বিয়োগপর্বের অন্যতম বাতিঘর মঈন চৌধুরী, কবি, চিত্রকর, চিন্তক, তত্ত্ব ও ভাষা বিশ্লেষক। সঙ্গীতে রয়েছে তার আকণ্ঠ অনুরাগ। ভূ-সংস্কৃতিকে তিনি বিন্যাস করতে প্রয়াসী সমকালীন বৈশ্বিক চেতনায়, বিনির্মাণ দ্যোতনায়, ভেদ রেখাকে সনাক্ত করে অভেদের সন্ধানে তার যাত্রা অব্যাহত। তত্ত্বের গভীরে পৌঁছে হৃৎ-অনুভবের তাড়নায় নিজে একীভূত হোন না কখনো। নিরপেক্ষ অবস্থানে অবিচল থেকে সময় সাপেক্ষ সত্য উচ্চারণ করেন বিনম্র চিত্তে। তত্ত্বকে অ্যাকাডেমিক লেকচারের বিষয় করে না রেখে বরং রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায়োগিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণসহ অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছেন দৃঢ় চিত্তে। বিপ্লবের জার্সি গায়ে দিয়ে তিনি আপোষকামিতার আণ্ডার-ড্রেস পরেননি। আত্ম-আয়নায় নিজেকে দেখেছেন বারবার। প্রচল প্রবাহ কিংবা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সামিয়ানায় সামিল না হয়ে ক্রমশঃ নিজেই হয়ে উঠেছেন প্রতি প্রতিষ্ঠান। বৌদ্ধিক ভাবে শৃঙ্খলিত হয়েছেন, নিজেকে প্রকাশ করার নিমিত্তে। পাওয়ার ষ্ট্রাকচার বিরোধিতায় আস্থাশীল মঈন চৌধুরী।
বাঙলা সাহিত্যের বাঁক বদলের অন্যতম প্রতিভূ তিনি। বাঁক পরিবর্তনের তাড়না থেকেই সম্পাদনা করেন; ‘প্রান্ত’ নামক সাহিত্য কাগজ। প্রলোভনে গা না ভাসিয়ে ক্রমশঃ হয়ে উঠেছেন অনন্য। মিডিয়া ম্যানিপুলেশন বুঝেই মিডিয়া ও মঈন চৌধুরী পরস্পর দূরে সরে গেছেন ক্রমে ক্রমে। এই ধীমানের ধীর স্থির যাত্রা অব্যাহত বঙ্গাল-সংস্কৃতির করতলে। আদর্শবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের অবিকল নতুন চিন্তা ভাবনাকে পাঠকের মানসপটে পৌঁছে দিতে এক ধরনের ব্যাকুলতা রয়েছে তাঁর ভেতর। এই তাড়নাবোধ থেকেই তিনি বারবার প্রকাশ করেছেন সমকালীন চিন্তকদের ডিসকোর্স নিয়ে পুস্তিকা। ‘সৃষ্টির সিঁড়ি’ ‘ইহা শব্দ’ ‘শব্দের সম্ভাবনা’ তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ। যা চিন্তাশীল পাঠকের মননরেখায় খোরাক যুগিয়েছে। দুর্নীতির মনস্তত্ত্ব ও ফিল্যানথ্রপী: মোটিভ বিশ্লেষণ নিয়ে আলাপচারিতা, বাংলা বানান সংস্ককরণ ও ভাষা নিয়ে কলিমখানের সাথে তাঁর বির্তক ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত সকল প্রবন্ধ আলাপচারিতা ও বির্তকের স্পাইরাল বাইন্ডিং প্রবন্ধ সংগ্রহ। যিনি প্রত্যেকটি বিষয়কে নৈর্ব্যত্তিক অবস্থান থেকে ফিলোসফিক্যাল ইনভেষ্টিগেশন করে আপাততঃ সত্যকে দাঁড় করিয়েছেন প্রশ্নের মুখে। বাংলা সাহিত্য ও দর্শনের অনুরাগী তারণ্যকে হাইডেগার, দেরিদা, ফুকো, সস্যূার, কার্লপপার, ফ্রয়েড, লাঁকা, ভিটগেইস্টান সাথে যেমন পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তেমনি একই সাথে সকালীন ভাষা ও রাজনীতি, উত্তর আধুনিকতা, উত্তর উপনিবেশকতা, নিম্নবর্গের ইতিহাস-সহ সাহিত্যের নানা ডিসকোর্স ও প্যারাডামিক বিন্যাস কাঠামোকে হাজির করেছেন অগ্রসর পাঠকের পাঠ বিবেচনায়। একিভাবে দেখিয়েছেন বিনির্মাণ ও বিকেন্দ্রিকরণের কাজ।
কাব্য নিরীক্ষার নিরন্তর শব্দ প্রকৌশলী কবি মঈন চৌধুরী। এ কেমন ভালোবাসা, ইন্দ্রজালে আপেক্ষিক, জীবন শব্দ রেখা, কবিতা ও ড্রইং, প্লাবন ও অন্তঃবৃক্ষের গান, জলপাই চাই, শব্দের পদ্মফুল উল্লেখ যোগ্য কাব্য গ্রন্থ। প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থ-ই নিজস্ব নিরীক্ষায় স্বতন্ত্র। এই নিরীক্ষার জাল কোন ভাবেই বিন্যাসিত হয়নি অন্য কাব্য গ্রন্থের বুনন জালে। প্রত্যেকটি কাব্য গ্রন্থে রয়েছে কিছু কিছু ক্ল্যাসিক্যাল কবিতা। যাহা নিরেট কবিতার ফ্রেমে ভেসে ওঠে কবির আত্ম আয়নায়। ভাঙ্গচুরে তাকেই মানায় যে প্রতিমা গড়তে সিদ্ধহস্ত। কবি মঈন চৌধুরী কাব্যভুবনের অন্যতম সেই কাণ্ডারী। যিনি কোন কিছু না ছুঁয়ে কেবল ছুঁয়েছেন জ্ঞানতত্ত্বের মনন রেখা। আর সব কিছু ছুঁয়ে গেছে তাঁকে। চোখ-কান-মুখ বন্ধ রাখলে পরিবর্তন থেমে থাকবে না, পরিবর্তন নিদিষ্ট সূচী অনুযায়ী ঘটে, ঘটবে। যারা দেখার দেখবেন, করণীয় কর্মসূচী পালন করবেন। কাঙ্খিত পরিবর্তন কামনাই শুভবোধ-সম্পূর্ণ মানুষের লক্ষ্য। জাতিগত, দলগত, বর্ণগত, ধর্মগত পার্থক্যের ক্লেদাক্ত গ্রাস থেকে পরিত্রাণ সম্ভব কেবল বৌদ্ধিক সততার মাধ্যমে। প্রচল সময় মানব জীবনকে ক্রমশ আবেগ, উৎকণ্ঠা, ত্রাস, শূন্যতা, নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তথা দুঃখবাদী নৈরাশ্যময় করে তুলছে। মঈন চৌধুরীর বয়ান মতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ও এপিষ্টোমগত বিশৃঙ্খলার শেষ হয়নি। এখানে এখনো অবস্থান করছে সে সব ‘ফুকোর মানব’ যারা একিসাথে আধুনিক এবং প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগপন্থী। একিসাথে আধুনিক প্রগতিশীল, আবার মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়াশীল। যেখানে একি চিন্তাকাঠামোতে অবস্থান করে এপিষ্টেম সংক্রান্ত সমস্যা, যা প্রকাশ করে প্রচন্ড দ্বৈততা। এই যুগ্ম বৈপরীত্যে থেকে উদ্ধারে ‘ফুকোর মানব’-কে দিতে হবে সোশ্যাল সাইকো থেরাপী।
সমকালীন চিহ্নায়কের মূল্য উপলব্ধি করে, প্রকৃষ্ট গতির চাকা সঙ্কুচিত না করে সমাপ্তিহীন সত্য অন্বেষণের নিরিখে আপাতত পুঞ্চিত সম্ভাবনার প্রতিবেদন মঈন চৌধুরী’র প্রবন্ধ সংগ্রহ।
রুদ্র শায়ক রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত হিজিবিজি, মঈন চৌধুরী ও সমকালীন চিহ্নায়কের মূল্য উপলব্ধি — প্রমিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।