সমসাময়িক বাঙ্গালা বানান কী কঠিন, কী কঠিন! অথবা, বাঙ্গালা বানান কি সত্যিই জটিল!

সম্প্রতি এক বাঙ্গরেজ কলেজছাত্রীর সাথে কথা হচ্ছিল— উফ্! বাঙ্গালাটা কী কঠিন ভাষা। হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ঈ, কোথায় যে কোন্টা বসবে বোঝাই যায় না। আরে, উচ্চারণ তো সেই একই— /i/। তাহলে এত জটিলতা কেন। এইজন্যই বাঙলা ভাষা দিয়ে হবার কিছু নয়। মোবাইলেও সেই জন্যই নাকি বাঙলা হরফে লেখাও ঝকমারি। তার চেয়ে ইংরাজীতে লেখা কত্ত সহজ। যেমন উচ্চারণ, তেমনই লেখ। কোন ঝামেলা নেই।

কী আর বলব। শুনলাম, কিছু বললাম না। কারণ বলে কোন লাভ নেই। যে শুনতে চায় না, তাকে বলে কী লাভ। প্রতিটি ভাষাতেই জটিলতা থাকে। মানে ভাষার নিয়ম না বুঝলে তাকে জটিলতাই মনে হয়। বুঝলে মনে হয় না; কি/কী, ভারি/ভারী— তখন খামখেয়ালী মনে হয় না, তার অর্থ ও কারণ পরিষ্কার বোঝা যায়। এটা শুধু বাঙ্গালা ভাষায় নয়, সব ভাষাতেই— জার্মান, ফরাসি কি স্পেনীয় ভাষাতেও। উচ্চারণ ও বানানের মধ্যে সব ভাষাতেই একটা সাযুজ্য আছে, একটি রুট শব্দ থেকে সেই নিয়ম মেনেই তৈরী হয় একের পর এক প্রায়োগিক শব্দ, প্রয়োগ অনুযায়ী যার অর্থ বিভিন্ন হয়।

উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঙ্গালা থেকে দিলে বাঙরেজরা তো নাক কুঁচকোবেন, তাই আপাতত অন্য ভাষা থেকেই দিই। জার্মান থেকে। hängen (হেঙেন, ঝুলানো) শব্দ থেকে একের পর এক শব্দ এসেছে— Anhänge, অর্থাৎ যা ঝুলিয়ে রাখা হয়, তা নেকলেস হতে পারে, আবার ই-মেল-এর ক্ষেত্রে অ্যাটাচমেন্ট-এর ক্ষেত্রেও তা ব্যবহার করা হয়; আবার Abhänge, যা নীচের দিকে ঝুলে থাকে, Hügel মানে hill’এর সাথে যুক্ত হলে তার মানে দাঁড়ায় পাহাড়ের ঢাল, আবার abhängen von মানে যা থেকে ঝুলে থাকা যায়, মানে যার উপর নির্ভর করা যায়। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই।

এবার ইংরেজীর দিকে তাকানো যাক। সেখানে ঐ ‘ই’ শব্দটি লিখতে কী বানান লেখা হয়?— ‘i’ (pit, ভারি সোজা বিষয়, কিন্তু কোন girl’এর সাথে flirt করার সময় বিষয়টা একটু জটিল হয়ে যায়), ‘ie’ (field, যদিও friend-এর ক্ষেত্রে আবার সে নিয়ম খাটে না), ‘ea’ (eat, meat, seat, কিন্তু creation !), ‘ee’ (see, bee), ‘ei’ (receive, কিন্তু neighbour’এর ক্ষেত্রে আবার এক্ষেত্রেও প্রতিবেশিসুলভ অন্য সৌজন্য প্রদর্শন করা দরকার) ‘e’ (reopen, যদিও এই বর্ণটি নাকি ‘এ’ উচ্চারণের জন্য preserved)। আরও আছে— ‘oe’, ‘ae’. এক ‘ই’ উচ্চারণ করতে এত্রকম বানান— কিন্তু বাঙরেজদের একটুও অসুবিধে হয় না, কিন্তু ‘নিশীথ’ বানানে কেন একটাই ‘ই’ repeat হল না, বাঙ্গালা ভাষার জটিলতা ও দুর্ব্বলতার তার থেকে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে।

অবশ্য আমরা, যারা ওঁদের মত বাঙরেজ নই, বাঙ্গালার পাশাপাশি ইংরেজীটাও ওঁদের মত না হলেও একটু আধটু জানি— তারা বুঝি, ওখানেও বাস্তবে সব নিয়ম-কানুন ঘেঁটে ঘ’র অবস্থা নয়। ওখানেও there is a method in madness. ইংরেজরা যখন যেখান থেকে যে শব্দ আত্মস্থ করেছে, তার বানান, এমনকি উচ্চারণ সমেতই করেছে। তাই ‘en fin’ ইংরেজরাও ব্যবহার করে, কিন্তু মূল ফরাসী উচ্চারণকে অনুসরণ করে তাকে ‘অঁ ফ্যাঁ’ই উচ্চারণ করে, বাঙরেজদের মত ‘এন ফিন’ নয়। ইংরেজী বানানের এই নিয়মের জটিলতা পুরোপুরি কেটে যায় শব্দগুলির ব্যুৎপত্তি অনুসরণ করে মূল ভাষায় গিয়ে তার নিয়মকে একটু জানার চেষ্টা করলেই। schedule কেন শিডিউল, স্কেজিউল নয় (আমরা এখানে ইংরেজদের উচ্চারণই অনুসরণ করি, মার্কিনদের নয়), light’এ ঐ অনাবশ্যক ‘gh’টা কেন, indictment’এ ঐ ‘c’টা কোত্থেকে এল— সবটাই তখন বোঝা যায়।

তা এতটা জটিল নিয়মও যদি বোঝা অসুবিধে না হয়, বাঙ্গালার তুলনামূলক সহজ নিয়মগুলো বুঝতে এত অনাগ্রহ কেন? আমাদের নিজের ভাষাটা মনে হয় না ইংরেজীর মত অতটা জটিল, একটু ঢুকলেই সেটা বোধহয় বোঝা যায়।

 

 

 

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, বাঙ্গালা বানান কী কঠিন, কী কঠিন! অথবা, বাঙ্গালা বানান কি সত্যিই জটিল! — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *