সংস্কৃতে ং কে বিন্দু (.) দিয়েও লেখা হয়। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রমতে বিন্দু থেকেই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং সৃষ্টির আদি মহাশব্দ এই ‘ং’ (ওম > ওঁ) ধ্বনি যা আবার ভাষার জগতে ‘অব্যক্ত’ রহস্যরূপিনী হিসেবে পরিচিত। সে যাই হোক, রহস্য রূপিনী ‘ং’ এর আরো পাঁচটি পঞ্চ-বর্গীয় রূপ আছে যেগুলো যথাক্রমে ঙ, ঞ, ণ, ন, ম। তাই বলা যায় সংস্কৃত তথা বাংলা ভাষায় সর্ব্বমোট ছয়টি রহস্যরূপিনী বর্ণ আছে: ং, ঙ, ঞ, ণ, ন, ম। এই বর্ণগুলো নাসিক্য-বর্ণ হিসাবেও পরিচিত। এই ছয়টি রহস্যরূপিনী বর্ণযুক্ত কোনো সংস্কৃত শব্দ যখন তদ্ভব বা বাংলা শব্দে রূপান্তরিত হয়, তখন তা বাংলার নিজস্ব স্বল্প-রহস্যরূপিনী চন্দ্রবিন্দুতে (ঁ) পরিণত হয়।
এর নিয়ম হলো এইরূপ—
ং, ঙ, ঞ, ণ, ন, ম এই ছয়টি নাসিক্য বর্ণযুক্ত সংস্কৃত শব্দ তদ্ভব শব্দে রূপান্তরিত হওয়ার সময় ওই নাসিক্য বর্ণগুলো বিলুপ্ত হয়ে তার পূর্ব্ববর্ত্তী বর্ণের মাথায় চন্দ্রবিন্দু (ঁ) রূপে আশ্রয় নেয়। নীচে মাত্র সামান্য কিছু উদাহরণ দেওয়া হল—
ং
অংশ/অংশু> আঁশ
হংস > হাঁস, হাঁসা/হাঁসী/হাঁসুয়া
বংশী > বাঁশী/বাঁশ
কাংস > কাঁসা
অংশ্/অক্ষি (অঞ্জন?) > আঁখি
উদক্ষি > উঁকি
ঝং > ঝাঁ, ঝাঁক, ঝাঁকুনি, ঝাঁঝর ইত্যাদি
ঙ
অঙ্ক/অঙ্কন > আঁকা
বঙ্ক/বঙ্কিম > বাঁকা
কঙ্ক/কঙ্কণ > কাঁক/কাঁখ/কাঁকন
কঙ্কর > কাঁকর (পাথর)
পঙ্ক/পঙ্কিল > পাঁক (জলাশয়ের কাদা)
শঙ্খ > শাঁখা
হুঙ্কার > হাঁক /হাঁকা
ঞ
পঞ্চ > পাঁচ
অঞ্চ > আঁচ (তাপের পরিধি)
অঞ্চল > আঁচল
কঞ্চ/কঞ্চি > কাঁচা > কাঁচ
মঞ্চ > মাঁচা
বঞ্চ > বাঁচা
ভঞ্জ > ভাঁজ
হঞ্ছি > হাঁচি
উঞ্ছ > ওঁছা (ধানের ওঁছা)
খঞ্জ > খাঁজ, খোঁজা, খোঁড়া
গঞ্জিকা > গাঁজা/ গোঁজামিল
সিঞ্চন > সেঁচ (পানি সেঁচা)
ণ
ষণ্ড > ষাঁড়
ভণ্ড > ভাঁড়
কণ্টক > কাঁটা
হণ্ডী > হাঁড়ি
হণ্ডা > হাঁদা
কন্থ > কাঁথা
কণ্ড > কাঁড়া (চাউল)
ন
চন্দ্র > চাঁদ
ক্রন্দন > কাঁদা/ কাঁদানো
যন্ত্র > যাঁতা
তন্তু > তাঁত
দন্ত > দাঁত
দন্ড > দাঁড় > দাঁড়ানো
বন্ধন > বাঁধা, বাঁধন
রন্ধন > রাঁধা (রান্না)
গেন্দা> গাঁদা (ফুল)
হন্টন (হঁ + অট্?) > হাঁটা, হাঁটু
অন্তঃ > আঁত, আঁতকে ওঠা, আঁতে ঘা
ইন্দুর > ইঁদুর
সিন্দুর > সিঁদুর
ঘন্ট > ঘাঁটা, ঘেঁটু
অন্ধকার > আঁধার
সন্তরণ > সাঁতার
সন্ধ্যা > সাঁঝ
স্কন্ধ > কাঁধ
ম
ওম > ওঁ
গ্রাম > গাঁ
কম্পন > কাঁপা
ঝম্পন> ঝাঁপা
লম্ফ > লাঁফ হওয়া উচিত (যদিও লাফ লেখা হয়, হয়তো কিছু কাহিনী আছে)
হর্ম > হাঁ (হাঁ করে থাকা)
হম্প > হাঁপা/ হাঁপানি/হাঁফ ছেড়ে বাঁচা
গুম্ফ > গোঁফ
আবার এই রহস্যরূপিনী বর্ণগুলো দিয়ে যুক্তাক্ষর তৈরীরও একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। যেমন—
ঙ এর পরে শুধু একই বর্গের ক খ গ ঘ যুক্ত হতে পারবে। অঙ্ক, শঙ্খ, গঙ্গা, জঙ্ঘা।
ঞ এর পরে শুধু একই বর্গের চ ছ জ ঝ যুক্ত হতে পারবে। চঞ্চল, লাঞ্ছনা, রঞ্জন, ঝঞ্ঝা।
ণ এর পরে শুধু একই বর্গের ট ঠ ড ঢ যুক্ত হতে পারবে। বণ্টন, লণ্ঠন, কাণ্ড, ষণ্ঢ।
ন এর পরে শুধু একই বর্গের ত থ দ ধ যুক্ত হতে পারবে। দন্ত, পান্থ, কন্দ, অন্ধ।
ম এর পরে শুধু একই বর্গের প ফ ব ভ যুক্ত হতে পারবে। চম্পা, লম্ফ, কম্বল, দম্ভ।
বাকী বর্ণগুলির সাথে রহস্যরূপিনী ং হিসাবেই যুক্ত হবে। যেমন, সংযম, সংসদ, সংলাপ, বংশ, সংসার, সংহার, সংশয় ইত্যাদি।
হারুনুর রশিদ রাজা রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য, চন্দ্রবিন্দু কথা