পয়ার শব্দটা সম্পর্কে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রায় হচ্ছে ‘সংস্কৃত বাংলা এবং প্রাকৃত বাংলা’র মধ্যে পয়ার প্রাকৃত বাংলার ছন্দ।’ কিন্তু তিনি শব্দটার মূল এড়িয়ে গেছেন। অন্তত অনেকের মত তিনিও শব্দটার মূল সংস্কৃত দেখানোর চেষ্টা করেননি। অথচ বাংলা শব্দের মূল সংস্কৃত দেখানোর বাতিক এক্ষণো শেষ হয়নি। আর এই বাতিকের শিকার হয়েছে ফারসী থেকে আসা পয়ার শব্দটাও। তাই শব্দটার মূল নিয়ে ধন্দ এক্ষণো শেষ হয়নি।
শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের ‘সংসদ বাংলা অভিধানে’ শব্দটা রয়েছে। এতে পয়ার শব্দের মানে হিসেবে লেখা রয়েছে চতুর্দ্দশাক্ষর ছন্দ। শৈলেন্দ বিশ্বাসের মতে, বিশেষ্যবাচক এই শব্দটা সংস্কৃতজ। এসেছে সংস্কৃত ‘পদকার’ থেকে। অথচ পদকার মৌলিক শব্দ নয়। সংস্কৃত-ও নয়। ফারসী পদ আর কার শব্দ মিলে ‘পদকার’ তৈয়ার হয়েছে। আর এই পদকার থেকেই বাঙ্গালায় ‘পয়ার’ এসেছে।
ফারসী পদ শব্দের মূল ‘পা’, যার অর্থ ‘চরণ’। জীব-জানোয়ার পা থেকে শুরু করে অফিস আদালতের পদ, এমনকি কবিতার পংক্তিও (পদ বা চরণ) হৈতে পারে। অন্যদিকে ফারসী ‘কার’ মানে কাজ, শ্রম, চাকরী। আবার কবিতা রচনাও একটা কাজ। তাই পদকার শব্দটাও সংস্কৃত নয়। ফারসীর পাশাপাশি বাঙ্গালাতে ‘পদকার’ অর্থ কবি। অর্থাৎ যিনি কবিতার চরণ বা পদ রচনা করেন।
অন্যদিকে বাংলা একাডেমির ব্যাবহারিক ‘বাংলা অভিধান’ও একই পথে হেঁটেছে। এতে বলা হয়েছে সংস্কৃত ‘পদ’ আর ‘চার’ শব্দের মিলনে পয়ার হয়েছে। অথচ ফারসী ‘চাহার’ থেকে চার হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রাচীন পুঁথীতে ১০ম শতাব্দীর আগে পয়ার ছন্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় না। অভিধানে পয়ার শব্দের অর্থে কবিতার পদ বা চরণ-ই বলা হয়েছে (বালকবয়সে একদিন সেই চোদ্দ অক্ষর মিলিয়ে ছেলেমানুষি পয়ার রচনা ক’রে নিজের কৃতিত্বে বিস্মিত হয়েছিলুম– বাংলাভাষা পরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
পয়ার হচ্ছে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ৮/৬ মাত্রার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটা শ্রেণী-বিভাগ। এ’টা মধ্যযুগীয় বাঙ্গালা কাব্যের প্রধান ছন্দ-রীতিও বটে। দুইটা চরণের মাধ্যমে একটা পয়ার তৈয়ার হয়। আর প্রতিটা চরণে দুইটা পর্ব্ব থাকে। প্রথম পর্ব্বে মাত্রা সংখ্যা থাকে আট এবং দ্বিতীয় পর্ব্বেও মাত্রা সংখ্যা হয় ছয় অর্থাৎ ৮ + ৬ হৈবে। অক্ষরবৃত্তে ৪ + ৪ + ৪ + ২ ছন্দকেও ৮ + ৬ হিসেবে বাঁধা যায়। কিন্তু চরণের জন্যে সেই ছন্দকে পয়ার থেকে আলাদা করে।
পয়ারে চরণদুইটা পরস্পর মিত্রাক্ষর হৈবে অর্থাৎ চরণের শেষে অন্ত্যানুপ্রাস শব্দালঙ্কার থাকবে। প্রতি চরণের শেষে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি ঘটে। অন্যদিকে মহাপয়ারেও দুইটা চরণ এবং প্রতিটা চরণে দুইটা পর্ব্ব থাকে। প্রথম পর্ব্বে মাত্রা সংখ্যা থাকে আট এবং দ্বিতীয় পর্ব্বের মাত্রা সংখ্যা হয় দশ হৈবে অর্থাৎ ৮ + ১০ হৈবে। অক্ষরবৃত্তে ৪ + ৪ + ৪ + ৪ + ২ ছন্দকেও ৮ + ১০ হিসেবে বাঁধা যায়। কিন্তু চরণের জন্যে সেই ছন্দকে মহাপয়ার থেকে আলাদা করে। মহাপয়ারেও চরণদুইটা পরস্পর মিত্রাক্ষর হৈবে অর্থাৎ চরণের শেষে অন্ত্যানুপ্রাস শব্দালঙ্কার থাকবে। এখানেও প্রতি চরণের শেষে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি ঘটে।
এছাড়া যে পয়ার বা মহাপয়ারে প্রতি চরণের শেষে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি হওয়া অনিবার্য্য নয়, ভাব প্রয়োজন মত চরণ থেকে চরাণান্তরে প্রবহমাণ হৈতে পারে। একে তাহাকে প্রবহমাণ পয়ার ও মহাপয়ার বলে। এদের কেউ কেউ সমিল অমিত্রাক্ষরও বলেন। …
জিয়াউদ্দিন সাইমুম রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত হিজিবিজি, ‘পয়ার’ শব্দের মূল সংস্কৃত নয়, ফারসী — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।