প্রবন্ধ ইউভাল নোয়া হারারির সেপিয়েন্স : এ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব ম্যানকাইণ্ডের পর্য্যালোচনা

ইতিহাস কোনসময় সুখপাঠ্য হয় না। ইতিহাস পাঠ করতে গেলেই মনে হয় এই বুঝি অত্যাচারী, লুণ্ঠনকারী রাজাদের বর্বরতা ও আগ্রাসনের কাহিনী শোনতে হবে। তবে ইউভ্যাল নোয়া হারারি, ‘সেপিয়েন্স’ বইটিতে একটা প্রজাতি হিসেবে মানুষের কীভাবে সামাজিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটেছে সেটা এক বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকের চোখে দেখতে চেয়েছেন। হারারির মূল উদ্দেশ্য সেপিয়েন্স নিয়ে, তার উৎপত্তি, বর্তমান এমনকি ভবিষ্যত। হারারি মানুষের বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব দিয়েই বইটি শুরু করেন।

মাত্র ৭০ হাজার বছর আগে কগনিটিভ বিপ্লব শুরু হয়। সেপিয়েন্স শুরু থেকেই নার্সিসাস, আত্মপ্রতিষ্ঠায় মগ্ন ছিলো। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় ফ্রান্সের শুভে পু দার্ক গুহায় ৩০০০০ বছর পূর্বের মানব প্রজাতির সদস্যের হাতের ছাপ পাওয়া যায় যে বলতে চেয়েছে “আমি এখানে ছিলাম”। বুদ্ধিভিত্তিক সেপিয়েন্সরা তখন নিয়ান্ডার্থালদের মধ্য প্রাচ্য থেকে শুধু তাড়ায়নি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। প্রায় ৪৫ হাজার পূর্বে তারা যেভাবেই হোক সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে এবং ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছে। ধীরে ধীরে সেপিয়েন্সের মধ্যে জেনেটিক মিউটেশন ঘটে এবং মস্তিকের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। তারা চিন্তা ও ভাষা (সীমিত পর্যায়ে) ব্যবহার করে ভাববিনিময় করতে শিখে। এটাকে হারারি ‘দি ট্রি অফ নলেজ মিউটেশন’ নাম দিয়েছেন।

সেপিয়েন্স প্রথম যে কাজটা করে সেটা হলো পরচর্চা(গসিপ), মতবিনিময়, কাকে বিশ্বাস করা যেতে পারে, তারা বিভিন্ন সংকেত যেমন ‘হ্যান্ডশেইক করা’ মানে অন্য গোত্রের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা বা বিশ্বাস করা যেতে পারে এমনটা প্রকাশ করতো। পরচর্চা হোমো সেপিয়েন্সের বিশাল আকার ও অধিক স্থিতিশীল দল গঠনে সাহায্য করেছিলো। আমাদের ডিএনএর ভিতর এই পরচর্চা গসিপ করার প্রবণতা আছে বলেই অপরিচিত মানুষ, পাশের ঘরের হাড়ির খবর জানতে আমাদের এতো আগ্রহ। হাজার বছর আগে পৃথিবীতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের বহু আগেই তারা ফলমূল ও উদ্ভিদের রঙ্গের ভিন্নতা চেনার জন্য চোখে রড ও কোণ কোষ তৈরি হয়। শিকারী ও যাযাবর সেপিয়েন্সদের জায়গা জায়গা ঘুরে বেড়াতো হতো বলে মিষ্টি জাতীয় ফল খেতে হতো যেটাতে ক্যালরি বেশি ছিল ও ডুপেমিন হরমোনের জন্য গোত্রের সাথে আনন্দে বাস করতে পারতো।

মানবের প্রথম বিবর্তন হলো, সে দুই পায়ে সোজা দাঁড়াতে শিখে। দাঁড়িয়ে থাকার সুবিধা হলো যে সে হাত দু’টোকে অন্য কাজে ব্যয় করতে পারল। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে পাঁচ আঙ্গুলের ব্যবহার তথা মুষ্টিবদ্ধ করা শিখতে পারা সভ্যতার উন্নয়ণে একটা মাইলফলক ছিল। কারণ, একদিকে যেমন দাড়িয়ে উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের বৃক্ষহীন তৃণভূমিতে শত্রুর উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতো, অন্যদিকে হাত দিয়ে পশুদের বা শত্রুদের উপর পাথর, বল্লম, বর্শা নিক্ষেপ করে প্রতিকূল অবস্হা থেকে বাঁচতে পারতো। এভাবে কৃষি বিপ্লবের সময় শিকারী সেপিয়েন্সরা ধীরে ধীরে গানিতিক জ্ঞান আয়ত্ত করেন। হোমো স্যাপিয়েন্স প্রথম যে কাজটা করে তারা ‘গল্প বলা’ শুরু করে। বিভিন্ন মিথ বা কল্পিত নিয়মের আবিস্কার করে। এভাবে ট্যাবু টোটেমের জন্ম হয়। আজকের দিনেও আমরা গল্প বলতে ও শুনতে পছন্দ করি। মানুষ এই মিথগুলোতে বিশ্বাস করতো বলেই সভ্যতা এগোলো। সেটা হাম্বুরাবি কোড, পিরামিড নির্মাণ থেকে শুরু করে সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ কিংবা রোমান্টিক ভোগবাদ হোক না কেনো। একটা প্রাচীন সমাজ ট্যাবু টোটেমকে বিশ্বাস করতো বলে গোত্রগুলো নিয়ম মেনে চলতো।

মৃত্যুর পর আবার পূনরুজ্জীবিত হবে বলে রাজাদের সাথে স্বর্ণ, দাস দাসী রেখে মমি করা হতো। জাতীয়বাদ চেতনাবোধ ব্যক্তি, ধর্মের উর্ধ্বে এ মিথটা এতোই প্রবল হয় যে মানুষ নিজের জীবনের চেয়ে পতাকাকেই বেশি মূল্যায়ণ করতে শিখে। এমনকি আজকের বিপণন বাজার মানুষকে বোঝাতে সক্ষম যে আপনার সুখ, স্বাচ্ছন্দ, জীবনের প্রকৃত মানে হলো ভোগ করা, নিত্যনৈমিত্তিক জিনিস ক্রয় করা। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে বিদেশে যাওয়া।

হারারির মতে, প্রাচীন যুগ থেকেই ইতিহাসে মানুষ দুই প্রকার– হয় কোটাভোগী নয় ভুক্তভোগী। সমাজে অভিজাত শ্রেণি রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের নামে সাধারণ শোষণ করে আসছে। কেউ ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে, কেউ অভিজাত আর্য সন্তান বলে, কেউ জিইসের পুত্র, কিংবা সভ্যতার ধারক বাহক হিসেবে। অর্থ্যাৎ কল্পিত বিশ্বাস, মিথ লালন করে। তিনি বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে ১৭৭৬ খ্রিস্টপূর্ব ও ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ সাল দু’টো ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তখনকার পৃথিবীর সবচে’ বড়ো শহর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের রাজা হাম্বুরাবি সমাজ পরিচালনার বিশেষ নিয়ম, প্রথা চালু করেন যা দ্য কোড অব হাম্বুরাবি নামে খ্যাত। মেসোপটেমিয়ানরা সেটাকে আদর্শ নিয়ম নীতি বলে মেনে নেন। হাম্বুরাবি সমাজকে অভিজাত, সাধারণ ও ক্রীতদাস এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করে, অভিজাতদের জন্য কোটা বরাদ্দ করে। অনেকগুলো কোডের মধ্যে জগণ্যতম ছিলঃ কোন অভিজাত পুরুষ অন্য কোন অভিজাত নারী, শিশুকে নিপীড়ন বা হত্যা করলে, নিয়ম ছিল ওই অভিযুক্ত পুরুষের নারীকে বা কন্যাকে একই কাজ করে বা হত্যা করে বিচার করা। তবে ক্রীতদাস কোন নারী নির্যাতনের ফলে মারা গেলে পরিবারকে মাত্র ২০ শেকল ওজনের রৌপ্য জরিমানা দেয়া হতো। ১৭৭৬ সালে ফিলেডেলফিয়ায় আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় বলা হয়েছে– সব মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে দিয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য অধিকার, এগুলোর মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের অনুসন্ধান। দলিলে সই করা বেশিরভাগ ছিল দাসমালিক। তারপরও সাদা ও কালোর বৈষম্য ঘুচায় নি। স্হানীয়দেরকে শোষণ, নিপীড়নের দ্বারা মহাদেশকে ইউরোপীয়রা আবাদ করেছে। সমুদ্রতীরে সানবাথ পর্যন্ত কালোদের নাগালের বাইরে রেখেছে। শ্রমিকরা কুচি দিয়ে লুঙ্গি পড়তো বলে অভিজাতরা তা বর্জন করতো। হিপিদের আন্দোলনের আগে তো জিন্স, টি শার্ট পড়তো না। কারণ কল কারখানার শ্রমিকরা পড়তো বলে। এমনকি আমাদের উপমহাদেশে সাদারা তাদের ঘরের বাইরে লিখে রাখতো “Dogs and Indians are not allowed”.

মানুষ কি আদৌ কোন সময় স্বাধীন ছিলো? অবশ্য হারারি অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের মতো প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের দেয়াল তুলে না ধরে মানবের মাঝে হেগেলীয় “master and slave” দাস ও প্রভুর একটা চিরন্তন খেলা আছে সেই জিনিসটা তুলে ধরেছেন। তিনি শুধু উপেনিবেশিকতার খারাপ দিকই বলেননি। ভালো দিকটাও তুলে ধরেছেন। আইন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামোর উন্নয়ন, নিওগৈথিক শৈলিতে ছত্রপতি শিবাজি ট্রেন স্টেশন, ভিক্টোরিয়া স্টেশন তৈরি, মুসলিম সাম্রাজ্যের দ্বারা তাজমহলসহ আরো অনুপম শিল্পের সৃষ্টি সবই উপনিবেশবাদের সুফল হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি মহেন্জাদারো সভ্যতা ১৯০০ খৃষ্টপূর্বে ধ্বংস হয়েছিল ১৯২২সালে ব্রিটিশ টিম খনন করে প্রথম মহান সভ্যতা আবিস্কার করে। রাউলিনসন ও জোন্সের মতো মানুষের সাহসী ও সঠিক পর্যবেক্ষণে সংস্কৃত, গ্রীক, ল্যাটিন, গথিক, কেলটিক,প্রাচীন পার্সি, জার্মান ও ইংলিশ ভাষার মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পান যা পরবর্তীতে ইন্দো ইউরোপীয় পরিবার হিসেবে পরিচিতি পায়। অবশ্য এর বিনিময়ে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে শোষিত মানুষদের।…

সেপিয়েন্স বইটির পুরো অংশ জুড়েই আমাদের সুখ, বিশেষ করে ক্যামিক্যাল হেপিনেসের কথা উঠে এসেছে। হারারি ২৩০০ বছর আগের দার্শনিক Epicurus কথাই বলতে চাচ্ছেন যিনি তাঁর ছাত্রদের সাবধান করে গেছেন যেন সুখের পিছনে না ছোটে। কারণ, সুখ একটা চলমান খোঁজ। এর কোন সমাপ্তি নেই। হারারি সুখের বিষয়টাকে psychological ও biological perspectiveএ ব্যাখ্যা করেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলে মানুষের মাঝে সুখ নিয়ে গেইম থিওরি চলে। ক্লাসের প্রথম যে হয় সে সুখী কারণ অন্য সবাই তারচে’ নিচে। একজন বহতল ভবনের মালিক সুখী, কারণ সে তার প্রতিবেশির চে’ অনেক উপরে। একটা রাষ্ট্র সুখী হবার জন্য আশেপাশের দেশগুলোর চে’ জিডিপিতে, শিক্ষায় কতো এগিয়ে দেখিয়ে সুখী ভাবেন। এভাবে পরস্পরের মাঝে সুখের প্রতিযোগিতা চলে।…

