রোদন অরণ্যেই করা উচিৎ। মানুষ মানুষের ভাষা বোঝার সময়, মানবিক পরিস্থিতি হারিয়ে ফেলেছে। বৃক্ষদের দিকে তাকান, যক্ষণ মানুষ ছিল না তক্ষণো তারা প্রাণপ্রদায়ী বায়ু, সুশীতল ছায়া, ফল এবং ফুল প্রদান করেছে। তাহাদের ওপর মানুষের এত অত্যাচার সত্ত্বেও তাহাদের সেই দানের কমতি পড়ে নাই কোনদিন। বৃক্ষদের ভিতরে গিয়ে মানুষের প্রতি করুনা বিগলিত হৈয়ে নতুন প্রাণ স্পন্দন মহিমায় উদ্ভাসিত হৈয়ে বর্ষাকালেও গেয়ে উঠিতে পারেন “রোদন ভরা এ বসন্ত সখী কক্ষণো আসেনি বুঝি আগে”।
রোদন করিতে হৈলে অরণ্যেই করুন। অরণ্যৈ বোঝে মর্ম্মব্যথা। …
১৯৬৬ সালে Backster Effect (গাছের ধারে কাছে অন্য জীবকে হত্যা করিলে গাছের দুঃখ হয়) আবিষ্কার হয়।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে ধ্রুপদী সঙ্গীত অবিরাম শোনালে গমের ফলন ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। এই হৈল প্রকৃতিজাত হোয়ার/হ্ওয়ার গুণ।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, অস্তিত্ববাদী দার্শনিক কিয়ের্কেগার্ড বিশ্বাস করিতেন মানুষের ভিতর তিন ধরণের জীবন রয়েছে, ধরণ শব্দটাকে ঠিক সমান্তরাল বা পাশাপাশি বা সমজাতীয় হিসাবে তিনি দেখেন নাই বরং স্তর বা Stage হিসাবে তিনি ব্যাবহার করেছেন, তিনটা স্তর হৈল ভোগী স্তর, Aesthetic, নৈতিক স্তর এবং ধর্ম্মীয় স্তর। মানুষের ভিতর তাহার ক্রিয়াশীল এই চেতনা যাহা তাহার জীবন এবং যাপন পদ্ধতি এবং বোধকে নির্ম্মাণ করে। সমাজ এবং রাষ্ট্রের রূপ কেমন হৈবে, কেমন হৈবে তাহার গতি-প্রকৃতি তাহার একটা সরল হিসাব এই তিন স্তরের মানুষের অনুপাত করিলে অনুমেয় হৈবে। কিন্তু বিষয়গুলা এত সহজ নয় বরং আরো একটু জটিল, বলা যায় বেশীই জটিল।
ফ্রিদা কাহলো
বৃক্ষদের নিজস্ব ধর্ম্ম আছে, সেই ধর্ম্ম প্রকৃতিজ, সেইটাকে সরলীকরণ করা যায়, এমনকি মানুষ বৃক্ষদের সাথে কী ধরণের আচরণ করিলে তাহারা কী ধরণের আচরণ করিবে সেটাও নির্দ্ধারিত। মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না, একজন ব্যাক্তি মানুষ জগৎ-সংসারে বিভিন্ন পরিচয় বহন করিতেছে এবং প্রত্যেকটা পরিচয়ের আলাদা আলাদা ব্যাক্তি বিচারে মানদণ্ড আছে সেই অনুসারে সেই ব্যাক্তিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক জীবনের আচরণ নির্দ্ধারন করে। সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা, আইনকানুন, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় সমূহ তাহার মানদণ্ডের কোষ তৈয়ার করে। এরপর-ও কথা থেকে যায় একৈ পরিবারে, সমাজে রাষ্ট্রে থেকেও ব্যাক্তির আচরণ এবং জীবনবোধের এত ভিন্নতা কেন দেখা যায়? কারণ চেতনা বা মানদণ্ড কোন স্থায়ী বা অপরিবর্ত্তনীয় কোন বিষয় নয়, ব্যাক্তি প্রতিক্ষণে জগৎ-সংসারের পরিবর্ত্তনীয় বিষয়গুলোর সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে বেঁচে থাকে এক্ষেত্রে যার মতি যেদিকে (গীতা তিন স্তরের কথা বলছে, সত্বঃ, রজঃ, তমঃ) অনুপাত অনুসারে ক্রিয়াশীল হৈতে থাকে।
ব্যাক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ এবং একটা কাঠামোবদ্ধতার ভিতর নেওয়ার জন্যই তৈয়ার হৈয়েছে বিভিন্ন সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠানের। গোলটা এইখানে বেঁধেছে, ব্যাক্তি নিজে স্থির কোন মানদণ্ড ঠিক করে নিজের চেতনা দ্বারা পরিচালিত হৈতে পারিতেছে না কিন্তু সামষ্টিকতার জন্য সে ওই চেতনাকে খাটিয়ে আদর্শ এবং কাঠামো নির্ম্মাণ করিতেছে ফলে আদর্শ এবং কাঠামোর ভিতর ব্যাক্তি হয়ে পড়িতেছে গৌণ, মানুষ হোয়ার/হ্ওয়ার বৈশিষ্ট্যগত কারণেই সে এই গৌণতাকে আবার মেনে নিতে পারিতেছে না, আদর্শ এবং কাঠামোকে ভেদ করিতে চাইছে সে আবার। এমনিভাবে একটা চক্র চলিতেছে, ঘোরপাকের একটা চক্র, শরীর নাকি মন? আত্মা নাকি চেতনা?
যেই কোন কাঠামো অন্যকোন কাঠামো সাপেক্ষেই মৌল এমনকি যদি আপনি কাঠামোহীনতার কথাও ভাবেন সেটাও একটা কাঠামোকেই নির্দ্দেশ করে। ব্যাক্তি মৌলবাদীর সমস্যা হৈল সে আরোপ করিতে চায়, আরোপিত যেই কোন কিছুই ত অপ্রাকৃতিক। প্রশ্ন হৈল যাহার যেমন ইচ্ছে বা সাধ সে কি তেমনিভাবে চলিবে নাকি তাহাকে কোন মানদণ্ড অনুসরন করা উচিৎ। “উচিৎ” শব্দটা আবার দেশকাল পাত্র নির্দ্ধারন করে। এইখানে উচিৎ বলে কিছু থাকিতেছে না বরং দেশকাল বিবেচনায় ব্যাক্তিকে একটা মানদণ্ড অবশ্যই অনুসরন করিতে হয় এক্ষেত্রে ব্যাক্তি নিজের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত আরোপ করিবে কট্টরভাবে। ব্যাক্তিকে একটা মানদণ্ড নির্দ্ধারন করে তাহার জীবন এবং যাপনের ওপর কট্টরপন্থা অবলম্বন করিতেই হয়, এই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাক্তি কট্টরপন্থার-ও উর্ধ্বে যেতে পারে না। ব্যাক্তির এই যে মৌলবাদী হোয়া/হ্ওয়া, কট্টর হোয়া/হ্ওয়া এবং সেটা ব্যাক্তির নিজের সাপেক্ষেই পরমভাবে হৈয়ে যেতে পারার যেই অমোঘ পরিণতি তাহা কোন গতিপথে হৈবে এবং ব্যাক্তি কিভাবে তাহা নির্দ্ধারন করিবে এইটার সুরাহা দার্শনিক পথে হৈতে হয়। আর সেই দার্শনিক সমাধান প্রয়োগ করিবে সামষ্টিক চিন্তার সজীব প্রয়োগকারী রাজনীতিবিদরা। মৌলবাদ, কট্টরপন্থা, দার্শনিকতা, রাজনীতি এই শব্দগুলা যেই অর্থবাচকতা প্রকাশ করে সেখানে ব্যাক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানগুলো ফাংশন করে। এদের ফাংশনের নিয়ামক মোটাদাগে ধরা হয় মানবিকতার গজকাঠিতে। মানবিকতার সাথে সময় সরাসরি সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ অতীতে মানবিকতা বলিতে যেমনটা উপলব্ধি করা হৈত বর্ত্তমানে তাহা পাল্টে গেছে আবার ভবিষ্যতে তা পাল্টে যাবে। তবে মানবিকতা শব্দটাও একটা প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্প্রদায়িক শব্দ। জগৎ-সংসারের কল্যাণ মানুষের কল্যানের পরিপূরক নয় আরো অনেক প্রাণ সম্প্রদায় আছে জগৎ-সংসারে আমরা যদি গোটা জগৎ-সংসারের কল্যাণের কথা ভাবি দেখা যাবে প্রাকৃতিক বিচারে গোটা মানবসমাজ ভীষণ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী আর কট্টর। কারণ মহাজাগতিক নিয়মকে অস্বীকার করে নিজের নিয়মকে প্রতিষ্ঠা করার এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করে আরোপ করার ধৃষ্টতা কেবল মানুষ দেখিয়েছে যা সভ্যতার ইতিহাসে চরম জঘন্য বিষয়। মানুষের ইতিহাস মূলতঃ মৌলবাদীতার ইতিহাস, ক্ষমতা ঘনীভূত এবং আরোপ করার ইতিহাস, এর বাইরে যেইসব আর্টকালচারের বিষয় বলা হৈয়ে থাকে তাহা এইগুলোর বাইপ্রোডাক্ট ছাড়া কিছু নয়। অন্যের ধন চুরি করে নেওয়ার বুদ্ধি যেই প্রাণী রপ্ত করিতে শিখেছে সেখানে গান, কবিতা শিল্প সাহিত্যও সৃষ্টি করিতে শিখিবে সে, এটাই স্বাভাবিক।
মানুষকে মহান ভেবে মানুষকে মানুষ ভালবাসার কথা বলে গেছে, ভালবাসিতে হৈলে বৃক্ষদের ভালবাসুন তাহৈলে মানুষের প্রতি ভালবাসা এমনিতেই তৈরী হৈয়ে যাবে, মানুষকে ভালবাসিতে যাওয়াটা জগতে শান্তি আনার ব্যর্থ পথ, শান্তির জন্য বৃক্ষের কাছে যান। বৃক্ষদের ভিতর কিকেয়ার্কেগার্ড নাই, গীতাও নাই তাদের এসবের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু বৃক্ষরা গান শুনিতে জানে, অন্যের কষ্টে কষ্ট-ও পেতে জানে। মানবিকতা অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং ধ্বংসাত্মক শব্দ, দুনিয়া থেকে মানবিকতাবোধের ধারণাই উঠিয়ে দিতে হৈবে। মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ কারচুপি আর দস্যূবৃত্তি বৈধ হৈয়েছে এই একটা গজকাঠি দিয়ে যাহা যুগে যুগে ব্যাক্তি, গোষ্ঠী কক্ষণো ধর্ম্ম কক্ষণো দর্শন দ্বারা বৈধ করে প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীকে কলুষিত এবং প্রাণ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হৈল মানুষ নিজেদের ভিতরেই বিভেদ এবং বিভাজন তৈয়ার করে রেখেছে।
মানবিকতার যেই কাঠামো তৈয়ার হৈয়েছে সাথে আধুনিকতার সমান্তরাল সম্পর্ক রেখেই তাহার উন্নয়ন ঘটেছে, আধুনিকতা যেই বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে সেইখানে ব্যাক্তি কোন-না-কোনভাবে ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করিতে গিয়ে এতদিনে গড়ে ওঠা তাহার সাংস্কৃতিক বলয় ভেঙ্গে ফেলিতেছে। ফলে নিত্য নতুন ধারায় নির্ম্মাণ হৈতেছে নব মানবিক কাঠামো, এইটা মানুষের যন্ত্র আবিষ্কারের সাথে সাথেই ঘটে আসিতেছে। যন্ত্রকে মানবিকতার সেরা নিদর্শন হিসাবে দেখা যায় কিন্তু যন্ত্র স্বয়ং কোন মানবিক ব্যাপার নয়।
যন্ত্রের অনুগামী হৈলে যন্ত্রণায় ভূগ্্-বে গোটা প্রাণ সম্প্রদায় আর বৃক্ষের অনুগামী হৈলে যন্ত্র হৈবে প্রাণ সম্প্রদায়ের অনুগামী। …………
শামীম রেজা রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, রোদন অরণ্যেই করুন, অরণ্যৈ বোঝে মর্ম্মব্যথা — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।