে। ভাষাকে তাই একটী সর্ব্বজনীন সুনির্দ্দিষ্ট রূপ দেওয়ার প্রয়াস হল আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা। আন্তর্জাতিক ভাষা হল কৃত্রিম ভাষা। এরকম একটী ভাষার স্বপ্ন দেখেছিলেন দার্শনিক দেকার্ত খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। এরপর আরও বিভিন্ন মনিষীর পরিকল্পনা শেষে যে কৃত্রিম ভাষার সৃষ্টি হয় তা হল এসপেরান্তো। পোল্যান্ডের চক্ষু চিকিৎসক ড. এল এল জামেনহোফ ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে এসপেরান্তো বিষয়ে তাঁর পরিকল্পনা প্রকাশ করেন।

কিন্তু কেন এই পরিকল্পনা?
কারণ—

১। বানান ও উচ্চারণ সমস্যা বা বৈষম্য
২। এই ভাষায় ব্যাকরণে মাত্র ১৬টী নিয়ম

১৯৮৮ সালে এই বর্ণমালাটীকে সংশোধিত করা হয় যাতে একই বর্ণ বিভিন্ন ভাষাতেও তার উচ্চারণ বজায় রাখে। আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালায়—

১। প্রত্যেক তাৎপর্য্যপূর্ণ মূলধ্বনির জন্য একটী করে বর্ণ থাকবে।
২। কোন ধ্বনির জন্য একের বেশী বর্ণ থাকবে না।

এই ভাষা যে কোন ভাষার ধ্বনিভিত্তিক এবং স্বনিমভিত্তিক প্রতিবর্ণিকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের সব কথিত ভাষার সব ধ্বনিকে প্রমিতভাবে তুলে ধরা এর উদ্দেশ্য। বর্ত্তমানে ইংরেজী, জার্ম্মান, ফারসী ও আরবী ভাষায় বর্ণগুলি ব্যবহৃত হয়।

ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য, দৈনন্দিন কাজকর্ম্ম জীবনাচরণ ভাষায় প্রভাব ফেলে। কৃত্রিম ভাষায় কাজ চালানো হয়ত যাবে, কিন্তু মনের কথার যে সাবলীল প্রকাশ তা সম্ভব নয়।

কৃত্রিম ভাষা কার দরকার? বাংলাদেশের যে কৃষক রোদে পুড়ে ফসল ফলান, যে গার্মেন্টস কর্ম্মী হাড়ভাঙা শ্রম দিয়ে পোষাক তৈরী করেন কিংবা ইথিওপিয়া সোমালিয়ার অনাহারক্লিষ্ট শিশুর মা বাবার? এই ভাষার যারা পরিকল্পক তাঁদের ঐতিহ্য ইতিহাস কী?

ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি এই জনপদ চিরদিন শাসিত হয়েছে বহিরাগত দ্বারা। সমৃদ্ধ এই জনপদের মানুষজন নিজেরা নিজেদের সকল প্রয়োজন মিটাত নিজেরাই উৎপন্ন করত। এই অঞ্চলের উর্ব্বর মাটীতে যেন সোনা ফলত। তাই বাণিজ্যের নামে বহিরাগতরা এসেছে। এসেছে চীন, এসেছে আরব, তুর্কী, ফারসী, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, সবশেষে ইংরেজ। এই বহিরাগতরা তাদের নিজেদের ভাষাকে চাপিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজভাষা হিসেবে। এই দেশের মানুষকে কামলা খাটিয়ে জুলুম অত্যাচার করে দখল করেছে ভূমী, দখল করেছে শাসনভার। যে সময়ে এই দেশের লোকজন পরিশ্রম করে উৎপাদন করেছে বিভিন্ন ফসল, তখন বহিরাগতরা করেছে কূটকৌশল। এই বহিরাগতদের নিজস্ব সম্পৎ ছিল না, এরা এই দেশের সম্পৎ আত্মসাৎ করে সম্পৎশালী হয়েছে। কূটকৌশলে জয়ী হয়ে করায়ত্ত করেছে দেশ, বিস্তার করেছে সাম্রাজ্য। শিল্পবিপ্লবের পর ধীরে ধীরে এই জনপদের জনগণ পরিণত হয়েছে স্বল্পমূল্যের মজুরশ্রেণীতে। তারা তাদের মত করে শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে। উৎপাদন খাতকে করেছে বঞ্চিত, আজও আমাদের উৎপাদক শ্রেণী তার উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য পায় না।

যখনই সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের আগ্রাসন চালায়, তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি, রাজনীতি। পুঁজির বাজার সৃষ্টি তাঁদের লক্ষ্য, নয় মানুষের সেবা করা। এজন্য তাঁরা মারণাস্ত্র তৈরী করে, জীবাণু অস্ত্র তৈরী করে, আবার যুদ্ধ বন্ধের কূটনীতি করে, ঔষধও তৈরী করে। এর ফলে দরিদ্র আরও দরিদ্রতর হচ্ছে, কৌশলে নিয়ে যাচ্ছে মেধা, নিয়ে যাচ্ছে শ্রম। যে দেশ বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই দেশ রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করবে। পিছিয়ে পড়া দেশের মানুষ ধনী দেশের সেবা করার জন্য দেশান্তরী হবে। এসবগুলোই ভাষাকে আক্রান্ত করে। বিশ্বরাজনীতিতে চীন অচিরেই যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দেবে, ইতিমধ্যেই সে ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এখন লোকজন দলে দলে চাইনীজ ভাষা শিখবে। বাজার দখলের জন্য ইতিমধ্যেই চীন কিছু দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের দেশ কবে সেই পর্য্যায়ে পৌঁছাবে? না, আমরা তো কোন আবিষ্কারমূলক কাজ করছি না, জ্ঞান বিজ্ঞানে নতুন কোন সংযোজনের চেষ্টা আমাদের নেই। আমাদের বর্ত্তমান প্রজন্ম ইন্টারনেটে ডুবে যাচ্ছে দিন দিন। ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে, ধনিক শ্রেণী রাষ্ট্রের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বেগমপাড়া গড়ছে উন্নতদেশে। যাদের কিছু করার আছে, তাঁরাই অধিক প্রাচুর্য্যের লোভে দেশান্তরী। একটী ভাষার সম্পৎ, অলংকার, ঐতিহ্য দিয়ে নোবেল জেতা যাবে, ভাষার বিকাশ হবে যে ভাষায় কথা বললে অর্থাগম সহজ হবে সেই ভাষার। আধিপত্যবাদের এমনই শক্তি তাঁরা ইতিহাস বদলে ফেলে, অন্যের সম্পৎকে অনায়াসে নিজের বলে প্রচার করে। ইংরেজের ইতিহাস পড়লে সে বিষয় জানা যায়।

এবার আসি চীন প্রসঙ্গে—

গত কয়েকদশকে চীন সারাবিশ্বের ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তিতেও তারা এগিয়ে সারা বিশ্বে। কিন্তু তারা নিজেদের মাতৃভাষা ম্যান্ডারিনেই কথা বলে, কাজকর্ম্ম, জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনা সব নিজের ভাষায়ই করে। ব্যাবসার কাজেও তারা ইংরেজী নয়, মাতৃভাষাই ব্যাবহার করে।

চিকিৎসা বিজ্ঞান, গবেষণা সবদিকেই তারা সারাবিশ্বকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তারা তাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্পতে পরিণত করেছে, তারা অন্য কোন ভাষাকে প্রাধান্য দেয়নি। নিজের মাতৃভাষা নিয়েই তারা হতে চলেছে বিশ্বে একনম্বর।

সেই জায়গায় আমরা কী করি! আমাদের ভাষায় গবেষণা নেই, প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা নেই। অনবরত ইংরেজীর সাথে নিজের ভাষাকে তুলনা করি, অন্যদেশের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে আমরা লিখতে পারি না, জটিল লাগে সেই অজুহাতে বর্ণ কেটে দেওয়ার জন্য সুচিন্তিত মতামত দিই। অন্যের থেকে ধার করা জিনিসে ভাগ্য উন্নয়ন হয় না। যার থেকে ধার আনা সে চাইবে তার মত করে সব হোক, তার চিন্তাধারা সবকিছুতে প্রতিফলিত হোক। এমনিতেই আমরা ভিন্ন ভাষার আগ্রাসনে পড়েছি, কারণ আমাদের ভাষায় আমরা উচ্চশিক্ষা নিই না, গবেষণা করি না, প্রযুক্তির উৎকর্ষে আমরা সাধনা করি না। আমাদের সাধনা কেবল নিজেকে নিয়ে। কোনমতে ভিনদেশী ভাষা শিখে, ভিনদেশে থিতু হতে পারলেই জীবন স্বার্থক যেন।

তো যদি এমন চলতে থাকে তবে বাংলাভাষা গভীর সংকটে পড়বে একদিন, সে বলাই যায়। সর্ব্বস্তরে বাংলা প্রচলন মুখের কথা নয় কেবল উচ্চশিক্ষা ও গবেষণামূলক কর্ম্মকাণ্ড বাংলায় হওয়া দরকার, জ্ঞান বিজ্ঞানে নতুন নতুন আবিষ্কারকে উৎসাহিত করা প্রণোদনা দেওয়া দরকার। ভাষাপ্রেম, স্বদেশপ্রেম ছাড়া একটী জাতির ভাগ্য উন্নয়ন করা যাবে না।

 

 

 অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, রাঙা পথের ধূলায় — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *