এই দেশের সিংহভাগ আলেমশ্রেণী ইসলামী সংস্কৃতিকে বিদ’আত বলে যতৈ দূরে ঠেলে দিচ্ছে পশ্চিমা অপসংস্কৃতির আগ্ৰাসন ততৈ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংস্কৃতিহীন কোন জাতি বাঁচিতে পারে না। আর বছরে দুই ঈদ দিয়ে সংস্কৃতির অভাব পূরণ করিতে বলা নিছক বোকামি বৈ’ ত কিছুই নয়।
দেখুন, এই দেশের ছাত্ররা আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার দিনে স্থানীয় হুজুরদের দাওয়াত দিয়ে মিলাত মাহফিলের আয়োজন করিত। বিদায় ভাষণে ছাত্র শিক্ষকদের চোখের পাণি নাকের পাণি এক হয়ে ঝরিত! কি দারুণ মূহুর্ত্ত। আজীবন মস্তিষ্কে দাগ কাটার মত। কিন্তু এ’ক্ষ’ণ কী হচ্ছে? পশ্চিমা ষ্টাইলে সাদা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে অবাধে ডান্স, মেয়েদের বুকে হাতাহাতি, নানান অশালীন অঙ্গিভঙ্গী, টি-শার্টে অরুচিকর মন্তব্য! সব মিলিয়ে রীতিমত মদের বার!
আমি অবশ্যৈ এই সবের বিরোধী। আমরা যদি অপসংস্কৃতির আগ্ৰাসন রুখিতে না পারি তাহা হৈলে সাম্রাজ্যবাদের আগ্ৰাসন রুখিব কী ভাবে? একটা রাষ্ট্র যদি অন্য কোন রাষ্ট্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার করিতে চায় তাহা হৈলে সর্ব্ব প্রথম সৈই দেশে সংস্কৃতি চালান করে। একটা দেশের জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য অথবা শোষণ করার জন্য সাংস্কৃতিক বিনিময়ের থেকে উত্তম কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে ভারতের এত প্রভাবের পিছনে যেইটা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার সেইটা হচ্ছে দুই দেশের প্রায় অভিন্ন সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি নদির মত বহমান। সংস্কৃতিকে আমরা চেষ্টা করিলেও খাঁটী রাখিতে পারিব না। একদেশের সংস্কৃতির সাথে অন্যদেশের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিবেই। আমরা যদি পশ্চিমাদের সংস্কৃতি বা ধ্যান ধারণার সার উপাদানগুলি আয়ত্ত করিতে পারি তাহা হৈলে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হৈবে। কিন্তু আমরা কী করিতেছি? পশ্চিমাদের আধিপত্য, উন্নতি, ধর্ম্মহীনতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাহাদের মত ভান ধরিতে পারাটাকে বিশাল কিছু বলে ধরে নিচ্ছি। যাহা হীনমন্যতা ছাড়া কিছুই নয়।
সংস্কৃতির সাথে ধর্ম্মের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সংস্কৃতি থেকে ধর্ম্মকে আলাদা করিলে না থাকে ধর্ম্ম না থাকে সংস্কৃতি! ইসলাম ধর্ম্মের ভৌগলিক উৎপত্তি আরবে। আর যেইহেতু ধর্ম্মের সাথে সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সেইহেতু ইসলাম ধর্ম্মের সাথে আরব্য সংস্কৃতির একটা সংমিশ্রণ ঘটেছে। অবশ্য যেইসব সংস্কৃতি ইসলাম ধর্ম্মের মৌলিকতার সাথে সাংঘর্ষিক সেইগুলি পরিহার করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম্ম যেইহেতু শুধু আরবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি সেইহেতু সে যেইখানেই গিয়েছে আরব্য সংস্কৃতিকে সাথে করে নিয়ে গেছে।
আর এইখানেই একটা বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। কোন দেশের ধর্ম্ম প্রচারকগণ একগুঁয়েমি করে আরব্য সংস্কৃতির সাথে নিজ দেশের সংস্কৃতির আপোষকে গোমরাহির কাজ বলে গণ্য করেছেন। এই একগুঁয়ে ব্যক্তিগণ বোধহয় আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেই বেশী ছিল। আবার তৎকালীন তুর্কী অঞ্চলের ধর্ম্ম প্রচারকগণ আরব্য সংস্কৃতির সাথে স্বীয় সংস্কৃতির আপোষ করতে পেরেছিল। আর এর ফলেই হয় ত তুর্কিরা ইসলামের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশিতে পেরেছিল। যাহার চুড়ান্ত ফলাফল হিসাবে তাহারা আটশ বছর খিলাফতের নেতৃত্ব পায়।
সংস্কৃতি একটা জাতির আইডেণ্টিফাই নির্দ্ধারণ করে। আমরা বাঙ্গালী কিংবা বাঙ্গালী মুসলমান, হাযার হাযার বছর ধরে বাঙ্গালায় বসবাস করিতেছি। আমাদের দেশের ধর্ম্ম প্রচারকগণ এই দেশের ভৌগলিক সংস্কৃতির সাথে আপোষ করিতে কক্ষণোই আগ্ৰহ দেখায়নি। শুধু তাহাই নয় আরব্য সংস্কৃতিকে পূজাতুল্য মনে করে আজীবন তাহা ছড়িয়ে দেওয়ার বাসনা নিয়ে কাজ করেছে। আর ভৌগোলিক সংস্কৃতিকে হয় ত হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি নয় ত বিদ’আত বলে পাশ কাটিয়ে গেছে।
তাহারা বুঝিতে পারেনি স্বীয় দেশের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে অন্য দেশের সংস্কৃতিকে আয়ত্ত্ব করা কতটা দুর্ব্বোধ্য কাজ। যাহার ফলে বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে সংস্কৃতির একটা সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ভাতের সঙ্কট আর সংস্কৃতির সঙ্কট নিয়ে জীবন চলা সম্ভব নয়। এই কারণে অজান্তেই আরব্য সংস্কৃতির সাথে এই দেশের সংস্কৃতির একটা সংমিশ্রণ হয়ে গেছে। আর এই বিষয়টা আলেম ওলামাদেরেও নজর এড়ায়নি। তাহারা এইসবকে সর্ব্বদা হারাম বলে ফতোয়া দিয়ে বেড়িয়েছে। বর্ত্তমান আলেম-ওলামারাও তাহার ব্যতিক্রম নয়।
পশ্চিমা অপসংস্কৃতির এই আগ্ৰাসনের সময় যদি ধর্ম্মের সাথে এই দেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণকে সাপোর্ট না করে আগের মতৈ বিরোধিতা করে সংস্কৃতিহীন করে রাখার অপপ্রয়াস জারি রাখা হয় তাহা হৈলে শুধু এমন বিদায় অনুষ্ঠান নয় ভবিষ্যতে আরো অনেককিছুই দেখার প্রস্তুতি নিয়ে রাখিতে হৈবে। এইসব যদি দেখিতে না হয় তাহা হৈলে আসুন এইসব গাঁজাখুরি ফতোয়ার তোয়াক্কা না করে অপসংস্কৃতি রুখে দিয়ে স্বীয় সংস্কৃতির চর্চ্চা করি। …
মুরাদ হাসান রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, র্যাগ ডে এবং সংস্কৃতির সঙ্কট — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।