গল্প তিনার আঁকা ষাঁড়ের ছবি

তিনা তা’র আম্মুকে বলল, জান আম্মু, আমার খাতায় আঁকা ঐ লালরঙের ষাঁড়টা, আমাকে দেখলেই শিং দিয়ে গুঁতা মারার জন্য ফোঁসফোঁস করে তেড়ে আসে। তাই আমি দড়ী দিয়ে কষে বেঁধে রেখেছি। তা না হলে দুষ্টু ষাঁড়টা আমাকে মাথায় তুলে আছাড় দিত। আমি নাকি ওকে ঠিকমত আঁকতে পারিনি। তাই ও আমার প্রতি রেগে আছে। আমি ভাইয়াকে বলেছিলাম। ভাইয়া আমার কথা শুনে বলল, ছবির ষাঁড় আবার কাউকে গুঁতা মারে নাকি? ভাইয়া তো আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করে না!

তিনার আম্মু বলল, আমি ষাঁড়টাকে বকে দেব। সে যেন আর তোমাকে ভয় না দেখায়।

তিনা বলল, ঠিক আছে আম্মু। ষাঁড়টা খুব দুষ্টু। সে নাকি লালপোশাক দেখলেই ঢুঁশ মারার জন্য তেড়ে আসে। আচ্ছা আম্মু, বাংলা বর্ণমালা থেকে যদি শ, ষ, স তুলে দিয়ে শুধুমাত্র একটি রাখা হয় তাহলে ষাঁড় বানান কীভাবে লিখব?

তিনার কথা শুনে তার আম্মু বুঝতে পারল, তিনা এখন ‘শ’ ‘ষ’ ও ‘স’ নিয়ে কথা বলতে চায়। তাই তিনি বললেন, যে কোন শব্দের বানান ‘শ’ ‘ষ’ ও ‘স’ থেকে যে কোন একটা দিয়ে লিখলেই যে শুদ্ধ হবে তা কিন্তু নয়। এই বাংলা বর্ণগুলা শুধু বানান আর উচ্চারণের জন্য নয়, এরা অর্থকেও ধারণ করে। তোমাকে ‘শ’ ‘ষ’ ও ‘স’ সম্পর্কে একটা ছোট্ট ধারণা দেব। তুমি শিখে রাখলে বুঝতে পারবে কেন আমাদের ‘শ’ ‘ষ’ ও ‘স’ এই তিনটা বর্ণ দরকার। একটাও কম হলে চলবে না। ‘শ’ ‘ষ’ ও ‘স’ — এই তিনটার শক্তি প্রকাশের পার্থক্য আছে। শ-তে শক্তিযোজন বোঝায়। যদি শক্তি যা সূর্য্যের আলোর মত চতুর্দ্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এমন বোঝায় তবে তাকে ‘শ’ দিয়ে ব্যক্ত করতে হবে। আর যদি কোন অবস্থা থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়ে একদিকে ছুটে যায় বা বিচ্ছুরিত হয় তাহলে তাকে আমরা ‘ষ’ দিয়ে ব্যক্ত করব। কারণ ষ-তে দিশাগ্রস্ত শক্তিযোজন বোঝায়। আর স-তে একরৈখিক শক্তিযোজন বোঝায়। সুতরাং শক্তিবিচ্ছুরণের শেষাবস্থা অর্থাৎ খুব সরু বা চিকণ হয়ে যায় যে শক্তি তাকে আমরা ‘স’ দিয়ে ব্যক্ত করব।

তিনা বলল, আম্মু আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। একরৈখিক শক্তিযোজন মানে কী, আম্মু?

 

শিল্পী: অপরূপ দে

 

তিনার আম্মু বলল, একটা বিন্দু থেকে সৃষ্ট হয়ে একটা রেখা যেমন চিকণ বা সরু হয়ে অগ্রসর হয় ঠিক তেমনই খুব সামান্য শক্তি যেখানে যুক্ত থাকে বা যুক্ত করা হয় বা যোজন করা হয় তাকে একরৈখিক শক্তিযোজন বলে।
আচ্ছা, তুমি কি শজারু দেখছ?

তিনা বলল, আমি ছবিতে দেখেছি।

তিনার আম্মু বলল, শজারুর কাঁটা সব দিকে দাঁড়িয়ে যায় বা ছড়িয়ে পড়ে বলে আমরা শজারু বানান সজারু না লিখে শজারুই লিখে থাকি। ঐ যে বললাম, চতুর্দ্দিকে বিচ্ছুরিত হয় যে শক্তি তাই-ই আমাদের ‘শ’। তুমি লক্ষ্য করে থাকবে, মেঘ থেকে যখন বৃষ্টি হয় তখন কিন্তু একটা স্থান থেকে ঝর্ণার মতো ঝরে পড়ে। অথবা যখন বর্ষা নামে তখনও এমনভাবেই বৃষ্টি হতে থাকে। তাই বর্ষা বা বৃষ্টি বানানে আমরা ‘ষ’ ব্যবহার করি। বৃষ্টিকে বৃস্টি লিখলে মনে হবে বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে। ঐ যে, বলেছি, যে শক্তি একদিকে বিচ্ছুরিত হয় তাকেই আমরা ‘ষ’ দিয়ে বুঝিয়ে থাকি। তাছাড়া কোন শক্তিবিচ্ছুরণের শেষ অবস্থা তো অবশ্যই চিকণ বা সরু হয়ে থাকে। আর সেই শেষাবস্থার ধারণাকে ধারণ করে বানান লিখতে হলে আমরা ‘স’ ব্যাবহার করব। তুমি বলেছিলে, ষাঁটটাকে দড়ী দিয়ে কষে বেঁধে রেখেছ। যদি কসে বাঁধ তবে কিন্তু দড়ীটা খুব সরু হওয়াতে ছিড়ে যাবে। কারণ ‘স’-টা খুবই সরু। তাই সরু বানানটা শরু লিখলে ভুল হবে। শিং বানানে কেন শ দেওয়া হয় তা তো তুমি বুঝতেই পারছো। ষাঁড়ের শিংয়ে কিন্তু অনেক শক্তি।

সাপ বানান যদি শাপ লেখ তাহলে মনে হবে শাপটা কদমফুলের মত বা সূর্য্যের আলোর মত কোনকিছু একটা হবে। আর ষাপ লিখলে মনে হবে এটা একদিকেই কেবল ছুটে যাচ্ছে। সামনে বা পিছনে এগুতে পারে না। তাই ‘স’ দিয়ে লিখে বুঝানো হয় এটা একটা সরু প্রাণী। একই কারণে ফোঁসফোঁস শব্দে ‘স’ ব্যবহার করা হয়। তুলসী বানানে তুলষী বা তুলশী লেখা হয় না কারণ তুলসী মানে যেখানে তুলনা শেষ হয়ে যায়।

তিনা বলল, আম্মু, আমি তো মনে করতাম, শুধু উচ্চারণের পার্থক্যের কারণেই আমাদের শ ষ ও স দরকার। এখন তো দেখছি এই শ ষ ও স এর শব্দগঠনের ক্ষেত্রেও অসামান্য ভূমিকা রয়েছে।

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের বর্ণমালার প্রত্যেকটা বর্ণ সতত জীবন্ত। প্রতিটা বর্ণ শুধু উচ্চারণ নয় অর্থের-ও ধারক। এদের কোন একটিও বাদ দেওয়া যাবে না। কেউ যদি না জেনে না বুঝে তাদেরকে বাদ দেওয়ার কথা বলে, আমরা তাকে বিনয়ের সাথে বুঝানোর চেষ্টা করব। তারা তাদের অবস্থা বুঝতে পারলে অবশ্যই লজ্জিত হবে।

তিনা ‘শ’ ‘ষ’ ও ‘স’ এই তিনটা বর্ণের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ বুঝতে পেরে খুবই খুশি হয়। …

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, তিনার আঁকা ষাঁড়ের ছবি — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *