[কেন কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী তাঁহাদের উদ্ভাবিত শব্দার্থতত্ত্ব ও বানানবিধিকে ‘ক্রিয়াভিত্তিক-ধ্বনিভিত্তিক’ না বলে ‘ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক’ শব্দার্থতত্ত্ব ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক বানানবিধি’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং তাহার পিছনে তাঁহারা কী ধরণের যুক্তি-দর্শন-ভাষাবিজ্ঞান সম্বলিত ভাব-ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তাহা অনুধাবন করিতে এই ধ্বনি, বর্ণ প্রভৃতি সংজ্ঞার সঙ্গে পাঠকের সম্যক ধারণা ও পরিচিতি একান্ত আবশ্যক। — সম্পাদকীয়]
ধ্বনি—
‘ধারণ-অন্তস্থ-বাহক সক্রিয়ণ নাকরণ-অনকরণ যাহাতে’ অথবা, ‘যাহা কোন এক প্রকার ধারণা বা অর্থ বহনকারী আওয়াজ রূপে উচ্চারিত হৈতেছে’— [ ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক অভিধান বা ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ ও ‘সরল শব্দার্থকোষ’ ]।
ধ্বনি শব্দটির অভিধার্থ ধারণাবহনকারী আওয়াজকে বোঝায়। অর্থাৎ বাঙ্গালাভাষায় ধ্বনি হৈল এমন এক আওয়াজ-ধারী বা উচ্চারণবাহী একক সত্তা যাহা ধারণা (অর্থ) বহনের কাজে সক্রিয় রয়েছে।
সেইখানে ইংরেজী ভাষায় রয়েছে phoneme। সে হৈল উচ্চারণের এমন একক, যাহার কাঁধে কোন বোঝা নাই, কিন্তু আওয়াজের বোঝা রয়েছে।
তাহার মানে, বাঙ্গালাভাষার ধ্বনি যদি কাঁধে বোঝা নিয়ে চলা মুটে হয়, ইংরেজী ভাষার phoneme সেখানে মুটে মাত্র, যার কাঁধে অর্থের বোঝা নেই বলে মনে করা হয়।
আধুনিক ভাষাবিদগণৈ এই রকম অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত করে রেখেছেন। সুতরাং বাঙ্গালার ধ্বনি আর ইংরেজীর phoneme এক ব্যপার নয়।
বর্ণ (১) —
‘বর’করণ [ আবরণকারীকে সসম্মানে গ্রহণ করা ] চলমান যাহাতে; অথবা, ক্রিয়ার আধার রূপে স্বভাবত বরেণ্য যে; কিংবা শব্দ, সুর, রূপ (রং), সমাজ… প্রভৃতির প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্ম্মাধিকারে বিশেষ বিশেষ একক রূপে বরেণ্য যে; অথবা ধ্বনির উড়ন্ত মাদুর-স্বরূপ যে সত্তা বিশেষ ক্রিয়াকে ওপরে বসাইয়া লৈয়া উড়িয়া চলিয়াছে; কিংবা বিশেষ আবেগের উৎসারকে বিষয়ীকৃত করিয়া যে সুরের ধারা প্রবাহিত হৈয়া থাকে; অথবা যে রঙের কণা বিশেষ বোধের রূপকে বিষয়ীকৃত করিয়া আভাসিত হৈয়া থাকে; কিংবা যে মানবগোষ্ঠী সমাজদেহের বিশেষ কর্ম্মকে ধর্ম্মরূপে ধারণ করিয়া জীবনযাত্রা অতিবাহিত করিয়া থাকে। / ‘যাহার দ্বারা রঞ্জন সাধিত হয়’ — (ব শ)।
প্রতীকী অর্থসমূহ —
অক্ষর, শব্দাংশ, সপ্তসুর, সপ্তরং, ব্রাহ্মণাদি চতুর্ব্বর্ণ; বর্ণনা করা, বিবৃত করা, সবিস্তর বলা বা লেখা, রূপগুণ ব্যাখ্যা করা।
— [কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত ‘সরল শব্দার্থকোষ’ থেকে উদ্ধৃত]।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত ‘বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান’ গ্রন্থে ‘বর্ণ’ শব্দের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ —
বর্ণ-সংক্রান্ত ভাবনা — [বর্ণ = ‘ক্রিয়ার আধার রূপে স্বভাবত বরেণ্য যে’]।
বাঙ্গালাভাষায় রয়েছে ৪৩টি মাতৃকাবর্ণ। তাহাদের সুনির্দ্দিষ্ট বহুরৈখিক অর্থ আছে। সেই ৪৩টি বর্ণে গড়ে উঠেছে [দাশবংশ, ঘোষবংশ ইত্যাদির মত] ক-বংশ, খ-বংশ প্রভৃতি ৪৩টি শব্দবংশ। এইরূপ প্রত্যেকটী শব্দবংশ থেকে জাত হয়েছে অজস্র শব্দ-পরিবার; প্রত্যেকটী পরিবারের আবার রয়েছে দুইশত-পাঁচশত শব্দ-সদস্য। এইভাবে ৪৩টি শব্দবংশ থেকেই বংলাভাষার বিপুরল শব্দসম্ভার সৃষ্টির হয়েছে। মনে রাখা দরকার, শব্দ-পরিবারের শব্দ-সদস্যরা প্রত্যেকেই উচ্চারণ-বান ও অর্থবান এবং তাহাদের মধ্যে থেকেই অনেককে বাক্যের কর্ম্মী রূপে খাটার জন্য ডেকে কাজে লাগানো হয়। তক্ষণ তাহাদেরকেই পদ বলে।
ইংরেজী ভাষার Letter-এর সেই গৌরব নাই। অর্থ তো letter-দের নেই-ই, শুধুমাত্র ‘a’ আর ‘i’-এর অর্থ ছাড়া; আছে শুধুই উচ্চারিত হৈবার যোগ্যতা। ইংরেজীর সেই অর্থহীন উচ্চারণ-সম্বল letter-এর সংখ্যা মাত্র ২৬টি। ত-বর্গটী তাহার নাই বললেই চলে। তাছাড়া ইংরেজীর শব্দবংশ, শব্দ-পরিবার, শব্দ-সদস্য স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে অস্পষ্ট ভাবে থাকিলেও ইংরেজী ভাষাবিদগণ তাহাদের উদ্ধার করে একালীকরণ করিতে পারেননি আজো। সংস্কৃতকারগণের ও বৈয়াকরণিক প্রযুক্তির সহায়তায় এবং বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বাঙ্গালাভাষার বর্ণমালাকে এমন সুবিন্যস্ত করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যাহার সঙ্গে কেবল ‘মেণ্ডেলিয়েভ টেবল’-এরৈ তুলনা করা যায়।
আদিম বাঙ্গালাভাষায় (সংস্কৃতভাষায়) তক্ষণো পর্য্যন্ত ছ ঝ ঠ ঢ থ প্রভৃতি মাতৃকাবর্ণে বলতে গেলে হাতে গোনা কয়েকটী মাত্র শব্দ সৃষ্টি হয়েছিল; থ বর্ণে ত একটা শব্দও সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু বর্ণমালায় একেবারে অঙ্ক কষে প্রত্যেক শব্দবংশের জন্য যক্ষণ ঘর ছেড়ে রাখা হয় তক্ষণ ঐ ‘ছ’-প্রভৃতি বর্ণের জন্যেও ঘর ছেড়ে রেখে যাওয়া হয়। বাঙ্গালার প্রাচীন ভাষাবিদগণ জানিতেন, ঐ ঘরের শব্দগুলা জন্মাবে পরে। যেই কোন বাঙ্গালা অভিধান দেখিলেই বোঝা সম্ভব, ঐ বর্ণগুলিতে কী পরিমাণে কত নতুন নতুন শব্দ পরবর্ত্তিকালে জন্ম লাভ করেছে।
বাঙ্গালাভাষার উপরোক্ত ৪৩টা বর্ণেরেই আওয়াজ ও অর্থ দুইই আছে। কিন্তু মানবমনের গভীরে এক রহস্যময় প্রক্রিয়ায় ঐ আওয়াজ ও অর্থ প্রস্তুত হয় বলেই তাহাদের উদ্ধার করা কঠিন। এর কারণ হৈল, একক ধ্বনি বা বর্ণকে নিয়ে মানবমনের গভীরে যেই অর্থময় ধ্বনির বিবর্ত্তন [meaningful-phonemic evolution] চলে, ওপরিতলে মানবের মুখের উচ্চারিত ভাষায় তাহাকে প্রকাশ করা সহজ কাজ নয়। যেমন ‘চালক’ ‘পালক’ প্রভৃতি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ক’ বর্ণের অর্থটী খুবৈ স্পষ্ট ও প্রকট। অনেকে জানেন ঐ ‘ক’-এর অর্থ হৈল ‘করে যে’। কিন্তু বর্ণমালার অধিকাংশ বর্ণের বাহিত অর্থ অত স্পষ্ট ও প্রকট নয়; কাহারো কাহারো অর্থ অস্পষ্ট, কাহারো-বা খুবই অস্পষ্ট ও রহস্যময়। সেই রকম বর্ণগুলির (ধ্বনিগুলির) অর্থ অনুভব করা গেলেও ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। দুই খণ্ডে ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ ও ‘সরল শব্দার্থকোষ’ রচনার মাধ্যমে আমরা দুইজন তাহা সাধ্যমত করে দিয়েছি।
তা সেই যাই হোক, আজ আমরা নিঃসন্দেহ যে, ‘অ’ থেকে ‘হ’ পর্য্যন্ত বর্ণমালার প্রত্যেকটি বর্ণের অর্থ আছে; সেজন্যেই তাহাদের নিয়ে গড়ে ওঠা শব্দের-ও অর্থ আছে এবং সেই অর্থের প্রচলন-ও আছে। শুধুমাত্র তাহাই নয়, তাহার ঐতিহাসিক সত্যতা যেমন রয়েছে, তেমনি নিত্যতাও বর্ত্তমান রয়েছে। নিত্যতা আছে বলেই বাঙ্গালা মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষেরা আজো আওয়াজ ও অর্থবান নব নব শব্দ সৃষ্টি করে চলেছেন। ‘টপকা ঝোল’, ‘পুঁচকে ঝলক’, ‘পাগলু’ প্রভৃতি তাহার টাটকা উদাহরণ।
ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে সেই নব নব শব্দগুলিকে সংস্কার করে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল, আমাদের পূর্ব্বসূরিগণ আমাদের শব্দসম্ভার নিয়ে যেই কাজ করে রেখে গিয়েছিলেন, নানান কারণে যাহার ওপর শ্যাওলা জমে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল, সেইগুলিকেও উদ্ধার করা ও একালীকরণ করা। আমাদের দুজনের লেখা শব্দার্থগুলিতে আমরা তাহা সাধ্যমত করেছি। একেবারে নিখুঁতভাবে ও সম্পূর্ণভাবে করে ফেলেছি, এমন দাবী আমরা করি না। শব্দতত্ত্ববিদগণ অনেকে মিলে হাত লাগালে তবেই কাজটি সম্পূর্ণ ও নিখুঁত হৈতে পারে।
এক্ষণ তাহলে বাঙ্গালাভবাষার মাতৃকাবর্ণগুলির অর্থ যেইরূপ পাওয়া গেছে, সেইগুলি উপস্থাপন করা দরকার। কেননা, বানান সংস্কার করার জন্য ঐ অর্থগুলি লাগিবে। নিম্নে বানান ও spelling-এর তুলনামূলক আলোচনা করে তাহার পরেই আমরা সেই অর্থ সরবরাহ করে তাহার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করিব। …
— [কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত ‘বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত]।
‘বানান’ —
‘শব্দ বানাকরণ বা নির্ম্মাণ চলমান যাহাতে’; অথবা, ‘নিয়মানুসারে বর্ণের সহিত বর্ণ যোগ করিয়া শব্দ বানানো বা নির্ম্মাণকরণ চলমান যাহতে’।
বাঙ্গালায় যাকে বানান বলা হয়, ইংরেজীতে তাহাকে spelling বলা হয়ে থাকে। বাঙ্গালায় ‘বানান’ মানে হৈল, যে এক বা একাধিক বর্ণের ইঁট দিয়ে একটা শব্দ বানানো হয়, সেই ইঁটগুলির কথা বলা। ইংরেজীতে spelling মানে হৈল, শব্দ ভাঙ্গিলে যেই বর্ণের ইঁট বা ইঁটগুলি পাওয়া যায়, যেন সেই ইঁটগুলির কথা বলা।
একৈ কথা হলেও বাঙ্গালায় বলা হয় শব্দ গড়িতে কী কী লাগিতেছে তাহার কথা; পক্ষান্তরে, ভাঙ্গিলে কী কী পাওয়া যাবে, ইংরেজীতে তাহার কথা বলা হচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গিটাই আলাদা। তাহার ওপর, ইংরেজীতে শব্দের spelling রূপে যাহা পাওয়া যায়, তাহার উচ্চারণ আছে, অর্থ নাই। বিপরীতে, বাঙ্গালায় বানান রূপে যাহা পাওয়া যায়, তাহার উচ্চারণ আছে, অর্থও আছে।
পুরানোপন্থী বাঙ্গালা ভাষাবিদগণ মনে করেন, বানান শব্দটী প্রাচীন বাঙ্গালার সংস্কার-কৃত (সংস্কৃত) রূপের ‘বর্ণন শব্দ থেকে বিবর্ত্তিত হয়ে একালের বাঙ্গালায় এসেছে। অতএব, সেইটি লিখিতে হবে ‘বাণান’ বানানে। নব্যপন্থীরা এর বিরোধী। তাঁহারা ‘বানান’ বানানেই স্বস্তি বোধ করেন। এবং সেরকমই লিখে থাকেন।
অথচ তাঁহাদের হাতে ‘বানান’-এর পক্ষে বলার মত তেমন কোন যুক্তি নেই। আমরা দুজন কিন্তু বুঝেছি, ‘বানান’ কথাটিকে ‘ণ’ দিয়ে লেখা ঠিক নয়। কারণ, বর্ণন শব্দটী যেই অর্থ ধারণ করে, ‘বাণান’ শব্দটি সেই অর্থ ধারণ করে না। তাহার অর্থ হৈল চলমান বাণ বা শর। বিপরীতে বানান শব্দটি ‘বর্ণন’ শব্দের উদ্দিষ্টকে গড়ে তোলার দিক থেকে সিদ্ধ করে।
বাঙ্গালার বন, বনা, বানা, বনিবনা, বানিয়ে তোলা, বানানো প্রভৃতি শব্দ যে নিয়মে সৃজিত হয়েছে, ‘বানান’ শব্দটী সেই নিয়মেই সৃজিত হয়েছে। ‘যাহা দ্বারা শব্দকে বানিয়ে তোলা বা বানানো হয়’ তাকেই বানান বলে। এতএব, এইরকম বানানই যুক্তিযুক্ত।
— [কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত ‘বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত]।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত পুনঃপঠন, ‘ধ্বনি’, ‘বর্ণ’ ও ‘বানান’ শব্দগুলির ‘ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক’ অর্থব্যাখ্যা — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।