হারারির মতে, বিপণন বাজার একটা বড়ো প্রহসন ‘পূজিবাদী রাক্ষস’। এটা সুখের কথা বলে মানুষকে ড্রাগের মতোই অভ্যস্ত করছে। অথচ সুখ কোন উপাদানে নেই। তিনি উদাহরণ টানেন, মধ্যযুগে একজন কৃষক যখন বাড়ি ফিরতো তখন তার জীবনের এতো বিচিত্রতা না থাকলেও পরিবারের সাথে সুখে থাকতো। এখনকার একজন ব্যাংকার আধুনিক সব সুবিধা ভোগ করেও শান্তিতে নেই। বায়োলজিক্যালি সুখ হলো হরমোনের খেলা। আমরা সুখী হই এজন্য নয় লটারি জিতে যাই, ভালো জব/চাকরি পাই বলে নয়। বরং যখন কোন কিছু পাবার, প্রত্যাশা পূরণের জন্য হন্য হয়ে ফিরি তখন মস্তিস্কে dopemin, endorphin, serotonin নিওরোট্রান্সমিটার নিসৃত হয়, আমরা সুখ অনুভব করি। তবে সমস্যা হলো এটাই যে, সে হরমোন বেশিক্ষণ থাকে না। তখন হতাশ হই। তাই মানুষ একটার পর একটা নতুন প্রত্যাশার পিছনে ছুটে যেন হরমোন আবার নিসৃত হয়। বিবর্তনবাদীরা বলে মানুষের এ বায়োকেমিস্ট্রি তার বিবর্তনে, সভ্যতাকে এগোতে সাহায্য করে। যদি মানুষের ডুপেমিন বা অন্যান্য সুখের হরমোন সর্বোচ্চ পর্যায় থাকতো সে কখনো অস্থির, হতাশ হতো না। সামনে এগোনোর স্বপ্ন দেখতো না। একদল কাঠবিড়ালি ও ইদুরের সামনে প্রচুর বাদাম রেখে বিজ্ঞানীরা দেখেন, কয়েকদিন আনন্দের সাথে খাওয়ার পর বন্ধ করে নিস্তেজ হয়ে গেছে, এমনকি তারা সংগম করাও বন্ধ করেছে। অথচ অন্যদিকে কমসংখ্যক বাদাম ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দেয়ায় অন্য কাঠবিড়ালিরা সেগুলোকে হন্য হয়ে খুঁজে বের করছে। তারা প্রফুল্ল থাকছে ও সহজে বংশবিস্তার করছে। বিজ্ঞানীরা এখন আমাদের ভিতরে জৈবরসায়নের খেলাটা ধরতে পেরেছে। তাই বস্তুর মাঝে সুখ না খুঁজে, মানুষের ভিতরের হরমোন কিভাবে পর্যাপ্ত নিসৃত করা যায়, সেদিকেই এগোচ্ছে।

হারারি গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ তত্ত্বের প্রতি একটু আস্থাশীল মনে হলো সুখের সংজ্ঞা নিরুপন করতে গিয়ে। হারারি অন্যান্য সব বিষয়ে যেমন স্ক্যাপটিক্যাল, তেমনি আধুনিক রোমান্টিক ভোগবাদ, লিবারেলিজম-এ আশাবাদী হতে পারিনি। একটা জায়গায় হারারি বলেন, মধ্যযুগে একজন বিবাহিত নারী যদি পরপুরুষের সাথে সস্পর্ক স্হাপন করতো, তখন আত্মগ্লানিতে ভুগতো, পাদ্রির কাছে গিয়ে পাপের জন্য অনুশোচনা করতো, ফাদার তার এ পাপের জন্য শাস্তিস্বরুপ, তাকে দশটা স্বর্ণের মুদ্রা, ছয় মাস মাংস খাওয়া থেকে বিরতি, সেইন্ট থমাস ব্যাকেটে তীর্থযাত্রা করে পাপমোচন করতে বলতো (অবশ্য পুরুষ একই কাজ করলে পাপ বলে গণ্য হতো না)। কিন্তু বর্তমানে কোন নারী এমন করলে কোন পাদ্রি বা পীরের কাছে যায় না। তারা বন্ধুবান্ধবদের সাথে শেয়ার করবে অথবা মনোবিজ্ঞানীদের কাছে যাবে। এরা বলবে না “হে পাপিষ্ঠা নারী, তুই নরকের আগুনে জ্বলবি”। বরং বলবে “how do you feel from inside? feel from heart,” হৃদয়ের কথা শোন। তোমার আত্মা যদি বলে পাপ করোনি, তাহলে সেটাই পূণ্য। হারারি রুশোর এই কথাটাকেই আধুনিক ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ ও উদার নীতির মূলকথা বলে উল্লেখ করেন। তবে এই রোমান্টিক ভোগবাদ, উদারনীতি আমাদের সেচ্ছাচারী, লোভী ও চরম মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে।

দেকার্তে বলতো “আমরা যতোদিন চিন্তা করতে পারবো, ততোদিন টিকে থাকবো” এখন পূজিবাদ, রোমান্টিক ভোগবাদ বলে “enjoy your life,” বিপনন বাজার যেমন কোকাকোলা কোম্পানি বলে “ডায়েট কোক। মন যা চায় তাই করো”। “যতদিন কিনতে পারবেন, ততদিন টিকে থাকবেন”। মানুষ আজ প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বিদেশ যায়, কারণ, তারা রোমান্টিক ভোগবাদে বিশ্বাসী। বিপনন বাজার, টেলিভিশন, আপনার সামনে বিচিত্র ধরনের রন্ধনপ্রণালী, প্রসাধনী, যোগব্যায়াম থেরাপি, নতুন নতুন চাকচিক্যময় পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হয়ে বলছে “we are at your service” আমরাও এগুলো কিনতে আগ্রহী হই। কারণ, আমরা ধীরে ধীরে রোমান্টিক ভোগবাদে বিশ্বাসী হচ্ছি। আমরা পরস্পরের মাঝে প্রতিযোগিতা করি, আমরা সুখ মানেই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিনিসপত্র ক্রয় করা, নিজেকে তৃপ্ত রাখা, প্রতিনিয়ত পরশ্রীকাতরতায় ভুগছি। এভাবে সবাই কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছি, বিনোদনের নামে, ভালোবাসার নামে। রোমান্টিক ভোগবাদী কনসালটেন্টরা বলে “কয়েকদিন সমুদ্রে ঘুরে আসেন, দেখেন নিজেদের ভিতরে ভালোবাসা জাগে কিনা”।

জীবনের এই hedonistic view আমাদের চরম স্বার্থপর করে তুলেছে।

এমনকি আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলোও ভোগবাদে বিশ্বাসী। এমন কোন উৎসব নেই যেখানে শপিংমলে উপচে পড়া ভীড় হয়না। হারিরি বলেন, একসময় মানুষ অনাহারে মরতো। এখন কে এফসি, ম্যাকডোনাল্ট ফাস্টফুডগুলো হাইপ্রসোসড ক্যালোরির জন্য অধিক মানুষ হত্যা করছে। ভোগাবাদী বাজার মিথ তৈরি করে বুঝাতে সক্ষম হলো যে মানুষ কম খেলে অর্থনৈতিক সংকোচন ঘটে, বরং মানুষকে নতুন নতুন ভিন্ন খাবার খাওয়াতে হবে। আর বিপণন বাজার এটা সুকৌশলে করে থাকে।…

হারারি, সেপিয়েন্স বইয়ের শেষদিকে লিখেছেন মানুষ কীভাবে একটা অ্যানিম্যাল থেকে ঈশ্বরে পরিনত হয়েছে। মাত্র ৭০০০০বছর আগেও আফ্রিকার কোণে খাবার খুজে বেড়াতো। আজ শুধু প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণই নয়, সে অমরত্বের দিকে যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সে ধীরে ধীরে হোমো সেপিয়েন্স থেকে একটি সাইবর্গে পরিণত হচ্ছে, যেটাকে হারারি হোমো ডিউজ নাম দেন। জেনিটিক রেভ্যুলোশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একদিকে যেমন মানুষকে আরাম, আয়েশ, দীর্ঘ জীবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ শ্রম বাজার হারাবে। সিলিকন ভ্যালির জায়ান্টরা সেই ফ্রাংকেস্টাইন দানব (সুপারহিউম্যান) তৈরি করবে যা মানুষের মাঝে বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তুলবে। বিশ্বায়ন বলতে কিছু থাকবে না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কাছে পৃথিবীর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অসহায় হয়ে পড়বে। কেননা প্রযুক্তি সব কাজ কম সময়ে, অধিক দক্ষ, নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করবে। গুগল নিয়ন্ত্রণ করবে সব। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমাদের প্রাইভেসি বলতে কিছু থাকবে না। আমার, আপনার পছন্দ, অপছন্দ, ভালোলাগার, খারাপলাগার মুহুর্ত, আমরা যতো বেশি অনলাইন, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে থাকবো গুগল ডাটা অ্যানালাইজ করে একজন জ্যেতিষীর মতো বলে দিবে। হারারি সেটাকে ‘ডাটা রিলিজিয়ন’ নাম দিয়েছেন। আর ডাটা সাইনটিস্টরা আগামী বিশ্বের জ্যেতিষী। তবে সেপিয়েন্সের এতো দ্রুত অগ্রগতি, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে, মানুষকে অস্থির ও বিপন্ন করে তুলবে।

হারারি শেষদিকে হতাশাজনক কথাই বলেছেন। “মানুষের বিস্ময়কর সক্ষমতা সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য সম্পর্কে অনিশ্চিত এবং বরাবরের মতোই অসন্তুষ্ট। আমরা ডোঙ্গা নৌকা থেকে জাহাজ, বাষ্পচালিত জাহাজ থেকে মহাকাশ যান পর্যন্ত উন্নত করেছি, কেউ জানে না আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমরা অসীম শক্তিশালী হয়েছি। তবে এই শক্তি কী করবো? আরো খারাপ হলো মানবজাতি এখন আগের তুলনায় আরো দায়িত্বহীন হয়েছে। স্বঘোষিত ঈশ্বর হোমো সেপিয়েন্সদের সঙ্গী কেবল পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র, সেখানে তারা কারো কাছে দায়বদ্ধ নয়। তাই, আমরা অন্যান্য প্রাণি ও পরিবেশের উপর নিপীড়ন করি, আমরা নিজেরা আরেকটু স্বস্তি ও আনন্দ পেতে চাই। তবুও কখনোই সন্তুষ্টি খুঁজে পাই না।

যদিও আইজ্যাক আসিমাভ এর “বিগিনিংস” এবং কার্ল সেগানের “কসমস” বই দুটি সেপিয়েন্স ও মহাবিশ্বের রহস্য উম্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ বই। তবে হারারি’র ‘সেপিয়েন্স’এর বিশেষত্ব হলো তিনি মানুষের ইতিহাসকে প্রথমবার একজন মনোবিজ্ঞানী, বিবর্তনবাদী এবং দার্শনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের মতো করে বর্ণনা করেছেন। হারারির ‘সেপিয়েন্স’ মোটের উপর একটা থটপ্রভোকিং ও পেইজ টার্নার বই। এবং হারারি একজন মাস্টার স্টোরিটেলার।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, ইউভাল নোয়া হারারির সেপিয়েন্স : এ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব ম্যানকাইণ্ডের পর্য্যালোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *