যখন থেকে মানুষের সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের গোড়াপত্তন তখন থেকে আজ অবধী বেশ কয়েকধরণের সমাজব্যাবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। তার মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা একটী। আর একথা প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা হল মানুষের সমাজ ও সভ্যতা স্থাপনের সময়কার প্রথম ও আদি সমাজব্যাবস্থা। একথার পক্ষে যুক্তি পাওয়া যায় লুইস মরগানের লেখা বই “Ancient Society”-তে। আর ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস সহ সাম্প্রতিক সময়ের বিবর্ত্তনবাদী জীববিজ্ঞানী, জীনতত্ত্ববিদ ও এন্থ্রপোলজিস্টগন বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সভ্যতার আদিকালে সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল। এ সমাজব্যাবস্থার প্রথম বৈশিষ্ট্য হল এখানকার সমাজ ও পরিবারের কর্ত্তৃত্ব ও ক্ষমতা নারীর হাতে ন্যস্ত থাকে। অতীতে ও বর্ত্তমানেও জনজীবনে এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা প্রচলন ছিল ও আছে। দক্ষিণ আমেরিকায় গিটক্সান, পশ্চিম সুমাত্রা ও ইন্দোনেশিয়ার মিনানকাবাও, মেঘালয়ের গারো, খাসিয়া ও জয়ন্তীয়া, চীনের মোসুও, স্পেন এবং ফ্রান্সের বাস্কুইস, পশ্চিম আফ্রিকার আকান, আশান্তি এবং তুয়ারেগ, দক্ষিণ পূর্ব্ব এশিয়ার চাম সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশের গারো ও খাসিয়া সহ পৃথিবীর আরও বেশকিছু জাতিগোষ্ঠী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা বিরাজমান।
বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে এখন পর্য্যন্ত গারো ও খাসিয়াদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ও পরিবারব্যাবস্থা চালু আছে। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট আদিবাসী সংখ্যা ১৫,৪৮,১৪১। এর মধ্যে খাসিয়াদের সংখ্যা ২৯০০০-এর মত। শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার সহ সুনামগঞ্জের বেশ কিছু জায়গায় খাসিয়াদের বসবাস। এছাড়াও ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক খাসিয়া বাস করে। শান্তিকামী খাসিয়া সম্প্রদায় সাধারণত বিভিন্ন টিলার পাদদেশে বাস করেন। খাসিয়াদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। তাদের যেকোন সামাজিক ও পারিবারিক সিদ্ধান্তে নারীরা এক বড়সড় রকমের প্রভাব রাখেন। এমনকি বিয়েতেও নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। খাসিয়া সমাজে বিয়ের পর বর কনের বাড়ীতে গিয়ে ওঠেন এবং সেখানেই বাস করতে থাকেন। এখানে সম্পত্তির উত্তরাধিকারও মাতৃসূত্র অনুসারে পরবর্ত্তী নারী উত্তরাধিকারীর ওপর বর্ত্তায়। খাসিয়া সমাজে কন্যাসন্তান বিশেষভাবে কাম্য, যা বাকী পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চিত্রগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত। খাসিয়া সমাজে মাতৃতান্ত্রিক নিয়ম অনুসারে ছেলেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না, কোন সম্পত্তির ভাগ পায় না। কন্যাদের মধ্যে সর্ব্বকনিষ্ঠ মেয়েই সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। কোন দম্পতীর যদি কন্যাসন্তান না থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে একটী মেয়েকে দত্তক নেওয়া হয়, এবং পরবর্ত্তীতে তার ওপরই সম্পত্তি অর্পিত হয়। খাসিয়া নারীরা শারীরিকভাবে খুবই কর্ম্মঠ ও পরিশ্রমী, নারীরা ঘরে বাইরে সমানতালে কাজ করেন। এছাড়াও সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ হিসেবে আলাদা খ্যাতি আছে খাসিয়াদের। খাসিয়াদের একেকটী গ্রাম ও এলাকাকে ‘পুঞ্জি’ বলা হয়। পান ও সুপারী খাসিয়াদের প্রিয় এবং প্রধান উল্লেখযোগ্য অর্থকরী ফসল। তাদের পুঞ্জিগুলোতে গেলে বিস্তৃত পরিসরের পানের বরজগুলো চোখে পড়ে। বলতে গেলে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের আদি পানচাষী মূলত খাসিয়ারাই।
