‘ভ’ বর্ণের অর্থ ভাতি যুক্ত যে অর্থাৎ যে সত্তা অস্তিত্বলাভ করে দীপ্তমান।

ভ-এর আধার— ‘ভা’
ভা-এর দিশাগ্রস্থ বিচ্ছুরণ— ‘ভাষ’
ভাষ-এর আধার— ‘ভাষা’

অর্থাৎ যে কোনো শোভমান সত্তা নিজেকে যে সব শব্দ, রস, রূপ বা গন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করে তাকেই তার ভাষা বলা যায়। তাই পাখীর ডাক তার নিজস্ব ভাষা, ফুলের রূপ ও গন্ধ তার ভাষা, গাছের পাতার মর্ম্মরধ্বনি তার ভাষা, এমন কি পাহাড়ের পাথর গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ তার ভাষা, সে আমরা বুঝি আর না বুঝি।

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভরত মুনি তার ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থে মনুষ্য ভাষার সংজ্ঞা ও রূপ নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গেছেন। নাট্যশাস্ত্র মতে ভাষা চার রূপের এবং তার দুই ধরনের পাঠ।

চার রূপের ভাষা হচ্ছে— অভি ভাষা, আর্য্য ভাষা, জাতি ভাষা ও জাত্যন্তরী ভাষা। আর ভাষার দুই রকম পাঠ হল— সংস্কৃত ও প্রাকৃত।

তাই নাট্যশাস্ত্র মতে সংস্কৃত আসলে ভাষা নয়, এটা ভাষা পাঠের একটি অতি উচ্চমার্গীয় পদ্ধতি যা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে বহুল প্রচলিত। আর প্রাকৃত হল আমজনতার ভাষা পাঠের অলিখিত পদ্ধতি।

৩০০০-৪০০০ বছর আগে ভারতবর্ষে যে সকলে মোটামুটি একই ভাষায় কথা বলত এ নিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর “বুদ্ধদেব কোন্ ভাষায় বক্তৃতা করিতেন” প্রবন্ধ হতে উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ উপরোক্ত এই আলোচনার অবতারণা করেছেন। নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থ অবলম্বনে ভাষার বিভিন্ন রূপ নিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে বিবরণ-বিশ্লেষণ করেছেন, নীচে তার সামান্য অংশ তুলে ধরা হল।

“ভাষা চতুর্ব্বিধা জ্ঞেয়া দশরূপে প্রয়োগতঃ।
সংস্কৃতং প্রাকৃতং চৈব তত্র পাঠ্যং প্রযুজ্যতে॥”

অর্থাৎ ভাষার চারটি রূপ এবং সংস্কৃত ও প্রাকৃত হল ভাষার দুই রকম পাঠ পদ্ধতি।
ভাষার চারটি রূপ কী কী—

“অভিভাষার্য্যভাষা চ জাতিভাষা তথৈব চ।
তথা জাত্যন্তরী ভাষা নাট্যে প্রকীত্তির্তা॥”

অর্থাৎ ভাষার চারটি রূপ হল— অভি ভাষা, আর্য্য ভাষা, জাতি ভাষা ও জাত্যন্তরী ভাষা যা নাটকে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ভাষার এই চার রূপের সংজ্ঞা—

“অভিভাষা তু দেবানাং”
“আর্য্যভাষা তু ভূভুজাম”
“সংস্কৃতপাঠসংযুক্তা সম্যক গ্রামপ্রতিষ্ঠিতা।”

অর্থাৎ অভিভাষা হল সমাজের উচ্চাসনের লোকের ভাষা যা কাব্যাদিতে সমৃদ্ধ হয়ে জ্ঞানচর্চ্চার উপযোগী। আর আর্য্যভাষা হল সমাজের শিক্ষিত ভদ্রসমাজে প্রচলিত ভাষা। এই দুই ভাষার পাঠ মূলত সংস্কৃতেই বেশী হয়।
জাতি ভাষা ও জাত্যন্তরী ভাষার লক্ষণ কী—

“জাতিভাষাশ্রয়ং পাঠ্যং দ্বিবিধং সমুদাহৃতং।
সংস্কৃতং প্রাকৃতঞ্চব চতুর্ব্বণ্যসমাশ্রয়ম॥”
“অথ জাত্যন্তরী ভাষা গ্রামারণ্যপশূদ্ভবা।
নানাবিহঙ্গজা চৈব নাট্যধর্ম্মিপ্রয়োগজা॥”

অর্থাৎ জাতি ও জাত্যন্তরী ভাষা সাধারণ জনারণ্যে প্রচলিত, চার বর্ণেরই মানুষের মাঝে ব্যবহৃত এবং এদেরও সংস্কৃত ও প্রাকৃত পাঠ আছে এবং নাট্যে এদেরও প্রয়াগ হয়।।

২৫০০ বছর আগে লিখিত নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে বর্ণিত ভাষার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে ভাষাবিদ কলিম খান বলছেন যে আদি মানবের একটিই ভাষা ছিল যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে প্রয়োগ হত (অর্থাৎ যদিও ভাষা ছিল একই, সমাজের উচ্চস্তরের ভাষায় সংস্কৃত পাঠ ছিল তুলনামূলকভাবে বেশী আর সমাজের নিম্নস্তরে প্রাকৃত পাঠ ছিল তুলনামূলকভাবে বেশী)। আদি ধনতন্ত্রের আবির্ভাবের প্রাক্কালে যখন আদিম যৌথসমাজ ভেঙ্গে গিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী, উপগোষ্ঠিতে পরিণত হচ্ছিল, তখন ভাষাও তার একক সাতন্ত্র্য হারিয়ে বিভিন্ন প্রতীকি ভাষায় পরিণত হচ্ছিল।

তাই অনুমান করা যায় যে আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে বাংলা, মিথিলা (বিহার), আসাম ও উড়িষ্যার মানুষের একই ভাষা ছিল! ২৫০০ বছর আগে দক্ষিণভারত বাদে বাকিসব অঞ্চলের ভাষা ছিল একই!! ৫০০০-৭০০০ বছর আগে সমগ্র ভারতবর্ষ ও পার্শ্ববর্ত্তী এলাকার মানুষের ভাষা ছিল একই!!! এবং তারও আগে তৎকালীন সমগ্র পৃথিবীর মানুষের ভাষাও ছিল একই!!!!

তথ্যসুত্র— বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য, ভ থেকে ভাষা — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *