তাজমহল শুধুমাত্র একটা সৌধ নয়, বরং শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য এবং প্রযুক্তিবিদ্যার এক সম্মিলিত রূপ। তবে আজ শুধুমাত্র এটার প্রযুক্তিবিদ্যাগত অভিনবত্ব নিয়েই আলোচনা করব। আর একদিন আলোচনা করব এই স্থাপত্যের অন্তর্নিহিত দর্শন এবং সাহিত্যে এর আর্কিটাইপ এবং আর একদিন করব মুঘল আমলে শোষণ এবং মানুষের অবস্থা নিয়ে।
ভিত্তি ও নদী-প্রতিরোধী কাঠামো:
তাজমহলের ভিত্তিমূল নির্মাণে যমুনা নদীর তীরবর্তী ভূমির পলিমাটি শক্তিশালী করার জন্য একটা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছিল। এই প্লাবনপ্রবণ অঞ্চলে স্থিতিশীল কাঠামো নির্মাণে প্রযুক্তিবিদরা ২০ মিটার গভীর পাইলিং সিষ্টেম তৈরি করেন। শতাধিক গভীর কূপ খনন করে সেগুলো কাঠ, ইস্পাত এবং একটা বিশেষ ধরণের কংক্রিট দিয়ে পূর্ণ করা হয়, যা নির্মাণশৈলীতে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। এই পাইলগুলো মূলত প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে, যা নদীর পলিমাটিকে দৃঢ়ভাবে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে। মুঘল স্থাপত্যে এই ধরণের পাইলিং প্রক্রিয়া প্রথমবার ব্যবহৃত হয়, যা আধুনিক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্যপূর্ণ। ফলে নদীর জলের স্রোত, বন্যা এবং ভূমিকম্পজনিত চাপে সৌধটি সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে। এই প্রযুক্তিগত কৌশলটি সেই সময়ের জন্য অত্যন্ত উন্নত ছিল এবং এর ফলে তাজমহলের ভিত্তি আজো অক্ষত রয়েছে (Koch, 2006; Balasubramaniam, 2009)।
হাইড্রোলিক প্রযুক্তির বিস্ময়ঃ সিন্ধু সভ্যতা থেকে মুঘল যুগ:
সিন্ধু সভ্যতার (খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০–১৯০০) নগরগুলি যেমন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো উন্নত জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সেচ প্রযুক্তির জন্য বিখ্যাত। পাকা ইটের তৈরী নালা, কূপ এবং পয়ঃপ্রণালী আধুনিক নগর পরিকল্পনার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। এই ব্যবস্থাগুলি শুধুমাত্র বৃষ্টির জল সঞ্চয় করত না বরং শহরের বর্জ্য অপসারণের কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এমনকি, এই শহরগুলিতে প্রাকৃতিক গ্র্যাভিটির ব্যবহার করে জল চলাচলের সুচারু ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছিল, যা প্রাচীন প্রযুক্তির উৎকর্ষ প্রকাশ করে (Possehl, 1996)।
পরে মৌর্য ও গুপ্ত যুগে আরো উন্নত বাঁধ, জলাধার এবং খাল নির্মাণ করা হয়। এই প্রাচীন ভারতীয় প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকরী ছিল। এই সব প্রযুক্তি মুঘলদের জন্য একটা ভিত্তি তৈরি করেছিল; তবে, তারা নতুন প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে সেগুলিকে আরো উন্নত করে। মুঘলরা তাদের হাইড্রোলিক প্রযুক্তিতে বেশ কিছু অভিনব বৈশিষ্ট্য যোগ করেছিল। যেমন বাবরের শালিমার বাগ ও আকবরের ফতেহপুর সিক্রিতে সেচ ব্যবস্থায় গ্র্যাভিটি ফ্লো এবং পশু-চালিত পাম্পের ব্যবহার।
তাজমহল নির্মাণে মুঘল প্রযুক্তি আরো উন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এখানে জল উত্তোলনের জন্য পশু-চালিত পাম্প এবং আর্চযুক্ত অ্যাকোয়াডাক্ট ব্যবহার করা হয়। অ্যাকোয়াডাক্টের মাধ্যমে জল একটা বৃহৎ সংরক্ষণাগারে প্রবাহিত হত, যেখানে পশু-চালিত পাম্প জল উত্তোলন করত। ফোয়ারা সমানভাবে জল সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রতিটি ফোয়ারার নিচে তামার পাত্র স্থাপন করা হয়েছিল, যা জলচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ছিল। এই পদ্ধতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং পরিকল্পিত ছিল, যা আধুনিক জলচাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সূচনা বলে বিবেচিত হতে পারে (Begley,1979; Koch,2006)।
মুঘল উদ্ভাবনের প্রাসঙ্গিকতা ও আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সংযোগ:
মুঘল হাইড্রোলিক প্রযুক্তির একটা মূল বৈশিষ্ট্য ছিল জ়িরো-এনার্জি ভিত্তিক জলচাপ নিয়ন্ত্রণ। তামার পাত্র ব্যবহারের মাধ্যমে চাপ সমান রাখার প্রযুক্তি সেন্ট্রালাইজড ওয়াটার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের কাজ করত, যা আধুনিক সেন্ট্রালাইজড ওয়াটার ডিষ্ট্রিবিউশন সিষ্টেমের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের স্বয়ংক্রিয় ড্রিপ ইরিগেশন সিষ্টেমেও মুঘল উদ্ভাবনের ছাপ দেখা যায়। মুঘলদের এই প্রযুক্তি শুধু স্থাপত্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেনি, বরং জলচাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটা কার্যকর মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে (Balasubramaniam, 2009)।
তাজমহলের বাগান এবং জলসেচ ব্যবস্থা আজকের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির জন্য অনুকরণীয় মডেল। মুঘল উদ্ভাবনগুলি কেবল তাদের সময়কেই নয়, আধুনিক প্রযুক্তির মূলনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
গোল্ডেন রেশিও এবং ‘হাশত বেহেশত’: তাজমহল স্থাপত্যের জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য:
তাজমহলের স্থাপত্যে গোল্ডেন রেশিও (1:1.618) এবং ‘হাশত বেহেশত’ ধারণার সূক্ষ্ম প্রয়োগ এটিকে দৃষ্টিনন্দন ভারসাম্যের এক অনন্য নিদর্শন করে তুলেছে। গোল্ডেন রেশিও, যা প্রকৃতির নিখুঁত সমতার প্রতিনিধিত্ব করে, তাজমহলের প্রতিটি উপাদানে প্রতিফলিত হয়েছে। সৌধের উচ্চতা ও প্রস্থের অনুপাত থেকে শুরু করে প্রতিটি মিনার এবং গম্বুজের বিন্যাস— সবকিছুই এই অনুপাত মেনে তৈরি করা হয়েছে (Koch, 2006)। এটি শুধু স্থাপত্যের ভারসাম্যই নিশ্চিত করেনি বরং এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক শৈল্পিক প্রভাব তৈরি করেছে যা দর্শকদের মুগ্ধ করে।
‘হাশত বেহেশত’, অর্থাৎ “আটটি স্বর্গ” বা “আটটি কক্ষের বিন্যাস”, প্রাচীন ইসলামী স্থাপত্যের একটা পরিচিত নকশা। এটি একটা কেন্দ্রীয় অষ্টভুজ পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত, যেখানে আটটি কক্ষ একটা কেন্দ্রীয় গম্বুজাকৃতির প্রাঙ্গণের চারদিকে বিন্যস্ত থাকে। এই ধারণাটি তাজমহলে চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। মূল সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষটি, যেখানে মমতাজ মহল ও শাহজাহানের কবর রয়েছে, সেটি একটা অষ্টভুজাকার বিন্যাসে গড়া। চারদিকে ছোট ছোট কক্ষ, গম্বুজ এবং খিলানযুক্ত দরজা এই কেন্দ্রীয় অষ্টভুজকে ঘিরে একটা একক ও সম্মিলিত বিন্যাস তৈরি করেছে। এই বিন্যাসে জ্যামিতিক সামঞ্জস্যের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন ঘটেছে, যা মুঘল স্থাপত্যের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য (Begley, 1979)।
তাজমহলের চারবাগ উদ্যান এবং স্থাপত্য কাঠামোর বিন্যাসেও গোল্ডেন রেশিও এবং ‘হাশত বেহেশত’-এর প্রয়োগ দেখা যায়। চারটা প্রধান অংশে বিভক্ত চারবাগ পরিকল্পনা, কেন্দ্রীয় ফোয়ারা এবং পুলের অবস্থান এবং গম্বুজের উচ্চতা— সবকিছুই নির্ধারিত মাপ এবং অনুপাতের ভিত্তিতে নির্মিত। এটি শুধু নান্দনিকতাই বৃদ্ধি করেনি, বরং আধ্যাত্মিক স্বর্গের একটা প্রতীকী রূপ তৈরি করেছে, যা মুঘল সাম্রাজ্যের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাস প্রতিফলিত করে (Asher,1992)।
পিয়েত্রা দ্যুরার প্রযুক্তি এবং মুঘল স্থাপত্যে এর গুরুত্ব:
পিয়েত্রা দ্যুরা (Pietra Dura) হল একধরনের সূক্ষ্ম পাথর খোদাই ও ইনলে-এর কাজ, যেখানে বিভিন্ন রঙিন ও অর্ধ-মূল্যবান পাথরকে একত্রে স্থাপন করে চিত্র বা নকশা তৈরি করা হয়। এই প্রযুক্তির উদ্ভব ইতালিতে রেনেসাঁস যুগে, বিশেষত ফ্লোরেন্স শহরে। এই প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন পাথর, যেমন: ল্যাপিস লাজুলি, জ্যাসপার, কার্নেলিয়ান, টারকোয়েজ, মালাকাইট এবং অন্যান্য মূল্যবান পাথর ব্যবহার করে জ্যামিতিক নক্সা, ফুলেল মোটিফ এবং ক্যালিগ্রাফী তৈরির সূক্ষ্ম কাজ। মুঘল আমলে এই প্রযুক্তি ইউরোপীয় বণিক ও কারিগরদের মাধ্যমে ভারতে আসে। শাহজাহানের আমলে পিত্রা দ্যুরা তাজমহলের মত বৃহৎ স্থাপত্য প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়ে মুঘল স্থাপত্যের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে [(Koch, 2006)]। তাজমহলে পিত্রা দ্যুরার ব্যবহারে সাদা মার্বেল পাথরের পিঠে ২৮ রকম মূল্যবান পাথর খচিত করা হয়েছে।
প্রাচীন ভারতের স্থাপত্যের সাথে তুলনা:
প্রাচীন ভারতের স্থাপত্যকলা, যেমন চালুক্য আমলের মন্দির বা অজন্তা-ইলোরা গুহা, তাদের অনন্য পাথর খোদাই এবং স্থায়িত্বের জন্য বিখ্যাত। তবে, তাজমহল যেই ধরনের জটিল হাইড্রোলিক সিস্টেম, জ্যামিতিক বিন্যাস, এবং পিয়েত্রা দুরা, তাহা প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যে পাওয়া যায়নি। চালুক্য মন্দিরগুলি দৃঢ় নির্মাণশৈলীতে অগ্রগামী হলেও তাজমহলের নকশার সূক্ষ্মতা এবং প্রযুক্তিগত নতুনত্ব একে অনন্য করে তোলে [(Koch, 2006)]।
উগ্র মতবাদ এবং ইতিহাসের বিজ্ঞানসম্মত বিচার:
সাম্প্রতিককালে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাজমহলকে মুঘল আমলের নয় বরং প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য বলে দাবী করা শুরু করেছে। বলছে যে, এটা আসলে হিন্দু মন্দির এবং এর আসল নাম তেজো মহল। আবার সেই একিরকম হিন্দুত্ববাদী ফ্যানাটিক প্রাচীন ভারতীয় অ-মুসলিম স্থাপত্যকে তাজমহলকে মুসলিম স্থাপত্য ধরে নিয়ে সেটাকে নিকৃষ্টতর বলে দাবী করছে এবং কিছুতেই এটার প্রযুক্তিগত বিকাশকে স্বীকার করতে পারছে না। এগুলি মূলত ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা।
References:
Koch, E. (2006). The Complete Taj Mahal and the Riverfront Gardens of Agra. Thames & Hudson.
Allan, J. (1958). The Cambridge Shorter History of India. Cambridge University Press.
Asher, C. E. B. (1992). The Architecture of Mughal India. Cambridge University Press.
Balasubramaniam, R. (2009). New insights on the modular planning of the Taj Mahal. Current Science, 97(1), 42–49.
Begley, W. E. (1979). The Myth of the Taj Mahal and a New Theory of Its Symbolic Meaning. The Art Bulletin, 61(1), 7–37.
Bloom, J., & Blair, S. (1994). The Art and Architecture of Islam: 1250–1800. Yale University Press.
Kennedy, T. (2007). The Notion of Hierarchy in Taj Mahal. Archnet-IJAR, 1(1), 105–121.
Leoshko, J. (2002). The Moonlight Garden: New Discoveries at the Taj Mahal. Persimmon.
Petruccioli, A. (2006). Rethinking the Islamic Garden. Yale Bulletin, 103, 358–359.
Possehl, G. L. (1996). The Indus Age: The Beginnings.
Ruggles, D. F. (2011). Islamic Gardens and Landscapes. University of Pennsylvania Press.
পিণ্টু দাস রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, তাজমহল: প্রযুক্তিগত ও স্থাপত্যগত বিস্ময় — প্রমিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।