খাসিয়াদের মত আরেক মাতৃতান্ত্রিক আদিবাসিগোষ্ঠীর নাম গারো। গারোদের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাস করে ভারতের মেঘালয় ও আসামে। এছাড়াও বাংলাদেশের গারো পাহাড়ের পাদদেশে, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে গারোদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বসবাস রয়েছে। আর মৌলভীবাজার জেলার চা বাগান পাশ্ববর্ত্তী এলাকাগুলোতেও কিছুসংখ্যক গারো বাস করে। খাসিয়াদের মত গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজেও সম্পত্তিসহ সকল সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীই মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও নারী, পুরুষ নয়। এখানেও বিয়ের পর নবদম্পতী কনের মায়ের বাড়ীতেই বাস করেন। তবে ইদানিংকালে আধুনিকতার প্রভাবে কিছু সংখ্যক গারো দম্পতী বিয়ের পর বরের বাড়ীতে বাস করছে। পরিবারের ছোট মেয়েকে গারো ভাষায় ‘নোকনা’ বলা হয়। ‘নোকনা’ই তার সম্পত্তিধারী মায়ের পরবর্ত্তী উত্তরাধিকারী। আর বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা ও ভরণপোষণের দায়িত্বও ‘নোকনা’র। গারোরা আগে জুমচাষ করলেও ১৯৫০ সালের পর থেকে সরকারী নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্ত্তমানে হালের চাষাবাদ প্রক্রিয়া চালু আছে। গারো ও খাসিয়ারাও এখন শিক্ষা ও ব্যবসা বাণিজ্যে বেশ এগিয়েছে।
বাংলাদেশের গারো ও খাসিয়া আদিবাসী ছাড়াও পার্শ্ববর্ত্তী দেশ ভারত ও পৃথিবীর অন্যান্য মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় চালিত হওয়া সমাজ ও জনগোষ্ঠীগুলো নিজেদের একেকটী অনন্য ভাবমূর্ত্তি ও বিশেষত্ব ধরে রেখেছে, বিশেষ করে যখন পুরো পৃথিবীর এক বৃহৎ অংশ পিতৃতান্ত্রিকতার দখলে। হয়ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থার বিপরীত মেরুতে অবস্থানই এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোর অনন্যতার অন্যতম কারণ।
আজকের পিতৃতন্ত্রের করায়ত্ত সমাজগুলোর সাথে মাতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোর এক স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মাতৃতান্ত্রিক গারো ও খাসিয়া সমাজে ও পরিবারগুলোতে মেয়েদের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকাররের ওপর বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে, যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় বিরল এবং এর আশাও যেখানে দুরাশা। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় নারীরা পুরুষদের সাথে সমানতালে শিক্ষা ও জীবিকা নির্ব্বাহের সুযোগ পায়। বিভিন্ন চাকরিক্ষেত্রে এমনকি ব্যবসা বানিজ্যেও এই সমাজের নারীরা অনেক আগে থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত্ত অংশগ্রহণ করে আসছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোর মত কোন সামাজিক বাঁধাধরা বা কটাক্ষ এখানে সাধারণত থাকে না। নারীকে ছোট করে বা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখার মত পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিকৃত মনমানসিকতার ব্যপারটা এখানে নেই বললেই চলে। আমি দেখেছি, এই সমাজব্যাবস্থার নারীরা তাদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে পারে। যৌতুকের মত অমানবিক ও নীচ প্রথাগুলো এখানে অনুপস্থিত। গারো ও খাসিয়াদের বিয়েতে বর বা কনে কাউকেই যৌতুক দিতে হয় না, বলতে গেলে কোন প্রকারের কোন লেনদেনই হয় না। অথচ বাকী পিতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যৌতুক দাবী, যৌতুকের জের ধরে নারীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এমনকি খুন হয়ে যাওয়ার মত নিকৃষ্ট ঘটনাগুলো আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও বর্ত্তমান। ধর্ষণের মত বর্ব্বরোচিত অপরাধ যখন আজ প্রায় সর্ব্বত্র জেঁকে বসেছে, সেখানে মাতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা খুজে পাওয়াও কষ্টসাধ্য। অবশ্য বাংলাদেশের বাকী আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো যেগুলো মাতৃতান্ত্রিক নয় সেগুলোতেও ধর্ষণের মত অপরাধ ঘটে না বললেই চলে। আমার মনে আছে, একবার এক ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ সভায় চট্টগ্রামের একজন তরুন আদিবাসী ছাত্রনেতা বক্তৃতাকালে বলেছিলেন যে, উনাদের মাতৃভাষায় ধর্ষন বলে কোন শব্দ বা প্রতিশব্দও নেই।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থার সুফলগুলো পিতৃতন্ত্রের মধ্যে থাকা অসংখ্য খামতি, অসমতা ও বৈষম্যগুলোকে চোখ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নারীকে জৈবিক ভাবে দূর্ব্বল ও দায়িত্বগ্রহনে অনুপযুক্ত ভেবে নারীকে অবদমিত করার যে প্রক্রিয়ায় পিতৃতন্ত্র বিশ্বাসী মাতৃতন্ত্র সেই বিশ্বাসটাকে অনেক আগেই ভুল প্রমাণিত করেছে। নারীও সুযোগ পেলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে, প্রয়োজনে কঠিন কর্ত্তৃত্বও কায়েম করতে পারে তার জলন্ত উদাহরন মাতৃতন্ত্র। ইতিহাসের পাতায়ও নারীর সাহসিকতা, শক্তি ও ক্ষমতার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। কৃষ্ণসাগর উপকূল ও দক্ষিণ এশিয়ার নারী যোদ্ধা-জাতি ‘অ্যামাজন’ এবং দুর্দ্দান্ত রোমান নারী যোদ্ধা-জাতি ‘সাইটন’ এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এই নারী-যোদ্ধারা শক্তি, সাহস ও মেধায় অতুলনীয় ছিলেন বলে জানা যায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় আজ নারীর দূর্ব্বলতার কারণ তাদের সহস্র বছরের কাজের ধরণ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন পদ্ধতি। নারীকে পুরুষদের তুলনায় কম খেতে দিয়ে, দৌড়াতে না দিয়ে, বাইরের ভারী পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে না দিয়ে, ঘরে আবদ্ধ করে পিতৃতন্ত্র নারীর এই জড়দশা ঘটিয়েছে। এর একটী সত্যনির্ভর উদাহরণ পাওয়া যায় চীনের মাতৃতান্ত্রিক জনগোষ্ঠী ‘মোসুও’দের মাঝে। এই জনগোষ্ঠীর নারীরা সেখানকার পুরুষদের চাইতে শক্তিশালী। কারণ, এই পুরুষেরা ঘরে থাকেন আর নারীরা বাইরের কাজ করে জীবিকা নির্ব্বাহ করেন, বহু বছর ধরে শক্ত কাজকর্ম্ম না করার কারণেই সেখানকার পুরুষেরা তাদের শারিরীক কর্ম্মক্ষমতা হারিয়েছে।
পিতৃতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃতন্ত্রে নারীদের প্রাপ্ত সুবিধাগুলো যদিও একেকটা আশাপ্রদ ব্যাপার, তারপরও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে দেখলে দেখা যায় মাতৃতন্ত্রে অভারসাম্যজনিত কিছু সমস্যা আছে। যেমন, আমার জানামতে গারোদের পরিবারের ছোট মেয়েটাই সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। তাহলে দুই বা ততোধিক মেয়ে থাকলে তাদের ভাগে কিছুই পড়ার নিয়ম নেই, আর ছেলেদেরও সম্পত্তিতে কোন অধিকার থাকে না, যা বৈষম্যমূলক। সম্পত্তির প্রয়োজনীয়তা ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই থাকে। আর নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য খাসিয়া পুরুষদের বেশ কিছু আন্দোলনের কথাও শোনা যায়। নারিবাদী সূত্রানুযায়ী নারী বা পুরুষ কারো একক কর্ত্তৃত্ব কখনোই সমাজের জন্য চিরস্থায়ী মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। নারী ও পুরুষের সহযোগী সহাবস্থানই পারে একটী সুষম সাম্যবাদী সমাজের জন্ম দিতে।
তারপরও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পিতৃতন্ত্র নামক পৃথিবীবিস্তৃত অসম ও বৈষম্যপূর্ণ সমাজব্যাবস্থার বিপরীতে দাড়িয়ে মাতৃতন্ত্রই পিতৃতন্ত্রের অসংখ্য কমতি, অন্ধবিশ্বাস ও হীনতাকে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। …
নন্দিতা সিনহা রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য, মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।