— সমরেশ মজুমদারের একটি বইয়ের নাম “আট কুঠুরি নয় দরজা”।
আট কুঠুরি নয় দরজা মানে কী, লিমন ভাই?
: নীলা, প্রথমে একটি মজার কথা বলি, অনেক সময় প্রেসক্রিপশনে লিখতে দেখা যায়—
Rx:
Antazol nasal drop
দুই ফোঁটা করে দুই নাকের ছিদ্রপথে দিনে ৩ বার — ৫ দিন।
— তো সমস্যা কী?
: সমস্যা হল মানুষের নাক দুটি নয়, নাক একটি।
লেখা উচিত, নাকের দুই ছিদ্রপথে।
— জ্ঞানের কথা বুঝলাম। আট কুঠুরি নয় দরজা মানে কী বলো এবার?
: এটা তো ব্যাকরণের প্রশ্ন নয়। আমাকে কি সবকিছুর উত্তর দিতে হবে না কি? আমি তোকে আনন্দবাজার গ্রুপের পুরনো ‘সানন্দা’ কপি এনে দেব। সেখানে পাবি “আমার মা সব জানে”। সেখান থেকে তোর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর পাবি।
— বাবারে বাবা, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। আর কত্ত কথা শুনিয়ে দিলে।
: উঠলি কেন? এই নীলা শুনে যা।
— বলো।
: আট কুঠুরি নয় দরজা বলতে প্রাচীন মুনি/ঋষিরা মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ আটটি গ্রন্থি ও নয়টি রন্ধ্র বা ছিদ্রপথের কথা বলেছেন।
— তা-ই নাকি? এই জন্যই বুঝি তুমি দুই নাকের গল্প দিয়ে শুরু করেছ। হা হা হা। আচ্ছা বলো লিমন ভাই।
: নয় দরজা যদি শরীরের নয়টি দ্বার হয় তবে সেগুলো হবে—
দুই চোখ, দুই কানের ছিদ্রপথ, নাকের দুই ছিদ্রপথ, মুখ, শরীরের যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ।
— আর আট কুঠুরি?
: আর আট কুঠুরি যদি মানব শরীরের গ্ল্যান্ড বোঝায় তবে এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এসব থেকে হরমোন নিঃসৃত বা সিক্রেশন হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আটটি এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ড হল — ১) পিনিয়াল গ্ল্যান্ড ২) পিটুইটারি গ্ল্যান্ড ৩) থাইরয়েড ৪) থাইমাস ৫) অ্যাড্রেনাল ৬) প্যানক্রিয়াস ৭) ওভারিস ৮) টেস্টিস।
অনেক জায়গায় প্যারোটিড গ্রন্থির কথা লেখা আছে; কিন্তু প্যারোটিড গ্রন্থি এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ড নয়; এটি স্যালিভারি গ্ল্যান্ড বা লালা গ্রন্থি। এর কাজ স্যালাইভা বা লালা নিঃসৃত করা খাবার সময়। দুটি প্যারোটিড গ্ল্যান্ডের অবস্থান হল মুখের দুপাশে ঠিক কানের নিচ বরাবর। এখানে ভাইরাল ইনফেকশন হলে মাম্পস রোগ হয় যা খুব সংক্রামক।
— ওই যে মুখ ফুলে যায় সেটি তো। তখন অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই তো হবে তা-ই না?
: অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে কেন? কথায় কথায় তোদের মাথায় অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার কথা কে ঢুকিয়েছে বলত? এই রোগ ভাইরাসের কারণে হয় বললাম না।
— না, ভুল হয়ে গেছে। এসময় কী করতে হবে?
: সিম্পটোমেটিক ট্রিটমেন্ট, যেমন জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল খেতে হবে আর প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খেতে হবে। সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হলে তখন চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক দেবেন হয়তো। আর এখন ইপিআই শিডিউল অনুযায়ী মাম্পস রোগ প্রতিরোধের জন্য শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয় জানিস তো?
— হুম জানি। আচ্ছা লিমন ভাই, কোভিডও ভাইরাল ডিজিজ। তবে এই অসুখে যে মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক খায়। কেন?
: এটি ভালো প্রশ্ন। আসলে কোভিড রোগের এখনও কোনো অ্যাকুরেট ট্রিটমেন্ট ফিক্সড হয়নি। যার যেমন ইচ্ছে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছেন বা দিচ্ছেন। এজন্য ম্যাক্সিমাম রোগীই আইভারমেকটিন (Ivermectin) খাচ্ছেন। অথচ এটি কোভিড-১৯-এর জন্য WHO-অনুমোদিত ঔষধ নয়। এটি মূলত স্ক্যাবিস বা খোস-পাঁচড়া, কৃমির ঔষধ। আর ওই যে বললাম ভাইরাল ইনফেকশন থেকে পরে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে। সেজন্য প্রথম থেকেই সতর্কতা হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক রোগীরা খাচ্ছেন। আসলে যা চলছে এটিকে তুই একটি মিক্সচার ট্রিটমেন্ট বলতে পারিস।
– হযবরল ট্রিটমেন্ট তবে।
: তাও বলতে পারিস।
— তা “আট কুঠুরি নয় দরজা” নিয়ে এটাই কি চূড়ান্ত কথা?
: আমি জানি না। বলেছি না এসব প্রাচীন কথা। আট কুঠুরির আরেকটি মতবাদ আছে, যদিও তাও শরীরসংক্রান্ত। এই আট কুঠুরি হল—
মাথার খুলি, দুই ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, কোলন ও দুই কিডনি।
: আট কুঠুরি নয় দরজা উপমাটি তো লালনের গানেও আছে।
— বাহ নীলা। তোর মাথা তো খুব সমৃদ্ধ।
: তোমার সঙ্গে থাকার ফল।
— আচ্ছা তা-ই নাকি! লালনের কোন গানে আছে বলতে পারবি?
: “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
… … …
আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।”
— তোর গানের গলা বেশ। চর্চাটা নিয়মিত করলে তো পারিস।
: আর নিয়মিত! তুমি বলো। মরমী, আধ্যাত্মবাদ শুনতে ভালো লাগছে।
— সাহিত্য, কবিতা, গান মানেই সংসার, প্রকৃতি, আধ্যাত্মবাদ পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। লালনের গান ছাড়াও শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকের হ্যামলেট চরিত্রটির কথা ভাব। ডেনমার্কের রাজপুত্র ছিল হ্যামলেট। তার বাবার হত্যাকারী তার সামনেই ঘুরে বেড়ায়। তার কিছুই করার থাকে না। সে অসহায়। লালন ফকিরও অসহায়। তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ান তিনি তাঁর গানের সুরে, বাণীতে। “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।” রাজপুত্র হ্যামলেটের মনের অন্তঃপুরেও একই প্রশ্ন। — “To be or not to be.” হবে কি হবে না? লালনের “কেমনে আসে যায়”
আর শেক্সপিয়ারের “টু বি অর নট টুবি” আসলে একই কথা। কেমনে আসে যায় — জগৎসংসারেরই সার কথা।
কীরে নীলা, এমন জোরে নিশ্বাস ফেললি যে।
: তুমি এত সুন্দর করে বর্ণনা করো না মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়।
— বেশি মুগ্ধ হোস না। সেটি কাজের কথা নয়। যা এক কাপ চা নিয়ে আয়।
: যাচ্ছি। শুধু একটা কথা। এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ডগুলোর ছবি দেখতে পারলে ভালো হত, লিমন ভাই।
: আচ্ছা দিলাম একটি ছবি।
হল তো এবার, আট কুঠুরি নয় দরজা।
মোরশেদ হাসান রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, আট কুঠুরি নয় দরজা — লেখক নির্দ্ধারিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।