হিজিবিজি পাঠ-পর্য্যালোচনা: ইলিয়াস ও প্রশ্নের শক্তি

লেখক পরিচিতি: আনু মুহাম্মদ। জন্ম ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬; গোপীনাথপুর, জামালপুর। বসবাস ঢাকায়। ১৯৮২ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি একি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগেও একদশকের বেশী সময় শিক্ষকতা করছেন। সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র বিষয়ক জার্নাল ‘সর্বজনকথা’র সম্পাদক।

 

পাঠ-পর্য্যালোচনা:
আনু মুহাম্মদ রচিত ক্রিটিক্যাল প্রবন্ধগ্রন্থ ‘ইলিয়াস ও প্রশ্নের শক্তি’। গ্রন্থে স্থান পাওয়া প্রবন্ধগুলি দেশের কাছাকাছি সময়ের কয়েকজন সৃজনশীল মানুষকে কেন্দ্র করে, যাহারা বিদ্যমান আধিপত্যবাদী ব্যবস্থা, চিন্তা, দর্শন, সমাজ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নিজস্ব ভূমিকা পালন করেছেন। গ্রন্থটির প্রধান চরিত্র আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। একি সাথে তাঁর সময়ের অগ্রজ ও অনুজ আখলাকুর রহমান, হুমায়ুন আজাদ, বদরুদ্দীন উমর, দীপংকর চক্রবর্তী, শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, শামসুর রাহমান, শওকত আলী, তসলিমা নাসরিন, সেলিম আল দীন, আরজ আলি মাতুব্বর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মওলানা ভাসানী, আবদুশ শহীদ, অনিক, সত্য মৈত্র-সহ এমন আরো বেশ কয়েকজন মানুষের কথা ও কাজের চমৎকার আলোচনা উঠে এসেছে। সমাজে যাহাদের কাজের পর্য্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ বলে লেখক মনে করেছেন। আলোচনাগুলি শুধু ব্যক্তি নয়, প্রতিটি আলোচনা শেষে রচনাকালের উল্লেখ সেই কাল বা সময়কে উপলব্ধি করিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

মোট বারটা আলোচনা নিয়ে ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হৈলেও গ্রন্থিক সংস্করণের এই বৈটিতে/বইটিতে আরো নয়টা আলোচনার সংযুক্তিতে মোট একুশটা অসাধারণ প্রবন্ধ বা আলোচনা রয়েছে। প্রবন্ধের শিরোনামগুলি হৈল যথাক্রমে, ‘ঊনসত্তরের গনঅভ্যুত্থান এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই (সেপ্টেম্বর ১৯৮৭)’, ‘খোয়াবনামা: খোয়াবে-চেতনায় মানুষ ও সময় (ডিসেম্বর ১৯৯৬)’, ‘ইলিয়াসের উদ্বেগ, ইলিয়াসের মানুষ (আগষ্ট ১৯৯৭)’, ‘ইলিয়াসের লেখার জমিন (ফেব্রুয়ারী ২০০০)’, ‘ইলিয়াসের প্রাঙ্গন (জানুয়ারী ২০০৩)’, ‘আক্রান্ত লেখক ও জরুরী কিছু প্রশ্ন (মার্চ ২০০৪)’, ‘কারণ আমরা এই বাংলাদেশ চাই না (আগষ্ট ২০০৫)’, ‘অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফী এবং তসলিমা নাসরিন (ডিসেম্বর ২০০৩)’, ‘অসাধারণ তরুণ, আজীবন বিপ্লবী (এপ্রিল ১৯৯৯)’, ‘শামসুর রাহমান (আগষ্ট ২০০৬)’, ‘সেলিম আল দীনের সৃষ্টিকথা (মার্চ ২০০৮)’, ‘প্রশ্নের শক্তি: আরজ আলি মাতুব্বর (২০০৫)’।

গ্রন্থিক সংস্করণের সংযোজিত প্রবন্ধগুলি যথাক্রমে, ‘সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী; বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গীকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত (জুন ২০২১)’, ‘মাওলানা ভাসানীর খামোশ (নভেম্বর ২০১৩)’, ‘কমরেড আবদুশ শহীদ (মে ২০২০)’, ‘আখলাকুর রহমান: পণ্ডিত শিক্ষক (ফেব্রুয়ারী ২০১৫)’, ‘উমরের সফল জীবন (ডিসেম্বর ২০২১)’, ‘দীপংকর চক্রবর্তী এবং অনিক (২০১৪)’, ‘সত্য মৈত্র: জীবনের যোদ্ধা (মে ২০১৯)’, ‘প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্: নূতন জগতের অসামান্য কারিগর (জানুয়ারী ২০১২)’, ‘শওকত আলী ও তার সৃষ্টিকথা (ফেব্রুয়ারী ২০১৯)’।

বাংলা সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একটা উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি একজন স্বল্পপ্রজ লেখক ছিলেন। বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তাহার রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা। তাহাকে সমাজবাস্তবতার অনন্যসাধারণ রূপকার বলা হয়েছে। তাহার রচনাশৈলী স্বকীয় ও সংলাপে কথ্যভাষার ব্যবহার বাংলা কথাশিল্পে অনন্যসাধারণ। এই ব্যতিক্রমি রচনাশৈলী তাহার উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এবং ‘খোয়াবনামা’ -দুইটাকেই বিখ্যাত করে তুলেছে। ঊনসত্তরের গনঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘চিলেকোঠার সেপাই’ দেখিয়েছে, কীভাবে একজন অতিসাধারণ মানুষ-ও পারিপার্শ্বিকতার আবহে আন্দোলনে সরিক হয়। এক সাধারণ হৃদয়েও ঠিক কিভাবে মুক্তির চেতনা জাগ্রত হয়। আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে কী ভাবে গণ-অভ্যুত্থানের মোড় ঘুরে যায়। ইলিয়াসের সর্ব্বশেষ উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’-তেও খোয়াবে চেতনায় মানুষ ও সময়কে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখক এবং সমালোচক আনু মুহাম্মদ উপন্যাস দুইটার চমৎকার দুইটা আলোচনার পাশাপাশি তুলে ধরেছেন ইলিয়াসের উদ্বেগ, ইলিয়াসের লেখার জমিন এবং ইলিয়াসের প্রাঙ্গন। ইলিয়াসের সাথে আনু মুহাম্মদ তাহার ব্যক্তিগত সম্পর্কের রেশ টেনে লেখার বিভিন্ন উপাদান এবং উক্তি দিয়ে ইলিয়াস সম্পর্কে পাঠককে মোটামুটি একটা চমৎকার ধারণা দিয়েছেন। ইলিয়াস মুলতঃ মানুষকে দেখিতে চেয়েছেন। মধ্যবিত্ত মানুষ, আমাদের সমাজব্যবস্থায় যাহারা সবথেকে বেশী সংকটাপন্ন সময় অতিবাহিত করে। এই সম্পর্কে আলোচনা করিতে গিয়ে আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, “ইলিয়াসের লেখায় মধ্যবিত্তের অংশটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ ইলিয়াস মানুষ অনুসন্ধান করেছেন, তাহার জমিন ছিড়েখুঁড়ে দেখেছেন নেহায়েতেই দেখার জন্য নয়— তাহার লক্ষ্য শিল্প সৃষ্টির এবং তাহার চাইতেও বড় নূতন জমিন সৃষ্টির অসাধারণ আনন্দের কষ্টকর যাত্রাকে স্পষ্ট করবার জন্য। এই শিল্পসৃষ্টি তাহার কাছে বিপ্লবী রাজনীতি বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক। সেইজন্যে তাঁহার বিশ্লেষণের একটা সারকথা ছিল— ‘নির্বাচনের জন্য পোস্টার যথেষ্ট, কিন্তু বিপ্লবের জন্য চাই সাহিত্য’।”

মধ্যবিত্ত বিপ্লবী জীবন নিয়ে আলোচনা করিতে গিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, “মধ্যবিত্ত থেকে যে কর্মীরা বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন তাদের সাধ এবং সাধ্য, আকাঙ্ক্ষা এবং শ্রেণিগত টানাপোড়েন, অঙ্গীকার এবং দোদুল্যমানতা, সাহস এবং ভয় ইত্যাদিকে জলজ্যান্ত মানুষের ভেতর দিয়ে দেখা ইলিয়াসের বিশেষ মনোযোগের বিষয় ছিল। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশে বিপ্লবী আন্দোলনে মধ্যবিত্ত কর্মীদের সংযুক্তি এবং সম্পৃক্তি একদিকে যেমন অপরিহার্য, অন্যদিকে তেমনি সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ।”

রাজনীতিবিদদের কাছে শ্রমজীবী নারী পুরুষের অবস্থান নিয়ে আনু মুহাম্মদ ইলিয়াসের ভাষ্যে বলেছেন, “পার্লামেন্টারি রাজনীতি যারা করেন, তাদের কাছে মানুষের একমাত্র পরিচয় ভোটার হিসেবে। ছলে-বলে কৌশলে ভোটটি আদায় করতে পারলে পার্লামেন্টারি রাজনীতিবিদ চূড়ান্তভাবে সফল। আর বামপন্থী রাজনীতিবীদদের কাছে, মানে যাহাদের রাজনীতি সংসদীয় পথ থেকে ভিন্ন, জনগণের পরিচয় কী? তাদের কাছে শ্রমজীবী মানুষ হৈল ‘আন্দোলনের হাতিয়ার’।”

হুমায়ূন আজাদের ওপর ভয়ঙ্কর আক্রমণের ঘটনা আমাদের বুঝিয়ে দেয় মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতা কতবড় অচলায়তনের সামনে। একি সাথে আনু মুহাম্মদ এই ঘটনার উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে জরুরী কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের মাধ্যমে এর যথাযথ উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রই যুৎসই, এটা নিয়ে কেউ আপত্তি করবে না। আবার মতের বিরুদ্ধে মত, লেখার বিরুদ্ধে লেখা, চিন্তার বিরুদ্ধে চিন্তা, বিশ্লেষণের বিরুদ্ধে বিশ্লেষণই কেবল তৈরি করতে পারে এক সমৃদ্ধ জগৎ।” ঘাতক গোষ্ঠীকে নিয়ে তিনি আরো উল্লেখ করেন, “লেখার বিরুদ্ধে তাদের লেখা নিয়ে তারা এগুতে পারে না, মতের বিরুদ্ধে মত নিয়েও তারা দাঁড়াতে পারে না। আছে তলোয়ার আর ধর্ম নিয়ে হিংস্র উন্মাদনা, ব্লাসফেমি আইনের হুংকার, রাষ্ট্রের দমনপীড়নের যন্ত্রপাতি আইনকানুন।” হুমায়ূন আজাদের সাথে সতন্ত্রতা এবং আক্রান্ত হওয়া নিয়ে আলাপচারিতায় এক প্রসঙ্গে লেখক বলেন, “সংগঠন দিয়ে কেবল যৌথতা হয় না। মানুষ আসলে চাক বা না চাক সে যৌথতারই অংশ।”

বৈটি/বইটি এমন এক সময়ে পড়িতেছি যক্ষণ নিজের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে এক অস্থির সময় অতিবাহিত করিতেছি। ব্যক্তিস্বার্থে মানুষের বদলে যাওয়া, সুযোগ বুঝে ক্ষমতার অপব্যবহার, লালিত দর্শনের বিপরীতমুখী অবস্থান, সুশীলতার আড়ালে থাকা ভন্ডামী কিংবা মুখোস মানুষ— এই বিষয়গুলি প্রতিনিয়ত নাড়া দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরিতেছি নিজেই নিজেতে। পরবর্ত্তী আলোচনা পড়িতে গিয়েই অনুধাবন হৈল, এই নূতন নয়। ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত আসিলেই মানুষের স্বরূপ উন্মোচিত হয়। বদলে যায় দর্শন এবং চেতনা।

বাঙ্গালায় খুব আলোচিত এবং সমালোচিত নাম তসলিমা নাসরিন। তসলিমা নাসরিনের ‘ক’-গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হৈবার সময়কার কিছু সাবলীল বর্ণনা এবং সেসময়কার ঘটনাবলী কঠোর যুক্তিতর্কের মাধ্যমে শক্তপোক্ত ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে আনু মুহাম্মদ-এর আলোচনায়। উন্মোচিত হয়েছে কিছু নির্ম্মম সত্য। ব্লাসফেমী আইনের বিরুদ্ধে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নেতৃত্বে সরিক হয়েছিলেন তৎকালীন বিভিন্ন দল-মতের লেখক শিল্পীরা। সৈয়দ শামসুল হক এবং আনু মুহাম্মদ-ও সরিক ছিলেন সেই সমাবেশে। আবার সেই সৈয়দ শামসুল হক-ই যক্ষণ তসলিমা নাসরিনের ‘ক’ গ্রন্থ নিষিদ্ধ করবার জন্য আদালতে আবেদনের পক্ষে তিনটা উল্লেখযোগ্য যুক্তির দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে ‘গ্রন্থে তসলিমা নাসরিন ধর্মের প্রতি কটূক্তি করেছেন’ কথাটি মোক্ষম পয়েণ্ট হিসাবে দাঁড় করান, তক্ষণ পরিস্থিতি অনুযায়ী যে কিছু মানুষের দর্শনের পরিবর্ত্তন ঘটে তাহারি প্রমাণ মেলে। লেখকদের মধ্যে থেকেই তসলিমার বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনার ঝড় ওঠে। বাঙ্গালাদেশের হুমায়ূন আজাদ এবং ভারতের সমরেশ মজুমদারের দুইটা উদ্ধৃতির উল্লেখ করে তাহাদের কঠোর সমালোচনা করে আনু মুহাম্মদ বলেন, “দৃষ্টি থাকলে এই কথাটা কারও জন্য বোঝা কঠিন নয় যে, একজন নারীর পতিতা হবার পেছনে সাধারণ ভাবে থাকে আমাদের সমাজের ভয়ঙ্কর, জালিয়াতি ও নারকীয় নিপীড়ন এর ইতিহাস।” তিনি আরো বলেন, “নারীকে নিন্দা করবার জন্য নিকৃষ্ট পুরুষতন্ত্র নিপীড়িত নারীর এই পরিচয়কেই(পতিতা/বে*শ্যা) মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কেননা নারীকে আক্রমণ করবার, তাকে নাস্তানাবুদ করবার, তাকে ধরাশায়ী করবার জন্য এর চাইতে কার্যকর কিছু নাই।”

অসাধারণ তরুণ, আজীবন বিপ্লবী সইফ-উদ্-দাহার এবং শামসুর রাহমান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পরেই সেলিম আল দীনের সৃষ্টিকথায় উঠে এসেছে মঞ্চ-টিভিতে হুমায়ুন ফরীদির নূতন যাত্রার কথা।

“বস্তুত: বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোন ডিগ্রি নেই। জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন। সেই অসীম জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তা হচ্ছে লাইব্রেরি।”— কথাগুলি উত্থাপিত হয়েছে প্রশ্নের শক্তির আরেক শক্তিশালী বাহক আরজ আলি মাতুব্বর দ্বারা। যিনি পা ভাঁজ করে মহাবিশ্ব দেখেছিলেন। প্রশ্ন নিয়ে যিনি ভেসেছেন অকূল চিন্তা সাগরে। অবশ্য এই প্রশ্ন নিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, “প্রশ্নের কারণ কি? কারণ, ‘অজানাকে জানার স্পৃহা মানুষের চিরন্তন এবং এইরকম ‘কি’ ও ‘কেন’র অনুসন্ধান করিতে করিতেই মানুষ আজ গড়িয়া তুলিয়াছে বিজ্ঞানের অটল সৌধ।” কোনরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া অতিদরিদ্র পরিবারে এবং পরিবেশে বেড়ে উঠেও তাহার জানার প্রবল আগ্রহৈ তাহাকে অনন্য অবস্থানে তুলে এনেছে। সমাজ, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম্ম, বিজ্ঞান সমস্ত বিষয়ে গভীর পাঠ এবং অনুসন্ধানে তিনি ছিলেন অনেকটা নেশাগ্রস্তের মত।

এরপরে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গীকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মওলানা ভাসানীর খামোশ। কমরেড আবদুশ শহীদ সম্পর্কে আনু মুহাম্মদ ব্যক্ত করেছেন, “জীবনের প্রথম থেকেই যিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হলেন, দায়বদ্ধতার সাথে মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে সক্রিয় থাকলেন জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি নিয়ে, এরপর তিনি কোথায় গেলেন, কী করলেন? পাকিস্তান আমলে যখন পার্টি নিষিদ্ধ ছিল, যখন নিপীড়ন ছিল সর্বব্যাপী, তখন শহীদ ভাই সক্রিয় ছিলেন পার্টিতে, কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আর তিনি কোনো পার্টির সাথে যুক্ত হলেন না। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ।” আলোচনা করা হয়েছে, আখলাকুর রহমান: পণ্ডিত ও শিক্ষক, উমরের সফল জীবন, দীপংকর চক্রবর্তী এবং অনিক। সত্য মৈত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বলেন, “এদেশে বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতা যতোটা উদযাপন করা হয় ততোটা তাহার পর্যালোচনা করা হয় না। কতোমানুষ তাঁদের সর্বোচ্চ শক্তি ও মেধা দিয়ে একেকটা ধাপ তৈরি করেছেন। সাফল্য তো বটেই তাদের ভুলও একেকটি শিক্ষা। পর্যালোচনা করলে এর মধ্যে বহুশক্তির জায়গাও সনাক্ত করা যাবে, পাওয়া যাবে অনেক খন্ড খন্ড বিজয়ের সংবাদ যার ওপর আমরা দাড়িয়ে আছি। যার কারণে এখনও এই দেশের মানুষ লড়াই করে, মুক্তির স্বপ্ন দেখে। সত্যদার মতো মানুষরাই সেই শক্তি তৈরি করেছেন।”

নূতন জগতের অসামান্য কারিগর প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং শওকত আলী ও তারা সৃষ্টিকথা আলোচনার মাধ্যমে বৈটির/বইটির সমাপ্তি ঘটেছে।

আমাদের সমাজ শুধু নয়, সব সমাজের অধিপতি শ্রেণী সবচেয়ে সন্ত্রস্ত থাকে, ভিন্নমতে, প্রশ্ন উত্থাপনে। তাহাদের প্রয়োজন চিন্তাহীন, প্রশ্নহীন, সৃষ্টিহীন, পরিবর্ত্তনে অসার, বিশ্লেষণের ক্ষমতাহীন অনুগত জনগোষ্ঠী। আর মানুষের সমাজ দেখিতে চাহিলে আমাদের প্রয়োজন অন্ধভক্তি, প্রশ্নহীন আনুগত্য আর ঘৃণ্য আত্মসমর্পণের সংস্কৃতিকে পরাজিত করা; পরিবর্ত্তনে সৃজনশীলতা আর মানুষকে জয়ী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রন্থটির আলোচনাগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আলোচনাগুলি পাঠককে যেমন সেই সময় বা ঘটনাবলীকে উপলব্ধি করিতে শেখায় তেমনি মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর এই আলোড়ন সৃষ্টি করাই ত ছিল লেখকের উদ্দেশ্য। এইক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফল বলে আমার বিশ্বাস। সবমিলিয়ে গ্রন্থটিতে স্থান পাওয়া বেশ কয়েকজন ব্যক্তি সম্পর্কে এক মলাটে প্রাণবন্ত কিছু আলোচনায় ঋদ্ধ হবে অনুসন্ধানী পাঠক হৃদয়।

বই: ইলিয়াস ও প্রশ্নের শক্তি (প্রবন্ধ সঙ্কলন)
লেখক: আনু মুহাম্মদ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রয়ারী ২০০৯
প্রথম গ্রন্থিক সংস্করণ: অমর একুশে বৈমেলা/বইমেলা ২০২২
প্রকাশক: গ্রন্থিক প্রকাশন
প্রচ্ছদ: রাজিব দত্ত
মুদ্রিত মূল্য: ৪০০.০০৳
পৃষ্ঠা: ২৪৮
ISBN: 978-984-95407-2-4
বৈটি/বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে লেখকের প্রিয় মানুষ হাসান আজিজুল হক এবং শওকত আলীকে।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত হিজিবিজি, পাঠ-পর্য্যালোচনা: ইলিয়াস ও প্রশ্নের শক্তি — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *