গদ্য প্রবন্ধ হিংসা পরম ধর্ম্ম : প্রকৃতির অস্তিত্বজাত তাড়নার স্বরূপ


জেনেছে ফ্রয়েড/
সুরভিত/
ফুলের চারপাশে যে কাঁটা/ সে-ও চাকুর ঝকমারি/ বাঁচার আকুতিময়/…
গতিময়/
নাচনমুখর/ সাপের যে চলা/ দোলায়িত/
সেখানেও আছে/ সৌন্দর্য্য/ ও ফণা/…
আর/
মানুষের/সৌন্দর্য্যের ইতিহাসে/
হাতাহাতি/ খামচাখামচি/ কামড়াকামড়ি/
কেবল রূপান্তরিত হয়েছে/ হচ্ছে/ হবে/
(প্র)যুক্তি বান্ধবে/হাতের ইয়ারে> হাতিয়ারে/—
প্রকৃতির স্বভাব কি মানুষ খণ্ডাতে পারে/…
প্রকৃতি নিজেই বিকশিত/ বিনাশের ধারাপাতে/ হিংসায়/…
বনবালা
ইকোর প্রনালী জানে/
মানুষের মতবাদে/ সংঘাতে/ বহিছে জীবন/ ভারের সাম্যতায়/ ভাবের সাম্যতায়/…
যেহেতু/
মানুষকে বধিতে পারে/ কেবল মানুষ/…
শিবের ত্রিশুল জানে/
ঔঁ শান্তিময়/ অহিংসার গান/ কেবলই মায়াবী রোদন/
প্রেমজ বিতান/…
ক্লান্তির ভ্রমণ শেষে খোঁজা/ কাজলা দীঘির জল/ প্রশান্তির মায়া/…
কিংবা/ তমসার আঁধারে দপ্ করে জ্বলে ওঠা/ আলেয়ার আলো/…
ড্রোনাচার্য্য জানে/
এ জগৎ তরবারিময়/ ট গ্ ব গ্ ট গ্ ব গ্ / ক্ষুরের নাচন/…
সমর শিল্পের মাঠ/ বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী/…
সৃজনের নন্দনকাননে/ যেদিকে তাকাই/ দেখি/ ‘হিংসা’ পরম ধর্ম্ম/ প্রকৃতির/…

                                                — ‘হিংসা’ পরম ধর্ম্ম || আরণ্যক টিটো

 

 

সাধরণত এমন একপ্রকার ধারণা আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল যে, প্রকৃতি সর্ব্বদা উদার এবং প্রেমময়।… যদিও প্রকৃতির সংঘাতময় রূপটি কখনো কখনো আমাদের কাছে (প্রতি)ভাত হয়।…

কিন্তু তাতে আমাদের তেমন একটা আগ্রহ বা মনোযোগ থাকে না। যখন কেউ বলে— যুদ্ধই চিরন্তন, যুদ্ধই শাশ্বত তখন আমাদের চেতনার জিজ্ঞাসা চিহ্নটি কিছুটা আলোড়িত হয় ঠিকই। কিন্তু তা তেমন একটা ভাবান্তর ঘটাতে সক্ষম হয় না। কারণ আমাদের সাধারণ আবেগ ও ঔচিত্যবোধ বার বার শান্তি ও স্বস্তি খুঁজে— পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না; বৃক্ষের ফল, নদীর জল ও গাভীর দুগ্ধ কিছুই তাদের নিজেদের জন্য নয়— এমন ধারণার মাঝে!…

মজার ব্যাপার যে, জগতের কোনো কোনো চিন্তকের চিন্তায় জগৎ-প্রকৃতির প্রেমময় রূপটি ধরা পড়ছে আবার কোনো কোনো চিন্তকের চিন্তায় সংঘাতময় রূপটি ধরা পড়েছে। এমন চিন্তকও আছেন যাদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতায় জগৎপ্রকৃতির উভয় রূপই ধরা পড়ে(…) এমনও দেখা যায় যে, জগতের সংঘাতময় রূপে আক্রান্ত হয়ে কেউ কেউ প্রেমময় রূপটি অস্বীকার করে যায় আবার কেউ কেউ প্রমময় রূপে বিভোর হয়ে সংঘাতময় রূপটি অস্বীকার করে যায়।… জগতের প্রেমময় রূপটি এড়িয়ে যাওয়ার মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা আমাদের কাছে ভয়াবহ মনে হতে পারে। কিন্তু এ-ও ভেবে দেখতে হবে যে, জগতের সংঘাতময় রূপটি অস্বীকারের পিছনেও আমাদের কোনো ভয়াবহ ধ্বংসাত্বক মনস্তত্ত্ব কাজ করে কি না!?…

মানবের সীমাহীন দুঃখ দুর্দশা চরমভাবে বিচলিত করেছিল বুদ্ধকে।… তিনি দুঃখের উৎস খুঁজতে গিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন— আসক্তি/লোভ/লালসাই মানবের দুঃখের মূল! এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য বুদ্ধকে অবশ্যই একরকম মনোবৈজ্ঞানিক পথেই যেতে হয়েছিলো। শেষাবধি তিনি স্থির করলেন— জীবনের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করাই দুঃখ নিবারণের একমাত্র পন্থা। জগতের সংঘাত বিলোপনের জন্য বুদ্ধ প্রচার করলেন, অহিংসার বাণী— অহিংসা পরম ধর্ম্ম!…

অহিংসাবাদের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলো জৈনরা।… জৈন ঋষিরা বিবেচনা করলো— মানুষ নিয়ত অন্য জীব/জীবনকেই খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করছে। তাই খাদ্য গ্রহণের সাথেই জড়িত আছে হিংসার পাপ।… এভাবে চরম অহিংসাবাদী জৈনরা তাদের খাদ্যতালিকা সংক্ষিপ্ত করতে লাগলো।… জীবের অস্তিত্ব রক্ষার পিছনে যে একপ্রকার ধ্বংসাত্বক/হিংসার প্রেরণা আছে, জৈনদের কাছে তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তবুও তারা হিংসাকে এড়ানোর প্রাণপণ প্রয়াস করলো অহিংসার/প্রেমের মায়াবী মুগ্ধতায়।…

আমাদের শান্তিবাদী আবেগ ও ঔচিত্যবোধের আলোকে অহিংসাকে যদি আমরা পরম ধর্ম্ম বলে মানি তবে হিংসার সাথে জীবসত্ত্বা/মানবসত্ত্বার কোনো পরমতাত্ত্বিক সম্পর্ক আছে কিনা তাও যাচাই করে দেখা দরকার! নাহলে জীব/মানবের প্রকৃত সত্ত্বা সম্মন্ধে আমাদের জ্ঞানের ঘাটতি থেকে যাবে বরাবরই।…

এবার একটু বিবেচকের মনন নিয়েই পাঠ করতে হবে, ‘হিংসা’ পরম ধর্ম্ম (…………………………)

কবিতার প্রথম পংক্তি, ডট ডট ডট(…)
যা ফ্রয়েড জেনেছে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হচ্ছে। অথবা এটা নিছক কোনো লুপ্ত পঙক্তি।…
তারপর বলা হচ্ছে:
সুরভিত/
ফুলের চারপাশে যে কাঁটা/ সে-ও চাকুর ঝকমারি/ বাঁচার আকুতিময়/…
গতিময়/
নাচনমুখর/ সাপের যে চলা/ দোলায়িত/
সেখানেও আছে/ সৌন্দর্য্য/ ও ফণা/…

এখানে কাঁটাকে দেখা হচ্ছে, ঝকমকে চাকু হিসাবে আর গতিময় নাচনমুখর সাপের দোলায়িত চলনকে দেখা হচ্ছে, একাধারে সৌন্দর্য্য ও ভয়ানক ফণার সম্ভাবনা হিসাবে। তাহলে কাঁটা কি ফুলের অস্তিত্বেরই অখণ্ড অংশ, যা ফুলের মতো প্রেমময় নয়ানাভিরাম দ্রব্যের ধ্বংসাত্বক/আত্নরক্ষার চিহ্ন?!… দোলায়িত সাপটি আমাদের মহাদেব শিবের গলায় পেচানো সাপের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে, যার সাথে সম্পর্ক আছে জগতের ভারসমতার/জগতের গতির। হতে পারে এটি বাইবেলের সেই প্ররোচক সাপ, যাকে আবার হয়তো দেহবাদী বাউলফকিরদের কাছে মানবের তলপেটে পেঁচিয়ে থাকা কোন রহস্যময় নাড়ী বলে মনে হয়েছিলো, যা মানবকে নিয়ত ধ্বংস ও বি+নাশে/বিশেষ নাশের প্ররোচনা দিয়ে যায়।… অথবা মনে হতে পারে, এটি আমেরিকার কবি জরি গ্রাহাম’র “সাপ” কবিতার গোচর অগোচরে চলা সেই সাপ যার সাথে কামনার/কামের/অস্তিত্ব সংগ্রামের যোগ আছে বলে ধারণা হয়েছিলো কবির।…

এখন আমাদের ভেবে দেখতে হবে, ধারালো কাঁটা ঘেরা প্রেমময় ফুল ও সৌন্দর্য্য আর ফণাময় সাপের সাথে ফ্রয়েড বা ফ্রয়েডীয় মনোবৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে কী এমন সম্পর্ক থাকতে পারে!…
১৯৩১/১৯৩২ সনের দিকে বস্তুজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আন্তর্জাতিক বুদ্ধিব্যাপারীদের সংগঠন ও লীগ অব ন্যাশন’র অনুঘটক হয়ে যুদ্ধের মতো বিভীষিকা থেকে মানব সভ্যতার মুক্তি আছে কিনা এ ব্যাপারে মতামত চেয়ে চিঠি লিখেন মনোপণ্ডিত সিগমু্ণ্ড ফ্রয়েডের কাছে। আইনস্টাইন সা’ব ফ্রয়েডকে সমস্যাটি নিছক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে না দেখে, মানবের মনস্তত্ত্বের আলোকে বিবেচনা করতে জোর দেন এবং আইনস্টাইন নিজেও এতে যথেষ্ট মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা আছে বলে ধারণা ব্যক্ত করেন।… আইনস্টাইনের চিঠির উত্তরে ফ্রয়েডও একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেন, [………………..]— যাতে যুদ্ধের সাথে মানবের মনস্তাত্ত্বিক অনেক খুটিনাটি সম্পর্ক ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ উঠে আসে। চিঠিতে ফ্রয়েড যুদ্ধ বা সংঘাতকে মানবের সহজাত প্রবৃত্তির ধ্বংসাত্বক প্রবণতা বলে আখ্যায়িত করেন এবং মানবের অধিকারবোধ ও যুদ্ধের/হিংসার/সংঘাতের মধ্যে গভীর অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক আছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। এমন কী তিনি আইনকেও মানবের হিংসাত্বক প্রবণতা বলে ধারণা করেন। আমরা কেনো যুদ্ধের মতো ধ্বংসাত্বক (প্র)ক্রিয়া নিরসনে সোচ্চার হবো না— এমন প্রশ্নের মুখেমুখি তিনি, বরং আমরা কেনো যুদ্ধ বিরোধিতা করবো— এ জিজ্ঞাসার অবতারণা করেন।… তার মানে তিনি ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন যে, আমাদের যুদ্ধবিরোধী হওয়ার পিছনেও কোনো হিংসাত্বক প্রবৃত্তি কাজ করে।…

ফ্রয়েডীয় মনোবিদ্যায় প্রেম ও হিংসা, মানবের এ দুই ধরণের সহজাত প্রবৃত্তির কথা বলা হয়। মানবের প্রতিটি কাজের পিছনে নাকি থাকে এ উভয়প্রকার (অসংখ্য) প্রবৃত্তির তাড়না। দুই ধরণের প্রবৃত্তি মানব মনে আকর্ষণ-বিকর্ষণের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি তৈরী করে, যাতে একপ্রকার ভারসাম্যের মধ্য দিয়েই কাজটি ঘটে যায়। চিঠিতে ফ্রয়েড মনে করছেন, অধিকারবোধ থেকেই মানবের হিংসার উৎপত্তি। ভাবতে হবে, ফ্রয়েডের অধিকারবোধ আধ্যাত্মবাদীদের অহম বোধের/আমিত্ববোধেরই নামান্তর কি না— যে অহম/আমিত্বকে অনেকেই মানব ও মানব সমাজের প্রথম অসুখ বলে ধারণা করে থাকেন— যে আমিত্বকে অতিক্রম করার জন্য সাধুরা নিয়ত লড়ছে জিহাদে/যোগে/তন্ত্রে/তপস্যায়।…

ফ্রয়েডীয় সহজাত প্রবৃত্তি ধারণার সাথে কিছুটা/অনেকটা মিলে যেতে পারে, সুফীদের নফস্ ধারণার সাথে। সুফীরা যে ক’প্রকার নফস্/ জৈবিক প্রবৃত্তির কথা বলেন, সেগুলো কাম এবং প্রেম দু’ভাগে বিভক্ত, যা নানাভাবে মানুষকে প্ররোচিত করে প্রেমে-সংঘাতে। এখানে মনে রাখতে হবে যে, ফ্রয়েডীয় মনোবিদ্যায় প্রেম আর কাম একই জিনিস কিন্তু সুফীরা কামকেই হিংসার সমার্থক বলে জানেন।… অধিকারবোধ/আমিত্ববোধ/ব্যক্তিমালিকানাবোধ/ কামনাবাসনাবোধ… এসব ধারণা বিবেচনায় রাখলে স্বীকার করতেই হবে যে, ধ্বংস কিংবা সংঘাত প্রবণতা মানব অস্তিত্বের অনেক গভীরে অবস্থান করছে। আবার যা রয়েছে প্রকৃতির স্বভাবেও।…

মানব সভ্যতার ইতিহাস যেমন বিকাশের ইতিহাস তেমনি আবার বিনাশেরও। সভ্যতার ইতিহাসে সুন্দরের পাশাপাশি চলছে অসুন্দর/সংঘাত/বিধ্বংস। মানুষ এক হিসাবে বন্যদশা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে, আবার অন্য হিসাবে সভ্যদশায় পতিত হয়েছে। সময়ে/শীলনে/অবদমনে মানুষের হিংসাত্বক প্রবণতা কিছুটা রূপান্তরিত হলেও, আদতে তা ঠিকই বহাল থেকেছে।… একদিন মানুষ নিজের আমিত্ব/অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অথবা তা অন্যের ওপর জাহির করার জন্য সহজেই হত্যা ও রক্তপাত ঘটাতো। আর এখন বিনা রক্তপাতে তাই করে চলছে প্রযুক্তির মাধ্যমে, বিচিত্র হাতিয়ারের কলা কৌশলে। তাই বলে রক্তপাত থেমে আছে, তাও নয়।… এখানে হাত-ইয়ার> হাতের বন্ধু ধারণা প্রচলিত অস্ত্র অর্থের বাইরে হয়তো আরও আরও অর্থের ইঙ্গিত দিচ্ছে।…

প্রকৃতির স্বভাব কি মানুষ খণ্ডাতে পারে/…
প্রকৃতি নিজেই বিকশিত/ বিনাশের ধারাপাতে/ হিংসায়/…

চরণ কিংবা পঙক্তিদ্বয়ে প্রকৃতির স্বভাবকে কি অলঙ্ঘনীয় অখণ্ডনীয় বিকাশ ও বিনাশশীল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে?!

প্রকৃতির দিকে গভীর দৃষ্টি নিবিদ্ধ করা যাক, প্রকৃতির যে নিয়ত বিকাশশীলতা তা কি চলছে বিনাশের ধারাপাতের ওপর ভর করে?!… বিনাশের মধ্য দিয়েই ঘটে চলছে নব নব সৃষ্টির ধারাবাহিকতা। বিকাশ আর বিনাশই যেন দুই প্রান্তের প্লাস-মাইনাস হয়ে বজায় রাখে প্রকৃতির (স্ব)ক্রিয়তা।… এখানে দু’টি পঙ্ক্তি অথবা চরণই অসম্পূর্ণ এবং দুটির শেষেই ডট ডট(…) দিয়ে লুপ্ত পর্ব্ব নির্দেশ করা হয়েছে। তাই ভাবতে হবে দ্বিতীয় পঙ্ক্তি অথবা চরণের “হিংসায়” পর্ব্বটির পর লুপ্ত পর্বে কি অন্য কোন প্রবৃত্তি আসবে?… বনবালা/ইকোর প্রণালী শব্দবন্ধে ইকোসিস্টেমের পাশাপাশি শাক্ত/শক্তি/ইকোফেনিজিমের ইঙ্গিত মিলে কিনা!— খাদ্যশৃঙ্খলে যেমন খাদ্য খাদকের নিয়ত সংঘাতের মধ্য দিয়ে জীব-জগতের ভারসাম্য রক্ষিত হয় বলে আমরা মনে করি তেমনি মতাদর্শ/মতবাদ/ধর্ম্ম আক্রান্ত মানুষে মানুষে
সংঘাত সংঘর্ষে কি মানব সমাজেরও ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছে?!…
যেহেতু/
মানুষকে বধিতে পারে/ কেবল মানুষ/…
হিংসা/অধিকারবোধ যদি মানবের সহজাত প্রবৃত্তি হয়, আমিত্ববোধ যদি মানব অস্তিত্বের নিয়ামক হয়, সংঘাত-সংঘর্ষ যদি বিকাশের বাহন হয় তবে সেখানে প্রেমের মতো অনিন্দ্যবস্তুর কী ভূমিকা হতে পারে?!…

ফ্রয়েডের আনুষাঙ্গিক চিঠিটিতে তিনি একবারও স্বীকার করেননি, যুদ্ধ নিরসন সম্ভব— যদিও তিনি মানবের হিংসাত্বক আবেগগুলোকে প্রেমের দিকে পরিচালিত করার মধ্যে কিছুটা সম্ভাবনা দেখিয়েছেন।… আবার তিনি এ-ও জানতেন— প্রেমও অনেক সময় সংঘাতের প্রেরণা হতে পারে।… সুফীরা মুক্তির জন্য কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করতে বলেন। এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন সাহিত্যিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীও। কিন্তু তাও যেন সংঘাতের ফল থেকে নিজেকে নির্লোভ ও নিঃষ্কাম রেখে সংঘাতই করে যাওয়ার মতো।… যেখানে সংঘাত প্রবণতা অঙ্গাঙ্গি অস্তিত্বের সাথে, বিকাশের সাথে, তমঃগুণের সাথে সেখানে অহিংসার বাণী মায়াবী রোদন ছাড়া আর কী ই বা হতে পারে!? সংঘাততাড়িত এ বিশ্বে প্রেম যেন সারাদিন কর্ম্মব্যস্ততার পর কাজলা দীঘির জলের মতো অবকাশের মায়া মাত্র, তমঃ/তমসার আধারে আঁধারে জ্বলে ওঠা আলেয়ার আলো মাত্র!…

শিবের ত্রিশূলকে আমরা যেমন ওঁম শান্তিময় ধ্বনির প্রতীক বলে জানি তেমনি তা আবার জগতধারণ ও তোলপাড় করা রুদ্রদেবের নাচের মুদ্রা কি না!?… যুদ্ধগুরু দ্রোনাচার্য্য(ড্রোনাচার্য্য >ড্রোন+আচার্য্য?!)ও কি জেনেছিলেন, জগৎ সংসারের সংঘাতশীল বিকাশের মর্ম্ম?!…

বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী…
এ কথা আমরা অনেক আগে থেকেই জানি। কিন্তু এ কৃষিতান্ত্রিক জনপদে এমন বাণিজ্যবাদী বচন আসল কী ভাবে?! এ কি ইকোনোমিক্যাল আমিত্ববোধ/ব্যক্তিপুঁজির কারামতি?!…
যা ব্যাপ্তি পাচ্ছে, সমর শিল্পের মাঠে, বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মীময়!…

মুক্তক অক্ষর বৃত্তে রচিত কবিতাটি ভাবে ও সুরেলতায় বরাবরই প্রবাহমান। এতে বিরামে দাড়ি, কমা ও অন্যান্য চিহ্নের পরিবর্তে সর্ব্বত্রই বি+কল্প চিহ্ন(/) ব্যবহৃত হয়েছে; ও’গুলো আবার পর্ব্ব চিহ্নায়কের ভূমিকাও পালন করে। পুরো কবিতাটিকে একটি মাত্র চরণ ধরে পাঠ করলেও ভাব আর সুরের প্রবাহমানতা বজায় থাকে সর্ব্বদা। অপর দিকে অসম্পূর্ণ পঙ্ক্তিগুলোর শেষে ব্যবহৃত ডট ডট(…)গুলো চরণ নির্দ্দেশ করে আশ্চর্য্যজনক ভাবে।…

পুনরায় ভাবি, এ অস্ত্রবানিজ্যময় বিশ্বে সমর/সংঘাতও শিল্প কি না! ওহ্, এমন নির্ম্মম… আর ভাবা যাচ্ছে না! কিন্তু তবু ভাবতে হবে, সৃজনের এ নন্দনকানন কতোটা চালিত হয় হিংসায়!…

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য প্রবন্ধ, হিংসা পরম ধর্ম্ম : প্রকৃতির অস্তিত্বজাত তাড়নার স্বরূপ — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *