প্রবন্ধ যুক্তাঞ্চল : আঞ্চলিক সত্তার সমন্বয় ও অদ্বৈত বিশ্বের রূপরেখা

জানি;
মৃত্যু যেখানে মহিমাময়,
সেইখানে, তোমাকে ঠেকানো বড় দায়!
তবু বলি,
…এইসব মৃত্যুর মিছিলে
তুমি কী ধর্ম্ম করছ হে খ্যাপা? …
‘ধর্ মিতি মিতি’ রাগে
(ধারণ যোগ ম-এ
মনের ধরনে গাথা) ধর্ম্ম—
যে ভাবের রসে
মিলন বিরহে গাথা জীবনকলায়,
‘কর্ মিতি মিতি’ রাগে
(করণ যোগ ম-এ
মনের করণে গাথা) কর্ম্মে, তুমি যুক্ত কর হে বন্ধন!
(মুক্তমনা না, যুক্তমনা আমি!) মুক্ত কর ভয়, সন্মুখ সমরে ডাকে যুক্তাঞ্চল! …
মুক্ত বকুলেরা জানে,
যুক্ততায়
সুতোর গাঁথুনি, মালাবিনিময়! …
তেমনি,
আয় তবে হাতে হাত রাখি রাখীর বাঁধনে।
খ্যাপা,
ক্রিয়াশীলা নদীর মননে
জলের ঘূর্ণনে বাজে প্রতি-ক্রিয়াশীলতার গান? …
ভেসে যাওয়া
জনপদের কাহিনী জানে,
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামা অথৈ প্লাবন,
পিছনে রাখিয়া যায় পলিভাষা, নবতর ফসলী বিন্যাসে! …
শাশ্বতীর মনে,
বাদে ও বিবাদে আয় অবাধ সমুদ্রে,
ভেদ ও বিভেদে আয়
অভেদ সমুদ্রে! …
খ্যাপা,
তিনি সর্ব্বভূতে বিদ্যমান, ফানা! …

— যুক্তাঞ্চল || আরণ্যক টিটো

মানবের কাছে মৃত্যু এক রহস্যময় ধারণার/কল্পিত-অনুভূতির নাম। অবশ্যই মৃত্যু সম্পর্কিত সব জল্পনা-কল্পনা জীবিতেরই অনুমান। অধিকাংশ মানুষ মৃত্যু বিষয়ক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের চেয়ে ধর্ম্ম এবং অধিবিদ্যার ওপরই নির্ভর করে বেশী। মৃত্যুকালীন ও মৃত্যু পরবর্ত্তী সময় নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগা মানুষগুলোর অনেকেই মৃত্যুকে অতি ভয়ানক অবস্থা বলেই মানে। মৃত্যুভয় মানবের জন্য সবচেয়ে কঠিন ভয়। কেউ কেউ মৃত্যুকে অতি মহিমাময় অর্জ্জন বলেও মানে। … তাই মানব সমাজে অনেককে দেখা যায় মৃত্যুভয়ে নিজের অবস্থান ত্যাগ করে পালাতে। আবার অনেককে দেখা যায়, মৃত্যু জেনেও নিজের অবস্থানে অটল থাকতে কিংবা সামনে এগিয়ে যেতে। এমন লোকদের কাছে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করাই জীবনের চেয়ে বেশী মহিমাময় হয়ে ওঠে। এজন্যই ধর্ম্মের নামে, প্রেমের নামে, অধিকারের নামে মৃত্যুর মত অনিশ্চিতকে বরণ করতে স্বপ্রণোদিত হয় কেউ কেউ। অবশ্যই এর পিছনে জড়িত থাকে মানুষের মূল্যবোধ/ ঔচিত্যবোধ বিশ্বাস-আবেগ। …

আবহমান কাল ধরে মানব সমাজে ধর্ম্ম মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যবোধ ও মিলনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে তা যেমন ঠিক তেমনি নানান ধর্ম্ম ও ধর্ম্মীয় মতবাদ/মতাদর্শ মানুষে মানুষে তৈরি করেছে বিচিত্র ভিন্নতা সংঘাত-সংঘর্ষ, বিচ্ছিন্নতা। যে ধর্ম্মীয় আবেগ-অনুভূতি থেকে মানুষের সাথে মানুষের মহামিলনের প্রেরণা পাওয়ার কথা সেই ধর্ম্মীয় আবেগ-অনুভূতিই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা প্রসারে। তাই আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার পথ ধরে এগুতে হবে, আরেকবার ভাবতে হবে, ধর্ম্মের নামে সংঘাত, মৃত্যু, বিচ্ছিন্নতা ধর্ম্মের সাথে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ!? …

এবার তবে পাঠ করা যাক ‘যুক্তাঞ্চল’—

জানি;
মৃত্যু যেখানে মহিমাময়,
সেইখানে তোমাকে ঠেকানো বড় দায়!
তবু বলি
এইসব মৃত্যুর মিছিলে
তুমি কী ধর্ম্ম করছ খ্যাপা? …

পৃথিবীর প্রায় প্রধান ধর্ম্মগুলো বিভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত। এসব ধর্ম্মে আভ্যন্তরীণ কোন্দল যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অন্য ধর্ম্মের সাথে কোন্দল। ধর্ম্মের নামে ধর্ম্মানুসারীদের যে সব সংঘাতে আমরা জড়াতে দেখি সে সব সংঘাতের পিছনে ধর্ম্মীয় বিরোধ ছাড়াও আরও বিচিত্র কারণ জড়িত। অথবা এসব ধর্ম্মীয় সংঘাতে অন্য কোন স্বার্থের সংঘাত। কিন্তু এসব সংঘাতকে আমরা বরাবরই ধর্ম্মীয় সংঘাত হিসাবে বিবেচনা করে আসছি। ধর্ম্মের নামে বিশ্বে যে সব রক্তপাত হয়েছে/ হচ্ছে এসব ঘটনায় যাদের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় তাদের বহুমুখী আচরণের জন্য তাদের ধর্ম্ম বিশ্বাসকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। তাই ধর্ম্মীয় নেতার চাইতে ধর্ম্মভীতু বা ধর্ম্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের ধর্ম্মের প্রতি আনুগত্য অনেক সরল ও ধর্ম্মীয় আবেগপূর্ণ। অধিকাংশ ধর্ম্মীয় নেতা বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্টীর দালাল/এজেন্ট হিসাবে কাজ করে এবং তাদের আন্দোলন/যুদ্ধকে বিক্রি করে। অপর দিকে সাধারণ ধর্ম্মপ্রাণ মানুষ বুঝে না/বুঝতে চায় না। তারা ধর্ম্ম রক্ষার নামে ভিন্ন ধর্ম্ম বা ভিন্ন মতাদর্শীদের সাথে রক্তপাতে জড়ায়। আবার ধর্ম্মীয় নেতারা সাধারণ মানুষের সরল বিশ্বাসের কারণে খুব সহজে তাদেরকে প্ররোচিতও করতে পারে। ধর্ম্মের প্রতি সরল আবেগ ও আনুগত্যের কারণেই সাধারণ মানুষ ধর্ম্মের নামে শরীরে আত্মঘাতী বেল্ট বেঁধে মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করতে উদ্যত হয়। তাদের ধর্ম্মীয় বিশ্বাসে ধর্ম্মের জন্য মৃত্যু মহিমাময়। ধর্ম্মের জন্য যুদ্ধ করে নিহত হওয়া তাদের কাছে শহীদী মৃত্যু আর বেঁচে থাকা বীরত্বের স্বাক্ষর। যারা এরকম ধর্ম্মের জন্য আত্মঘাতী হওয়াকে মহিমাময় বলে জানে তাদেরকে মৃত্যুর পথ থেকে ঠেকানো/দমানো কি এতই সহজ?! …

আমরা অনেকেই বলি, ধর্ম্ম কোন যুদ্ধ বা জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। কিন্তু বাস্তবে অনেক ধর্ম্মপ্রাণ মানুষ ধর্ম্ম রক্ষার নামে যুদ্ধ বা জঙ্গিবাদে জড়ায়। এক্ষেত্রে তাদের যুদ্ধ ধর্ম্মযুদ্ধ/জিহাদ কিনা— প্রশ্ন হতে পারে। কারণ এসব যুদ্ধে ধর্ম্মের পাশাপাশি আরও অনেক মৌলিক কারণ থাকে। আবার এমন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ধর্ম্মপ্রাণ মানুষের যে ধর্ম্মীয় আবেগ থাকে না— তাও বলা যায় না। এসব যুদ্ধের পেছনে অন্যান্য কারণ থাকলেও ধর্ম্মপ্রাণ মানুষ ধর্ম্মীয় কারণকেই বড় করে দেখে। ফলে তারা মৃত্যুর মুখোমুখী হলেও লক্ষ্যে অবিচল থাকে আর সহজেই আত্মঘাতী হয়ে নিজের মৃত্যুর সাথে আরো অনেকের মৃত্যু ডেকে আনে। আমরা যাই বলি না কেন, এসব যুদ্ধে যে তাদের ধর্ম্মানুভূতির প্রেরণা থাকে তা কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। যারা ধর্ম্মের জন্য মৃত্যু মহিমাময় বলে মানে তাদেরকে মৃত্যুর পথ থেকে ঠেকানো বড় দায়! তবুও ভাবতে হবে, এইসব মৃত্যুর মিছিলে আদতে কী ধর্ম্ম পালিত হয়!? … খতিয়ে দেখতে হবে ধর্ম্ম প্রাণ মানুষের ধর্ম্ম বিশ্বাসের গতি-প্রকৃতি। কারণ ধর্ম্মের প্রতি তাদের যে দুরন্ত আবেগ তা যদি মৃত্যুপথের পরিবর্ত্তে জীব ও জীবনের সেবায় ব্যবহার করা যায় তবে বিশ্বে সম্প্রিতি রক্ষায় আমাদের বিরাট সফলতা আসতে পারে।

ধর্ম্মের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কথা আসলেই কেউ কেউ ধর্ম্মের শাব্দিক অর্থ ও ব্যুৎপত্তিগত অর্থকে অধিক গুরত্ব দিয়ে থাকেন। সেদিক থেকে ধর্ম্মের অর্থ দাঁড় করনো হয় ‘ধারণ করা’। ‘ধারণ করা’ কথাটাকে আরো খোলাসা করলে দাঁড়ায়, শক্তি, গুণ, বৈশিষ্ট্য … । …

একটি বস্তু যে বৈশিষ্ট্য, গুণ, শক্তি, সর্ব্বোপরি স্বভাব ধারণ করে তা-ই ঐ বস্তুর ধর্ম্ম। তাহলে মানুষের অন্তর্নিহিত স্বভাব, গুণ, শক্তিই কি ধর্ম্ম?! … স্বভাব, গুণ, শক্তি না বলে বৈশিষ্ট্য বললে ব্যাপারটি এখানে ক্লিয়ার হবে বেশী। তাহলে কি মানুষের স্বভাবই মানুষের ধর্ম্ম? … যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমাদের নৈতিকতাবোধ/ঔচিত্যবোধ/মূল্যবোধের ভিত্তিতে আমরা মানুষের যে দোষ-গুণ নির্দ্ধারণ করি তার সবই মানুষের ধর্ম্ম বলে বিবেচিত হবে!? কিন্তু তা কি আসলে সম্ভব?! …

ইবনে রুশদ ধর্ম্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ধর্ম্মের দু’টি অংশের কথা বলেন— একটি বাইরের অংশ আর অপরটি ভেতরের অংশ। ধর্ম্মের ভেতরের অংশ হচ্ছে বিশ্বাস আর বাহ্যিক অংশ হচ্ছে ধর্ম্মীয় রীতিনীতি। ইবনে রুশদের এ মত্ অবশ্যই সর্ব্বজনীন না-ও হতে পারে। কারণ অনেকেই ধর্ম্মীয় রীতিনীতি ও আচার সর্ব্বস্বকেই ধর্ম্ম বলে মানে। আবার ইবনে রুশদের বিশ্বাস সম্পর্কিত ধারণাটাও একবারে ফেলে দেবার বিষয় নয়। কারণ যে কোন ধর্ম্মে বিশ্বাসের ব্যাপারটাই আগে আসে। আর বিশ্বাস হচ্ছে মানুষের বিমূর্ত্ত বিষয়, যা মানসিক/চিন্তাজাত। বিশ্বাসের সাথে মানবের মনের অন্তরের আত্মার সম্পর্ক। তাই ধর্ম্ম কিছুতেই মেনে নেওয়ার বিষয় নয়, বরং তা মনে নেওয়ার বিষয়। …

‘ধর্ মিতি মিতি’ রাগে
(ধারণ যোগ ম-এ
মনের ধরণে গাথা) ধর্ম্ম—
যে ভাবের রসে
মিলন বিরহে গাথা জীবনকলায়,
‘কর্ মিতি মিতি’ রাগে
(করণ যোগ ম-এ
মনের করণে গাথা) কর্ম্মে, তুমি যুক্ত কর হে বন্ধন!

অনেকের কাছে চরণটি বিদঘুটে লাগতে পারে। কিন্তু ধর্ম্ম আর কর্ম্ম ধারণার একটু গোঁড়ার তথ্য জানা থাকলেই এখানে পাওয়া যেতে পারে ধর্ম্ম-কর্ম্ম জনিত ভারতীয় অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। … এখানে ধর্ম্ম আর কর্ম্ম শব্দ দু’টি লেখা হয়েছে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক বানানরীতি অনুসারে। তাই ব্যাপারটি খতিয়ে দেখার জন্য আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির শরাণাপন্ন হতে হবে। শ্রী কলিম খান ও শ্রী রবী চক্রবর্ত্তী সঙ্কলিত বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে ধর্ম্ম শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ দেখানো হয়েছে— ধর্ (ধৃ) মিতি(ম) মিত(ম) যাহাতে, অর্থাৎ ধর্ এর মিতি মিত যাহাতে, যে স্থানে, যে কর্ম্মে, যে আচরণে … সে সবকে ধর্ম্ম বলে। সেই হিসাবে সমাজকে (তদ্রুপ সমাজ রূপে) ধরে রাখে তার যে বিশেষ প্রকারের ক্রিয়াকলাপ, আাচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, তার সুনির্দ্দিষ্ট এলাকাকে সমাজের ধর্ম্ম বলে। মানুষকে (তদ্রুপ মানুষ রূপে) ধরে রাখে তার যে বিশেষ প্রকারের ক্রিয়াকলাপ তার সুনির্দ্দিষ্ট এলাকাকে মানুষের ধর্ম্ম বলে। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে ধর্ম্ম শব্দের অর্থ নিরুপণে অতীব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারকে। পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে ব্যাপারটা এরকম— মানবের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে সব অপরিহার্য্য আচারাদি প্রয়োজন সে সবই মানবের ধর্ম্ম। তাই জগতের অস্তিত্বধারী/অস্তিত্ব সম্পন্ন সবকিছুই ধার্ম্মিক/ধর্ম্ম-পরায়ন। …

আর অস্তিত্ব বা স্থিতি একই সিষ্টেমের/রীতির পুঃনপুন ব্যাবহারের মাধ্যমে যেমন বজায় রাখা সম্ভব হতে পারে তেমনি নিত্য নতুন সিষ্টেম/রীতি এপ্লাই করেও সম্ভব হতে পারে!?

ধর্ম্ম সম্পর্কিত এমন ধারণা আজকের ধর্ম্ম প্রাণ মানুষ মানবে কিনা তা বলা মুশকিল। কিন্তু বাস্তবে লোকসমাজেও কিছুটা এমন ধারণা/বিশ্বাস দেখা যায়— ধর্ম্ম আছে বলেই জগৎ টিকে আছে; যে দিন জগৎ থেকে ধর্ম্ম মুছে যাবে সে দিন জগৎ ধ্বংস হবে। এসব ধারণায় অবশ্যই জগতের অস্তিত্বের সাথে ধর্ম্মের সম্পর্ক স্বীকার করা হচ্ছে। … ধর্ম্ম যদি অস্তিত্ব রক্ষার অপরিহার্য্য কার্য্যাবলীই হয়ে থাকে তবে মানতে হবে, বস্তু বা মানবের অস্তিত্ববাদী ক্রিয়া-(প্রতি)ক্রিয়াও ধর্ম্ম। আবার ক্রিয়া-(প্রতি)ক্রিয়ার কথা আসলে সেখানে দোষ গুণের কথাও চলে আসবে। কারণ অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মানুষের এমন আচরণও প্রকাশ পেতে পারে, যা আমাদের সামাজিক ঔচিত্যবোধ ও মূল্যবোধের কাছে দোষ বলে বিবেচ্য। …

এখন ভাবতে আমাদের (প্র)চলিত ধর্ম্মসমূহে যেসব আচারাদি পালন করা হয় তা মানবের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে কতটা অপরিহার্য্য আর ধর্ম্মীয় কার্য্যাবলী মানবের জন্য কতটা জরুরী এবং মঙ্গলজনক!? … ধর্ম্মবিশ্বাসীরা তো নিজ নিজ ধর্ম্মীয় আচারগুলো মঙ্গলজনক বলেই মানে। …

জগতে প্রচারিত ধর্ম্মগুলোর আচারাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সমকালীন মানবের প্রয়োজনেই/অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই এসব আচারের (প্র)চলন করা হয়। আর জগৎ সর্ব্বদা পরিবর্ত্তনশীল; সে হিসাবে বিভিন্ন সময়ে মানবের জীবন ধারায়ও পরিবর্ত্তন এসেছে। ফলে প্রচলিত ধর্ম্মগুলোর আচারাদিতে যেমন পরিবর্ত্তন এসেছে নানা সময়ে তেমনি পুরাতন ধর্ম্মের পরিবর্ত্তে (প্র)বর্ত্তন হয়েছে নতুন ধর্ম্মের। আবার অনেক ধর্ম্মীয় আচার আদি রূপ থেকে বিচ্যুতও হয়েছে সময়ে সময়ে। …

উক্ত চরণটি ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি ছাড়া অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে … (ধারণ যোগ ম-এ)— (করণ যোগ ম-এ) … এসব ভাষ্যে ধর্ম্ম আর কর্ম্মের সাথে গভীর সম্পর্ক স্বীকার করা হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি, বিশ্বাসের দিক দিয়ে ধর্ম্মের সাথে মনের সম্পর্ক রয়েছে। কর্ম্ম হচ্ছে মানব মনের ইচ্ছারই (প্রতি)ফলন; সে হিসাবে কর্ম্মের সাথেও রয়েছে মনের সম্পর্ক। আবার চাইলে ‘ম’কে পঞ্চ ম ধরেও একপ্রকার ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যেহেতু ‘অমর কোষ’-এ ধর্ম্ম বলতে দেহসাধনকেই নির্দ্দেশ করা হয়েছে। তাই সেদিক থেকে ধর্ম্মের সাথে দেহ সাধনের অনেক তান্ত্রিক ব্যাপারও জড়িত থাকতে পারে। …

আমরা আগেই বলেছি, জগতের সকল মানবকে কল্যাণের/শান্তির পথে একই কাতারে আহ্বান করতেই ধর্ম্মগুলোর (প্র)বর্ত্তন হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যায়, ধর্ম্মকে ইস্যু করে মানুষ মানুষের সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে, মানুষ মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। জগতে একদিকে শান্তির বাণী নিয়ে নতুন ধর্ম্মের উদ্ভব হয়েছে অপর দিকে সে নতুন ধর্ম্মের অনুসারীদের সাথে সংঘাত হয়েছে পুরাতন ধর্ম্মের অনুসারীদের। আবার একই ধর্ম্ম বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের জন্ম দিয়েছে। এভাবে কখনো অঞ্চল ভেদে, কখনো আচারিক ভিন্নতায় আবার কখনো চিন্তাও বিশ্বাসের ভিন্নতায় একই ধর্ম্মেও প্রবল হয়েছে বিচ্ছিন্নতাবোধ। ফলে বার বার ব্যাহত হয়েছে ধর্ম্মের মৌলিক লক্ষ্য। …

এখন সকল মানবের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে, মানুষের কাছে মানুষের নিরাপত্তার তাগিদে, সর্ব্বোপরি সকল ধর্ম্মের মৌলিক উদ্দেশ্য রক্ষার তাগিদে মিলনবিরহে গাথা জীবনকলায় যুক্ত করতে হবে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন। …

(মুক্তমনা না, যুক্তমনা আমি!) মুক্ত কর ভয়, সন্মুখ সমরে ডাকে যুক্তাঞ্চল! …

যুগে যুগে মানবেরর মুক্তিকামী/মঙ্গলকামী ধর্ম্ম যেমন বিকৃত হয়ে মানব সমাজে সংঘাত ছড়িয়েছে তেমনি কেউ কেউ ধর্ম্মের সীমাবদ্ধতাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে যুক্তির অবলম্বনে মানবের কল্যাণ কামনায় হেঁটেছে মুক্তচিন্তার পথে। কিন্তু সেখানে অনেকের ফলাফল দাঁড়াল উল্টো। সমাজকে শান্তির পথে ডাকতে ডাকতে, ঐক্যের পথে ডাকতে ডাকতে মুক্তচিন্তকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সমাজ থেকে। এতে সমাজের পরিশোধনও হয় না, বিকল্প সমাজ নির্ম্মাণও হয় না। ফলে সমাজে আরও একটি নতুন সংঘাতের পথ প্রসারিত হয়। … কথকের স্বীকারোক্তি— মুক্তমনা নয় বরং সে যুক্তমনা। … এখন ‘যুক্তমনা’ আর ‘যুক্তাঞ্চল’ শব্দ দু’টি যাচাই করা দরকার। যুক্তমনা কি সেই মানুষ যে একই সাথে জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক?! অথবা যে জন নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সক্ষম আবার অন্যের অস্তিত্ব রক্ষায়ও সহায়ক?! অথবা হতে পারে যে জন নিজের চিন্তাকে সর্ব্বদা সমাজের ঐক্যের দিকে পরিচালিত করে?! … যুক্তাঞ্চল হতে পারে বিশ্বগ্রাম অথবা ব্যক্তিমালিকানাহীন বিশ্বসমাজ। আর সেই যুক্তাঞ্চল হবে একটি বকুলমালার মত যেখানে ধর্ম্মের সুঁতায় বাঁধা থাকবে একেকটি মুক্ত মানুষ।

ক্রিয়াশীলা নদীর মননে
জলের ঘূর্ণনে বাজে প্রতিক্রিয়াশীলতার গান?
ভেসে যাওয়া জনপদের কাহিনী জানে,
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামা অথই প্লাবন
পিছনে রাখিয়া যায় পলিভাষা, নবতর ফসলী বিন্যাসে!

ধর্ম্ম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা আগেই বস্তু ও মানবের ক্রিয়া-(প্রতি)ক্রিয়ার কথা বলেছি। পণ্ডিতরা বলেন, সাধারণ চোখে বস্তুর (প্রতি)ক্রিয়াকে অস্বাভাবিক ঠেকলেও প্রকৃতপক্ষে ক্রিয়ার মত (প্রতি)ক্রিয়াও বস্তুর অস্তিত্বজাত। তাই ক্রিয়াশীলা নদীর জলের ঘূর্ণনকে যেমন (প্রতি)ক্রিয়া বলে মনে হয় তেমনি মানবের ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন অনেক আচরণ পরিলক্ষিত হয় যেগুলোকে অস্বাভাবিক মনে হলেও তা মানবেরই অস্তিত্বজাত। … ঢাল বেয়ে নামা অথৈ প্লাবনকে ভয়াবহ মনে হলেও তাতে থাকে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা, থাকে পলিমাটির জরায়ু, ফসলী বিন্যাস।

শাশ্বতীর মনে,
বাদে ও বিবাদে আয় অবাধ সমুদ্রে,
ভেদ ও বিভেদে আয়
অভেদ সমুদ্রে! …
খ্যাপা,
তিনি সর্ব্বভূতে বিদ্যমান, ফানা! …

এখানে বাদে ও বিবাদে, ভেদে ও বিভেদে অবাধ-অভেদ সমুদ্রে আহ্বান করা হচ্ছে খ্যাপাকে। শাশ্বতীর মন বলতে হয়ত ক্রিয়া-(প্রতি)ক্রিয়াশীল জগৎপ্রকৃতির স্বভাবকে বুঝানো হয়েছে। অথবা ধরা যেতে পারে, শাশ্বতী স্বয়ং প্রকৃতি আর অবাধ সমুদ্র হচ্ছে জগৎসংসারের পরম/অদ্বৈত স্বত্তা। স্পষ্টতই এখানে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী ধারণাই প্রকাশ পাচ্ছে। সেই সাথে সুফিবাদের ফানাফিল্লা ধারণাও। এতে জগৎপ্রকৃতির বৈচিত্রতা/খণ্ড স্বত্তাকে যেমন স্বীকার করা হয়েছে তেমনি জগৎপ্রকৃতির পরম/অখণ্ড/অভেদ স্বত্তাকেও স্বীকার করা হয়েছে। … এখন আমাদের ভাবতে হবে, জগৎপ্রকৃতির বৈচিত্রতা অনুসারে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভূ-প্রকৃতি। আবার সে হিসাবে সে সব অঞ্চলের মানুষের রয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার ভিন্ন ভিন্ন প্রয়াস। … তাই মানুষের ধর্ম্মকর্ম্মে বৈচিত্রতা থাকবেই। তবুও সেই সব বৈচিত্রতা নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে, একটি অভেদ/যুক্তাঞ্চলের কথা যার মূল ভিত হবে মানবের অস্তিত্বজাত ধর্ম্ম। আর আমাদের বিশ্বাসে থাকবে আমাদের আবহমান সরল সহজিয়া দ্বৈতাদ্বৈতবাদী ও ফানাফিল্লা ধারণা। … তিনি সর্ব্বভূতে বিদ্যমান— এ কথার মধ্য দিয়ে এখানে সর্ব্বপ্রাণবাদী অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে এবং সাথে সাথে ধর্ম্মের ক্ষেত্রে/অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে সর্ব্বপ্রাণের/জগতের সকল প্রাণের মাঙ্গলিক আচার চর্চ্চার অভিমত প্রকাশ পেয়েছে।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, যুক্তাঞ্চল : আঞ্চলিক সত্তার সমন্বয় ও অদ্বৈত বিশ্বের রূপরেখা — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *