গল্প পৎ থেকে পাতাল

চিত্রকর্ম্ম : মঈন চৌধুরী

মা এসেছিলেন, লকডাউন কিছুটা শিথিল হতেই তড়িঘড়ি চলে গেছেন, বাড়ী ছাড়া উনার ভাল লাগে না। রিণির তাই ভাল লাগছিল না, আজ অফিস বন্ধ, কিন্তু বাসায় বসেই অনলাইনে কিছু কাজ সারতে হবে। জানালার পাশে সেই কখন থেকে দুইটা টুনটুনী ওড়াউড়ি করছে, রিণি একমনে তাই দেখছিল। কলিংবেলের একটানা আওয়াজে তার ধ্যান ভাঙল। দরজা খুলতেই ছিপী হুড়মুড় করে ঢুকল। ছিপীর বর আর ছেলেও সাথে।

ওদের দেখে ছিপীর মনটা খুশী হয়ে গেল নিমেষে।

রিণি ওদের ভেতরে আমন্ত্রণ জানাল হাসিমুখে। ছিপীর বর হেসে বলল, আমি আরেকদিন, আপনাদের মাঝে আমি থেকে লাভ নেই, ছোট বেলার পাতান সই, আপনারা একসাথে আজ সময় কাটান, আমি ছেলেকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। দুপুরে কিন্তু আমার এখানে খাবেন। রাজী হয়ে ছিপীর বর চলে গেল, রিণি আর ছিপী দুজনে ভেতরের রুমে ঢুকল। রিণি ছিপীর হাতের ছোট ব্যাগটার দিকে দেখল, পুরানো খাম দেখা যাচ্ছে, কী ওতে?

ছিপী রিণির বিছানার দিকে তাকাল, টানটান করে বিছানা পাতা। পাশে একটা বই। খালাম্মা চলে গেছে? হ্যাঁ, লকডাউনে আটকা পড়েছিল, একটু শিথিল হতেই চলে গেল।

ছিপী ব্যাগটা উপুড় করে বিছানায় ঝেড়ে দিল। ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল পুরানো দিনের পোষ্টকার্ড, চিঠির খাম। এগুলো কই পেলি? আমার ড্রয়ারে পুরানো একটা ব্যাগের ভিতর ছিল, ওগুলো ওখানে ছিল আমি তা খেয়ালই করিনি। কাল ড্রয়ারটা পরিষ্কার করতে গিয়ে পেলাম।

রিণি পোষ্টকার্ড আর খামগুলো হাতে নেয়। ওতে রিণির লেখা চিঠিও আছে। তখন ছিল পত্রমিতালীর যুগ। প্রতিদিন দেখা হত, তবু প্রতিদিন পত্র লেখা চাই। রিণি ছিপী দুজনেই ছোট বেলার বন্ধু, রীতিমত অনুষ্ঠান করে ওরা সই পাতিয়েছিল। একমনে দুজনেই চিঠিগুলো পড়তে থাকে। বাইরের রাস্তায় কাজ চলছিল, ভীষণ শব্দ। ছিপী বলল, কীসের শব্দ যেন … কান পাতা দায় …। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, রাস্তায় কাজ চলছে। রিণি জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে বসল।

জানিস কাল আমার বর এইসব চিঠি পড়ছিল আর বলছিল, এগুলো ফেলে দিতে। এগুলো নাকি গাছের ঝরা পাতার মতই রঙহীন মচমচে হয়ে গেছে? তুই বল গাছের পাতা আর চিঠির পাতা কি এক? এগুলো যতই পুরানো হোক, এই স্মৃতি আমি কেন ফেলে দিব?

তোর বর খুব একটা ভুল বলেনি। গাছের পাতাও পত্র, চিঠির পাতাও পত্র। তাই বলে গাছের পাতা আপনি ঝরে যায় সময় হলে, চিঠিও একসময় পুরানো হয়ে যায়। সেই চিঠিপত্র কেউ যত্ন করে রাখে, কেউ রাখে না। তবে দলিলপত্র সবাই যত্ন করে রাখে।

ছিপী এবার হাসতে লাগল, নিশ্চয়ই তুই আজ আমাকে পত্র বিষয়ে জ্ঞান দিবি? তবে তার আগে চা খেতে হবে এককাপ।

রিণি কিচেনে গেল চা করতে। বিছানার একপাশে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, ও হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষ রাখা। ছিপী টেবিলের দিকে তাকাল, কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তীর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ এখনও খোলা অবস্থায়। ওফ্ এই মেয়েটা এত পড়তে পারে তাও যদি গল্পের বই হত। ছিপী বিছানায় রাখা দুইটা বইয়ের পাতা উল্টে যায়। রিণি চায়ের কাপ নিয়ে আসে। তারপর কী যেন বলছিলি? রিণি চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। ছিপী কাপটা হাতে নিয়ে বলে, পত্র, চিঠি।

ও হ্যাঁ পত্র, পত্র হল যা পড়ে, এই যেমন তোর হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে গেল, সেটা হবে পতন, এই পতন তারিত হয় পত্র-তে। আবার যা ওড়ে, যেমন পাখী ওড়ে, সেটাও পত্র। আবার যার দ্বারা গমন সাধন হয় তাও পত্র। পত্ হল পতন বা পতিত হওয়া বা পড়া, পত্ হল গমন করা। গাছের পাতাও বাতাসে ওড়ে, পতাকাও বাগাসে পত্ পত্ ওড়ে। এই পত্ হল পায়ীর তারণ।

আগে বল তুই এই তথ্য কোথায় পেলি?

কেন বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে, হরিচরণ এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহনেও আছে। ছিপী চা খেতে খেতে বিছানায় রাখা বইগুলোয় চোখ বুলায়। তুই যে বললি পায়ীর তারণ সেটা একটু বুঝিয়ে বল।

খুবই মজার বিষয় এইটা। যে কোন একটী শব্দকে ভাঙতে ভাঙতে সেই শব্দটীর ক্রিয়ামূল পাওয়া যায়। সেটা আবার ব্যাকরণের নিয়মে বিভিন্ন শব্দযোগে বিভিন্ন অর্থ বহন করে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মূল শব্দমূল কিন্তু একটীই, কিন্তু সেটী আরো বর্ণ, উপসর্গ, আগে পরে যুক্ত করে অবলীলায় আরো কত শব্দ তৈরী করছে, অর্থ প্রকাশ করছে। মজার বিষয় এটী।

ছিপী অবাক হয়ে বলে, মজার বিষয় কেন? তুই একটা উদাহরণ দে।

রিণি বলতে থাকে, যেমন আমি প বর্ণটী নিলাম। তুই জানিস প-বর্ণের একটী নিজস্ব অর্থ আছে। প্রতিটী বর্ণের অর্থ আছে, সেটা আগেও তোকে বলেছি।

প = প্ অন করে যে। প্ অন করা মানে প্ করা, প্ করে যে বা প্-কারী। করে যে সেই কারী। কাজেই প্ যে করে তাই প্-কারী বা পায়ী। যে কোন বিষয়ের একটী পজিটিভ এবং একটী নেগেটিভ দিক আছে। অন্ হচ্ছে পজিটিভ। প্ যখন অন অর্থাৎ সক্রিয় বা প, তখন যা তাকে দেয়া হয় তা সে গ্রহণ করে। এই গ্রহণ কখন সম্ভব?

ছিপী মাথা নাড়ে, সে জানে না। তাই বলে তুই-ই বল।

যখন তার ধারণ ক্ষমতার অবকাশ বা সুযোগ থাকে। ধারণ ক্ষমতা না থাকলে গ্রহন করা সম্ভব নয়। তোর যখন পানীর তৃষ্ণা পাবে তখনই তুই পানী পান করবি, যখন ক্ষিধে পাবে তখনই খাবি। ভরা পেটে তো খেতে পারবি না। প-এর বিষয়টাও সেরূপ। অর্থাৎ সে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব। প-বর্ণ তাই অবকাশধারী বা পায়ী, পানকারী; আর গ্রহণের অবকাশ রাখে তাই প প্রাপণকারী বা পালনকারী। এই প বর্ণ থেকেই সৃষ্ট শব্দ পত্, যা থেকে পত্ পত্, পত, পাত, পাতা, পত্র এমনকি পাতালও।

তাই এই যে তারণ বললি, সেটা কী?

পত্ হল পায়ীর তারণ, আর ত্ (ত-হস্) হল তারণ, যে তরণ করে চলে যায় তাকে তারী বলে। তরণ হল সাঁতার কেটে যাওয়ার মত যাওয়া যাকে সন্তরণ বলে আমরা জানি। তরণ এর আধার হল তারণ। তাহলে পত্ যদি পায়ীর তারণ হয়, পত হল পায়ীর তারণ যার আছে।

সত্যি খুবই মজার ছিপী বলে ওঠে। রিণি বলতে থাকে, পত থেকে পাত। পত হতে জাত শব্দ পাত। পাত অর্থ পতন, পড়া, চুত্যিড় এর আরো অর্থ আছে। পতনের ফল হল পাত। পত অন হলে পতন। যেমন জল পতন হয় বা পড়ে জলপ্রপাতে। বজ্রপতন হলে বলি বজ্রপাত। আবার পাত অন হলে হয় পাতন। পাত এর আধার বা আশ্রয় হল পাতা। পাতা অন হলে পাতান হয়, যেমন সই পাতান। পাতানো হলে পাতা হয়, যেমন বিছানা পাতানো হয়েছে। পাতা শব্দটা গাছের পাতা থেকে শুরু করে চোখের পাতা, বিছানা পাতা, হাত পাতা, কান পাতা, পাত পাতা (খাবার জন্য), আঁচল পাতা, বুক পাতা, মাথা পাতা, আড়ি পাতা, দোকান পাতা, দই পাতা, লেখার পাতাড় আরো আরো কত পাতা হয়। রিনি চা শেষ করে কাপটা রাখে। যে পাতায় লেখা থাকে তাকে পত্রও বলে যেমন চিঠিপত্র, প্রেমপত্র, পরিপত্র। এই পত্রও পত থেকে জাত আগেই বলেছি। আগে যখন আমরা পত্রমিতালী করতাম, ভেবে দেখ আমাদের লেখা পাতা কোথা থেকে কোথায় চলে যেত। যাওয়া মানেই তো গমন। পাখীরা পত্পত্ করে উড়ে যায়। আবার পত্ মানে পড়া, নীচের দিকে পতন। যেমন আমরা বলি তার অধঃপতন হচ্ছে দিনে দিনে। পাত করে যে সে পাতক। এই পাত দিয়ে আমরা কত শব্দই না বলি। উৎপাত, নিপাত, অনুপাত, প্রপাত, সূত্রপাত কত শব্দ আছে।

ছিপী মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে রিণির কথা।

এই যে পত অন হলে পতন হয়, বা পড়া হয়। মানুষের যখন চরম অধঃপতন হয়, তখন সে নরকে যাবার উপযোগী হয়। এই পতন হয় নীচের দিকে, এর মানে সে নরকে যাচ্ছে। সে যখন স্বর্গে যাবে বলা হয় এর মানে তার ঊর্দ্ধগমন হয়। আর নিম্নগমন হল নীচে গমন অর্থাৎ পাতাল। এই দেখ এখানে পত্ (পতনে) + আল (আলঙ্) – অধিকরণে। মানে তার পতনের চূড়ান্ত হলে সে পাতালে বা নরকে যাবে। যে পাতা লালন করে, অভীষ্ট দান করে যে তাকে বলে পাতাল এটা হল শব্দার্থকোষের কথা। আর হরিচরণ আর জ্ঞানেন্দ্রমোহন তো বলেছেনই পাতাল হল পত্ (পতনে) + অল।

বিষয়টা কঠিন লাগছে। পাতালের সাথে পাতার সম্পর্কটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

আচ্ছা, তুই যে জমীটাতে বাড়ী করলি, সেটা তো তোর নামে। তুই জমীর দাম দিয়ে সরকারের ট্যাক্স পরিশোধ করে জমীটা তোর নামে কিনেছিস বা তোর বর তোকে কিনে দিয়েছে। এখন ওই জমীটার মালিক যে তুই, তার প্রমাণ কী? জমী তো হাতে নিয়ে বয়ে বেড়াবার জিনিস নয়। এই পৃথিবীর প্রত্যেক ইঞ্চি জায়গারই কোন না কোন মালিক আছে। সেই মালিকানা মুখে মুখে নয়, হাতে রেখেও নয় তা লিখা থাকে কাগজের পাতায়। সেই কাগজের একখানি থাকে সরকারের ঘরে। ওই জমীর মালিক যে তুই সরকার তার সাক্ষী দেবে। কাগজের পাতায় তোর জমীকে তুই দেখছিস মানে সেই পাতা তোকে লালন করে, তোর অভাব পূরণ করে, তোর চাহিদা মিটায়। যেভাবে মাটীর তলদেশ, অর্থাৎ পাতাল আমাদের খাবার/পাতের আধার/ফসল এসব লালন করে তার ভেতরে থাকা খনিজ উপাদান দিয়ে। তুই তোর চারপাশে যা দেখছিস তা আসলে সেখানে নেই, সব আছে কাগজের পাতায়। এবার আসি, কারা পাতালে যায়। যারা পাপ করে, এই পাপ হল তার সম্পৎ (সম্পদ)। যার যত বেশী সম্পৎ (সম্পদ) তার পাতালে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশী। এই পাপ খসাতে লোকে পাপ ক্ষয় করে, পূণ্য অর্জ্জন করে। তখন সে পাতালে নয়, আকাশে যাবে অর্থাৎ স্বর্গে।

ছিপী অবাক হয়ে শুনছিল রিণির কথা। নাহ্ … এবার একটু পড়তে হবে রিনির বইগুলো। কত অজানা যে রয়েছে ভাষার জগতে। রিণি কাপগুলো নিতে নিতে বলে, চল কিচেনে যাই, দুপুর হয়ে এল রান্নাটা শেষ করে ফেলি। রিণি আর ছিপী তাড়াতাড়ি কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। …

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, পৎ থেকে পাতাল — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *