প্রবন্ধ নিশীর ডাক— নতুন ব্যাকরণ চাই

প্রসঙ্গ
একটা কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে : বাংলা ব্যাকরণের সংস্কার হোক। অনেকের মুখে দাবীটা আরও জোরালো— তাঁরা বলেন, বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ চাই। তাঁদের অভিযোগ, বাংলা ব্যাকরণ নামে যে বিদ্যার চর্চ্চা হচ্ছে তা আসলে বেনামীতে সংস্কৃত ব্যাকরণ।

কথাটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ণত্ববিধান, ষত্ববিধান, সন্ধিবিচ্ছেদ, সমাসপ্রকরণ, প্রকৃতি-প্রত্যয় নির্দ্দেশ, বাচ্যান্তর, বিশেষ্য ও বিশেষণ শব্দের লিঙ্গ প্রকরণ ইত্যাদি নিয়ে বহু কাল ধরে বাংলা ব্যাকরণে যে আলোচনার অবতারণা হয়ে আসছে, তা যেন সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে তুলে আনা জিনিস। খাঁটী বাংলা শব্দের সন্ধি বা সমাস নিয়েও আলোচনা থাকে বটে, কিন্তু তাও সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে। অবশ্য, ক্রিয়াপদ নিয়ে আলোচনা-অংশে ইংরেজী ব্যাকরণের Tense-তত্ত্বকে কাজে লাগানো হয়। কারক ও বিভক্তির আলোচনায় সংস্কৃত ও ইংরেজী দুই ব্যাকরণের মিশ্রণ থাকে। স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে, বাংলা ভাষা কি এত দীন ভিখারী যে তার নিজস্ব ব্যাকরণ থাকবে না?

ব্যাকরণের সংক্ষিপ্ত সংবাদ—
যাঁরা নতুন ব্যাকরণের দাবী তুলছেন তাঁদের কথা শুনে মনে হবে অন্য ভাষাগুলি বুঝিবা তাদের নিজ নিজ ব্যাকরণ তৈয়ার করে ফেলেছে, পেছনে পড়ে আছে শুধু হতভাগ্য বাংলাভাষা। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে, ঠিক নিজস্ব ব্যাকরণ নয়, বলা যেতে পারে ‘নিজস্ব ব্যাকরণের কাছাকাছি কিছু বস্তু’ হয়েছে— এমন কথা বলার দাবীদার হতে পারে কেবল কয়েকটা ধ্রুপদী ভাষা, যথা— সংস্কৃত, গ্রীক ল্যাটিন, হিব্রু, আরবী ইত্যাদি। এই ভাষাগুলিতে নিজ নিজ ভাষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ব্যাকরণতত্ত্বের চর্চ্চা হয়েছিল এবং তার ফলে সম্ভব হয়েছিল তাদের ভাষার একধরনের সামগ্রিক নিয়মাবলী, যাকে একালে আমরা ব্যাকরণ বলে থাকি। তবে মনে রাখা ভাল, তাঁদের সেই ব্যাকরণের পিছনে ছিল দুইটা স্বতন্ত্র তাত্ত্বিক কাঠামো, যা উদ্ভূত হয়েছিল ভারতে ও গ্রীসে। গ্রীকের সেই ব্যাকরণ-কাঠামোকে সামান্য পরিমার্জ্জিত করে নিয়েছিলেন ল্যাটিন ভাষার বৈয়াকরণরা। এবং সেই ল্যাটিন ব্যাকরণের তত্ত্বমতেই ইয়োরোপের ভাষাগুলির ব্যাকরণ সৃষ্টি হয় রেনেসাঁসের যুগে, বা আরও আগে, মধ্যযুগে।

বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বিষয়ে আজ যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, অনেক দিন ধরে একই অভিযোগ শোনা গেছে ইঙ্গ-মার্কিনীদের মুখে। তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন যে, ইংরেজীর ব্যাকরণ বলে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে যা শেখানো হয়ে আসছে, তা আসলে ল্যাটিন ব্যাকরণ এবং তার সার্থকতা এই যে, তা জানা থাকলে ল্যাটিন ভাষা ও ব্যাকরণ শেখা সহজ হয়। প্রশ্ন করা যায়, এই অসুবিধা সত্ত্বেও কেন ইংরেজিভাষীরা ল্যাটিন ব্যাকরণকে দীর্ঘকাল ধরে আদর্শস্থানীয় করে রেখেছিলেন? ল্যাটিনভাষী রাজার অধীনস্থ তো তাঁরা ছিলেন না! অন্য দিকে এইটাও লক্ষণীয় যে, ল্যাটিনভাষী রোমানরা বিজেতা হয়েও বিজিত গ্রীকদের কাছ থেকে ব্যাকরণ, দর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি আয়ত্ত করে নেন।

প্রাশ্চাত্যের ব্যাকরণচিন্তা যেখানে পৌঁছেছে …

আসলে যে কোন ভাষায় কোনকিছুর ব্যাখ্যা বা বর্ণনা করতে গেলে মূলে একটা তাত্ত্বিক হিসেবের দরকার। যেমন আমাদের লেখার ভাষায়, আমরা পদ, বাক্য ইত্যাদিকে আলাদা করে দেখাই। কিন্তু আমাদের মুখের ভাষায় শব্দে শব্দে প্রায়ই ছেদ থাকে না। আবার এক শব্দের মধ্যেই এক বা একাধিক ছেদ থাকতে পারে। বাক্যের ক্ষেত্রেও এক ব্যাপার দেখতে পাওয়া যায়। মুখের উচ্চারণের মধ্যে যে ছেদ ঘটে, লেখার সময়ে তা দেখতে পাই না। কতটা উচ্চারণকে আমরা এক শব্দ (অথবা পদ), বা এক বাক্য বলে ধরব, তা ঠিক করার জন্যই অনেক রকমের তুলনামূলক পর্য্যালোচনা চাই।

তার পরে আসে নানা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শব্দের কী রূপান্তর ঘটছে তা লক্ষ করে যাওয়া এবং বিভিন্ন রূপান্তরের পিছনের যুক্তিটাকে আবিষ্কার করা। সুতরাং বিশেষ্য-বিশেষণ পদের জন্য শব্দরূপ (Declension), আর ক্রিয়াপদের প্রয়োজনে ধাতুরূপ (Conjugation)— ল্যাটিন ব্যাকরণে যাদের একত্রে বলা হয় Accidence— তার চর্চ্চা হয়ে পড়ে আবশ্যিক। বিশেষ্য পদ ও ক্রিয়াপদের মধ্যে যে সম্পর্কজাল, যা নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের নানা রূপান্তর, তাকে বুঝতে হয়; এবং বাক্যের মধ্যে কোন পারম্পর্য্য শব্দদের সাজানো হবে, সেই তত্ত্ব বা Syntax, সেটারও চর্চ্চা প্রয়োজন।

যে ব্যাকরণ-তত্ত্বের সাহায্যে গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষার অন্তর্নিহিত নিয়মগুলি বোঝা গিয়েছিল— অন্তত বোঝা গেছে বলে মনে হয়েছিল পণ্ডিতদের— ইংরেজীর পক্ষে তা খুব সুবিধের হয়নি। চরিত্রের দিক থেকে ইংরেজী ভাষা ওদের থেকে ভিন্ন ধরনের।

ল্যাটিন ছিল সংস্কৃত বা গ্রীকের মত Flexional ভাষা, অর্থাৎ এমন একটা ভাষা যেখানে শব্দের Inflection [= শব্দরূপ (Declension) + ধাতুরূপ (Conjugation)] নামক ব্যবস্থাটার অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ক্রিয়াপদের রূপ থেকে জানা যেত বর্ত্তমান বক্তার মনোভাব সম্পর্কে অনেক তথ্য, তেমনি বিশেষ্য পদের রূপ থেকে বোঝা যেত তার (অর্থাৎ যা সূচিত হচ্ছে বিশেষ্য পদটা দিয়ে) কী সম্পর্ক ক্রিয়ার সঙ্গে, এবং বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রাণী, বা বস্তুর সঙ্গেই বা তার কী সম্পর্ক।

ইংরেজীতে কিন্তু বিশেষ্য বা ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত শব্দের রূপান্তর হয়ে থাকে অনেক কম। ৬০০ থেকে ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেকার ইংরেজী গদ্য-পদ্যের নমুনা থেকে বোঝা যায় ইংরেজী ভাষা কী দ্রুত হারে তার প্রাচীন Flexional রূপ (প্রাচীন জার্ম্মান থেকে আগত স্বভাব) থেকে বর্ত্তমান Analytic রূপের দিকে এগিয়ে এসেছে, প্রাচীন ইংরেজী শব্দের শেষে থাকা প্রত্যয়কে (flexional endings-কে) কী দ্রুত হারে ক্রমাগত মোচন করে বা বাতিল করে অতীত থেকে বর্ত্তমানের Analytic রূপের দিকে এগিয়ে এসেছে। ভাষাতত্ত্বের চর্চ্চাকারীরা জানেন, Inflection-রহিত ভাষার পারিভাষিক পরিচয় Analytic বা Isolating ভাষা এবং একালের ইংরেজী ভাষা সে স্বভাবের খুব কাছে এসে গিয়েছে।

ল্যাটিন-সদৃশ চরিত্রের প্রাচীন জার্ম্মান থেকে আজকের ইংরেজীতে রূপান্তরের চরিত্র সংক্ষেপে বোঝার জন্য আমরা বাংলাভাষায় ক্রিয়াবাচক শব্দের যে রুপান্তর হয়, তার সঙ্গে ইংরেজীর ক্রিয়াবাচক শব্দের রূপান্তরের তুলনা করতে পারি। বাংলার কর্ ধাতু, আর তার পাশে ইংরজীর do আর make-এর রূপান্তরগুলি লক্ষ করুন।

বাংলার করি, কর্, কর, করিস, করে, করেন, করেছে, করেছি, করেছ, করেছেন, করলাম, করেছিলাম, করেছিলে, করেছিলেন, করছিল, করিত, করিতাম, করিতেন, করব, করবেন ইত্যাদি ত্রিশ-চল্লিশটা রূপ পাব, শুধু চলিত ভাষায়।

এর পাশে do আর make-এর এই ক’টা মাত্র রূপ পাওয়া যায়— do, does, did, doing done মোট পাঁচটা; আর make, makes, making, made এই চারটা।

আর যদি put বা set-কে ধরা যায় তবে এক একটার ক্ষেত্রে মোট তিনটা রূপ, যথা put, puts, putting। বাংলাতে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার্য্য শব্দ (অর্থাৎ প্রাতিপদিক) এর বেলায়ও খুব কম রূপান্তর হয় না। বিশেষ করে শব্দের শেষে টি, টা, গুলি ইত্যাদি প্রত্যৌ যোগ হয়ে শব্দের রূপান্তর যথেষ্ট সংখ্যাতেই হয়।

বাংলা ‘মানুষ’ শব্দের বহুসংখ্যক রূপান্তর হয়, যেমন মানুষ, মানুষের, মানুষটা, মানুষটার, মানুষটা, মানুষটার, মানুষগুলি, মানুষগুলির, মানুষিক, অমানুষিক; আর ইংরেজী man-এর রূপ মোট চারটা— man, men, man’s, men’s।

এত কম রূপান্তর করেও verb-এর tense ব্যাপারটাকে ইংরেজী সমাধা করে নেয় be, am, is, are, was, were, shall, will প্রভৃতি সহযোগী verb-এর এক বা একাধিককে কাজে লাগিয়ে এবং বিশেষ্য পদের বেলায় in, to, at, on, of, from, by ইত্যাদি বিশ ত্রিশটা preposition-কে কাজে লাগিয়ে। …

মুশকিল হয় তখন, যখন ইংরেজীর শব্দ বা বাক্যগঠনের যুক্তি এবং ইংরেজী ব্যবহারের উচিৎ-অনুচিতের সংজ্ঞা খোঁজা হয় ল্যাটিন ব্যাকরণের তত্ত্বের মধ্যে। ল্যাটিন ব্যাকরণের চাহিদা মত ইংরেজীর মধ্যে Finite Verb পেতে গিয়ে Auxiliary Verb-কে জোর করে জুড়তে হয় Principal Verb-এর সঙ্গে। বলতে হয় যে is going, has gone, will go ইত্যাদি, বা has been going— এগুলি দু-তিনটে verb মিলে Finite Verb। সেরকম ল্যাটিনের ব্যাকরণের অনুকরণে Subjunctive Mood খুঁজতে গিয়ে If I were / Had I been / If he be ইত্যাদি অল্প কয়েকটা প্রয়োগ খুঁজে পাওয়া যায় ইংরেজীতে।

আবার ল্যাটিন ব্যাকরণের নিয়মে প্রতিটা বাক্যে কর্ত্তা ও ক্রিয়ার খোঁজ করলে মনে হবে যে, It is raining / It is hot প্রভৃতি বাক্যে ‘It’ যেন এই দুইটা বাক্যে কর্ত্তা। ল্যাটিনপন্থী ব্যাকরণের দাবীতে ইংরেজীর পক্ষে স্বাভাবিক it’s me না বলে অনেককে বলতে হয়েছে ‘It is I’। আবার ঐ ব্যাকরণের দাবীতে Preposition-কে সব সময় সংশ্লিষ্ট noun বা pronoun-এর আগে আনতে হয়েছে, যদিও তা বহু সময়ই ইংরেজীর নিজস্ব রীতির বিরুদ্ধে। ফলে ‘Who has he spoken to’ না বলে বলতে হয়েছে ‘To whom has he spoken?’ এই রকম অনাচারে বিরক্ত হয়ে বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী চার্চ্চিল বলেছিলেন বিদ্রূপের স্বরে— ‘This is the sort of English up with which I will not put’।

এর থেকেও বড় মুশকিল বোধ করি এই যে, ইংরেজী বাক্যের মধ্যে বিভিন্ন রকমের শব্দের স্থিরনির্দ্দিষ্ট অবস্থানের তাৎপর্য্য নিয়ে ল্যাটিনপন্থী ব্যাকরণে কোন তত্ত্ব না থাকা। ‘The tiger killed the man’ আর ‘The man killed the tiger’— এই দুইটা বাক্যে কে kill কাজটা করেছে তা বোঝা যাচ্ছে killed-এর আগে কার নাম ব্যবহার হয়েছে তা থেকে; man বা tiger শব্দের রূপান্তর থেকে নয়, কারণ তাদের কোনরকম রূপান্তর হয়নি। [যেমন বাংলায় হয়— ‘বাঘটাকে মানুষটা মারিল’, কিংবা, ‘মানুষটা বাঘটাকে মারিল’, দুইটা বাক্যেই শব্দের অবস্থানের ওপর অর্থ নির্ভর করছে না, করে মানুষ ও বাঘ শব্দ দুইটার রূপান্তরের ওপর]।

তবে এরকম রূপান্তরহীন শব্দের অবস্থান-নির্ভর অর্থের এই রীতিটা কিন্তু শুধুমাত্র ইংরেজী ভাষারই সৃষ্টিছাড়া রীতি নয়। পৃথেবীর অনেক ভাষাতেই শব্দের রূপান্তর হয় না, তা সে শব্দ বিশেষ্য বা ক্রিয়া যার কাজ-ই করুক। চীনা ভাষা হল এই রকম ভাষার জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ। সেখানে প্রতিটা শব্দই যেন অব্যয়! চীনা ভাষার বাক্যে এক একটা শব্দ ক্রিয়া, বস্তু না কোন গুণগত বৈশিষ্ট্য বোঝাচ্ছে, এবং বাক্যটাতে মোটের ওপর কী বোঝাচ্ছে তা বোঝা যায় বাক্যে শব্দগুলির অবস্থান থেকে।

এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইংরেজী ভাষারও বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেল। ইংরেজী বাক্যমাত্রকে কয়েকটা বিভাজ্য অংশে ভাগ করে বাক্যকে দেখা হল সেই অংশগুলির [Noun Phrase, Verb Phrase ইত্যাদির] নিয়মমাফিক সন্নিবেশ হিসেবে। শুরু হয়ে গেল Structural Linguistics। অনেক কাজ-ও হল এই পথে, অর্থাৎ Phrase Structure Grammar-এর পথে। Syntax-এর চর্চ্চার রাস্তা ধরে চূড়ান্ত কাজ করলেন নোয়ম চমস্কী। তিনি দেখলেন, যে কোন ভাষার ব্যাকরণের, অথবা বাক্যগঠনের নিয়মাবলীর, দুইটা স্তর আছে। উপরের স্তরটা, বা উপরের ব্যাকরণটা হল এক এক ভাষার এক এক রকম, কিন্তু তার নীচের অর্থাৎ গভীরের স্তরের প্রক্রিয়া বা নিয়মগুলির হল সকল ভাষার ক্ষেত্রেই এক রকমের।

তবে বাক্যের মধ্যে শব্দের অবস্থান থেকেও ভাষাবিজ্ঞানীর কাছে বেশী অধরা থেকে গেল কথা বলার সময় অর্থাৎ ভাষা উচ্চারণের সময় কণ্ঠস্বরের ওঠানামার তত্ত্ব। ফলে ওঠানামার ওপর বাক্যার্থের পরিবর্ত্তন যে নির্ভর করে তার উদাহরণ আমরা ইংরেজী এবং বাংলা দুই ভাষাতেই পাব। বাক্যতুল্য শব্দের ক্ষেত্রেও উচ্চারণ অর্থকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। Yes, well, আচ্ছা— বিভিন্ন রকমের অর্থ বহন করে বিভিন্ন উচ্চারণে। আবার ‘You are coming’ ‘তুমি আসছ’— এই বাক্য দুইটা আদেশ, জিজ্ঞাসা, না আর কিছু, তা বোঝা যায় স্বরের ওঠাপড়া থেকে। ‘Flying planes can be dangerous’— এই অতি-ব্যবহৃত উদাহরণটা ধরা জাঁক। প্লেন ওড়ানো বিপজ্জনক না উড়ন্ত প্লেন বিপজ্জনক— এর উত্তর সম্পূর্ণ নির্ভর করছে উচ্চারণের ওপর। আর পৃথিবীর বহু ভাষায় বহু শব্দ একাধিক ভিন্ন পর্দ্দায় উচ্চারিতও হয়। এবং তখন শব্দের অর্থ একেবারেই পালটে যায়। চীনা ভাষা এই রকম একটা ভাষা, এবং এই কারণেই চীনা ভাষার জন্য ধ্বনিভিত্তিক লিপির প্রবর্ত্তন এতদিনেও সম্ভব হয়নি।

মোটের উপর, আজকের মানুষজকে সন্তুষ্ট করবে এমন ব্যাকরণতত্ত্ব সৃষ্টি হল না। আমরা চাই ব্যাকরণতত্ত্বের মূল থাকবে এমন ভাষাবিজ্ঞানে, যে বিজ্ঞান পৃথিবীর সব ভাষার শব্দগঠন, বাক্যগঠন ইত্যাদি আভ্যন্তর ক্রিয়ার সমুচিত ব্যাহ্যা করতে পারে। এ রকম ভাষাবিজ্ঞান তৈয়ারের চেষ্টায় কোন কসুর হচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু কোন সার্ব্বভৌম ভাষাবিজ্ঞান এখনও গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠলে তার ফল দেখা যেত অন্তত ইংরেজী ব্যাকরণের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে ভাষাবিজ্ঞানী ডাভিদ ক্রিস্টাল বলেছেন, ‘The absence of any complete grammar of English (which hs been the most analysed of all languages) is one of the most obvious limitations of the applicability of linguistics at the present time.’

তাহলে শেষ পর্য্যন্ত পরিস্থিতি কী দাঁড়াল? সে’টা অনেকটা এইরকম। (গ্রীক-)ল্যাটিনপন্থী ব্যাকরণ দিয়ে ইংরেজী ভাষার ঠিক ব্যাখ্যা করা গেল না, আবার ঐ ব্যাকরণের ধ্যানধারণার বাইরে গিয়েও সুরাহা মিলল না, কোন সম্পূর্ণ ও সন্তোষজনক ইংরেজী ব্যাকরণ তৈয়ার করা গেল না। ফলে স্কুলের পাঠক্রমে সম্পূর্ণ ব্যাকরণ পড়ানোর চেষ্টাও ছেড়ে দেওয়া হল, আর সে জায়গায় শেখানো শুরু হল নানারকমের Practical English Grammar, যেখানে ব্যাকরণতত্ত্ব বোঝার প্রয়াস নেই আছে শুধু খাঁটি বা শুদ্ধ ইংরেজী বলা এবং লেখা বা শেখার চেষ্টা। কিন্তু শুদ্ধের মানদণ্ড কী হবে? বুঝিবা অধিকাংশের ভোটের ওপর ছেড়ে দেওয়া হল সে সমস্যার সমাধান। পাশ্চাত্যের ব্যাকরণচিন্তা শেষ পর্য্যন্ত এই ‘অনিশ্চয়তা’য় এসে পৌঁছেছে।

বাংলা ভাষার ব্যাকরণ-চিন্তা—
বাংলা ব্যাকরণের সংস্কার নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে ইংরেজী ব্যাকরণ সংস্কারের কথা এত এল কেন? প্রথমত, যে বিদ্যাচর্চ্চার জগতে ইংরেজিভাষীরা বাস করেন, সেই একই জগতে আমাদের বাংলাভাষীদেরও বিচরণ। উপরন্তু আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান বিশ্বাস করে— বিভিন্ন ভাষার আলাদা রকমের রীতি থাকা সত্ত্বেও, সেসবের মূলে এমন কিছু সত্য পাওয়া যাবে, যার সাহায্যে সকল পার্থক্যেরও যুক্তি বোঝা যাবে। দ্বিতীয়ত ইংরেজী ভাষার মত বৈশিষ্ট্য বাংলাতেও আছে।

আধুনিক বাংলা ভাষায় ‘মানুষটা বাঘটাকে মারে’, এ ধরণের বাক্যের চেয়ে অনেক বেশী ব্যবহৃত হয় মানুষ বাঘ মারে’ কিম্বা ‘বাঘ মানুষ মারে’ জাতীয় বাক্য। এই বাক্যযুগলের মধ্যে যে পার্থক্য তা আমরা বুঝি বাক্যের মধ্যে শব্দের অবস্থান থেকে। কিন্তু এমন বাক্যও বাংলায় অনবরত হয় যেখানে উচারণের সময় স্বরের ওঠাপড়া থেকে বুঝতে হয় বাক্যটার মানে। যথা ‘মাছ খায় মানুষ’। উচ্চারণের পার্থক্য থেকে বুঝতে হবে কে খাদ্য আর কে খাদক। এখানে কর্ত্তায় শূন্য বিভক্তি, কর্ম্মে শূন্য বিভক্তি— এসব বলে যেন কিছুটা জোর করেই সংস্কৃত ব্যাকরণের কারক-বিভক্তি এবং ইংরেজী ব্যাকরণের Case-endings-এর তত্ত্বের সঙ্গে মেলানো হয়। একই রকম কারণে বাংলার বিশেষ্য পদের পরে ব্যবহৃত হইতে, থেকে, চেয়ে, প্রতি, নিকট, দিয়ে, ওপরে, নীচে, আগে, পরে প্রভৃতি শব্দকে বিভক্তিভূল্য ভাবা হয়, যদি সেরকম না-ভেবে ওগুলিকে ইংরেজী preposition-এর সঙ্গে তুলনীয় postposition বা অনুসর্গ ভাবাই অনেক যুক্তিসঙ্গত।

ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা সম্ভব, গ্রীক-ল্যাটিনপন্থী ব্যাকরণ থেকে তো নয়ই, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান থেকেও একালের ভাষার ব্যাকরণ তৈয়ারীর উপযোগী তত্ত্ব খুব পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে না বাংলা ব্যাকরণের জন্যও। অপর পক্ষে সংস্কৃতের ব্যাকরণতত্ত্ব দিয়ে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীর তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা কতটা তৃপ্ত হতে পারে, বা আদৌ হতে পারে কি না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। বিশেষত চমস্কীর মত ভাষাবিজ্ঞানীদের মুখ থেকে যখন আমরা আমাদের প্রাচীন ব্যাকরণের গুণগান শুনছিই।

সন্দেহ নেই, গ্রীক-ল্যাটিন ব্যাকরণের তুলনায় প্রাচীন ভারতের ব্যাকরণ-চিন্তা অনেক উন্নত; এবং দু-একটা ক্ষেত্রে সেকথা সহজেই বুঝতে পারা যায়। ধ্বনিতত্ত্বের দিক থেকে ভারতের ভাষাচিন্তায় যে-সমৃদ্ধি ছিল তার অকাট্য প্রমাণ ভারতীয় বর্ণমালার আভ্যন্তরীণ বর্ণবিন্যাস। আর রয়েছে শব্দার্থতাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টির অনেক সাক্ষ্য।

প্রথমে ধরা যেতে পারে সমাসের কথা। সব ভাষাতেই বৃহত্তর বাক্যের বা বাক্যাংশের মধ্যে দুইটা, তিনটা বা আরও বেশী শব্দ পাশাপাশি এনে এক শব্দের মত কাজ করানো হয়। এভাবে যেসব শব্দকে একত্রে এনে সমাস করা হয়, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যে সমাস বা মিলিত পদটা তৈয়ার হয়, তার তাৎপর্য্য নির্ভর করছে সেই পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। সংস্কৃত ব্যাকরণে অতি যত্নের সঙ্গে এই সম্পর্কগুলি বিশ্লেষণ করা হয়; এবং ব্যাসবাক্যের সাহায্যে শব্দটার অর্থ নিরূপণ করা হয়, নির্ণয় করা হয় কী সূত্রে সংশ্লিষ্ট শব্দগুলি সমাসে সন্নিবেশিত ও গ্রথিত হয়েছে। এই পদ্ধতিতে সমাসের চরিত্র নির্দ্দিষ্ট করা হয় ও সমাসের শ্রেণীবিভাগ করা হয়।

পাশ্চাত্যের ব্যাকরণে এত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের রেওয়াজ নেই। এমনকি বহু ক্ষেত্রে সমাস যে হয়েছে, তাও স্বীকার করা হয় না। আর, এক জায়গায় সংস্কৃত ব্যাকরণতত্ত্ব অন্য ভাষার ব্যাকরণ থেকে স্বতন্ত্র ও উন্নত। সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে ভাষার প্রতিটা পদের অর্থ নিষ্কাশন করতে হয় ব্যুৎপত্তি বিচারের মধ্য দিয়ে। এবং এই ব্যুৎপত্তি-বিচারের মধ্যে বিশেষ লক্ষণীয় যে, ভারতীয় ভাষাচিন্তা অনুযায়ী প্রতিটা মূল শব্দও— যথা বায়ু, জল, আকাশ, নদী প্রভৃতি শব্দও ক্রিয়ার নাম বা ধাতু থেকে নিষ্পন্ন।

শব্দের ব্যুৎপত্তি, ব্যাসবাক্য ইত্যাদি নির্ণয়ে যেমন, তেমনই অক্লান্ত ভাষাবিশ্লেষণ দেখতে পাই (ভারতীয় ভাষা চিন্তায়) বাক্যের বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্ব্বনাম পদের কারক নির্দ্ধারণে। পাশ্চাত্য ব্যাকরণের case-তত্ত্বটা সংস্কৃত ব্যাকরণের কারকতত্ত্বের তুলনায় অনেক পশ্চাদপদ ও নিকৃষ্ট।

পাশ্চাত্যের case কথাটার মূলে রয়েছে গ্রীক ptosis, যার ল্যাটিন প্রতিশব্দ হল casus। এটা আবার এসেছে ল্যাটিন cadere (=fall, পড়ে যাওয়া) ধাতু থেকে এবং সেজন্যই case এবং তার আদি শব্দ ল্যাটিন casus শব্দটার অর্থ পরিণাম, পরিণতি, পরিণমন বা পতন— অর্থাৎ মূল শব্দের (= প্রাতিপদিকের) একটা পতিত বা রূপান্তরিত আকার, তার বেশী কিছু নয়।

কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণের কারক শব্দটার ব্যুৎপত্তি এবং কারকের বিভিন্ন শ্রেণীর নামকরণ থেকেই বোঝা যায় যে, এই তত্ত্বটার সাহায্যে বর্ণনীয় জগতের বিভিন্ন ক্রিয়ার নানান কার্য্যকারণ সম্পর্ককে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা হয়; কাজটা কে করছে, কীসের সাহায্যে, কার জন্য, কী হেতু, কাজটার ফল কে কীভাবে ভোগ করছে ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা। কিন্তু পাশ্চাত্যের case-তত্ত্বের সেদিকে গুরুত্ব নেই, তার নযর বিশেষ করে শব্দের ধ্বনিগত পরিবর্ত্তনের দিকে। সেজন্য ভারতীয় ব্যাকরণে একই কারকে শব্দের বিভিন্ন বিভক্তি অর্থাৎ বিভিন্ন চেহারা হয়, এবং সেটাকে অতি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করা হয়, কিন্তু পাশ্চাত্যের ব্যাকরণে এরকম ভাবনার কোন সুযোগই নেই। তাতে বাইরের রূপ থেকে case নির্দ্ধারিত হয় এবং বড় জোর বলা যায় যে, বিভিন্ন case-এ্রর সাহায্যে এক অর্থ বোঝানো সম্ভব। সেজন্য বলতে হয় “John’s” আছে Genitive Case-এ আর “of John”-এ John আছে Accusative Case-এ। অথচ সংস্কৃত ব্যাকরণের কারক-তত্ত্বের এলাকা অনেক ব্যাপক। এমনকি চীনাভাষার মত ভাষায়, যেখানে প্রতিটা শব্দ অপরিবর্ত্তনীয়, সে ভাষা বিশ্লেষণেও সংস্কৃতের কারকতত্ত্ব কাজ করতে পারে, কিন্তু পাশ্চাত্যের case-তত্ত্ব সেখানে একেবারেই অর্থহীন।

ভারতের ব্যাকরণে তথা ভাষাচিন্তাতে ছিল ক্রিয়াকারীর থেকে ক্রিয়ার দিকে বেশী নযর। সে বৈশিষ্ট্য এমনকি আজকের ভাষার ভাববাচ্য ব্যবহারের মধ্যেও প্রমাণিত। বাংলায় বলা হয়, কোথায় যাওয়া হচ্ছে, কী করা হচ্ছে? সংস্কৃত ভাষায় বলা যেত, দীয়তাম্ ভুজ্যতাম্ (= দেওয়া হোক, খাওয়া হোক)। পাশ্চাত্যের ভাষায় ক্রিয়াপদের একটা কর্ত্তা থাকাই চাই। সুতরাং ওদের বলতে হয় ‘I have a pen’, ‘I don’t like it’। অথচ, ভারতের ভাষায় বেশীর ভাগ সময়েই প্রকাশের ঢঙ হয় ‘আমার একটা কলম আছে’, ‘আমার এটা ভাল লাগে না’; কলম-এর থাকা, কিংবা ‘ভাল’র লাগা ‘আমার’ ব্যাপার নয়, তাদের নিজেদের ব্যাপার।

পাশ্চাত্যের ভাষায় তা চলবে না, এমনকি কোন ক্রিয়াকারী দেখতে না পাওয়া গেলেও সৌকর্য্যের খাতিরে বলতে হবে ‘It is hot’, ‘It is raining’। অর্থাৎ পূর্ব্ব ও পশ্চিমের ব্যাকরণের স্বভাবই আলাদা। একথা বলা যায় যে সংস্কৃত এবং বাংলা ভাষায় ক্রিয়াভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী এখনও রয়েছে, আর পাশ্চাত্যের ভাষায়, যথা ইংরেজীতে, বিশেষ্যভিত্তিক চরিত্র বেশী উগ্র।

পাশ্চাত্যের যে ভাষাচিন্তা থেকে গ্রীস ও রোমের ব্যাকরণতত্ত্ব গড়ে ওঠেছিল, তাতে ক্রিয়াকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নযর দেওয়া হয়েছিল বেশী করে ক্রিয়াকারী এবং ক্রিয়ার ফলভোগকারীর দিকে, অর্থাৎ ব্যাকরণের হিসেবে বিশেষ্য পদের দিকে। এর ফলে যে জগচ্চিত্র মানুষের চেতনায় উদ্ভাসিত হত, তা অবিচ্ছিন্ন কার্য্যধারা নয়, বরং অনেক বেশী করে তা হল বিচ্ছিন্ন চিত্রসমূহের সমাবেশ। এই রকমের ভাষাচিন্তা এক হিসেবে মানুষের কিছু সহায়ক হয়েছিল। এই রকমের চিন্তা অবলম্বন করে বিশ্বসংসারকে গণিত বা জ্যামিতির মাপে মাথায় নিয়ে আসা মনুষের পক্ষে সহজ হয়েছিল।

কিন্তু বিজ্ঞান আজ বেশী করে বুঝছে যে বিশ্বচরাচরে চলেছে অবিচ্ছিন্ন ও বিরামহীন ক্রিয়ার ধারা। শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা চাইছেন এমন ভাষা, যে ভাষা বিশ্বসংসারকে তার চলমান সমগ্রতায় মানুষের চেতনায় নিয়ে আসে। অতএব মানুষের ভাষাকেও সেদিকে এগোতে হবে, যদি বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে দিতে না হয়। এই বিচারে ভাষাকে ক্রিয়াভিত্তিকতার দিকে নিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

এ যাবৎ আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা দেখলাম যে, এ ক্রিয়াভিত্তিক ভাষাব্যবহার ও ভাষাচিন্তা সংস্কৃত ব্যাকরণেই বেশী করে উপস্থিত আছে। এ ছাড়া ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের চাবিকাঠীর সাহায্যে আমাদের ভাষার সম্পৎ ও আমাদের সমগ্র সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে কীভাবে আয়ত্তে আনা যায়, এ গ্রন্থের পূর্ব্বাপর নিবন্ধগুলিতে সেই বিষয়ে বহু কথাই রয়েছে। ১

বাংলা ভাষার নতুন ব্যাকরণ বিষয়ে দু-চার কথা—
বাংলা ব্যাকরণের সংস্কার করতে হলে চলমান সভ্যতার মাঝখানে বসিয়েই সে সংস্কার করতে হবে। বাংলা ভাষার অতীতকে সম্মান দিতে হবে, আর ভবিষ্যতের পথ, অর্থাৎ এগোনোর পথও খোলা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, সংস্কৃত ব্যাকরণের ভাষাবর্ণনার শুধু খুঁটিনাটি নয়, তাত্ত্বিক দিকও এত সমৃদ্ধ ছিল যে বিশ্বের পণ্ডিতসমাজ আজো তার সম্বন্ধে বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ২।

এ অবস্থায় সংস্কৃত ব্যাকরণের ধারণাগুলিকে তাচ্ছিল্য করে বাংলা ব্যাকরণের ধারণাগুলিকে সংস্কার করতে যাওয়া যে শুধু Cosmetic surgery বা জোড়াতালির চুনকাম হবে তাই নয়, তা হবে রীতিমত হঠকারীর কাজ। অথচ সম্প্রতি সেই কাজ-ই করা হল, যখন বাংলা ব্যাকরণে প্রথম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ, উত্তম পুরুষ, এই নামগুলি বদল করে সে-পক্ষ, তুমি-পক্ষ, আমি-পক্ষ, এই নামগুলি রচলনের চেষ্টা হল।

সংস্কৃত ব্যাকরণের যা কিছু বোঝবার সেসব বুঝে সুনীতি চাটুজ্জে মশাই আমাদের জন্য নির্য্যাস করে দিয়ে গেছেন, এবং তার সুবাদে আমরা এখন অতীতকে বুঝে নেওয়ার দায় থেকে মুক্ত ও স্বাধীন— এমন মনে করার কোন দরকার নেই। আমাদের জানা দরকার, সকল বিদ্যাকে যুগোপযোগী করে রাখা একটা মহৎ কাজ, বাংলা ব্যাকরণ তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মহৎ কাজ তাড়াহুড়ায় সম্ভব হয় না। ব্যাকরণ সংস্কারে ধৈর্য্য এবং শ্রদ্ধা অপরিহার্য্য।

এ কথা আদৌ বলা হচ্ছে না যে, বাংলা ব্যাকরণ বলে যা চলছে, তাকে তেমনই রেখে দেওয়া উচিৎ। ব্যাকরণ চর্চ্চার ক্ষেত্রে অনেক পুরানো জিনিসের অন্ধ পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা দরকার। যেমন ইংরেজী ভাষাচর্চ্চার অনুকরণে বাংলা ভাষার মধ্যে সমার্থক শব্দের তালিকা করার চেষ্টা। সমার্থক শব্দের তত্ত্ব যেন রোলার চালিয়ে সব শব্দকে একমাত্রিক বা চ্যাপ্টা করে দেয়। যেগুলিকে আমরা সমার্থক শব্দ বলে ভাবি, সেগুলি আসলে ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়াকারিতার নির্দ্দেশক। এজন্য সমার্থক শব্দের চর্চ্চাকে উপযুক্ত ভাবে পরিমার্জ্জিত করে নেওয়া দরকার।

তবে সর্ব্বাগ্রে যে জিনিসটার প্রয়োজন তা হল স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ যে বাংলাভাষায় সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণ থেকে অনেক সরে এসেছে সেই ঘটনাটাকে ভাল করে বুঝে নেওয়া এবং সহজভাবে মেনে নেওয়া। কীরকমের পরিবর্ত্তনগুলো হয়েছিল, সেগুলি জানলে পর সন্ধি হয়ে তৈয়ার হওয়া শব্দগুলিও স্বচ্ছ হয়ে যায়। এবং সন্ধিগুলিকে ব্যাকরণের জবরদস্তি প্রসূত বলে মনে হয় না। তখন বুঝি ‘বিদ্যা’ আর ‘উৎসাহীর’ স্বাভাবিক মিলিত রূপ ‘বিদ্যোৎসাহী। (এই গ্রন্থের ‘বাংলাভাষার ঐতিহ্য ও বানান সংস্কার : কোথায় চলেছ প্রভু’ প্রবন্ধের আট নম্বর অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)।

পরিশেষে এই কথা বলতে হয় যে জীবন সম্বন্ধে আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের ভাষাব্যবহার এবং ভাষাবিষয়ক চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে বাধ্য। সকল সভ্য জাতিই যে ভাষাব্যবহারে এবং ভাষাচিন্তায় ক্রিয়াভিত্তিকতা থেকে বিশেষ্যভিত্তিকতায় সরে এসেছিল, তার মূলে আছে জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্ত্তন। ব্যাকরণ নিয়ে হঠকারী পদক্ষেপ অনেক ক্ষতিকর জটিলতা আনতে বাধ্য এবং সে কারণে সে রকমের পদক্ষেপ বর্জ্জনীয়।

‘কলিম খান’-এর সংযোজন—
নেচার যখন মানুষকে ভাষা শেখায় তখন সে ভাষায় সেই ঘটনাসমূহের ছায়াই শুধু ধরা থাকে না, যে নিয়মে সেই ঘটনাসমূহ ঘটেছে, তার হিসেবও ধরা থাকে। আর পাণিনির মত জ্ঞানী মানুষেরা ভাষা বিশ্লেষণ করার সময় সেই হিসেবটাকেও লিখে রাখেন, আর তাকেই আমরা একালে বাকরণ বলে থাকি। অর্থাৎ কিনা, মানুষের ভাষার ব্যাকরণ [বি-আ-করণ = ব্যাকরণ < করণসমূহের আধার = আকরণ। বিশেষ আকরণ = ব্যাকরণ] পণ্ডিতের মস্তিষ্কের উদ্ভাবন নয়, ভাষার ভিতরে নেচারের যে-নিয়ম সক্রিয় থাকে, তাকে উদ্ধার করে কোন জ্ঞানী মানুষ যখন লিখে রাখেন তখন তাকে আমরা ব্যাকরণ বলে থাকি। তাই, শ্রীযুক্ত রবি চক্রবর্ত্তী ঠিকই বলেছেন, ব্যাকরণের মূলে রয়েছে ব্যাকরণের হিসেব।

পাশ্চাত্যে ব্যাকরণ বিষয়ে আমি বিশেষ কিছু জানি না, যতটুকু জানি তা কেবল ভারতীয় ব্যাকরণ সম্বন্ধে এবং সে জানাও কেবল সংস্কৃত ও বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে সীমাবদ্ধ। এর একটা কারণ এই যে, ব্যাকরণ বিষয়ে পৃথকভাবে অনুসন্ধান করবার সময় আমি পাইনি। যাই হোক, যতটকু যা জানি এবং তাতে আমাদের ব্যাকরণের হিসেবটা আমি কমবেশী যা বুঝতে পারি, তা এইরকম—

ভারতীয় ব্যাকরণের মূলে জগদ্দর্শনের যে হিসেবটা রয়েছে, তাতে জগৎকে অসীম সংখ্যক ক্রিয়া (পুরুষ) ও ক্রিয়াকারী (প্রকৃতি) রূপে দেখা হয়েছে। এই হিসেবে এ-জগতে এমন কিছুই নেই, যা ক্রিয়া বা ক্রিয়াকারী নয়ু। আমাদের প্রাচীন চিন্তাবিদগণ কিছু কিছু সত্তাকে অবশ্য দেখেছেন, যেগুলি আরও সূক্ষ্ম। সেগুলি ক্রিয়া নয়, ক্রিয়াকারীও নয়, উভয়ের দ্বৈতাদ্বৈত রূপ বা অদ্বৈত রূপ।

শুনেছি, একালের কোয়াণ্টাম বিজ্ঞানেও নাকি এই চিন্তা অন্যভাবে চর্চ্চিত হতে শুরু হয়েছে। তাঁরা ক্রিয়া, ক্রিয়াকারী ও তাদের অদ্বৈত রূপটাকে চিহ্নিত করছেন যথাক্রমে action, actor, ও actan নামে। কিন্তু তাই বলে, সেই চিহ্নায়নের উপর নির্ভর করে তাঁরা কোনরকম ভাষা-ব্যাকরণ গড়ে তুলতে পেরেছেন, এমন কোন সংবাদ এখনও পাইনি।

আমাদের প্রাচীন ব্যাকরণকারগণের বৈয়াকরণিক হিসেবের মূলে ছিল পুরুষ-প্রকৃতির ধারণা। তাই তাঁদের কাছে ভাষণ বা বাক্য হল ক্রিয়াকারী (প্রকৃতি), আর তাতে বিধৃত বক্তব্য বা অর্থ হল ক্রিয়া (পুরুষ)। বাক্যের ভিতরের শব্দগুলি হল ক্রিয়াকারী (প্রকৃতি), আর সেই শব্দগুলির অর্থ হল ক্রিয়া (পুরুষ)। আরও সূক্ষ্ম স্তর হল বর্ণ। সেখানে স্বরবর্ণগুলি আধারবাচক (প্রকৃতি) এবং ব্যঞ্জনবর্ণগুলি আধেয়বাচক (পুরুষ)। এদের মূলে রয়েছে ং (অনুস্বার) বর্ণটা যা কিনা অদ্বৈত বাচক।

জগৎ পরিবর্ত্তনশীল। অতি সামান্য কয়েকটা ক্ষেত্রে অবশ্য পরিবর্ত্তন এত শ্লথ যে, সেগুলিকে অপরিবর্ত্তনীয় বলা চলে। যাই হোক, পরিবর্ত্তনশীল জগতের ছায়া মানুষের ভাষায় ধরে রাখার জন্য মানুষের ভাষাকেও পরিবর্ত্তনশীল স্বভাবের হতে হয়। তাই আমাদের ভাষায় প্রথমেই শব্দের দুটো গুণ দেখে তাদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে— ব্যয় (পরিবর্ত্তনশীল/পুরুষ) শব্দ ও অব্যয় (অপরিবর্ত্তনীয়/ প্রকৃতি) শব্দ।

তবে জগৎ মূলত পরিবর্ত্তনশীল বলে ভাষার প্রধান ভাগ হল পরিবর্ত্তনশীল শব্দ। অতঃপর ব্যয়-সত্তাগুলির দুইটা ভাগ করা হয়েছে, ধাতুশব্দ (পুরুষ) ও নামশব্দ (প্রকৃতি)। স্বভাবতই ব্যাকরণের আলোচনায় অব্যয় শব্দ, (ব্যয়)-শব্দরূপ, (ব্যয়)-ধাতুরূপ একান্তই আবশ্যিক। ধাতুরূপের পরিবর্ত্তন কালনির্ভর, তাই তাতে ক্রিয়ার কাল বিষয়ক আলোচনা জরুরী। আর, শব্দরূপের পরিবর্ত্তন করণনির্ভর, তাই তাতে কারক-বিষয়ক আলোচনা জরুরী। এবং শব্দের কর্ত্তাগিরি যেমন হবে তার সহধর্ম্মিনী তো তেমনই হবে, তাই কারকের স্বভাববদল অনুসারে তার বিভক্তিও যায় বদলে।

যাই হোক, আসলে কিন্তু করণ বা কর্ম্মই জগতের মূল। জগৎকে বুঝবার, তার প্রকৃত ছায়াচিত্র ভাষায় তুলে রাখার মুল চাবিকাঠিটা রয়েছে কর্ম্মকেন্দ্রিক আলোচনায়— কে কাজটা করছে, কেন করছে, কার জন্য করছে ইত্যাদি। কর্ম্মসংক্রান্ত এই সমস্ত সংবাদই যদি না থাকল, তবে কর্ম্মজগতের ছায়ায় বা ভাষায় সত্য ধরা থাকবে কী করে! সুতরাং শব্দের (প্রকৃতির) প্রত্যয় (পুরুষ) বিষয়ক আলোচনা ব্যাকরণের একটা প্রধান কাজ। প্রকৃতি (শব্দ) হল বেটার হাফ, পুরুষ (প্রত্যয়) ঠিক করে তার অর্থ কোন দিকে যাবে। পরিবর্ত্তনশীল জগতের ছায়া ভাষায় তুলে রাখার কাজে এই আলোচনা অপরিহার্য্য।

জগতের পরিবর্ত্তনের মূলে রয়েছে অ্যাক্টর (প্রকৃতি) ও অ্যকশনের (পুরুষের) মধ্যেকার সম্পর্কের হিসেব। তাই, মানুষের ভাষার মূলেও রয়েছে পুরুষ (ক্রিয়া) প্রকৃতির (ক্রিয়াকারীর) সম্পর্কের হিসেব। তাই, মানুষের ভাষার মূলেও রয়েছে পুরুষ (ক্রিয়া) প্রকৃতির (ক্রিয়াকারীর) বা আধার-আধেয়র সম্পর্কের হিসেব। এই সম্পর্কের হেরফের ঘটে অজস্র কারণে। তার মধ্যে প্রধান কারণটা রয়েছে পুরুষ প্রকৃতির স্বভাবে। আর, সেই স্বভাবের হিসেব পাওয়া যায় তাদের করণভিত্তিক অবস্থান থেকে অর্থাৎ লিঙ্গের (পুরুষ-প্রকৃতির বা আধেয়-আধারের) স্বরূপ থেকে। ব্যাকরণের আলোচনায় অতএব লিঙ্গানুশাসন জরুরী।

জগতের সত্তাগুলির আরও একটা বিশেষত্ব রয়েছে। তাদের অনেকেই আবার নানারকমের জোড় বেঁধে অবস্থান করে এবং সে জোড়বাঁধারও নিয়ম রয়েছে, সেখানেও পুরুষ-প্রকৃতির সম্পর্কের হিসেব রয়েছে। সেই নিয়মের অঙ্ক কষে রাখে সমাস বিষয়ক আলোচনা।

এই ব্যাকরণ ছিল স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ব্যাকরণ এবং যতদূর বুঝেছি, তা ছিল আমাদের প্রাচীন ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার মূলে। পরে পরে সেই ভাষাই বদলে যায়, তাতে একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তিজনিত নানান পরিবর্ত্তন ঘটে, এবং সেই মহাভাষা পরিবর্ত্তিত হয়ে হয়ে, খণ্ডিত হয়ে হয়ে অনেক বিশেষ্যভিত্তিক ভাষায় পরিণত হয়। সেইগুলিই একালের ভাষা এবং সেগুলির কারও নিজস্ব ব্যাকরণ আর গড়ে তোলা যায়নি।

প্রত্যেকটা ভাষাই আদি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক ব্যাকরণের বিকৃত, খণ্ডিত, অতি-বিকৃত, অতি-খণ্ডিত, টুকরো স্মৃতির সাহায্যে তাদের কাজ চালায়। যতদূর জানি, একথা কেবল পাশ্চাত্যের বর্ত্তমান ভাষাগুলির ক্ষেত্রেই খাটে না, প্রাচ্যের ভাষাগুলির ক্ষেত্রেও কমবেশী খাটে— একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলা ভাষা। সংস্কৃত ভাষার কথা বলা যেতে পারত, তবে দুটো কারণে তাকেও ব্যতিক্রমী বলা যাচ্ছে না। এক, ঐ ভাষা জনসাধারণ্যে ব্যবহৃত হয় না; দুই, একালের সংস্কৃত ভাষা, অ্যাকাডেমীগুলিতে যার চর্চ্চা চলে, তাও বিশেষ্যভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গীতেই চর্চ্চিত হয়ে থাকে।

তাই শেষ বিচারে, বাংলা ভাষাই একমাত্র ভাষা যার ব্যাকরণের ভিত্তিতে সেই আদি স্বাভাবিক— প্রাকৃতিক ব্যাকরণ এখনও যথেষ্ট সক্রিয়। তবে এর অনেক তত্ত্বই এখন নানান কারণে বেশ মলিন হয়ে গেছে। প্রয়োজন সেই মালিন্যকে সাফ করা, সাফ করে তাকে একাধারে ক্রিয়াভিত্তিক বাংলা ভাষার ভিত্তিতে যথাবিহিত ভাবে স্থাপন করা। অন্যদিকে একালের বাংলাভাষার বিশেষ্যভিত্তিক স্বরূপের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে নতুন ব্যাকরণ রচনা করা, অথবা সেই আদি ব্যাকরণের একটা ‘আপডেটেড ভার্শন’ তৈয়ার করা যা বর্ত্তমান বাংলাভাষাকে যথাযথ বৈয়াকরণিক ভিত্তি দিতে পারবে।

কাজটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবুও কাজটা করতে হবে, আজ নয়ত কাল, এবং আমার বিশ্বাস আমাদের সময়ের বা আমাদের উত্তরসুরীদের ভেতর থেকে এমন মানুষ নিশ্চয় উঠে আসবেন, যিনি বা যাঁরা এই মহান কর্ম্ম করবেন।

এসব না করে, এই ব্যাকরণকে সেই মালিন্যের কথা তুলে একালের কিছু মিথ্যাচারী ‘ভাষাবিদ’ সম্প্রতি এমন সব কথাবার্ত্তা বলছেন, এমন সব বিধান-নিদান দিচ্ছেন, যাকে কেবল ছেলেমানুষী বললেই যথেষ্ট বলা হয় না!

টীকাটিপ্পনী—

১। এ বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কলিম খান রচিত ‘মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে’, ‘দিশা থেকে বিদিশায়’ ও ‘আসমানদারী করতে দেব কাকে’ প্রভৃতি গ্রন্থে।
২। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে মানুষের চেতনা ও ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে যেসব আলোচনা রয়েছে, তার ওপরও আলোকপাত করে এমন আলোচনা পাওয়া যাবে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, পতঞ্জলীর মহাভাষ্য এবং ভর্ত্তৃহরির বাক্যপদীয় গ্রন্থে। ভর্ত্তৃহরি ‘ধ্বনি ও স্ফোটতত্ত্ব’ এই প্রসঙ্গে বিশেষ স্মরণীয়। সংস্কৃত ব্যাকরণ সম্বন্ধে বিশ্বের পণ্ডিতসমাজ কতখানি শ্রদ্ধাবান, তার অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। যথা—

‘…the topics covered by modern descriptive linguistics : semantics, grammar, phonology, and phonetics, were all treated at length in the Indian tradition; and in phonetics and in certain aspects of grammar, Indian theory and practice was definitely in advance of anything achieved in Europe or elsewhere before contact had been made with Indian work. … …। ‘… linguistics in India must have been seriously under way well before the middle of the first millennium B.C’ p.136-137 – A short History of Linguistics / R.H. Robins, Longman Paperback, 1967.

  1. ভাষাচার্য্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর পরিণত বয়সের রচনা ভাষাপ্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক প্রকাশ— ১৯৩৯, রূপে সংস্করণ, ১৯৮৮) গ্রন্থে case ও কারকত্বের মধ্যে দোদুল্যমান থেকেছেন।

কারক সম্বন্ধে দুবার দুরকম মন্তব্য করেছেন। (পৃষ্ঠা ২২১-এ বলেছেন) ‘আবার ক্রিয়ার সহিত সাক্ষাৎ যোগ নাই বলিয়া, সংস্কৃত ব্যাকরণে, সম্বন্ধ পদ কারক-পদ-বাচ্য নহে’। (পৃষ্ঠা ২২২-এ বলেছেন) সংস্কৃত ব্যাকরণকে আদর্শ করিয়া বাঙ্গালার ব্যাকরণ প্রায়শ লিখিত ও আলোচিত হয় বলিয়া, বাঙ্গালাতেও সংস্কৃতের অনুরূপ সাতটা (অথবা ‘সম্বোধন’ লইয়া আটটা) কারক ধরা হয়…।

আর ‘পুরুষ’-তত্ত্ব প্রসঙ্গে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন (যথা ইংরেজীর First Person-কে এড়িয়ে গিয়ে Third Person-কে কেন সংস্কৃত ব্যাকরণে প্রথম পুরুষ বলা হল) সম্বন্ধে কোন আলোকপাত করেননি। অথচ যেখানেই সংশয় কাটানর জন্য আলো ফেলা প্রয়োজন, সেখানেই পরম যত্নের সঙ্গে সেই প্রশ্নটার ওপর আলোচনা করা তাঁর প্রকৃতিগত।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিশীর ডাক— নতুন ব্যাকরণ চাই — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *