আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা। এক বহুজাতিক সার কারখানায় ট্রেনিং ম্যানেজারের চাকরী নিয়ে চট্টগ্রামে গিয়েছি। থিতু হয়েই চট্টগ্রামের কবীদের খুঁজতে শুরু করলাম। মোবাইল ফোন ও ফেসবুক কোনটাই ধরাধামে তখনো আসেনি, যোগাযোগের উপায় চিঠি ও ল্যান্ড টেলিফোন। তখন খোঁজ পাই কবীদের আড্ডাস্থল চকবাজারের এক রেস্টুরেন্ট, নাম ‘সবুজ হোটেল’। কবীদের মন তো সবুজই, বেশ মিলে গেল হোটেলের নামটী। আমি যেখানে থাকতাম, সেই হিলভিউ থেকে সবুজ হোটেল খুব একটা দূরে নয়, আবার খুব একটা কাছেও নয়। টিলার উচ্চতা থেকে নামতেই বাঁকানো সড়কটীর পাশে যে ত্রিতল দালানটী সেখানে থাকত দুই ব্যাচেলর— মাসরুর আরেফিন ও রইস উদ্দিন। এ এন জেড গ্রীনলেজ ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হিসেবে যোগ দিয়েছে তারা— ভবিষ্যতের দুই তরুণ মেধাবী ব্যাংকার।
মিমি সুপার মার্কেটের পেছনে এই হিলভিউ। নামটী কিন্তু যথার্থ! আমার এপার্টমেন্টটী ছিল চতুর্থতলায়। এর বারান্দা থেকে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়শ্রেণীর গাঢ়সবুজ নীলাভ পিঠরেখা দেখতে পেতাম। সেই মিমি সুপারমার্কেট পিছনে ফেললেই ডানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশাল সাম্রাজ্য আর বামে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা। রিকশা ছিল আরামপ্রদ ও কমদামী বাহন, তরতরিয়ে নিয়ে যেত চকবাজার মোড়তক। সবুজ হোটেলটী ওখানেই।
এখানে প্রায় প্রতিদিন আড্ডা দিত একদল কবী। আমার সাথে পত্রযোগাযোগ ছিল কবী হাফিজ রশিদ খানের সাথে। তার আহবানেই সম্ভবত প্রথম যাই সবুজ হোটেলে আর দেখা পাই লিরিক গোষ্ঠীর কবীদের। উত্তর আধুনিকতা নিয়ে লিরিক তখন আলোড়ন তুলেছে কাব্যাঙ্গণে। লিরিক সম্পাদক এজাজ ইউসুফী, চওড়া গড়নের উঁচু ও শুভ্রবরণ পুরুষ, তার উষ্ণীষের মত চুলরাশি ও চেহারার কৌলিন্যে সহজেই নজরে পড়ল। সেখানে নিয়মিত আসতেন হাবীব আহসান, জিললুর রহমান, পুলক পাল। এরা সবাই লিরিক গোষ্ঠীর কবী। আরও ছিলেন তরুণ কবী সাজিদুল হক ও সুজন বড়ুয়া। সকলের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন সৈয়দ রফিকুল আলম। মাঝে মাঝে দেখা পেয়েছি জাফর আহমেদ রাশেদ ও অলকা নন্দিতার। তখন তারা পরস্পরের প্রেমে মগ্ন, বিবাহবন্ধনে জড়াননি।
আমি যে দুবছর কাফকোতে চাকরী করি, সে দুবছর প্রায় প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার সকালে সবুজ হোটেলে গিয়েছি আর আড্ডায় মেতেছি সমসাময়িক ও একদশক তরুণতর কবীদের সাথে। লিরিক গোষ্ঠীর কবীরা পত্রিকার পাশাপাশি পাঁচ তরুণের পাঁচটী কাব্য সাদা আর্টপেপারে ঢালী আল মামুনের উত্তর আধুনিক প্রচ্ছদ নিয়ে প্রকাশ করল। সৈয়দ রফিকুল আলমের সায়াহ্নকালে প্রকাশিত হল প্রথম কবিতার বই ‘কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছে।’
আজ বহুবছর পর কথাসাহিত্যিক খোকন কায়সারের সাথে সবুজ হোটেলে ফের প্রবেশ করি। ক্যাশবাক্স আর ক্যাশিয়ার একই জায়গায়, প্রবেশপথের বামে রয়েছে। আমরা যেখানে বসতাম, সে জায়গায় চেয়ারটেবিল কিছু নেই, সিঁড়ী উঠে গেছে দোতলায়। খোকন ও আমি দোতলায় উঠে সমুখদিকটায় এপাশে তিন, ওপাশে তিন সিটের একটী টেবিলের দুটো চেয়ারে মুখোমুখী বসি। আমরা অর্ডার করি মাটীর বড় চুলা থেকে নামা গরম তন্দুরি ও গরুর পায়া। কবী হাফিজ রশিদ খান কাছেই শুলুকবহরে থাকেন, তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সবুজে আসার আহবান জানায় খোকন। তন্দ্রাজড়িত কবী, বয়সের কারণে কিছুটা ভাঙাচোরা, এসে যোগ দেন তন্দুরি ও পায়া উৎসবে। খেতে খেতে আমরা গল্প করে চলি সবুজ হোটেলের, কবীদের সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে যা হয়ে ওঠেছে কিংবদন্তী।
এই হোটেলে (আসলে রেস্তোরাঁ) এসে আড্ডা দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অনেক রথী মহারথিগণ। সে তালিকায় আছেন সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান প্রমুখ কথাসাহিত্যিকগণ, ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন, সঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছিলেন উত্তর আধুনিক তত্ত্বের একজন প্রবক্তা অঞ্জন সেন; আসামের শিলচর থেকে প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্য। এছাড়া আসতেন সৈয়দ মঞ্জুর মোর্শেদ, মহীবুল আজিজ, হোসাইন কবির, সালাহউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। শাহাদুজ্জামান ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র, চট্টেশ্বরী রোডে মেডিকেল ছাত্রাবাসটী এই জায়গা থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে। ফলে সহজেই যোগ দিতে পারতেন আড্ডায়। শাহাদুজ্জামান ছাড়াও আরও তিন কবী ছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র। এরা হলেন জিললুর রহমান, মোশতাক আহমদ ও হামিদ হোসেন খুররম।
কবী হাফিজ রশিদ খান জানালেন সবুজ হোটেলের আড্ডা থেকে জন্ম নিয়েছে অনেকগুলো লিটল ম্যাগাজিন। এগুলো হল হাফিজ রশিদ খান সম্পাদিত ‘পুষ্পকরথ’ ও ‘দৃষ্টি’; এজাজ ইউসূফী সম্পাদিত ‘লিরিক’; চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া সম্পাদিত ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’; সাজিদুল হক সম্পাদিত ‘সুদর্শনচক্র’; সুজন বড়ুয়া সম্পাদিত ‘চম্পকনগর’; হাফিজ রশিদ খান, মোহাম্মদ সেলিমউল্লাহ ও অমিতাভ কাঞ্চন সম্পাদিত ‘চারণ’।
রাজীব নূর, জাফর আহমদ রাশেদ ও সামীম আরা সম্পাদিত ‘আড্ডারু’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক হলেও এর মূল আড্ডাস্থল ছিল চট্টগ্রাম শহরের জাকির হোসেন রোড়ে, যে আড্ডার বিস্তৃতি ছিল সবুজ হোটেলেও; এবং ‘আড্ডারু’র দলে আরও ছিলেন শাহীনুর রহমান, অলকা নন্দিতা, তনুজা শর্মা, নজরুল ইসলাম বাবুল, মুহসিনুল কিবরিয়া চৌধুরী মুকুল, মোজাম্মেল মাহমুদ, আহসান আলম। জাকির হোসেন রোডের আড্ডায় এইসব তরুণ সাহিত্য কর্ম্মীর চেয়ে বয়সে বড় কবী হাফিজ রশিদ খান এবং কবী হোসাইন কবির যেতেন অনুপ্রেরণা দিতেন। আরেকটা কথা বলে রাখি, অনেক আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্কের পর “আড্ডারু” নামটী গৃহীত হয়েছিল। নামটী প্রস্তাব করেছিলেন হাফিজ রশিদ খান।
শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিন নয়, বাইরের জেলার কোন কোন লিটলম্যাগ প্রকাশের সিদ্ধান্ত সবুজের আড্ডায় হয়েছে, যেমন নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘ধাবমান’।
সবুজের আড্ডা থেকেই মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যেতেন কবী হাফিজ রশিদ খান। কোথায় যেতেন তিনি? তিনি যেতেন রাঙামাটী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন। তার সাথে সখ্য গড়ে উঠছে পাহাড়ী কবীদের। তারাও আসতে শুরু করেন সবুজের আড্ডায়। এদের মাঝে ছিলেন তিন মারমা কবী— মং ক্য শোয়েনু নেভী, মং সিং ঞো, ও শৈ অং প্রু। ছিলেন দুজন মনিপুরী কবী কন্থৌজম সুরঞ্জিত ও থোঙাম সঞ্জয়। কোন চাকমা কবীর কথা স্মরণ করতে পারলেন না হাফিজ রশিদ খান। তাদের স্মরণে এলো সবুজ হোটেলের মালিক আহম্মদ হোসেন সওদাগরের কথা। যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনিই ক্যাশে বসতেন। সুদর্শন ও মোটা লোকটীকে কবীরা নাম দিয়েছিল জাপানী জেনারেল, কারণ তিনি ছিলেন রাগী প্রকৃতির। রেস্তোরাঁর বয়-বেয়ারাদের ওপর চোটপাট করতেন, চীৎকার চেঁচামেচি করতেন। কর্ম্মচারীরা তার ভয়ে তটস্থ থাকত। সবুজ হোটেল চালু হয়েছিল পাকিস্তান আমলেই। মুসলিম লীগের ঘোর সমর্থক এই জাপানী জেনারেল বাঙালী হয়েও কথা বলতেন উর্দুতে। কবীদের সাথে তিনি উর্দুতে মজা করতেন। নেশা করে ঢুলু ঢুলু নেত্রে ও অনিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপে কবীরা দুপুর বেলা হোটেলে ঢুকলে তিনি বলতেন ‘পিনা হুয়া? আভি খানা খায়েগা? যাও বেইঠো, খাও কালাভুনা।’
কবী-সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থল হিসেবে পরিচিতি পেলেও সেখানে বিভিন্ন গ্রুপ এসে বসত। এদের মাঝে ছিল খেলোয়াড়বৃন্দ, মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা, চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটীর ছাত্রগণ। হাফিজ রশিদ খান জানালেন এখানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররাও আড্ডা দিত। লিরিকের প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ‘আল্লাহর রঙে রাঙিয়ে দিব’ থেকে ভুল সংকেত পেয়েছিল তারা। আসলে লিরিক সম্পাদক বার্তাটী সঠিকভাবে দিতে পারেননি।
আমরা তন্দুরি, পায়া ভক্ষণ ও চা পান শেষে বাইরে বেরিয়ে আসি। সড়কের ওপাশে একটী দোকান থেকে অগ্নিশলাকা সংগ্রহ করেন শেকল ধূম্রপায়ী (চেইন স্মোকার) হাফিজ রশিদ খান। সবুজ হোটেলের পাশেই ‘কুটুম বাড়ী’ রেস্তোরাঁ। সবুজ হোটেলের সরু কাঠামোর পাশে কুটুম বাড়ীর ভারী দেহ। হাফিজ রশিদ খান বললেন, ওখানে একটী বাদাম গাছ ছিল। চা-নাস্তা শেষ করে কবীরা ওখানে এসে সিগ্রেট ফুঁকত, আর তুমুল তর্কে জড়াত। এক চিলতে খোলা জায়গাটীকে কবীরা নাম দিয়েছিল ‘উদাস চত্বর’। এর পেছনে ছিল ডাক্তার এহসানের সোবহানিয়া এক্সরে ক্লিনিক, তখনকার চট্টগ্রামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এক্সরে ক্লিনিক। ডাক্তার এহসান ছিলেন আমুদে স্বভাবের। কবীদের কারো কারো সাথে এই দিলখোলা চিকিৎসকের মিলটী হল গঞ্জিকাসেবন। তখন কবীদের সম্বল ছিল স্টার সিগারেট প্রকাশ্যেই টানা যেত। এখনকার মত বিধিনিষেধ ও কড়াকড়ি ছিল না। প্রথমদিকে সবুজে রান্না হত জ্বালানীকাঠ দিয়ে, ধোঁয়া ওঠত প্রচুর, সেই ধোঁয়ার ভিতর বসেই তারা চালিয়ে যেত সাহিত্যের আলাপন।
সবুজ হোটেলের একেবারে লাগোয়া যেখানে সেই নব্বই দশকের মধ্যভাগে মোটর পার্টসের সারিসারি দোকান ছিল, সেখানে এক পাঁচতলা শপিংমল ওঠেছে। সেখানেই শেষ নয়, শপিংমলের ওপরে এপার্টমেন্ট হাউজ। ভূমীর এমন অতিলম্বিক ব্যবহার আমরা কবে জানতাম?
সবুজের আড্ডার নিয়মিত উপস্থিত থাকত সোহেল রাববি, লিরিক গোষ্ঠীর আরেক কবী। তার বাড়ী এই চট্টেশ্বরী রোডেই, সার্সন রোড যেখানে চট্টেশ্বরী রোডের বাহু ছেড়েছে বা ছুঁয়েছে সেই মোড়েই ছিল সোহেলের বাসা। প্রতিদিন দশটা-এগারটার দিকে সে সবুজ হোটেলে আসত, রাত ১০/১১টায় বাড়ী ফিরত। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার সবুজেই সারত। তার প্রিয় খাবার ছিল সিঙাড়া ভেঙে পরোটা দিয়ে খাওয়া। হাফিজ রশিদ খানের স্কুল জীবনের বন্ধু সোহেল রাববি অকালে মৃত্যুবরণ করেন, বই করার ইচ্ছে ছিল, নামও ঠিক করেছিল ‘যমুনাদিদির শরীর’। সোহেল কথা কম বলত, কিন্তু যা বলত তা ছিল তীক্ষ্ণ, তাতে গভীর কাব্যভাবনা ফুটে ওঠত। আমি হাফিজ রশিদ খানকে জানালাম ঘটনাচক্রে সোহেল রাববি ও আমি মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটীতে একই বিল্ডিংয়ে থাকতাম। কবী জিললুর রহমান যেতেন কবী সোহেল রাববির সাথে আড্ডা দিতে, মনে পড়ে।
হাফিজ রশিদ যখন প্রয়াত বন্ধুর স্মৃতিজড়িত শোকে বিহ্বল তখন সমুখের টেবিলের একজন নারীকে দেখে আমি ভীষণভাবে চমকে উঠি। হুবহু বুলু আপা। আজ থেকে, কত বছর হবে সময়টা, চল্লিশ তো বটেই, এই সবুজ হোটেল থেকে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। পুলিশি চোখ এড়িয়ে তিনি আত্মগোপন করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাসে।
কামরুল হাসান রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, সবুজ হোটেল — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।