একটা ছোট্ট চড়াই কুটকুট করে বন খাচ্ছে, বেকারীর বন। একরাশ অবহেলায় ফেলে রাখা বাঁশ পড়ে আছে রাস্তার পাশে। বনটা অতি বিস্বাদ। তবুও ঠোকর দিচ্ছে আর দিচ্ছে। হঠাৎ পাশ ঘেষে কিছু একটা ছুটে গেল। ভয়ে উড়ে গেল চড়াই।
একটা সুন্দর সন্ধ্যা কেক উড়িয়ে ডাকল চড়াইটাকে। ভয়ে এল না চড়াই। সন্ধ্যা তক্ষণ ভাবিতেছে, একটা সুন্দর দিনের ভাবনা। একটুকরা লালবাগকেল্লা বিস্তৃত, যাহার কোণার একটা ঘরে অপেক্ষা করিতেছে সন্ধ্যার। সুপুরুষ সন্ধ্যা ভাঙ্গতে পারে তাহার দীর্ঘ অপেক্ষার অনশন। চড়াইকে মনে মনে বলল, ওর মন খারাপ। ওকে বল খুব শীঘ্রৈ আসছি। লোহার আর্গল সরিয়ে চুপি চুপি বের করিব তাহাকে কেল্লার শূন্য মাঠে। দোতারা বাজিবে, করতাল নাচিবে সেই বসন্তে।
চড়াই উড়ে এল। কুটকুট করে খেতে লাগল বেকারীর কেকটা। একটু ভাল স্বাদ! তোফা খুব! এই একঘেয়ে নগরীর বুকে এর ভাল আর কী আছে। এইসময় চড়াই সন্ধ্যার কথা শুনিল। চড়াই তাই আবার কান পাতে। সে আবার শুনিতে পায় সন্ধ্যার মনে মনে বিড়বিড় করা, দেখবি তাহার ত্বক উজ্জ্বল। একটা চকচকে বর্ষার নদী যেন সে। হাযার অন্ধকারে কি ছোট্ট উজ্জ্বল! চোখ দেখবি দাউদনগরের টলমল করা প্রেম। পায়ে রক্তের মত লাল আলতা। তুই আমার কথা বললেই ছট্ ফট্ করে উঠিবে সে। নেচে উঠিবে আলো!
চড়াই উড়তে শুরু করে। কিন্তু অল্পটা গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যায়। আবার উড়ে, আবার ক্লান্ত হয়। হঠাৎ সামনে পরে বিরাট পাহাড়। ওরে বাবা। ছোট্ট চড়াই যাবে কিভাবে! ভেবে কেঁদে আকুল হয় সে। তাকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে আসে একজোড়া ভাল ভাগ্যের শালিক। শালিক জোড়া এসে জানতে চায় চড়ুইয়ের অশ্রু বিসর্জনের কারণ। চড়ুই বলে, সুপুরুষ সন্ধ্যা বলেছে বন্দী একটা সকালের কথা। তাহাকে দেখতে যাচ্ছিলাম। তিনদিন পরে এলাম এই পর্য্যন্ত! এক্ষণ এত পাহাড় কিভাবে পার হব বল ত! আমি ত ছোট্ট। সন্ধ্যার খবর কিভাবে নেব সকালের কাছে?
শালিক জোড়া চিনতে পারে সন্ধ্যাকে। প্রায় এই পাহাড়ে এসে গানে গানে বিস্বাদ আনে এই ছোট্ট জঙ্গলে। সে এলেই সব পাখীরা নীড়ে ফিরে। কিচ্ মিচ্ করে সারাদিনের খবর বলে সন্ধ্যাকে। তারপর সন্ধ্যা বাতাসে চাদর টানে গানঘুমের। তাহার ঘুমের গানে কোনো দুঃস্বপ্ন ছুঁতে পারে না পাখীদের।
শালিকজোড়া জেনে নেয় সন্ধ্যার বার্ত্তা। তারপর বাতাসে বাউলি কেটে কেটে পাড় হতে থাকে জঙ্গল। পথে একজোড়া শিকারীকে দেখে বন্দুক হাতে। আরেকটু দূরে বয়স্ক শূয়ার তক্ষণ আরাম করে বসে আছে। শালিকজোড়া উড়তে উড়তে ডাক দেয়, পালাও পালাও। গুরুম আসছে ওই দূরে। শূয়ার দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ঘোৎ করে উঠে, কোথায় যাচ্ছো। বৌ শালিক বলে, জঙ্গলের শেষ মাথায়। সন্ধ্যার বার্ত্তা আছে লালবাগকেল্লায় যাওয়ার। শূয়ার তক্ষণ বলে, আমি শর্টকাট জানি, চল আমার সাথে। নীচে শূয়ার পথ দেখায়, ওপরে উড়তে থাকে শালিক। এইভাবে সন্ধ্যার বার্ত্তা চলিতে থাকে লালবাগ কেল্লার পথে।
সন্ধ্যা তক্ষণ খুঁজছে এক পাগলের ঠিকানা। নগরে সেই কবে থেকে লুকিয়ে আছে পাগল। কি অস্থির! কি অস্থির! সন্ধ্যা যাহাকে খুঁজে, তাহাকে পেলেই জানিতে পারিবে লালবাগের রহস্য। সেই কবে মোগল আমলে তৈরি হয়েছিল অর্দ্ধসমাপ্ত ধাঁধা। এর সমাধান জানে একমাত্র পাগল। তাই পাগলকে দরকার, নয় ত সন্ধাও আটকে যাবে ওই একৈ কক্ষে।
শালিক সবে শূয়ারকে বিদায় দিয়ে এসে হাপাচ্ছে জঙ্গলের শেষ সীমানায়। সুন্দর শালিক ডেকে ওঠে, মধুদা! মধু নামের জোয়ান ঈগলটা পাখা ছড়িয়ে নেমে আসে জঙ্গলের ধারে। বৌ শালিক বলে, লালবাগকেল্লায় খবর নিতে হৈবে। মধুদা বলে, কাহার খবর। সুন্দর শালিক বলে, সুপুরুষ সন্ধ্যার খবর আছে সকালের জন্য। মধুদার মনে পরে সন্ধ্যার কথা। অভাবের দিনে বাজার থেকে মাংস কিনে রেখে যেত গাছের তলায়। তক্ষুণি মধু’দা উড়ে চলে নীল আকাশে। উড়তে উড়তে একবেলাতেই পার করে যায় পাহাড়তলী, ফেনী, গিজগিজে ইণ্ড্রাস্ট্রী, সভ্যতার পোড়া গন্ধ! উড়তে উড়তে মেঘের ওপর থেকে খুঁজতে খুঁজতে যায় চিলদের। মধুর একনাম্বার শত্রু। ভুবনচিলদের যা একটু পছন্দ করে সে। তাহাকে শ্রদ্ধা করে এই ভুবনচিলরা। আদবের সাথে কথা বলে।
মেঘের নীচে একটা একলা ভুবন চিল খেয়াল করে মধু’দার সোনালী পালকের শরীর। সুপুরুষ মধু’দা একা একা উড়ছে। ভুবনচিল তাহার সঙ্গ ধরে।
ও মধু’দা, কই যাও?
লালবাগকেল্লা। দ্রুত যেতে হৈবে। সুপুরুষ সন্ধ্যার খবর আছে সকালের জন্য।
ও-বা-বা, সে ত অনেক পথ বাকি এক্ষণো।
কিন্তু তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। সন্ধ্যা যেকোন সময় রওনা দেবে। তাহার আগেই যেতে হৈবে।
ওই দেখ একটা দুর্ধর্ষ কাল মেঘ উড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি নিয়ে। এক্ষুণিই ছুটবে। তাহাকে বলে দাও, খুব দ্রুতৈ সে পৌঁছে যাবে খবর নিয়ে।
সন্ধ্যা খুঁজে পেয়েছে পাগলকে। পাগল টুনু নাম নিয়ে লুকিয়েছে কাঠগড়ের এক আধো অন্ধকার বাসাতে। যেখানে জন্ম নিতে অপেক্ষা করছে এক দূরন্ত ছেলে। যে একদিন এই পৃথিবীতে সন্ধ্যা আর সকালের মিলনে জয়ের গান ধরিবে। ওই জয় বয়ে নিয়ে চলে এক পাগলের গল্প যা কিনা দেয়াল চাপা পরেছে। টুনু প্রাচীন নিয়মে নেচেকুঁদে অভিবাদন জানায় সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যা বলে, টুনু ধাঁধার সমাধান দাও। নয় ত এই ঘরের মানিক জয়ের গান ফেরি করিতে পারিবে না। টুনু শুরু করে প্রাচীন লালবাগকেল্লার শুরুর গল্প। বলে দেয় ধাঁধার সমাধান। আর সন্ধ্যাকে দেয় সকালের গায়ের গন্ধ।
কাল মেঘ সন্ধ্যার আগেই উড়ে চলে আসে লালবাগকেল্লার আকাশে। তুমুল বর্ষণের সাথে জানিয়ে দেয় সুপুরুষ সন্ধ্যার খবর। সন্ধ্যা আসছে সকালের কাছে। সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। তক্ষণি আলো জ্বলে ওঠে লালবাগের ওই কক্ষে। কয়েকজন্মের অপেক্ষার অবসান হৈল। সন্ধ্যার আর সকালের আলোতে জন্ম নিল অন্যরকম সুন্দর একটা সময়। পাখীরা নীড়ে ফেরে। গরুর পাল ধূলি উড়িয়ে ফেরে গোশালে। লোকে তাহার নাম দিয়েছিলো গোধূলী।
ঈশান বড়ুয়া রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, গোধূলী জন্মের উপকথা — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।