গদ্য সংস্কৃত ভাষা কি বাংলার জননী?

জননী শব্দটি দিয়ে সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়। ভাষার ক্ষেত্রে সংস্কৃতের সঙ্গে সম্পর্ক তখনই মার খেয়ে যায় যখন সংস্কৃত হল মৃত ভাষা, আর বাংলা হল জীবন্ত ভাষা। শিশুরা মায়ের মুখ থেকে বাংলা শুনে শেখে। জীবিত ভাষা কখনও মৃত ভাষার সন্তান হয় না, তেমনি বিপরীতে মৃত ভাষার পক্ষেও সম্ভব না জীবিত ভাষার জননী হওয়া।

 

বৈদিক ভাষা হল বেদের ভাষা। বৈদিক = বেদ + ইক৷ সেসময় মনে করা হত বেদ হল দেবতা প্রদত্ত। বেদকে শ্রুতিও বলা হয়, শুনে শুনে মনে রাখা হত বলে।

 

কালের প্রবাহে এটিতে বিকৃতি দেখা যাচ্ছিল। মুখের ভাষামাত্রই বিকৃত হয়। দেবতা প্রদত্ত ভাষার বিকৃতির রোধে তখন বৈয়াকরণগণ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শব্দ, ভাষা ছেঁকে, সংস্কার করে একটি প্রমিত ভাষা তৈরি করেন। এটিই হল সংস্কৃত ভাষা। সংস্কার থেকেই নাম সংস্কৃত। বহু বিখ্যাত বৈয়াকরণের শ্রমে এর নির্মিতি হয়েছে। যাস্ক, পাণিনি, কাত্যায়ন, পতঞ্জলি-সহ বহু মনীষী কাজ করেছেন। খিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৮০০ সালের মধ্যে একসময় মহামনীষী পাণিনির জন্ম। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ গ্রন্থে সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্রসমূহ লিপিবদ্ধ করেন।

 

সংস্কৃত ভাষায় শুধু লেখার জন্য ব্যবহৃত হত। সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থ লেখা হত। মানুষ কথা বলত না বলে জন্ম থেকেই সংস্কৃত মৃত ভাষা।

 

এদিকে বৈদিক ভাষা ও অন্যান্য ভাষা মানুষের মুখে মুখে চলছিল। মানুষের মুখের ভাষা জীবন্ত ভাষা, আর জীবন্ত ভাষাই সময়ের স্রোতে পরিবর্তিত হয়। পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ অবহঠট পেরিয়ে বা শ্রেণিকরণ করে বলা যায় প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা, মধ্যভারতীয় আর্যভাষা ও নব্যভারতীয় আর্য ভাষাযুগ পেরিয়ে কালের প্রবাহে আজকের বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, পাঞ্জাবি ভাষাসমূহের সৃষ্টি।

 

সংস্কৃত ভাষাটি এর আগে বৈদিক ভাষা-সহ এখানকার অন্য ভাষাগুলোর (দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও অন্যান্য) শব্দ নিয়ে, সংস্কার করে এবং যথাযথ ব্যাকরণ নির্মিতির মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কথা না বললে সেটি মৃত ভাষাই থাকে।

 

আমি বিষয়টিকে একটি উদাহরণের মাধ্যমে দেখাতে চাই—

উপমহাদেশের প্রথম সিনেমা হল ১৯১৩ সালের ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, প্রথম বাংলা সিনেমা ১৯১৯ সালের ‘বিল্বমঙ্গল’।

 

১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ আর্টফিল্ম হিসেবে বড়ো ধরনের খ্যাতি পায় সর্বত্র। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন এবং এই সিনেমা থেকে পরবর্তীকালের বাংলা সিনেমার পরিচালকরা ক্লাসিক সিনেমা উপহার দেওয়ার অনুপ্রেরণা পান। কিন্তু বাংলা সিনেমার জননী বলা যায় না এই মুভিটিকে।

 

সংস্কৃত ভাষাটিও এই উপমহাদেশে ভাষার যে ধারাবাহিকতা তাতে একটি সুনির্মিত ভাষা। এর ব্যাকরণ কাজে লাগছে, এটির অবদান অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু বাংলার জননীর ভূমিকায় বসিয়ে দিলে সংগত কারণেই সবাই মানতে পারেন না।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য, সংস্কৃত ভাষা কি বাংলার জননী? — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *