বাতিঘরে মাঝে মাঝেই ঢু-মারি নানান বই এর খোঁজে। পুরা বাতিঘরের মধ্যে আর্ট এণ্ড কালচার ও পেইণ্টিং-এর শেলফ এর দিকটায় আমার আনাগোনা বেশী বরাবরই, যে-দিনই যাই মোটামুটি দেখার চেষ্টা করি সাম্প্রতিক কোন বই আমদানি আছে কিনা! এমনিতেই পুরো বাঙ্গালা সাহিত্যে পেইন্টিং এর ওপর মৌলিক ভাল বই খুবই কম! যা-কিছু তার মধ্যে বেশীর ভাগৈ কলকাতার লেখকদের! বাঙ্গালাদেশী লেখকদের মধ্যে কবির চৌধুরীর কিছু বই রয়েছে। তাহার বেশীর-ভাগই অনুবাদ করা! অল্প-বিস্তর বাকী লেখকদের কিছু বই রয়েছে তাহাও তেমন উজ্জল্য ছড়ায়-না! আর্টের এই মহা-জগতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার-জন্য!
সেলফে খুঁজতে খুঁজতে পেলাম ‘সৈয়দ নিজার’ এর লেখা– “ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা”। বাতিঘরের পড়িবার জায়গায় বইটা উল্টে পাল্টে দেখিতে শুরু করলাম, শুরুর মুখবন্ধ পড়ে প্রথমেই চমকে উঠলাম! বাহ্! ঢাকায় আর্টের মৌলিক আলোচনা করা এত ভাল বই হয়! আমার বেলায় আরেকটা ব্যাপার ঘটে, কোন বই হাতে নিয়ে যদি প্রচ্ছদ, কাগজ, ছাপা, বাঁধাই ভাল হয় তাহৈলে ঐ-বইয়ে আগ্রহ জন্মে!
“ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা” বইটার বেলায় এই সর্ত্ত সম্পুর্ন পূরণ হয়ছে! মোটামুটি এক বসাতেই গোটাকতক পৃষ্ঠা পড়ে কিনে ফেলার চিন্তা করে চলে গেলাম নিয়মিত বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রর ছাদের আড্ডায়! সামিও শীশ আর তরুন প্রকাশক রুম্মান তাশফীক এর সাথে বইটা নিয়ে আলোচনা করা মাত্রৈ জানা গেল বইটার চমৎকারিত্ব! আমি বললাম তাহৈলে কিনে পড়তেই হয়! “রুম্মান” সাথে সাথেই বলল এই বইটা আমি আপনাকে গিফট করব! পরদিন “সৈয়দ নিজার” এর বইটা হাতে পাবার পর বাসায় এসে গিলতে লাগলাম প্রবল উৎসাহে!
এস এম সুলতান নিয়ে লেখক “সৈয়দ নিজার” এর ধ্রুপদী বিশ্লেষণ প্রথমেই পাঠক-কে আকৃষ্ট করে, সাথে সুলতানের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্য্যন্ত সেই সময়ের প্রেক্ষাপট সমস্তৈ বুঝা যায় নিরেট বাস্তবতাবাদী বর্ননায়। লেখক “সৈয়দ নিজার” মূলত “ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা” বই-এর মাধ্যমে উপনিবেশায়ন কালের হ্যাংওভার কাটানোর সুলতানী ও নূতন ছবির পরিকাঠামোর খোঁজ দিয়েছেন!…
ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন কী ভাবে হয়েছে ব্রিটিশ বেনিয়া গুষ্টির মাধ্যমে; প্রথমে পণ্য, এরপর পুঁজি ও ক্ষমতা, সর্ব্বশেষ ধাপ ভারতীয় শিল্প সাহিত্য-কে ব্রিটিশীয় চেহারা দিয়ে ষোলকলা পূর্ণ করা। ভারতে উপনিবেশায়ন ১৭৫৭ সালে শুরু হয়নি এই উপনিবেশের ধারা চালু হয়েছে আরো অনেক আগে থেকে যখন ইয়োরোপীয় বণিকরা এই ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্যর জন্য অনেক আগে থেকে আসতে থাকেন… ১৭৫৭ সালের পলাশীর পতন হৈল, ব্রিটিশ উপনিবেশের আনুষ্টানিক শুরু।
পনের শতক থেকে সুরু হয়ে ষোড়শ শতকের মাঝ থেকে যখন ইয়োরোপীয় বনিকরা আফ্রিকা, আমেরিকা, সাউথ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, মধ্যপ্রাচ্য-এর দেশগুলাতে ব্যাক্তি ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন… সেই সম্মিলিত চেষ্টার একান্ত মুকসুদে মাঞ্জিল হচ্ছে বাণিজ্য, বাণিজ্য এবং বাণিজ্য সেই নূতন দেশের আবিস্কারের সম্ভাব্য নেশায় বাণিজ্য খোর লোভী লোকগুলা জাহাজে অস্ত্র তুলেছে আর কল্পনায় নূতন আবিষ্কার সম্ভাব্য দেশের অধিবাসীদের চকচকে মাথা দেখেছে, থেতলে/কেটে শরীর থেকে আলাদা করে দেবার। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হৈবে ইয়োরোপীয় বাণিজ্য আগ্রাসী এই অধিকাংশ কপর্দকহীন দাগি আসামী লোকগুলো যদি জাহাজ নিয়ে সাগর মহাসাগর গুলোতে বেরিয়ে না-পড়তেন তাহৈলে আজকের দিনের এই বাণিজ্য প্রসারের যুগ পৃথিবীতে আসত আরো অনেক ধীর লয়ে অনেকটা ধ্রপদী সঙ্গীতের লয়ের/ছন্দের মত, ইয়োরোপীয় এই বাণিজ্য দৈত্যদের জন্য যে শধু ভারতীয় উপমহাদেশ বা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ক্যারাবীয় অঞ্চল বা আমেরিকা যন্ত্রনা সয়েছে তাই না সেই আগ্রাসী বাণিজ্য আস্তে আস্তে রুপ নিয়েছে অনেকটা টর্নেডো গতির মধ্যে… সেই টর্নেডো বাণিজ্যের আঘাতে আজ পৃথিবীর এই করুণ চিত্রের কর্পোরেট বাণিজ্য তৈয়ারী। পৃথিবীর স্বাভাবিক প্রতিবেশ পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংসের প্রথমিক লক্ষণের এর মধ্যে উপস্থিত।
ভাস্কো দা গামা থেকে কলম্বাস বা তাহাদের সেই ফিলসফির উত্তরসুরী বর্ত্তমানের ফেইসবুক বা গুগল, মাইক্রোসফট ও আইফোন। আগে সেই বাণিজ্য বনিকদের চোখে দেখা যেত, এই হাল আমলের বণিকদের আপনি চোখে দেখবেন না তবে সে আপনাকে আক্রান্ত করবেই! এখন অনেক মানব মরমী ভাই বলবেন আরে মার্ক জাকারবার্গ থেকে জাফ বেজোস বা বিল গেটস এরা এই বাণিজ্য বিস্তারের না করলে তো আমারা সভ্যতার অনেক কিছুই পেতাম-না! হ্যাঁরে-হ্যাঁ… হরিবলের নাতি, তা-ঠিক কিন্তু এই যে এত উন্নয়ন হয় গ্রীন হাউজ এফেক্ট থেকে পৃথিবীর হাযার বছরের সঞ্চিত ভালবাসার শুভ্র বরফ গলছে পৃথিবীর এই মৌলিক জিনিশগুলা হয়ত নষ্ট হৈত, তবে আরো অনেক দীর্ঘ সময় নিয়ে! বা প্লেটোর স্বপ্নরাষ্টের প্রয়োগ যদি কোন এক আদম-কন্যার হাত ধরে বাস্তবায়ন হৈত চিত্র হয় ত পুরাই অন্যরকম থাকিত। সে যাজ্ঞে এত সব প্যাঁচের আলোচনা ভাই ভাল লাগে না! সেই প্যাঁচ ও প্যাঁচ খোলা অন্য কোন প্যাঁচান্নিত জায়গায় করা যাবে! (…)
আমরা আসি, সৈয়দ নিজার-এর বইয়ের সুরতাহালের ঘরে আমি না হয় ডোম হৈলাম আজ আপনারা ডোমের সঙ্গী! বলেন হরিবল! “সৈয়দ নিজার” এর লেখা– “ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা” বইয়ে একটা জিনিশ প্রথমেই পরিষ্কার “নিজার” আদি ভারতীয় উপমহাদেশীয় চিত্রকলা, দর্শন সঙ্গিত অর্থশাস্ত্র তথা এই ভারতীয় মাটীর সমস্ত বুদ্ধি লক্ষণের নিরেট ভক্ত ও রক্ষাকারী! তো নিজারের পঠনে ধরা দিল সুলতান… হ্যাঁ ভাই আমাদের নড়াইলের লালমিয়া শেখ মোহাম্মদ সুলতান। সেই উনিশ শতকে জন্মানো সাধক সুলতান আর এই বিশ শতকের নিজারের পরিপক্ক জ্ঞান। এক জায়গায় মিশিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সেই পরম জ্ঞানের দ্বারে নিয়ে এসেছে দু’জনকেই! সুলতানের নড়াইল থেকে কলকাতা যাত্রা ও কলকাতা আর্ট-কলেজে ভর্তি, সুলতান ১৯৪০ সালে কলকাতা আর্ট কলেজে শিল্পানুরাগী শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ভর্তি হন। অনেক মহান শিল্পীর মত তিনিও আর্ট কলেজে ড্রপ আউট! কলকাতা আর্ট কলেজে ছেড়ে ১৯৪৪-এ বেরিয়ে পরেন ভারত দেখতে, ঘুরে বেরিয়েছেন সিমলা থেকে কাশ্মীর! সুলতানের ভারতীয় অজন্তা, ইলোরা গুহাচিত্রে সেই আদি ভারতীয় উপমহাদেশীয় যে-চিত্র লক্ষণ গুলো পান তা-থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে তার বিউপনিবেসিক চিন্তা সূত্রের উদ্ভব হয়। হয়তো এত শত না-বুঝেই সুলতান আপনা থেকেই এই চিন্তা করেছেন তাহাতে মন্দ কীসে? জগতে না বুঝেই কি বড় বড় মহান সৃষ্টি হয়নি? শিল্পী না-বুঝেই সৃষ্টি করে আর ঈশ্বরও না-বুঝেই হয় ত প্রাণ-প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন!…
সুলতান প্রথম যৌবনে কলকাতা আর্ট কলেজের মায়া করে ভারত ভ্রমনে বেরিয়ে পড়েন… ঘুরেছেন দিল্লি, বোম্বে, মহারাষ্ট, আগ্রা, বিহার, উড়িষ্যা, কাশ্মীর সব প্রায় ভারতের প্রতি প্রান্তে। সুলতানের এই লক্ষহীন ভ্রমনে ফল হয়েছে এই, ভারতীয় উপমহাদেশের আদি ইতিহাসের প্রথম পাঠ সুলতান নিয়ে নিয়েছেন প্রকৃতির মধ্যে, মানুষের মধ্যে, সুলতানিয় ঢঙ্গে। এই রাজসিক ভ্রমণের এক পর্য্যায়ে এসে সুলতান কিছুদিনের জন্য থিতু হলেন হিম-সহর সিমলায়। সেই ব্রিটিশ রাজকীয় শাসন আমলের সিমলায়! সেই কালের সিমলা ছিল বেশীর ভাগ ইংরেজ ও ইয়োরোপীয়দের রাজধানী সহর! সারা বছর হিমেল আবহাওয়ার জন্য অনেক ইয়োরোপীয়দের বাস ছিল এখানে। বাড়ী থেকে হাযার মাইল দূরে ভিক্ষুক এই ইয়োরোপীয় মানুষগুলা (পরে অবশ্য আমাদের শাসক বনে গিয়েছে) এই সিমলাকেই মনে করত ইংল্যান্ডের কোন সহর, কারন ছিল ম্যানচেস্টার, গ্লাসগো বা ডাবলিনের মতন আবহাওয়া।
সারা ভারতের নানান জায়গার সম্পদ লুন্ঠণ করতে, লুন্ঠনকারী দলের সবাই ছড়িয়ে পড়ত! তাহাদের বৌ, বাচ্চারা থাকত ইংল্যান্ডসদৃশ আবহাওয়ার সিমলাতে। সম্পদ লুন্ঠণ করে সেই ইংরেজ ভিক্ষুকদল (পরে ভারতীয় শাসনকর্ত্তা) বৌ-বাচ্চাদের কাছে আবার ফিরে আসত। এদের হাতে তখন লুন্ঠনের কাঁচা পয়সাও ঢের। সেই উদ্বৃত্ত পয়সার উৎপাতে এরা নানান শৌখিনতা করত সিমলা সহরে… এর মধ্যে অন্যতম হল নিজেদের পোট্রেট আঁকানো। মজার বিষয় হৈল আমরা যত ছোট ইংরেজদের পোট্রেট পাই সেইখানে দেখব সবাই বাহাদুর বেশে নানান ভঙ্গিতে ভারতের নানান জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তা জলে, জঙ্গলে, বাঘের পেটের ওপরে, পা-রেখে হোক, বন্দুক হাতে পাখী শিকারের ছবিই হোক তো সেই স্থুল শৌখিনতার কারনে পোট্রেট ব্যাবসা ছিল সিমলায় রমরমা!
তো, আমাদের সুলতান তার সিমলায় স্বল্প বাসের সময় এই ছোট ইংরেজদের পোট্রেট করেই সিমলায় থাকা আর খাবার যোগালেন। সিমলাতেই সুলতান দেখা পেলেন বড় এক ইংরেজ মহিলার, কানাডীয় বংশদ্ভুত এই মহিলা সুলতানকে বেশ আদর আপ্যায়ন করেছেন সুলতানের পুরো সিমলা অবস্থানের সময়ে। উনি চালাতেন একটা এনজিও সেই এনজিও ফান্ড রেইস করতে সুলতান তার একক চিত্র প্রদর্শনী করলেন সিমলায় কানাডীয় মহিলার উদ্দীপনায়। এই প্রথম সুলতান শিল্পী হিসেবে বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক সমঝদার মহলে সবার নজরে আসলেন। সেই সিমলা পর্ব্ব দিয়েই সুলতানের আনুষ্ঠানিক শিল্পী পর্ব্বের শুরু। সুলতান আবার নিরুদ্দেশ হয়ে পড়লেন স্বভাবমত, ভারতের সব বিখ্যাত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সহর ঘুরে সুলতান চলে এলেন কাশ্মিরে শুরু করলেন প্রকৃতি পাঠ!
১৯৪৭ এরদিকে কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান চলে আসেন। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর সুলতান আসলেন পাকিস্থানের লাহোর, এখানে ভারত থেকে ফেরত নানান রিফিউজি শিল্পীদের মতন সুলতানো ঘুরতে লাগলেন নূতন কী করা যায় নব্য এই রাষ্ট্রের মধ্যে, এই ভেবে… এরপর আসলেন রিফিউজি অধ্যুষিত বন্দর নগরী করাচী, পূর্ব্ব পাকিস্তানের অনেক শিল্পীকে পেয়ে গেলেন। চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমানর এর মধ্যে অন্যতম, খান আতাউর রহমানের নির্দ্দেশনায় করলেন মঞ্চ নাটক। সে যে সে নাটক নয় একেবারে নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তা-ও আবার সবথেকে ঘৃণিত চরিত্র মীরজাফর। খান আতা মীরজাফর চরিত্র করতে কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না শেষমেশ সুলতানকে ধরে উঠিয়ে দিলেন মঞ্চে।
১৯৫৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি নিয়ে সুলতান গেলেন আমেরিকায় যেখান থেকে ইয়োরোপ ঘুরে চলে এলেন ঢাকায়। ইয়োরোপ ও আমেরিকার পাঠ চুকিয়ে আমেরিকা এবং লন্ডন এর অবস্থান ও পাশ্চাত্য রীতি আয়ত্ত করা আবার নূতন উপনিবেশ পাকিস্থানে ১৯৫৫-তে এসে শিল্পের একনিষ্ঠ কর্ম্মী হ্ওয়া, এরপর নিজের একটা শিল্পরীতি খুঁজে পাওয়া।
মুক্তিযুদ্ধে শেষে নূতন দেশ বাঙ্গালাদেশে এর মূল মাটী ও মানুষের জীবন সংগ্রাম-কে সুলতানীয় রীতিতে তুলে পেইন্টিং-এ উপনিবেশিক হ্যাংওভার কাটিয়ে বিউপনিবেশায়ন ধারার শুরু করা। হতশ্রী বাঙ্গালাদেশেই ধরতে গেলে সুলতানকে আর বেশী নাড়া দিল এক দিকে কিছু মানুষের সেই ব্রিটিশ ও ইয়োরোপীয়দের মানুষের মতন অর্থবিত্তের নির্লজ্জ জৌলস আর অন্যদিকে দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা, পিড়িত মানুষ বাঙ্গালায় আবহমান কৃষক। যৌবনের ভারতীয় উপমহাদেশ ভ্রমনে সুলতানের ভারতীয় শিল্প সভ্যতার পাঠ বিশেষ করে প্রাচীন ভারতের গুহাচিত্র ও মুঘল মিনিয়েচার শিল্প সুলতানকে নাড়া দিয়েছিল প্রবল ভাবে, সাথে ইয়োরোপীয় আমেরিকান তরফে ইয়োরোপীয় শিল্পের নিবিষ্ট পাঠ এই দুইয়ে সুলতান বুঝলেন উপনিবেশ বলয়-এর চিত্র শিল্পীদের চিত্রশিল্প থেকে ভিন্ন কিছু তাহাকে করতে হৈবে, তুলে আনতে হৈবে ভারতীয় শিল্পকে, ভারতীয় মাটী ও মানুষকে, প্রকৃতিকে… গভীর সেই শেকড় সন্ধান শেষে সুলতান আঁকতে শুরু করলেন! এরপর একের পর এক চিত্রপটে সুলতান ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন সুলতানীয় ধারার শিল্পের নূতন ভুবন! যেই ভুবনে আনলেন মহাভারত-উত্তর যুগের শিল্পের কর্পূরের সুবাস। সাথে বাঙ্গালার গ্রামীণ জীবন, হাযার বছরের বাঙ্গালার লোকায়ত সমাজ গ্রামীণ অর্থনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাগ-ক্ষোভ শিল্পিত সৌন্দর্য্যে নূতন ভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে সেই পটে আবার থেকেছে সুলতানীয় নিজস্ব ঢঙ্গের নূতন ভুবন!… কী সেই ভুবন? আদি সেই হাড্ডিসার হাড়-জিরজিরে বাঙ্গালার কৃষক কিষাণী নয়, আঁকলেন বাঙ্গালার মানুষ, এই মানুষ অনেকটা কল্পিত সুসমাজের সেই জনপদের মানুষ যার অস্তিত্ব হয়ত বাঙ্গালায় এককালে ছিল হাযার বছরের পরিক্রমায় সুলতানের কল্পরাজ্যের সীমায়! তবে এই বাঙ্গালার কৃষক সুপারম্যানিয় ভাবে দেখতে পাওয়া শিল্পী সুলতানীয় দৃষ্টিকে আমরা বলতে পারি সুলতানীয় ঢঙ্গে এক বিস্তর গা-ঝাড়া দেওয়া প্রতি-বাদ হিসেবে, হাযার বছরের এই গ্রামীণ জনপদ মানুষকে পৃথিবীর নানান প্রান্তের ঠগ/জোচ্চর মানুষেরা এই দেশে শাসক বনে যে ঠকানোর ও শোষণের বেদনাক্রান্ত ইতিহাস পাওয়া যায় ইতিহাসের সেই দস্যুদের বিপক্ষে কৃষকদের হয়ে চিত্র শিল্পে সুলতানের লড়াই হিসেবে।
এই লড়াইয়ে সুলতান কৃষকদের পরাজিত দেখতে চাননি, দেখেছেন এই জনপদের সবথেকে শক্তিবান মানুষ হিসেবে, যারা এই জনপদকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাহাদের উৎপাদন ব্যবস্থা, ভালবাসা আর নিজেদের দারিদ্র অবস্থা জারি রেখে। হাযার বছরের এই প্রান্তিক কৃষক আসলে সুলতান নিজেই। সুলতান এসেছেন এই ধারা ক্রমিক প্রান্তিক জায়গা থেকেই। এই দুর্বল গ্রামীণ কৃষকদের মাসলে থাকে শক্তি, থাকে জোরালো কন্ঠস্বর আর গ্রামীণ জনপদের দেবতাসদৃশ শক্তি, যেই শক্তি বলে এই কৃষক বাঁচিয়ে রাখে সমাজের অন্য স্বদেশী বিদেশি বর্ব্বর অপদার্থ শক্তিকে। অনেক তো সুলতানের চিত্রপটের ফিলোসফী ৗৈহল… এবার সুলতানের ছবির বিউপনিবেশায়ন ধারা নিয়ে খোলামনে আলাপ তোলা যাক! সুলতানের ছবিগুলার সাদৃশ্য যদি খেয়াল করা যায় তাহার মধ্যে সবথেকে বেশী যেটা ধরা পড়ে তা হৈল প্রাচীন ভারতীয় গুহাচিত্রের প্রভাব, যেই গুহাচিত্র আর সুলতানের ছবির মধ্যে ফিগারের অঙ্কন রীতির ঢং প্রায় এক! যেমন, মানব শরীরের মধ্যভাগে গুহাচিত্রের একটা লাবণ্যময় কিন্তু দুর্দ্দমনীয় সৌন্দর্য্যের দেখা মেলে তেমনি সুলতানের ছবির পুরুষ ও নারীর বিশেষকরে নারী ফিগারের সাদৃশ্য প্রায় হুবহু একৈ, এই যে প্রাচীন ভারতকে সুলতানের মধ্যে দিয়ে ফিরে পাওয়া, আমাদের বা সুলতানের সেতো সেই বিউপনিবেশায়ন ধারার সূচনাপর্ব্বের অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কুমার স্বামীর বিউপনিবেশিক সংগ্রামের সফল পরিণতির সফল সূচনা।…
১৯৭৬ সালে দীর্ঘ বিরতির পর ঢাকায় একক চিত্র প্রদর্শনী। এরপর আহমেদ ছফা’র সুলতানকে নব-আবিস্কার! আশির দশকের শেষ ভাগে “ছফা” বাঙ্গালার ধ্বজভঙ্গ শিল্প সমজদারদের কাছে প্রাণ-প্রদীপে নিয়ে আসেন শিল্পী সুলতানকে!
লেখক সৈয়দ নিজার ঢাকার শিল্পচর্চ্চার ইতিহাস প্রবনতারগুলার মধ্য দিয়ে দেখতে চেয়েছেন আঠারো ও উনিশ শতকের হিন্দুপ্রধান ঢাকায় মুসলিমদের শিল্পচর্চ্চার ফুটষ্টেপ। জয়নুল আবেদিন, সুলতান, কামরুল হাসান-এর মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী মুসলিম-এর শিল্পচচর্চ্চা ও পাকিস্তানে মুসলিম জাতীয়তাবাদ এর প্রভাব খুঁজে দেখবার চেষ্টা করেছেন সফল ভাবে! এর মধ্যে মার্কসীয় প্রভাব, বৃত্তির টাকায় শিল্পীদের ইয়োরোপ যাত্রার প্রভাব লেখক নিজার-এর টর্চ-এর আলো পড়েছে বেশ তির্য্যকভাবে। …
সৈয়দ নিজার যেই সুলতানকে খুঁজতে চেয়েছেন ভারতীয় জ্ঞানকাণ্ডের অন্যতম মানুষ হিসেবে, সেই শিল্পী সুলতান-ই সবথেকে বেশী জ্বলজ্বলে বিউপনিবেশিক উত্তর-চিত্রকলার ইতিহাসে।
শিল্পরসিক মাত্রই সৈয়দ নিজার’র “ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা” বইটা উপনিবেশিক হ্যাংওভার কাটিয়ে বিউপনিবেশায়ন শিল্পের স্বাদ নিতে পারেন!
কায়সার কাদের সেলিম রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, সৈয়দ নিজারের ‘ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা’-এর পাঠ পর্য্যালোচনা — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।