হাসান আজিজুল হকের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথের “আগুনের পরশমণি” গানের মধ্য দিয়ে উৎযাপনের সমালোচনা হচ্ছে ইসলামী মহল থেকে। সেকুলাররা রবীন্দ্রনাথকে মনোপোলাইজ করার কারণে ইসলামিস্টরা রবীন্দ্রনাথকে শত্রুতার কাতারে দেখে। এই প্রতিক্রিয়া দিয়া রবীন্দ্রনাথকে বোঝা মুশকিল। আর সেকুলাররা যদি মৃতদেহ সৎকারকে সেকুলারাইজ করে তাতে আপত্তি কেন? তারা কি ট্রাডিশনাল ইসলামব্যাখ্যা এখতেয়ার করে? মৃতদেহ সৎকারে কেন তাদের ট্রাডিশনাল ইসলামী পদ্ধতি অকাট্টভাবে পালন করতে হবে?
‘‘আগুনের পরশমণি’’ গানের মধ্য দিয়ে শেষকৃত্য উৎযাপনে কেউকেউ “কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি”র অনুরণন দেখছেন। ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা একটা প্লুরালিস্টিক বা বহুত্ববাদী সমাজে বাস করি। এমনকি ইসলাম নিজেও বহুত্ববাদী ধারায় চর্চ্চিত হয় এখানে। কোন গুষ্টি যদি কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি উৎযাপন করে তাতে আপত্তি কেন? ইসলামের নামেও এখানে আরব-সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা আছে বিভিন্ন তরফ থেকে।
“হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি” এই পরিভাষায় আমি জাতি ঘৃণা টের পাই। এই ঘৃণার একটা ঐতিহাসিক কারণ আছে বটে কিন্তু ঘৃণার রাজনীতি দিয়ে ইসলামের বিকাশ ও পরিগঠন হয় না। নিম্মবর্ণ থেকে ধর্ম্মান্তরিত হওয়া মুসলমানরা উচ্চবর্ণের হিন্দু কর্ত্তৃক নিগৃহীত হওয়ার যে ঐতিহাসিক কারণ ছিল তার প্রেক্ষিতে যে ঘৃণার জন্ম হয়েছিল মুসলমানদের মধ্যে, তারই অভিপ্রকাশ হল সমস্ত হিন্দু চিহ্ন বর্জ্জন করা। ফলে যা কিছু হিন্দুয়ানী তা নাজায়েজ এমন একটা ইসলামী সুরতে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ হাজির হয়েছিল যার ধারাবাহিকতা চলছে এখনো।
এই সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতায় নবী মুহাম্মদ (স.)-এর সাংস্কৃতিক আত্তিকরণের সুন্নাহ রক্ষিত হয় না। ইসলামের আবির্ভাবে আরবের মিশ্র ইহুদী ও পেগান সংস্কৃতি আত্তিকরন হয়েছিল একত্ববাদ, ন্যায়বিচার ও শ্লীলতার মানদন্ডে। হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি মাত্রই পরিত্যায্য এমন বয়ান রাসূলের সংস্কৃতি আত্তিকরন সুন্নাহার সাথে সাংঘর্ষিক। রাসূলের সুন্নাহ অনুসরণ করেই সুফীদের প্রচারিত ইসলাম বহু লোকজ হিন্দু উপাদান গ্রহণ করেছিল।
কেউকেউ শেষকৃত্য উৎযাপনের এই ধারাকে প্রকাশ্য ইসলামবিকৃতি হিসেবে দেখছেন। তারা পারলে বলপ্রয়োগ দিয়ে বন্ধ করতে চান এমন চর্চ্চা। যদিও ইনহাউজ প্রোগ্রামে অনাপত্তি দিচ্ছেন অনেকে। তাদের অভিযোগ কেন প্রকাশ্যে “আগুনের পরশমনি” গান দিয়ে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা হবে। এই দাবীতে বলপ্রয়োগের আকাঙ্খা স্পষ্ট। বলপ্রয়োগ দিয়ে ইসলাম কায়েম করা যায় না। কোন্টা ইসলাম বিকৃতি, কোন্টা না সেটা যারযার ইসলাম বোঝাপড়া দিয়েই ঠিক হয়। বরং একটা বহুত্ববাদী সমাজে যার যার বোঝাপড়া ও চর্চ্চাকে যতবেশী বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা দিয়ে হাজির করা হয়, তার বয়ানই টিকে থাকে।
‘‘আগুনের পরশমণি’’ গানটী কতটা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্য এই বিষয়ে বলতে হলে রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্ম্ম নিয়ে কিছু বলতে হয়। ব্রাহ্ম ধর্ম্ম যেহেতু একত্ববাদী, তাতে ইব্রাহিমী ঐতিহ্যের ধর্ম্ম সমূহের প্রভাব আছে। আগুন যে কোন ধাতুকে পুড়িয়ে বিশুদ্ধ করে। জুরাথ্রাস্তীয় ধর্ম্মে আগুন তাই পবিত্রতার প্রতীক। ইসলামে যে দোযখ ধারনা আছে তাকে শাস্তিমূলক বিবেচনার বাইরে রুহ্কে তার মালিকের কাছে পৌঁছানের আগে বিশুদ্ধকরন ব্যবস্থা হিসেবেও দেখার ঐতিহ্যে আছে। ইকবালের কোন এক লেখায় এমন মত পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই গভীর আধ্যাত্ম দ্যোতনাময়। এসব গানে ব্যবহৃত শব্দের উৎস আরবী, ফারসী না হওয়াতে গানগুলো ইসলামী সঙ্গীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কিন্তু একজন আধ্যাত্মসম্পন্ন মানুষের আত্মিক তৃষ্ণা মেটাতে রবীন্দ্রনাথের গান দারুন উপযোগী হতে পারে। যেমন, তোমার অসীমে; আজি যত তারা তব আকাশে; মাঝে মাঝে তব দেখা পাই; আমি কান পেতে রই। রবীন্দ্রনাথ থেকে কতটুকু নিবেন যদি এটা আপনার ইসলাম বিবেচনা হয়, তো অবশ্যই রাসূলের সাংস্কৃতিক আত্তিকরন সুন্নাহ প্রয়োগ করেই করবেন।
মোকাররম হোসাইন রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, হাসান আজিজুল হকের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান ও রবীন্দ্রনাথের “আগুনের পরশমণি” — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।