ধর্ম্ম
কাপড়ের দোকানে এক সাথে দুইজন লোক আসলেন। দুইজন লোকই আচরণে অতিশয় ভদ্র এবং রূপে মার্জ্জিত। দুজনের চেহারাতেই পূর্ণিমা রাত্রীর আলো জ্বল জ্বল করছে।
দোকানে একসাথে ঢুকলেও বুঝা যাচ্ছে উনারা পূর্ব্বপরিচিত নন। আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে দু’জনই একটা থান থেকে সেলাইবিহীন ধবধবে সাদা কাপড়ের এক টুকরা করে দুই টুকরা কাপড় কিনলেন।
আচমকা একজন মুচকি হেঁসে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ভাইজান, কাপড় দিয়ে কী পোষাক তৈরী করবেন?’
অপরজন মুখ জোড়া হাসি নিয়ে বললেন,
‘একটা পাঞ্জাবী বানাব’। তা ভাই আপনি কী বানাবেন?
উনি বললেন,
আমি ভাই একটা ধুতী বানাব।
অমনি দোকানদার লোকটা বিকট আওয়াজে একটা হাসি দিয়ে বলল, লক্ষ্য করেছেন? আমার এক থানের দুই টুকরা কাপড় আমার সামনেই আলাদা দুইটা ধর্ম্ম গ্ৰহণ করে ফেলল।
রাষ্ট্র ধর্ম্ম
এক কওমের একটা পশ্চিমমুখী গোয়ালঘর ছিল। একসময় অবশ্য দক্ষিণমুখীই ছিল। মহামান্য কবী যখন কওমের প্রধান ছিলেন তখন তিনি বরকতের আশায় গোয়ালঘরটা দক্ষিণমুখী থেকে পশ্চিমমুখী করে দিয়েছিলেন। গরুর খাঁটী দুধ খাওয়া খাঁটী কবী ছিলেন তিনি। উনার কবিতা প্রত্যেকটা জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হত। তা এভাবেই চলতেছিল। কিন্তু প্যাঁচটা লেগেছে বর্ত্তমান কওম প্রধান গোয়ালঘরটা পুনরায় দক্ষীণমুখী করতে চাচ্ছেন। কওমের অধিকাংশ জনগণই মুসলমান। তারা এটা কোনভাবেই মানতে চাচ্ছে না। তারা বলছে ‘নব্বই শতাংশ মুসলমানের কওমে গোয়ালঘর পশ্চিমমুখী থেকে দক্ষিণমুখী হতে দেব না।’
এটা আমার আম্মার কাছ থেকে শোনা গল্প। আম্মারে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, গোয়ালঘর পশ্চিমমুখী আর দক্ষিণুমুখী একমুখী হলেই তো হয়! এটা নিয়ে এতো টানাহেঁচড়া কীসের!
আম্মা বললেন, ‘বাবা মুসলমানরা চাইতেছে এই গোয়ালঘরটারে মসজিদ বানাইব।’
আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম কবে?
আম্মা ফিক ফিক করে হেঁসে বললেন, ইমাম মাহদী আসলে!
মানুষ
এক পাগল সদ্য প্রসব হওয়া শিশুর মত কাঁদছে। চোখের পানী আর নাকের পানীর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। পাগলের ভুবন বিধ্বংসী কান্না দেখে এক কবী এসে প্রশ্ন করল বাবা, তুমি কাঁদছ কেন? অনেক কষ্টে পাগল কান্নাটা গলায় চাপা দিয়ে বলল, খোদা আমাকে নির্দ্দেশ দিয়েছেন আমার দায়িত্ব একজন মানুষের কাছে অর্পণ করার জন্য। কিন্তু আমি পুরা পৃথিবী ঘুরে এসেও একজন মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না।
কবী খুবই আশ্চর্য্য হলেন। তিনি আক্ষেপ নিয়ে বললেন পুরা পৃথিবী ঘুরে এসেও তুমি একজন মানুষ খুঁজে পেলে না! তোমার খোদা আসলেই তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছেন। নইলে আটশ কোটী মানুষের মধ্যে একজন হলেও তোমার নজরে পড়ত।
পাগল এতক্ষণে বাতাসবিহীন নদীর মত স্থিরতা লাভ করেছেন। মুখ থেকে জড়তা কাটিয়ে কবীকে বললেন, আমার নজরে যারাই পড়েছে তারা হয় মুসলিম, নয়ত হিন্দু, নয়ত বৌদ্ধ, নয়ত খ্রিষ্টান, নয়ত ইহুদী, নয়ত নাস্তিক, নয়ত আস্তিক, হয়ত আরো কত কি!
কবী এবার শিক্ষকের হাতে মার খাওয়া ছাত্রটীর মত চুপ মেরে গেলেন। ছাত্রটীর মতই আধা আধা করে অস্পষ্ট স্বরে বললেন, পাগল তুমি মানুষ খুঁজে পাইবা না!
দাঙ্গা
“মালাউনের বাচ্চার কত্ত বড় সাহস! নবীরে গালি দেয়। মালাউনের বাচ্চারা বড় বাইড় বাইড়া গেছে। কিচ্ছু করি না দেইখা মাথায় উইঠা গেছে। এর একটা বিহিত করতেই অইব। আইজকা উদেরই একদিন কি আমরারই একদিন। তোরা দা, বাঁশ, লাডী, আগুন লইয়া আয় আমার সাথে”, বলতেছেন চেয়ারম্যান মঈন আলী খান। বলার ভঙ্গীটা হচ্ছে এক কুকুরের এরিয়ায় আরেক কুকুর এসে পড়লে কুকুর যে ভঙ্গী নিয়ে গর্জ্জে ওঠে ঠিক সেই ভঙ্গী।
মূল ঘটনা হচ্ছে, পলাশ মণ্ডল নামক এক হিন্দু ছেলে নবীজীকে নিয়ে ফেসবুকে খারাপ পোস্ট করেছে— (…………………………)। কি মারাত্মক কথা! মুসলমানদের গায়ে মহানবী (সাঃ) নিয়ে এরূপ হীন মন্তব্য করলে আগুন তো লাগবেই। এ আগুন নমরুদের আগুনের কুণ্ডলী থেকেও ভয়ঙ্কর।
গ্ৰামের সাধারণ ধর্ম্মান্ধ ধর্ম্মপ্রাণ মুসলমানেরা বড়ই খুশী। এতদিন শুনে আসছে চেয়ারম্যান সাহেব নাস্তিক টাইপের। ফ্রান্সে নবীজীর ব্যঙ্গ কার্টুন আঁকার পরও উনি বাকস্বাধীনতা বলে সমর্থন করেছেন। তা হঠাৎ করে ধর্ম্মের দিকে আকর্ষিত হওয়া তো চাট্টেখানি কথা নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার খাশ রহমত। পাড়ার ইমাম সাবও খুব খুশী। তিনি মাগরীবের ওয়াক্তে চেয়ারম্যানের জন্য দোয়া পর্য্যন্ত করেছেন।
সবাই চেয়ারম্যানের সাহেবের ডাক পেয়ে বাঁশের লাঠী, দা, বল্লম, খুন্তী, ম্যাচ যে যা সামনে পেয়েছে তা নিয়েই মণ্ডল পাড়ায় আক্রমণ করেছে। গরু বাছুর টাকা পয়সা যে যেমন পেরেছে লুট করেছে। কয়েকটা তাগড়া পোলা তের চৌদ্দ বছরের দুই তিনটা মেয়েকে খাল পাড়ে নিয়ে কুকামও করেছে।
পরদিন পুলিশ সাংবাদিকে পুরা গ্ৰাম উপচে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসও আগুন নেভার পর সকালে এসেছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ঘরে তাদের পিতা পুত্রের কথা কাটাকাটি চলছে। ঢাবিতে অধ্যয়নরত ছেলে খবর শুনে রাতের গাড়ীতেই বাড়ীতে এসেছে। আসার পরপরই বাবার রুমে ঢুকেছে।
ছেলের কথা হচ্ছে, ‘আপনি জানেন কাজটা কী করছেন? যে পোস্ট দেখে বাড়িঘর পুড়ছেন এইটা তো পলাশের আইডি থেকে দেওয়া পোস্ট না। ফেইক আইডি থেকে কে পোস্ট করছে কে জানে!’
চেয়ারম্যান সাব হেসে হেসে বলতেছেন, আরে এইটা তো আমি জানিই, করিম্যেরে দিয়ে আইডিটা খুলাইছি। সামনে নির্ব্বাচন আইতাছে। সবাই আমার ওপরে ক্ষেইপা আছে। যদি এই বিহিতটা না করতাম তাইলে সামনে আর চেয়ারম্যান হওয়া লাগত না।
ছেলের মাথায় যেন বাজ পড়ছে। হতবাক হয়ে বলতেছে ‘এখন থানা পুলিশ সামলাবেন কেমনে?’
কেন? যে চার পাঁচটা গরু মণ্ডল পাড়া থেকে আনছি এগুলো বিক্রি করে থানায় দিয়ে দিব।
বাবার এসব কুকর্ম্মের কাহিনী শুনে ছেলে তো রেগে আগুন। আর এ আগুন প্রকাশ করারও মত না। আগুন হৃদয়ে রেখেই ছেলে তৎক্ষণাৎ বাড়ী থেকে চলে যায়।
শুনেছি ছেলে বাবার ঘর থেকে বের হয়ে যে ঢাকায় গিয়েছিল বাবা জীবিত থাকতে আর বাড়ীতে আসেনি। …
নাম বৃত্তান্ত
এক হিংস্র কিংবা ভীত শকুন একদা এক দোয়েলের বিশ্বস্ত সহকারী হিসেবে নিয়োজিত ছিল। শকুনটা বাহ্যিক রূপে ছিল টিয়া। আচরণে ছিল শিমুলের রুইয়ের মত তুলতুলে। মালিকের বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে পুরা রাজ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। কিছু বিপথগামী জংলী শকুনের সংস্পর্শে এসে ইতিহাসের এক নির্ম্মম কলঙ্কজনক অধ্যায়ের ভিলেন হিসেবে অভিষিক্ত হয়। স্বীয় মালিক দোয়েলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে দোয়েলকে স্বপরিবারে নমরুদের আগুনে নিক্ষেপ করতে সহযোগিতা করে। তারপর নমরুদদের সাহায্যে কিংবা বাধ্য হয়ে দোয়েলের ক্ষমতা অধিগ্ৰহণ করে।
বহু যুগ পরে, তখন শকুনও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, তৃতীয় নেপোলিয়ন নামক এক পাখী রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তিনি আবার দোয়েলের প্রত্যক্ষ রক্তের বাহক। ইতিহাসের নির্ম্মম নৃশংসতম সেই ঘটনা আজীবন বুকে জ্যান্ত রেখে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়েই তিনি এ পর্য্যন্ত পৌঁছেছেন। কিন্তু ক্ষমতা উনাকে জংলী শকুনের থেকেও ভয়ানক রক্ত পিপাসু হিসেবে আবির্ভূত করে। অল্প সময়েই ত্রাসের রাজত্ব কায়েমে সক্ষম হন তিনি। আর এ সক্ষমতার পিছনে ছিল লালসালু দ্ধারা আবৃত দোয়েলের অদৃশ্য এক মাজার। যার খাদিম হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তৃতীয় নেপোলিয়নের কাছে ‘টিয়া সিটী’ নামক এক শহরের পাখী-কুলেরা দাবী করেন তাদের শহরকে মহাশহরের মর্য্যাদা দিতে হবে। এই অঞ্চলের বাসিন্দারাও মূলতঃ টিয়া। তাদের রূপ ও গুণেরও কোন জুড়ি নেই এবং তাদের দাবীও ছিল যুক্তিসংগত।
কিন্তু বেঁকে বসেন স্বয়ং তৃতীয় নেপোলিয়ন। তিনি বলেন তোমাদের এ অঞ্চলে একটা শকুইন্যে টিয়া বাস করত। আর এ শকুইন্যে টিয়াই আমার পূর্ব্ব পুরুষ পীরে কামেল দোয়েলকে খুন করে। টিয়া সিটী নামটা শুনলেই আমার শকুইন্যে টিয়ার কথা মনে পড়ে যায়। এ নামে আমি মহাশহর হতে দিব না। তোমরা চাইলে আমি বরং ‘তোতা সিটী’ নামে মহাশহর করে দিতে পারি।
টিয়া পাখীরা তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে নাম নিয়ে অনেক বাকবিতন্ডা করেও ‘টিয়া সিটী’ নামটা বলবৎ রাখতে রাজি করাতে পারেনি।
টিয়ারা খুবই মর্ম্মাহত হল। তারা ভেবে দুঃখ পেল যে এক শকুইন্যা টিয়ার কারণে আজ আরেক শকুইন্যা তাদের পরিচয় টিয়া থেকে তোতা বানিয়ে দিচ্ছে!
মুরাদ হাসান রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, একথোকা ছোট গল্প — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।