লিমন ভাই, ‘যাওয়ার’ লিখব, না ‘যাবার’ লিখব?
— যাওয়ার আর যাবার; জওয়াব না জবাব, কী হবে? তুই কি জানিস তুই কীসে হাত দিলি, নীলা?
: ওমা আমি আবার করলাম?
— কী করছিস মানে! ওলট-পালট করে দিয়েছিস।
: কী? তোমার মন?
— এহ্, আমার মন! মনই নেই আমার।
: সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
— না রে! তুই অনেক বড়ো একটি বিষয়ে হাত দিয়ে ফেলেছিস।
: কী করলাম বাবা, বুঝিয়ে বলবে তো। নজরুলের একটি গান তো আছে জানি, “আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়।”
— রবীন্দ্রনাথেরও আছে, “আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে… ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে পিছু ডাকে পিছু ডাকে…।”
: তো?
— আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবি তো, নীলা?
: শুনব।
— পরপর দুটি স্বরধ্বনি পাশাপাশি থাকলে উচ্চারণের সুবিধার জন্য তাদের মাঝখানে অন্য কোনো ধ্বনি আনার প্রয়োজন হয়। তবে একটু কথা আছে, স্বরধ্বনি দুটো মিলে একটি সংযুক্ত স্বরধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়ে একটি দ্বি-স্বর বা যৌগিক স্বর হওয়া যাবে না। যেমন: আ + ই = আই (যাই = য্ + আ + ই, ভাই = ভ্ + আ + ই), এ + ই = এই (সেই = স্ + এ + ই, নেই = ন্ + এ + ই)। এমন যৌগিক স্বর আছে পঁচিশটি। এর বাইরে হলেই আমি উপরের কথাটি বলছি।
: যেমন? —
— যেমন, যা + আ উচ্চারণ করতে অসুবিধা হয়। ফলে, তা হয়ে দাঁড়ায় ‘যাওয়া’। য্ + আ + আ = যাওয়া। অর্থাৎ দুটো ‘আ’-ধ্বনির মধ্যে একটি ‘ওয়’ (W)-ধ্বনির আবির্ভাব ঘটে।— তুই একবার উচ্চারণ করে দেখ, নীলা।
: আচ্ছা করি, যা + আ; ঠিক তো লিমন ভাই, যাআ দ্রুত উচ্চারণ পারা যায় না। মাঝখানে ‘ওয়’-ধ্বনি এসে পড়ে। হয়ে যায় যাওয়া।
— এবার তুই ‘ওয়’ উচ্চারণের সময় উপরের ঠোঁট আর নিচের ঠোঁটের আচরণ দেখ। করে দেখ।
: করলাম।
— ‘ওয়’— দ্রুত উচ্চারণের সময় খেয়াল করিস। নিচের ঠোঁট উপরের ঠোঁটের প্রান্তে স্পর্শ লেগে এক প্রকার ব-ধ্বনির সৃষ্টি করে। একেই বলে শ্রুতিধ্বনি। যেহেতু এখানে ব-ধ্বনির সৃষ্টি করে, তাই এই শ্রুতিধ্বনির নাম দেওয়া হয়েছে অন্তঃস্থ ব শ্রুতি। — তুই যাওয়া দ্রুত দশবার উচ্চারণ করতে গিয়ে কানে শুনতে পাবি ‘যাবা’ বলছিস।
: ঠিকই তো বলেছ লিমন ভাই। যাওয়া হয়ে যাচ্ছে যাবা। আশ্চর্য তো।
— আশ্চর্যের কিছু নেই। ধ্বনিবিজ্ঞানীরা অনেক আগেই এসব খেয়াল করেছেন, গবেষণা করেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন।
: হায়, লিমন ভাই আমরা সাধারণ মানুষেরা সারা জনম কথা বলেই গেলাম। কখনও এসব চিন্তা করি না।
— করার দরকার নেই তো। এজন্যই তো আমরা সাধারণ মানুষ।
: দাঁড়াও দাঁড়াও লিমন ভাই। এমন শব্দ তো আরও অনেক আছে। যেমন, দেওয়া > দেবার, হওয়ার > হবার, জওয়াব > জবাব, নওয়াব > নবাব।
— বাহ্, নীলা। তুই তো পুরো ধরে ফেলেছিস। পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি দ্রুত উচ্চারণ করার সময় জিহ্বা এক ধ্বনি থেকে অন্য ধ্বনিতে যাওয়ার সময় একটি অযাচিত ধ্বনি উচ্চারণ করে ফেলে। এগুলো অনেক সময় শব্দে লেখা হয় না, তবে উচ্চারণে চলে আসে। উচ্চারণটি প্রধান হলে মাঝে মাঝে বানানেও লেখা হয়।
দেখ, শো + আ > শোআ > শোয়া > শোবা (শোবার ঘর)। তবে নীলা, তোকে এবার প্রশ্ন করব, বল এটা কোন ‘ব’।
: কোন ‘ব’ মানে?
