পায়ের কাছে গড়িয়ে এসেছে ছায়া, লম্বা হৈমন্তী বিকেল।
এরকম গাঢ় হলুদ রঙের রোদ মেখে আছে স্মৃতির নিমফুল।আমি তার শবের ওপর হেঁটে মাঠে যাই রোজ।মাঠগুলো আমাদের সবুজাভ স্বপ্নের মতো মনে হয়।ফিকে হয়ে আসা ভোরের মতো আগেকার ঘাসের ঘন রঙ আর মনে পড়ে না। আগেকার ঘাসের নরম আদর আর মনে পড়ে না। আগেকার মতো করে তবুও নতুন ঘাসে ফড়িং আসে; আমিও।
যে প্রহরে ঝিঁঝিঁর ঘুম ভাঙে, যে প্রহরে লাটাই গুটিয়ে নাগরিক হয়ে ওঠে আকাশমুখী বালকের চোখ; আমি মাঠে যাই।মাঠে একটা ছায়া গুটিয়ে আসে ঘুড়ির সুতার মতো।শ্যামলদের লাটাই গুলো কড়ই গাছের কোটরে রাখা আছে।আমি তার শেকড়ে গিয়ে হেলান দিয়ে বসি।শত সহস্র বিকেল আমি এই অপরিবর্তনীয় শেকড়ে মাথা রেখে শুনি সুবিনয়দের লাটাইয়ের একা হয়ে যাওয়া।
ফড়িঙের ডানা ঝরে পড়ার শব্দে তখন কেঁপে ওঠে শুকনো পাতা, শুকনো পাতার বুকে বাঁশি বাজে।খুব দূর পথ পেরিয়ে আসা সুরে বাঁশি বাজে।ক্লান্ত বাঁশি।
কে বাজায় ? কে, এত ক্লান্ত? এত ক্লান্ত!
কেউ কেন এত ক্লান্ত হয়?
আমি শেকড়ে বসি। অপরিবর্তনীয় এবং বিশ্বস্ত শেকড়।
এই শেকড়ে মাথা রেখে যে লোকটা প্রায় এক জীবন বাঁশি বাজিয়ে গেছে, যে লোকটা বাঁশি বাজিয়েই বলতে চেয়েছিলো— তার নাম আমরা কেউ শুনিনি।এখন কেবল শুকনো পাতার গায়ে তার অমীমাংসিত ক্লান্তি ওড়ে।
এইরকম করে কখন রোদ গাঢ় হতে হতে অন্ধকার হয়ে আসে শৈশব।আমরা রাতের মুখ দেখতে শিখে যাই।আশ্চর্য স্থির এবং বিষণ্ন মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত মাঠ।একা হয়ে যাওয়া লাটাইয়ের সংবাদ আসতে থাকে রোজ।
একমাত্র এক কড়ই গাছ সময়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকে পৃথিবীর সমস্ত বদলে যাওয়ার ক্লান্তিবিদ্ধ একা দাঁড়িয়ে থাকা।
অন্ধকার জমে এলে একটা মিহি হাসির সুর শোনা যায়।লাল রেশমি চুড়ির মতো বাতাসে দুলে দুলে বেজে ওঠে।হাসিদের পাড়া বদল হয়, মাঠ বদল হয়; হয়তোবা মাঠ হারায় তাদের।সুমনারা একদিন প্রেম ভুলতে দেয়াল তোলে শক্ত করে, অথচ ঠিক কোন ডাকপিয়নের হাতে সেই দেয়াল ডিঙিয়ে উড়ো চিঠি আসে এখানে তার খবর আমরা কেউ জানিনা।সবকিছু জেনে যেতে নেই।
আমাদের আশ্বিনী পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে কড়ই গাছের ডালে। বড় সাদা চাঁদ। চাঁদের গা থেকে ভেসে আসে চন্দনের ঘ্রাণ। চাঁদের মুখ দেখতে থেমে যায় বাতাস, সুরভী আলোয় চারিদিক স্তব্ধ হয়ে ওঠে।
ঠিক তখন একটা বুক ছেঁড়া কান্নার শব্দ শুনি।অনেকবার শুনি।গফুরের ছোট মেয়ের নিটোল পা দুটো বাতাসে কীভাবে দুলছিলো সেই গল্প শুনি।ফাতেমার হিম পায়ে নুপূরের হিমশব্দ শুনি।অনেকবার শুনি।
কে কাঁদছিলো? কার এত কান্না?
কড়ই গাছে একবার মাথা রেখে চলে গেছে তারপর।
সবকিছু চলে গেছে।সকলেই।অথচ একটা একা গাছ, একটা বিশ^স্ত অপরিবর্তনীয় শেকড় কেবল শূন্য মাঠ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বসন্তে মৃত এক নারীর গল্পে একটা দগ্ধ লাশের স্মৃতি ভেসে উঠতো বারবার। অনেক শেষ স্নানের পর তার নিজস্ব স্নান সময়ে কেউ জানতে চায় নি সেইসব লাশ কিংবা তার নিজের কোনো স্বপ্ন ছিলো কি না।স্বপ্ন দেখতে গিয়ে অনেকগুলো মানুষ বাঁচবে বলে চিৎকার করে উঠে কেমন সহজভাবে সংখ্যা হয়ে গেছে যাদের কোনো নাম নেই। নাম নেই বলে শুধু গল্প হয়ে আছে তারাও।কড়ই গাছের গল্প। স্বপ্নের খাবার জোটাতে মরে গেছে মানুষ সব।বহুকাল, বহু বিশুষ্ক দীর্ঘ বর্ষ পরে ঘর ছেড়ে বিকেলের আযানে ছায়ার নীচ দিয়ে চুপচাপ চলে গেছে বসন্তমৃতা।গভীর রাতে দেখি সেইসব একেকটা মৃত্যু হয়ে ভিজে আছে ঘাস।গভীর রাতে দেখি আকাশজুড়ে দেয়াল। দেয়ালের পিছে পিশাচের মতো ঘুম।
রোজ নাম বদলায় নদীর, রঙ বদলায়, রূপ বদলায়।ঠিকানা বদলে যায় ঘুমের।সেইসব ঘুমের ঠিকানা মনে রাখতে রাখতে নিজের নাম ভুলে যায় ডাকপিয়ন।একদিন বাড়ি ফিরতে না পেরে অজস্র চিঠি নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে। শেকড়ে খবর আসে মাছরাঙার চর থেকে অনেকগুলো নতুন পাখি উড়ে গেছে।তাদেরকে দেখতে চিঠির মতো মনে হয়।
হাজার বছর ধরে মৃত্যুও দিকে যেতে থাকার অনিবার্য পদাবলী শুনে এই শেকড়ের স্থিরতাকে ভাবি অবিনশ্বর। এই কড়ই গাছকে ভাবি ধ্রুব সত্য।
আশ্বস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি শেষ তক্ষকের ডাকে। ঘুমিয়ে পড়ে রাত, ঘুমিয়ে পড়ে ভেজা ঘাস, ফাতেমার নুপূর।
সময় ঘুমিয়ে পড়ে বিশ্বাস ঘুম।
অথচ সকাল হতে দেরী হয় না।আলো হাতেই ভাঙে ঘুম।ঘুমের ভাঙা টুকরো হাতে নিয়ে দেখি মাঠের ঘাস খয়েরী হয়ে আছে।
ভাঙা ঘুমে পা কেটে দেখি মাঠের সীমানা প্রাচীরের কিম্ভুত জন্ম।
আমি সূঁচের মতো হাতড়ে খুঁজতে গিয়ে ভীষণ শক্ত অবিশ্বাসে চিৎকার করে উঠি “এখানে একটা কড়ই গাছ থাকে।”
যন্ত্রের দ্রুততায় আমার দিকে অনেকগুলো তীর ছুটে আসে শুধু।তীরের দ্রুততায় ছুটে আসে সভ্য চাকার দল।চাকা মাথায় নিয়ে কিলবিল করা মানুষ কখনও কড়ই গাছ বোঝেনা।
চাকার পথমাত্র হয়ে উঠি আরও নতুন ক্লান্ত মৃত্যুর দিকে।
নুসরাত জাহান রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, বদল অথবা অবিশ্বাসের ক্লান্তি