— দুটো ‘ব’ আছে না? একটি হল প বর্গের ‘ব’। প ফ ব ভ ম। আরেকটি হল অন্তঃস্থ ব। য র ল ব। এর মধ্যে এটি কোন ‘ব’।
: বুঝতে পেরেছি লিমন ভাই। একটি হল বর্গীয় ব আরেকটি অন্তঃস্থ ব। প বর্গ (প ফ ব ভ ম)-এর মধ্যে হলে বর্গীয় ব বলে, আর অন্যটি অন্তঃস্থ বর্ণ ( য র ল ব)-এর মধ্যে হলে অন্তঃস্থ ব।
— হ্যাঁ নীলা। অন্তঃস্থ শব্দের অর্থ অভ্যন্তরস্থ বা মধ্যবর্তী। স্পর্শবর্ণ ও উষ্মবর্ণের মাঝে থাকে বলে য র ল ব-কে অন্তঃস্থ বর্ণ বলে?
: এই তো আরেক সমস্যা, লিমন ভাই, স্পর্শ বর্ণ আর উষ্ম বর্ণ আরেকবার বলো তো।
— সাধারণভাবে বুঝে নে। ক থেকে ম বর্ণ পর্যন্ত বলে স্পর্শ বর্ণ। আর শ, ষ, স, হ উচ্চারণ করার সময় অনেকক্ষণ ধরে শ্বাস ধরে প্রলম্বিত উচ্চারণ করা যায়। উষ্ম মানে শ্বাস। তাই শ, ষ, স, হ এরা উষ্ম বর্ণ।
তাহলে ক থেকে ম বর্ণ বা স্পর্শ বর্ণসমূহ এবং শ ষ স হ উষ্ম বর্ণসমূহের মাঝে থাকে অন্তঃস্থ য র ল ব।
: আচ্ছা।
— এখন দ্যাখ য, র, ল, ব উচ্চারণ করার সময় মুখ সম্পূর্ণ খোলাও যেমন থাকে না, তেমনি বাতাস একেবারে আটকেও যায় না। এ কারণে ধ্বনি বিচারে এগুলো পুরোপুরি স্বরধ্বনিও নয়, আবার ব্যঞ্জনধনিও নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে অন্তস্থ ‘য’ ও অন্তঃস্থ ‘ব’ দুটি অর্ধ্বস্বর / Semivowel, প্রথমটি অয় বা ইয় এবং দ্বিতীয়টি অব বা উ+অ/ওয় (w)-র মতো। যেমন : নেওয়া, হওয়া ইত্যাদি। এসব কারণেই এদের নাম অন্তঃস্থ ধ্বনি।
: বুঝতে পেরেছি, লিমন ভাই। তুমি আমাকে এখন বলো, হিন্দিতে বলে শেওয়াগ, আমরা বলি শেবাগ, ওরা বলে সুনীল গাওস্কর, আমরা বলি সুনীল গাভাস্কার। ওরা বলে হরিদুয়ার, আমরা বলি হরিদ্বার, ওরা বলে ভগওয়ান, আমরা বলি ভগবান, কেন?
— তুই তো একদম আসল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছিস, নীলা। সংস্কৃতে অন্তঃস্থ ব-এর উচ্চারণ ‘ওয়’ (W) রক্ষিত হয়। সংস্কৃত ও হিন্দি লেখা হয় দেবনাগরি হরফে। হিন্দিতে এমনকি অসমীয়া ভাষাতেও অন্তঃস্থ ব উচ্চারণের জন্য আলাদা বর্ণ আছে। কিন্তু বাংলাতে নেই।
: বাংলায় তবে?
— বাংলায় বর্গীয় ব ও অন্তঃস্থ ব-এর একই চেহারা। উচ্চারণেও মোটামুটি কাছে চলে এসেছে। এরমধ্যে আরেকটি ভুল করা হয়েছে আমার মতে, দুটির চেহারা একই হওয়াতে বাংলা বর্ণমালা থেকে এখন অন্তঃস্থ ব তুলে দেওয়া হয়েছে।
এই কিছুদিন আগেও বাংলায় চল্লিশটি ব্যঞ্জণবর্ণ ছিল, অন্তঃস্থ ব বাদ দেওয়াতে এখন হয়েছে উনচল্লিশটি।
: বাংলায় বর্গীয় ব আর অন্তঃস্থ ব দেখতে একই বলে তুলে দিতে হবে?
— হিন্দি লেখা হয় দেবনাগরী লিপিতে; সংস্কৃতও তা-ই।
অন্তস্থ ব— হিন্দি সমকক্ষ হল “व” (w),
এবং প বর্গীয় ব — হিন্দি সমকক্ষ পেটকাটা “ब” (b)।
এখন বাংলা লিপিতে আগে অন্তঃস্থ ব-এর জন্য বর্ণ ছিল, পরে পরিবর্তিত হয়ে অন্তস্থ ব এর চেহারা হয়ে গেল বর্গীয় ব-এর মতো। এতে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে ও বুঝতে পারল না কোনটা বর্গীয় “ब ” (b), আর কোনটা অন্তঃস্থ “व” (W)। বর্তমানে বাংলায় ব দিয়ে সব কিছুর উচ্চারণ b করা হয়। হিন্দিতে অন্তঃস্থ ব দুভাবে উচ্চারিত হয়, এক ওয়া (W), যেমন বিশ্বাস = বিসঅয়াস bis-was, আবার উচ্চারণ ভি (V) হয়। বিরাট = ভিরাট (Virat), Vivek/Vidya ইত্যাদি। অন্তস্থ ব এর উর্দু সমকক্ষ হল— و
: কিছু শব্দ দিয়ে উদাহরণ দাও তো লিমন ভাই।
— অন্তস্থ ব-এর উচ্চারণ হল উ+অ বা ‘ওয়’-এর মতো। বাংলায় একটা শব্দ আছে ওয়াকিবহাল। ওয়াকিবহাল হিন্দিতে লিখলে হবে, “वाकिफ-ए-हाल” অর্থাৎ বাকিফ-এ-হাল। এখন বাকিফ-এর উচ্চারণ ওয়াকিফ অর্থাৎ অবগত এবং হাল মানে পরিস্থিতি অর্থাৎ পরিস্থিতির ব্যাপারে অবগত। “বাংলা”লেখা হয় “बंगला” আর যখন “স্বদেশ” লেখা হয় সংস্কৃত অনুসারে তা “स्वदेश” অর্থাৎ “সোয়াদেশ”।
: বাংলায় অন্তঃস্থ ব বর্ণ বাদ দেওয়া ঠিক হল, লিমন ভাই?
— হুম কী আর করা যাবে বল। ভাষার পণ্ডিতদের কাজ।
: যেসব শব্দে ব-ফলা আছে সেসব অন্তঃস্থ ব না, যেমন স্বামী, স্বজন, উজ্জ্বল? তবে যে বললে অন্তঃস্থ ব উঠে গেছে, লিমন ভাই।
— এই তো রহস্য ধরে ফেলেছিস। অন্তঃস্থ ব বর্ণটিকে বাংলা বর্ণমালা থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভূত যেমন আড়ালে থাকে, তেমনি ব-ফলা যুক্ত শব্দে ও আরও কিছু শব্দে অন্তঃস্থ ব ঠিকই ভূতের মতোই বহাল আছে।
যেমন: স্বামী শব্দটিতে যে ব আছে সেটি অন্তঃস্থ ব, বর্তমান বাংলায় এর উচ্চারণ শামি হলেও প্রকৃত উচ্চারণ হল সোয়ামি। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তরবারি— এর প্রকৃত উচ্চারণ তরওয়ারি।
: সন্ধিতেও অন্তঃস্থ ব আছে মনে হয়।
— হ্যাঁ আছে। কিছু সংস্কৃত সন্ধির স্বরূপ আমরা দেখি। তুই জানিস, সু + আগত— স্বাগত। বাংলায় এর উচ্চারণ শাগোতো হলেও সংস্কৃতে ও হিন্দিতে এর উচ্চারণ সুয়াগত।
আরও ধর, অনু + অয় = অন্বয়; বাংলা উচ্চারণ অন্নয়; সংস্কৃত উচ্চারণ অনুঅয়। তেমনি: গো + আদি = গবাদি; বাংলা উচ্চারণ গবাদি, সংস্কৃত উচ্চারণ গোয়াদি। লো + অন = লবণ; বাংলায় উচ্চারণ লবোন্, সংস্কৃতে উচ্চারণ লোয়ন। পো+ ইত্র = পবিত্র; বাংলায় উচ্চারণ পবিত্র, সংস্কৃত উচ্চারণ পোয়িত্র।
হিন্দিতে অন্তস্থ ব এর উচ্চারণ ওয়া এর মত (সংস্কৃতেও উচ্চারণ ওয়া)। তবে তারা ওয়া ও ব (বর্গীয় ব) দুই রকমই উচ্চারণ করে। যেমন: আওয়ারা > আবারা, কাবলিওয়ালা > কাবলিবালা, বাপাস্ দো > ওয়াপাস দো, আওয়াজ > আবাজ, ঘারওয়ালো > ঘারবালো। হিন্দির মত সবক্ষেত্রে না হলেও, বাংলা ভাষায় কখনো কখনো এমনটি দেখা যায়। যেমন: জওয়াব > জবাব, নওয়াব > নবাব।
: আচ্ছা লিমন ভাই, অসমিয়া ভাষায় বর্গীয় ব আর অন্তঃস্থ ব-এর বর্ণ দেখতে কেমন?
— অসমিয়া ভাষায় অন্তঃস্থ ব-এর প্রতীক হচ্ছে ৱ, আর তাদের বর্গীয় ব-এর প্রতীক আমাদের বাংলার মতোই ‘ব’। তোর জানলে ভালো লাগবে অসমিয়া বর্ণমালা আর আমাদের বাংলা বর্ণমালা একই।
: পুরোপুরি একই?
— শুধু দুটি বর্ণের চেহারা ভিন্ন। একটি হচ্ছে অন্তঃস্থ ব যেটি একটু আগেই বলেছি, আর একটি হচ্ছে আমাদের বাংলা ‘র’ অসমিয়া বর্ণমালায় আছে ‘ৰ’ হয়ে। আর সব বর্ণই বাংলা বর্ণের মতো।
অসমিয়া ভাষায় ভগবান উচ্চারণ হয় ভগওয়ান। লেখা হয়, ‘ভগৱান’।
: বাহ। আমাদের বাংলায়ও অন্তঃস্থ ব এমন মানে ৱ হলে ভালো হত।
— এর চেয়ে ভালো হত একটু গলা ভেজাতে পারলে। তা সে সৌভাগ্য কী হবে!
: কবে না হয়েছে শুনি। তুমি না একটা নাফরমান, লিমন ভাই … চায়ের সাথে কী খাবে, বলো?
অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির
মোরশেদ হাসান রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, অন্তঃস্থ ব শ্রুতি — লেখক নির্দ্ধারিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।