। কৃষ্ণ : বসুষেণ, হাতে নিলে রথের লাগাম।
তা তুমি সারথ্য নিয়ে ভালোই করেছ-
কথাগুলো হবে আজ একান্ত গোপনে।
শ্রোতা নেই। সাক্ষী নেই। দিব্যচোখ নেই।
তবে দেখো অঙ্গরাজ, যদি শেষে তুমি
পথ ভুলে চলে যাও কৌরব শিবিরে-
গোপাল আটক হলে সব খেলা মাটি।
কর্ণ : হাহাহাহা লজ্জা দিচ্ছ বাসুদেব!!! রাধেয়কে তুমি
আজ ঠিক অতটাই কাপুরুষ ভাবো?
ছলে কোনো শত্রুনাশ করিনি কখনও।
তুমি তো শত্রুও নও। বান্ধব আমার।
স্নেহ ঢেলে দিতে পারি সে-সুযোগ নেই।
শ্রদ্ধার আসনে আছো বহুকাল হল।
অর্জুনের সখা তুমি। কিন্তু তাই বলে
কৃষ্ণের স্বরূপ ক্ষমতা আমি জানিনা ভেবেছ!
অর্জুনের চেয়ে ঢের বেশি করে জানি।
আজ যা ঘটেছে ওই কুরুসভাঘরে
জেনো তা কর্ণের নয় মস্তিষ্কপ্রসূত।
তোমাকে বাঁধার বুদ্ধি সখা সুযোধন
পেয়েছে তো মনে হয় শকুনির কাছে।
গোবিন্দকে বেঁধে রাখে এমন শেকল
পৃথিবীতে আছে বলে আমি তো জানিনা।
সে কথা বলেছি আমি, সখা তা শোনেনি।
কৃষ্ণ : অনুমতি দিলে বলি, তুমিও হাসালে!
আমাকে বাঁধার মতো লোহার শেকল
পৃথিবীতে নেই, তুমি জেনে গেছ আজ।
খুব ভালো। তবু বলি, পাঞ্চালীর শাড়ি
অনায়াসে পাক দিয়ে খুলে নিতে পারে
তেমন ভীষণ হাত পেয়েছিলে তুমি!
বরং এটাই বলি, চেয়েছিলে তুমি!
সেও ছিল রাজসভা। হস্তিনাপুরের।
বাঁধার বদলে ছিল খোলার উল্লাস।
একবস্ত্রা রজঃস্বলা অসহায় মেয়ে
আর তুমি মহাবীর, অতিমহারথী
সামর্থ্যের শ্রেষ্ঠ রূপ, দাতা, সুপুরুষ!
আজ তবু নীরবতা নিয়েছিলে তুমি।
সেদিন তো উল্লাসের অংশীদার ছিলে
দুঃশাসন শকুনির স্তরে নেমে গিয়ে!
আকস্মিক তেতো সুর ক্ষমা করে দিও।
কর্ণ : তোমার প্রয়াস পুরো বিফল হয়েছে।
ধরে নিই সে প্রয়াস আন্তরিক ছিল।
শুরু হবে মহাযুদ্ধ। বেশিদিন নেই।
সেই যুদ্ধ শেষ হলে কৃষ্ণ আর কর্ণ
পৃথিবীতে এভাবে তো বেঁচে থাকবে না।
একের মৃত্যুতে হবে অন্যের বিজয়।
মাধুর্যের আশা রেখে আসিইনি তো আমি।
এই হাতে ধরে আছি রথের চাবুক-
তোমার আঘাতে তার ছায়া লেগে আছে।
লোকে যা বলুক, আমি এটুকুই জানি
কেশবের অগোচর কোনো কিছু নয়।
সকলে যা বলে তুমি সেটুকুই জানো?
পাঞ্চালীর শাড়ি আর সখা সুযোধন
এর মধ্যে আমি কেন? কী করে এলাম?
কৃষ্ণ : আমি যেটা জানি হয়ত তুমিও জানোনা।
সেই কথা থাক বন্ধু। পরে বলা যাবে।
শুধু বলি চিরকাল এটাই ঘটেছে-
বায়ুমন্ডলের ফলে সূর্যের কিরণ
তার সব তাপ দিতে পারেনি মাটিকে।
পৃথিবীতে তাই আজ প্রাণের উৎসব।
সূর্যের সকল নিতে আসেনি জীবন।
নিজেকে আড়াল করা কম কথা নয়-
সূর্য হোক, অথবা সে পরম পুরুষ-
কিছু ঢেকে সামর্থ্যের প্রকাশ সঠিক।
কিন্তু সেই আড়ালের নিয়ম রয়েছে।
সূর্যকে লুকোতে হল শ্বাপদের ভিড়ে-
মনে হয় সে বড়ই করুণ কাহিনি।
তুমি সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হলে?
কর্ণ : আমি শুধু যোদ্ধা কৃষ্ণ। তার বেশি নই।
সূর্যের তুলনা দিয়ে কেন ছোট করো?
শুধু জানি শত্রুটির মস্তক কোথায়,
আর জানি কোন শরে কেটে নেব সেটা।
সামর্থ্য তো এই দুই ভূজায় রয়েছে।
আমি নই যুধিষ্ঠির। সহদেব নই।
সারথীর ব্যাটা আমি। ধনুক ধরেছি।
বিজয়ের ছিলা আর প্রবল টংকার
এই হল বসুষেণ। এই তার সব।
জ্ঞান নয়। ভক্তি নয়। কাজের মানুষ।
যদি চাও ভেবে নাও আমিও শ্বাপদ।
পৃথিবীর অদ্বিতীয় তীরন্দাজ আমি।
আমার হিংস্রতা আজ কৌরবের বল।
পার্থের সামর্থ্য নয়- প্রহরীরা তার
আপাতত একমাত্র চিন্তার কারন।
রথের রক্ষক তার বীর হনুমান-
সম্প্রতি শুনেছি তুমি সারথ্য নিয়েছ।
বহু অস্ত্র ব্যর্থ হবে তোমাদের গুণে।
কৃষ্ণ : নিজের জান্তব রূপে কোন সুখ পাও?
সংযম ও তপস্যার বলে লাভ করা
অত দিব্য অস্ত্র নিয়ে হিংস্রতার কথা!
আজও কি কমেনি বুকে কিছু অভিমান?
কর্ণ : অভিমান! হয়ত নয়! বলো অপমান।
অবশ্য জানিনা দুটো আলাদা কোথায়!
প্রথম শৈশব থেকে জীবন আমার
আরো দুটো ধারণার লড়াই দেখেছে-
সেই যুদ্ধ অধিকার আর আকাঙ্ক্ষার।
কিছু কম নয় সেটা যদি ভেবে দেখি
কৌরব ও পান্ডবের দ্বন্দ্বটির চেয়ে।
ধনুক যে পেয়েছি তা অর্জন করেছি।
কেউ হাতে তুলে দিয়ে একথা বলেনি
যাও ছেলে, এ জীবন জিতে নাও তুমি।
সূতপুত্র। শূদ্র আমি। ধনুকের ছোঁয়া
হাতে যদি লেগে যায়, দন্ড পেতে হত।
সারথীর ছেলে হয়ে ধনুক ধরেছে-
বড় সাধ যোদ্ধা হবে- রেহাই দেবোনা!
ওরা হীন অতি দীন অতি কাপুরুষ
তবু ওই ক্ষত্রিয়রা শাস্তি দিয়ে যেত।
আমাকে যদি না পায়, পরিবার আছে।
কত অত্যাচার কৃষ্ণ সেই পরিবারে
আমার কারনে শুধু নেমে এসেছিল!
এক প্রিয় খুল্লতাত- উগ্রসেন নাম-
আমাকে না মেরে তার হাত কেটে নিল!
অপরাধ? কম নয়! ধনুক দিয়েছে
যোদ্ধা হতে চাওয়া এই ভাইপোটির হাতে।
তুমি জানো সেই কথা? কিংবা ব্যাসদেব?
কেউ কি লিখেছে সেই লাঞ্ছনার গাথা?
আজ আমি অঙ্গরাজ। অতিমহারথি।
যে কোনো বীরের চেয়ে সামর্থ্য আমার।
কী করে হলাম? আমি… কীকরে এলাম?
কে আমাকে নিয়ে এল অ্যাতখানি পথ?
লেখার তো কথা নয়। শুধু এই বুকে
কোনোদিন নিভে যাবে এমন আগুন
বসুষেণ জেনে রেখো জ্বালিয়ে রাখেনি।
কৃষ্ণ : বুকের আগুন থেকে তুমি কি নিজেও
বলো প্রিয় দানশূর, রেহাই পেয়েছ?
তুমি নিজে জ্বলে গেছ অন্যদের চেয়ে।
আগুনের এই হল আশ্চর্য নিয়ম-
যে তাকে জ্বালায় সে-ও দাহ পায় তার।
কর্ণ : তাহলে কোথায় জ্বলে তোমার আগুন?
বোলোনা ও বুকে শুধু করুণার ধারা!
তোমার সংহাররূপ সকলেই জানে।
মামা কংস। জরাসন্ধ। কিংবা… শিশুপাল…
চক্রটি তো বাধ্য দেখি বাঁশির চেয়েও!
কৃষ্ণ : পরিহাস নয় বন্ধু। আগুন তো আছে।
সে আগুন কম নয় তোমার থেকেও।
বরং অনেক বেশি দাহক্ষম সেটা।
কর্ণ : তবে বলো বাসুদেব, তুমিও জ্বলেছ?
কৃষ্ণ : জ্বলার বদলে কিছু উপায় করেছি।
বুকের আগুন আমি বুকে পুষে রেখে
প্রতিদিন পুড়ে যাব অত বোকা নই।
বুকের আগুন আমি মস্তিষ্কে নিয়েছি।
ব্যক্তির আগুন যদি সমাজে ছড়ায়
সমাজ সুফল পায় চিরকাল জেনো।
কর্ণ : সাধারণ মানুষের দুঃখের কাহিনি?
শুনে শুনে জনার্দন কান পচে গেল।
ওই কাহিনির ভিতে আমিও বেড়েছি।
সমাজে বদল ঠিক এনে দেব ভেবে-
আমার আগুন যাতে সকলের হয়-
প্রথম তারুণ্যে এই ধনুক ধরেছি।
জন্মে কেউ শূদ্র কেন? কর্মে কেন নয়?
সারথীর ছেলে শুধু সারথীই হবে!
ধনুকের অধিকার কেন সে পাবেনা!
কেন কিছু ভীরু লোক জন্মের সুবাদে
অস্ত্রের দায়িত্ব নেবে কাঁপা-কাঁপা হাতে-
যখন যা খুশি এসে কেড়ে নিয়ে যাবে-
নারী হোক, অর্থ হোক, অথবা ফসল!
ওরা হল ক্ষত্রবীর! আমি হব দাস!
এ বিধান কেন আর মেনে নিতে হবে!
কিন্তু সেই দেখা গেল একা আমি শুধু।
আর কোনো কর্ণ নেই পাশে দাঁড়াবার।
বরং সবাই ওরা বারণ করেছে-
কেন বাছা বিবাদের সূত্রপাত করো?
সকলেই সুখে আছে কাদায় লুটিয়ে-
মাথা তুলে দাঁড়াবার ইচ্ছেটাই নেই।
শূদ্র সমাজের বুকে আমি ব্যতিক্রম।
ওরা বেশ ভুলে আছে লাথি ঝাঁটা খেয়ে।
কৃষ্ণ : তুমি ব্যতিক্রম নও। তুমি শুধু তুমি।
সূর্যদেব যদি ভাবে আমি কেন একা!
আরেকটা সূর্য হলে বেশ ভালো হত…
কর্ণ : দয়া করো বাসুদেব। বিদ্রূপ কোরোনা।
সমাজ আমাকে শুধু অশ্রদ্ধা দিয়েছে।
আমার হারের গল্পে খুশি হয় ওরা।
পাঞ্চালের সঙ্গে যারা যুদ্ধ করেছিল,
গুরুদক্ষিণার দায় থেকে মুক্ত হতে-
দ্রোণাচার্য্যশিষ্য তারা। আর কেউ নয়।
আর কেউ ওই যুদ্ধে ভাগ কেন নেবে?
দ্রোণের শিষ্যত্ব আমি চেয়েছি। মেলেনি।
পরশুরামের ছাত্র আমি আর উনি।
দ্রোণ তাই গুরু নন। শুধু গুরুভাই।
ওই যুদ্ধে যাবে কেন অঙ্গের নৃপতি?
তখন তো অঙ্গরাজ্যে ব্যতিব্যস্ত আমি-
জরাসন্ধ প্রতিদিন বাহিনি পাঠিয়ে
অঙ্গের দখল চায় যে কোনো প্রকারে।
মল্লযুদ্ধে ডাক দিল। বুঝি ভেবেছিল-
ধনুকের জোর আছে, বাহুতে তা নেই।
একুশ দিনের পরে হার মেনে নিল।
অঙ্গরাজ্য ত্রাণ পেল। কাঁটা দূর হল।
খোদ তুমি জরাসন্ধ পাছে হানি করে
মথুরা নগরী ছেড়ে দ্বারকায় গেলে-
আর পেলে লোকমুখে রণত্যাগী নাম।
একমাত্র আমি তাকে পরাস্ত করেছি।
হেরে গিয়ে মুগ্ধ হল। মিত্র হয়ে গেল।
কৃষ্ণ : তোমার বিজয় আমি কাজে লাগিয়েছি।
জরাসন্ধ হারতে পারে, তুমিই দেখালে।
বৃকোদর ওই পথে বধ করে তাকে।
কর্ণ : তবু শুনি লোকমুখে আমার ভূমিকা-
পাঞ্চালের হাতে নাকি বন্দী হই আমি,
পরে নাকি মুক্ত হই অর্জুনের তেজে!
তুমি বলো বাসুদেব কী এর উত্তর?
আমাকে পরাস্ত করে এমন প্রতাপ
কোনো ধনুর্ধারী আজও দেখাতে পারেনি।
তবু ওই গল্প আজ মুখে মুখে ঘোরে।
আরো আছে। শোনা যায় বিরাট সমরে
অর্জুনের চেয়ে ঢের হীনবল আমি
সংজ্ঞাহীন হয়ে নাকি পালিয়ে বেঁচেছি!
ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বত্থামা সব হেরে ভূত!
বিরাটের যুদ্ধে আমি কেন যাব বলো!
অঙ্গরাজ্যে আছি আমি- খবরই মেলেনি।
সুযোধন দুঃশাসন আর যত ভাই
শকুনির শলা মেনে যতদূর জানি-
গিয়েছিল খোঁজ নিতে অজ্ঞাতবাসের।
সঙ্গে নিয়েছিল ওরা মুষ্টিমেয় সেনা।
পান্ডবের ছদ্মবেশ যাতে জানা যায়-
ওরা বিরাটের সব গাভী চুরি করে,
এবং নাকাল হয় অর্জুনের বাণে।
ওরা কেউ ধনুকের মহাবলী নয়।
ভীষ্ম দ্রোণ জয়দ্রথ কৃপ অশ্বত্থামা-
কোনো ধনুর্ধর ওই সমরে ছিলনা।
সব যোদ্ধা যদি যেত বিরাট সমরে-
কে তবে বাঁচাত বলো হস্তিনানগর
আকস্মিক আক্রমণে পাঞ্চাল নরেশ
কুরুরাজ্য জিতে নিত। কেউ কি ভাবেনি!
এমন কাহিনি লোকে বিশ্বাস করেছে!
কর্ণ হবে সম্মোহিত! পলাতক হবে!
অর্জুন বাহুতে যদি অত বল রাখে
তবে কেন কৃষ্ণ ছাড়া কিছু সে পারেনা!
আমি এই পৃথিবী তো একাই জিতেছি!
কৃষ্ণ : তোমার জীবন শুধু বেদব্যাস নয়,
অসংখ্য কবির মুখে প্রচারিত হবে।
যে যার মনের মতো গড়ে নেবে তাকে।
কারো কাছে শ্রদ্ধা পাবে, কেউ দেবে ঘৃণা।
আমাদের আজ এই কথোপকথন-
ব্যাসদেব তার এক বর্ণনা দেবেন।
সেই ব্যাখ্যা ভাবীকাল মেনে যে নেবেই
এমন নিশ্চিত জেনো নাও হতে পারে।
যুগে যুগে স্তরে স্তরে সত্যের কাঠামো
অনেক কবির হাতে ভারাক্রান্ত হবে।
ব্যাসদেব ব্যক্তি নন- এক প্রতিষ্ঠান-
নিজের সুবিধামতো কথা বলেছেন।
প্রকৃত কাহিনিগুলো প্রচারের জলে
ডুবে যায়। মাথা তোলে যুগান্তর এলে।
সামর্থ্য তো থেকে যায়- নিজের যুক্তিতে-
তার কোনো মৃত্যু নেই- অব্যয়, অজর।
কিন্তু ওই দিগ্বিজয়- কার হল শেষে?
তোমার পৃথিবী শেষে দুর্যোধন পাবে?
কর্ণ : অবশ্যই সুযোধন! সে ভাবী সম্রাট।
আমি তো চাই-ই-নি হতে সম্রাট কখনো!
মুকুটের লোভ আমি রাখিনা মাধব!
কৃষ্ণ : অঙ্গরাজ্য…
কর্ণ : সে তো এক
কৃষ্ণ : সোনার শেকল?
লোহার শেকল তুমি ছিঁড়ে দিতে পারো-
সোনা দিয়ে গড়া হলে বুঝেও বোঝোনা!
কর্ণ : কিংবা আমি সুখ পাই দাসত্বের মাঝে!
শত হোক, কর্ণ এক সারথীর ছেলে।
সামর্থ্য যতই থাক, ক্ষত্রিয় সে নয়!
অনেক ক্ষত্রিয় আমি অবশ্য দেখেছি-
মেরুদন্ড ঋজু নয়- ক্লীব হয়ে সুখী।
নিজের স্ত্রীকেও বুঝি বেচে দিতে পারে।
সহস্র হাতির বল দেহে নিয়ে কেউ
বৌয়ের ধর্ষণ দেখে মাথা নিচু করে।
তাদের স্বজন তুমি। আমি তো অপর।
কৃষ্ণ : আর কারা, তুমি বলো, তোমার স্বজন?
পাশার আসরে মত্ত প্রিয় যুধিষ্ঠির
সেদিন যা করেছে তার উত্তর দেবনা।
কিন্তু তাতে কৌরবের পাপক্ষয় হবে?
ক্ষুধার্ত ভ্রাতাকে যারা বিষ দিতে পারে?
জতুগৃহ দাহ করে উল্লসিত হয়ে
ভেবেছিল জ্ঞাতিবধ সুসম্পন্ন হল…
কর্ণ : আর সেই জতুগৃহে নিষাদ রমণী
পাঁচ পুত্র নিয়ে সে তো আশ্রয় নিয়েছে!
জতুগৃহ দাহ হবে পান্ডব জেনেছে-
কিন্তু ওই অতিথিকে সতর্ক করেনি।
নিজেরা পড়েছে সরে রাতের সুযোগে।
তারা যদি পুড়ে মরে সুবিধাই হয়-
পান্ডব মরেনি কেউ ভেবেই পাবে না।
মৃতদেহে ভেদ নেই নিষাদে পান্ডবে।
নিচু জাতি। জীবনের মূল্য কতটুকু!
পুড়ে গেল। আগুনে তো কত পোকা মরে!
কী বলো হে যদুপতি, হতেই তো পারে!
পান্ডব সেদিন যদি পলায়ন করে
নিজেদের প্রাণ শুধু রক্ষা করে নিত,
নিষ্পাপের শবদেহে আড়াল না খুঁজে-
এক ঘোর পাপ থেকে ত্রাণ পেয়ে যেত।
আর যত দোষ সখা সুযোধন পেল!
ছলে বলে ও কৌশলে শত্রুনাশ করা-
এই হল রাজনীতি, তাই না কেশব?
নাহলে কী করে হত জরাসন্ধ বধ?
পাপ বলে যদি মরে সামান্য মানুষ।
অবশ্য ও পাপ করে স্বর্গবাস থেকে
যুধিষ্ঠির হয়ত বা বঞ্চিত হবে না।
নিষাদের প্রাণ নিলে পাপ হয় নাকি!
সূতপুত্র যত বড় যোদ্ধা হোক কেন,
অর্জুনের হাতে তার পরাজয় হবে।
যদি না সে হারে, তবে গুজব ছড়াও!
সমরে নামেনি, তবু কাহিনি বানাও!
কী আমার পরিচয়- কে যে বলে দেবে!
সূত নই! ক্ষত্র নই! ব্রাহ্মণও তো নই!
আছে শুধু সামর্থ্যের অর্জন- ধনুক।
আমি এক যোদ্ধা কৃষ্ণ- আর কিছু নই।
কৃষ্ণ : আমি আমি আমি আমি- অ্যাত আমি কেন!
নিজেকে ভোলার চেষ্টা করেছ কখনো?
অধিকার আকাঙ্ক্ষার সেই যে লড়াই
তার বুঝি কোনোদিন নিষ্পত্তি হবে না?
দ্রৌপদীকে চেয়েছিলে। ব্যর্থ হয়েছিলে।
ওই এক লক্ষ্যভেদ অপূর্ণ রয়েছে।
আজ তুমি বৃদ্ধ। তবু জরাগ্রস্ত নও।
যার অপমানে বুকে আগুন জ্বেলেছ,
তার আকর্ষণ কই আজও তো ভোলোনি!
সেই দ্বেষ একইভাবে বুকে ধরে আছো।
পরম পুরুষ তুমি, সেদিন সভায়
অসহায় মেয়েটিকে বেশ্যা বলে দিলে!
নারীর সম্মান যদি পুরুষ না করে,
হাতের নাগালে চায় খিদের কারনে,
তাকে কিন্তু বীর নয়, জন্তু বলা যায়।
কর্ণ : জন্তু শুধু শ্বাস নেয়। বিশ্বাসের বল
জন্তুর হৃদয়ে কৃষ্ণ কখনো কি থাকে?
নারীর সম্মান যদি নর কেড়ে নেয়,
যদি তাকে সভাগৃহে বস্ত্রহীনা করে,
তুমি তাকে জন্তু বলো, অনায়াসে বলো।
কিন্তু পুরুষের বুঝি সম্মান থাকেনা-
নারী বুঝি অনায়াসে অপমান করে
পুরুষের আত্মবল কেড়ে নিতে পারে?
জাতির কারনে কৃষ্ণা যেদিন আমাকে
স্বয়ংবর সভা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল-
বস্ত্র বুঝি মানুষের শরীরেই থাকে?
পৌরুষের বুঝি কোনো কাপড় লাগেনা?
আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে পাঞ্চালী সেদিন
ভরা সভাগৃহে, বলো, সঠিক করেছে?
গ্রহণের মতো কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়ার
রীতি আছে, আছে কিছু আচরণবিধি।
বীরের তো জন্ম নয়, পরিচয় শুধু
সামর্থ্যের নিরিখেই নির্ধারিত হবে।
দৈবের আয়ত্তে ছিল কূলের গৌরব-
আমার আয়ত্তে ছিল নিজের পৌরুষ।
মুঠোতে বালুকা ধরে রাখে সাধ্য কার?
যদি থাকে হাতে ঘাম, বালি রয়ে যায়।
শিশুকাল থেকে যারা ক্ষত্রিয়ের বেশে
করে গেল অত্যাচার- দ্রৌপদী সেদিন
নিবিড় নিতম্ব আর স্তনের গৌরবে
অপূর্ব মুখশ্রী নিয়ে তাদেরই মতন
বাপের রাজত্বে বসে সূতপুত্রটিকে
যদি বলি হেলাভরে ধর্ষণ করেছে?
অতঃপর কী করেছে? পাঁচ-পাঁচ স্বামী!
ক্ষমা করো, কেউ কি তা মেনে নিতে পারে?
তখন কোথায় গেল কুলের গৌরব?
বসুষেণ স্বামী হলে মান যেত তার,
পাঁচ ভাই একসাথে… রমণের কালে
কোনোদিন নিজেকে কি গণিকা ভাবেনি!
সেদিন সভায় শুধু বলেছি সে কথা
যে কথা সবাই আজ মনে মনে বলে।
শ্বাস নয়, ওই কথা বিশ্বাস বলেছে।
বিশ্বাস কেবল জানি ঈশ্বরের দান-
জীবনের পথে এক দুরূহ অর্জন।
কৃষ্ণ : কৃষ্ণা এক অগ্নিশিখা। রম্যনারী নয়।
ওর স্তন-নিতম্বকে ওভাবে দেখোনা।
মাংসে গড়া দেহ ওর- মাংসের অতীত।
দ্রৌপদীর জন্য নয় মোহ কিংবা শোক।
অধর্ম বিনাশে ওর ভূমিকা রয়েছে।
আমি থেকে মুক্তি নাও প্রিয় রশ্মিরথী।
কাজ আর জ্ঞান তুমি ঘুলিয়ে ফেলেছ।
‘আমি’-র অতল থেকে আজও কোনো বীর
শ্বাস ধরে রেখে জেনো ফেরত আসেনি।
সে হল জ্ঞানের পথ। আত্মারাম পারে।
কাজ যদি করো রেখে ফলের কামনা,
এ জীবনে মুক্তি নেই, পরিত্রাণ নেই।
গাছ তার ফল দেয়। ফল ত্যাগ করে।
অপর দিগন্তে তাই বন গড়ে ওঠে।
সেই বন ছায়া দেয়, ফুল-ফল দেয়।
বনের বিস্তার হয় প্রত্যাশা না রেখে।
সেই বনে পশুরাও বসবাস করে-
তারাও আশ্রয় পায়, ভেদাভেদ নেই,
তারা তো হনন করে ক্ষুধার কারনে-
হত্যার আনন্দে পশু শিকার করেনা।
শত্রু আর মিত্র এক, মায়ায় পৃথক-
যুদ্ধক্ষেত্র সে তো এক দর্পনের মতো।
যোদ্ধার কর্তব্য শুধু অধর্মের নাশ।
অধর্ম কী? ধারণের ক্ষমতা রাখেনা,
অথচ তা মানুষের জীবন-মরণ
অত্যাচারে অবিচারে দুর্বিষহ করে।
জেনে রেখো দুর্যোধন অসৎ। কারন
সিংহাসন শুধু তার ‘আমি’-র জিনিস।
দায়িত্ব-কর্তব্য নয়। শুধুই অহং।
পৃথিবীকে ‘আমি’ ছাড়া কিছু সে দেবেনা।
তার আমি ভার এই পৃথিবীর বুকে।
পাঞ্চালী সে ভার থেকে মুক্তি এনে দেবে।
অর্জুনের ভীমের সে প্রেরণাস্বরূপা।
কর্ণ : এ তোমার লোকনীতি? নাকি ধর্মমত?
ওরা তো আয়ূধ জানি তোমারই হাতের!
ভীমসেন খুব বেশি চিন্তাশীল নয়।
কিন্তু ধনঞ্জয় সে তো তোমার কৃপায়
আদর্শ ক্ষত্রিয় আজ- কলের পুতুল।
কৃষ্ণ : সবাই পুতুল সৌত। কেউ বাকি নেই।
কলের পুতুল নয়। কালের পুতুল।
আমিও পুতুল এক- স্বয়ং আয়ূধ।
কিন্তু এই স্ব-কে যেন অহং ভেবোনা।
আমিত্বকে বাদ দিয়ে অন্য এক ‘আমি’-
সেই ‘আমি’ সর্বভূতে বিরাজিত দ্যাখো।
তুমিও ‘আমি’-র এক অভিন্ন প্রকাশ-
দুর্যোধন সে ‘আমি’-র খবর রাখে কি?
দুর্যোধন স্বৈরাচারী। প্রতাপলোলুপ।
যে কোনো যুগেই জেনো কোনো দুর্যোধন
যদি আসে তবে তার পতন ঘটাতে
কোনো এক গোবিন্দকে জন্ম নিতে হয়।
যুধিষ্ঠির ব্যক্তিরূপে দুর্বল নিশ্চয়ই-
সে ‘আমি’-র ব্যভিচার করেনি কখনো।
কর্ণ : একমাত্র ব্যতিক্রম দ্যুতের আসর।
কৃষ্ণ : সেদিনের আচরণ নিন্দনীয় বটে,
পাপ নয়। অধর্মের দৃষ্টান্ত বলেনা।
কর্ণ : মহিষীকে পন রাখা- অধর্ম বলে না!
ধর্ম তো ধারণ বন্ধু! অন্য কিছু নয়!
সাধারণ কোনো লোক মদের নেশায়
স্ত্রীকে যদি বেচে দ্যায়- সেটার কী হবে?
সুযোধন অহংকারী। কিন্তু যুধিষ্ঠির?
সে তো এক কাপুরুষ! মেরুদন্ড নেই-
ভীম আর অর্জুনের বাহুবল যদি
সে না পায় তবে সে তো অসহায় কীট!
সাম্রাজ্যের অধিকার কোন মুখে চায়!
তুমি বন্ধু মহাজ্ঞানী। বেদব্যাস ছাড়া
তোমার অতুল মেধা কারো কাছে নেই।
আমি তো শাস্ত্রজ্ঞ নই। সেই অধিকার
সমাজের বিধিমতে অপ্রাপ্য আমার-
দ্বাপরে তলিয়ে গেছে সত্যযুগ আজ।
বহুযত্নে তবু আমি বেদের অভ্যাস
করেছি কেবল যাতে পরশুরামের
প্রবেশিকা পরীক্ষাতে বিফল না হই।
মহেন্দ্রগিরির পথে যখন চলেছি
পথে দেখা পাই এক সুযোগ্য গুরুর।
আমার মুখশ্রী তাঁকে প্রীত করেছিল।
জাতি, গোত্র, কুল, মান কিছু না শুধিয়ে
শিষ্যপদ তিনি তাই সানন্দে দিলেন।
চারবেদ জানি আমি সম্যকভাবেই-
বহু ব্রাহ্মণের চেয়ে যোগ্যতাও রাখি।
মনের শক্তির সেই তীব্রতম রূপ-
শর নয়, তির নয়- এক দিব্য বাণ।
হাত তাকে পায় যদি মন্ত্রবল থাকে।
মনের পরম সেই সংযোগের ক্ষণ-
লক্ষ্য আর যোদ্ধা যেন এক হয়ে যায়!
মনে ক্লেদ রেখে তার অভ্যাস কি হয়?
সে তো এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের মতো-
ধীর স্থির অবিচল উদাত্ত নিক্ষেপ!
পৃথিবীতে মহাবীর তাই এত কম-
ক্ষত্রিয়ের পরিচয়ে হাজার হাজার
যোদ্ধার পোশাক পরে রণক্ষেত্রে নামে।
ওরা কেউ বীর নয়- যুদ্ধব্যবসায়ী।
অন্নলোভে যুদ্ধে যায়- রক্তপাত করে।
এও জানি মহাপূন্য সূতের নিধন-
যদি সেই সূত মুখে বেদমন্ত্র আনে।
তরল সুবর্ণ তার মুখে ঢেলে দিয়ে
শুদ্ধ করে নিতে হয়- সামাজিক রীতি।
চারবেদ জানি তবু ব্রাহ্মণ তো নই-
জন্ম পরিচয়ে তাঁকে ছলনা করেছি
দিয়ে সেই পরিচয়। পরশুরামের
কাছে কোনো ক্ষমা নেই। অভিশাপ দিতে
দ্বিধা তিনি দেখাবেন প্রিয় শিষ্যটিকে-
তা কি হয়? তাই দ্যাখো, অভিশপ্ত আমি।
আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী তাহলে
ভুল কিছু করেছে তা কী করে বা বলি!
জন্মপরিচয়ে কর্ণ ক্ষত্রিয়ও তো নয়!
কৃষ্ণ : দ্রৌপদী সেদিন যদি কর্ণের বদলে
পার্থের গলায় মালা না পরিয়ে দিত,
ভারতের ইতিহাস এমন হত কি?
সাধারণ নারী নয় ওই কালো মেয়ে।
কৌরবের মৃত্যু হয়ে পৃথিবীতে এল।
ধৃষ্টদ্যুম্ন আর কৃষ্ণা যজ্ঞের ফসল।
যাজ্ঞসেনী নাম ওর। ওর মুখ, স্তন
নিতম্ব, কোমর- সবই অমোঘ আয়ূধ।
ওকে তুমি পাবে সে তো ভবিতব্য নয়!
নিয়তির লেখা শেষে খন্ডাতে কি চাও!
তুমি তো জানো না আজও নিজের স্বরূপ!
কে তুমি, কেমন করে পৃথিবীতে এলে!
এমন সামর্থ্য নিয়ে এত তেজ নিয়ে
কোনো শিশু এসেছে কি সারথীর ঘরে?
বিশ্বাসের কথা তুমি শ্বাসের বদলে
কিছুক্ষণ আগেই তো বলেছ তাই না?
তোমার বিশ্বাস হয়, সূতপুত্র তুমি?
কর্ণ : ছলনাতে সিদ্ধহস্ত, দেবকীনন্দন,
মনে হয় কোনো ছক কষে আজ তুমি
আমাকে এ রথে আজ আহ্বান করেছ।
কী চাও বলো তো বন্ধু, কৌরব শিবির
ত্যাগ করে যোগ দিই পান্ডবের দলে?
কৃষ্ণ : পান্ডবের দলে নয়। পান্ডু-পরিবারে।
কর্ণ : জামাতা হিসেবে নাকি? অর্জুনের হয়ে
বিবাহ প্রস্তাব তুমি নিয়ে এলে বুঝি!
হাহাহাহাহাহাহাহা!!!!!! বৃহন্নলা যদি
আমার গলায় আজ মালা দিতে চায়
মন্দ নয়, যদুপতি, পাঞ্চালী তাহলে
সূতের সতীন হয়ে জীবন কাটাবে।
যুদ্ধ তো হবে না কিন্তু তেমন বিরহ
সখীটিকে দেবে তুমি? ভালো করে ভাবো!
কৃষ্ণ : আজ প্রায় হয়ে গেল নব্বই বছর।
মহাক্রোধী মুনি এক ভ্রমণের কালে
কোনো রাজ্যে কিছুদিন অতিথি ছিলেন।
রাজাটির ছিল এক কুমারী দুহিতা।
ভীত ত্রস্ত সেই রাজা কন্যাটির হাতে
মুনির সেবার সব দায়িত্ব দিলেন।
দুর্বাসা মুনির নাম অবশ্য শুনেছ-
অভিশাপ দিতে তিনি অদ্বিতীয় নাম।
দিন-রাত এক করে একান্ত সেবায়
কন্যা সেই দুর্বাসার মন জয় করে
অভিশাপ মোটেই না, বর পেয়ে গেল-
যে কোনো দেবতা এসে শুধু এক ডাকে
পৃথিবীতে তাকে এক ছেলে দিয়ে যাবে।
বরলাভ হল তার- কিছুদিন গেল-
মনে হল রাজকন্যা অন্যমনা যেন!
প্রথমে সন্দেহ ছিল। পরে বোঝা গেল
দেখা গেল একে একে গর্ভের লক্ষণ।
কার তেজ পেটে তার? মেয়েটি জানাল-
সূর্যদেব এসে ওই ফল দিয়েছেন।
পরম সৌভাগ্য বটে, আবার দুঃখের-
কুমারী মেয়ের যদি পুত্রলাভ হয়-
বাপ তিনি যেই হোন, অভিশাপ ছাড়া
আর কিছু এ-সমাজে বলা তো যায়না।
রাজার কলঙ্ক হবে, বংশের সুনাম
চিরতরে নষ্ট হবে। এখন উপায়?
কর্ণ : এমন কাহিনি সে তো অজস্র শুনেছি!
কেচ্ছা যত শুনি শুধু ঘৃণা জাগে মনে।
মুনি আর দেবতারা রমণে ওস্তাদ-
সামান্য মানুষ হলে দোষ হয়ে যায়।
কৃষ্ণ : যথাকালে পুত্র হল। অসামান্য রূপ!
যে দেখে সে চোখ আর ফেরাতে পারেনা।
খুব বেশি চোখ তাকে অবশ্য দ্যাখেনি।
রাজকন্যা নিজে আর তার প্রিয় সখী।
শীঘ্র তাকে দিতে হল নদীতে ভাসিয়ে।
কর্ণ : এতদূর থাক কৃষ্ণ। আর স্পৃহা নেই।
এত নোংরা উপাখ্যান আর শুনিও না।
কৃষ্ণ : নদীতে যা জল ছিল তার চেয়ে ঢের
মায়ের দু-চোখ থেকে ঝরেছে সেদিন।
সেই কান্না আজও তার বুকে জমে আছে।
সকলের অগোচরে আজও মেয়ে কাঁদে।
কর্ন : আর সেই পুত্রটি যে পৃথিবীতে এসে
কোনো আলো দুটি চোখে দেখার আগেই
মরে গেল? সেই পাপ- শাস্তি তো হবেই!
কান্না খুব লঘু দন্ড- সে তো পাপীয়সী!
তার প্রতি এত দয়া কেন হে মাধব?
কৃষ্ণ : বাপের ভগিনী তিনি, পরম স্বজন-
এই দুর্বলতা তাই স্বাভাবিক খুব।
কর্ণ : বলো কী হে! ক্ষমা করো। না জেনে তোমাকে
আঘাত করেছি বন্ধু। তারপর বলো-
কৃষ্ণ : এমন সন্তান কেউ কখনো দ্যাখেনি।
আশ্চর্য উজ্জ্বল ছিল শিশুটির ত্বক-
হাত দিলে মনে হত ধাতব, কঠিন-
যেন কোনো তীক্ষ্ণ অস্ত্র ভেদ করে যাবে-
জন্ম থেকে সেই পথ রুদ্ধ করা আছে।
ত্বক নয়, যেন এক অক্ষয় কবচ-
শরীরে জড়িয়ে আছে আশির্বাদ হয়ে।
নদীতে দেওয়ার আগে দুই কান তার
সযত্নে সজ্জিত ছিল অপূর্ব কুন্ডলে।
সাধারণ শিশু তাকে ভাবা অসম্ভব-
পৃথিবীতে অজেয় সে দেখে বোঝা যায়।
যে কেউ কুড়িয়ে পেলে তার ঘরে সে তো
দেবের আশিস রূপে বিরাজিত হবে।
কর্ণ : কৃষ্ণ, তুমি কোন পথে যেতে চাও আজ?
তুমি জাদুকর। জানি। আতঙ্কিত আমি-
তোমার ছলনা আজ কোন রঙ্গ চায়?
জীবন নাটক নয়, কিন্তু তুমি দেখি
নাট্যগুণ ছাড়া তাকে গ্রহণ করোনা।
কৃষ্ণ : নিজের জন্মের কথা কতদূর জানো?
কর্ণ : যতটা যে কেউ জানে, তার বেশি নয়।
অধিরথসূতপুত্র রাধামা-র ছেলে-
আমি যোদ্ধা বসুষেণ এটুকুই জানি।
অনেক লাঞ্ছনা সয়ে যথাসাধ্য ওঁরা
আজীবন ছেলেটিকে ভালোবেসেছেন।
আমি তাঁর বাধ্য পুত্র নই বটে, তবু
বাবার পায়ের কাছে বসে চিরকাল
জীবনের বহু শিক্ষা পেয়েছি মাধব।
নিজেকে রাধেয় বলি, গর্ব করে বলি-
আমার মায়ের চেয়ে স্নেহময়ী কেউ
পৃথিবীতে আর নেই। ভাগ্যবান আমি।
কিন্তু তুমি যেন কোনো জটিল ইশারা
করে যাচ্ছ বলে ওই কবচের কথা!
অমন কবচ এই পৃথিবীতে শুধু
একজন জন্মসূত্রে ধারণ করেছে-
আমি সেই একমাত্র ব্যক্তি বসুষেণ!
কানের কুন্ডল সেও- আমার বর্ণনা!
আর কেউ এই বিশ্বে আছে কি অমন?
এই কাহিনির যিনি কানীন সন্তান-
তিনি কি জীবিত আজ? কোন পরিচয়ে?
আমার সদৃশ তিনি- কৌতূহল তাই।
কৃষ্ণ : হ্যাঁ তিনি জীবিত আজ। বিখ্যাত পুরুষ।
তাঁর পরিচয় তুমি অচিরেই পাবে।
আবার জিজ্ঞাসা করি, প্রিয় বৈকর্তন-
তোমার বিশ্বাস হয়, সূতপুত্র তুমি?
কর্ণ : অবিশ্বাস কেন হবে? কারন কি এই-
সূতের পুত্রের কোনো সামর্থ্য থাকেনা?
ভীমসেন সেই কথা সগর্বে বলেছে
অর্জুনের প্রতি আমি দ্বন্দ্বের আহ্বান
যেদিন করেছি সেই অস্ত্র পরীক্ষায়।
সেই কথা আজও কানে সীসা ঢেলে দ্যায়।
কিন্তু ওই বৃকোদর- কে তাকে বোঝাবে
সামর্থ্য কৌলীন্যে নেই। জন্মগত গুণ।
থাক কৃষ্ণ। তুমি বলো সেই নারী আজ
তিনি কি জীবিত? আর সেই পুত্র তাঁর?
কৃষ্ণ : আজ সেই নারী এই হস্তিনানগরে।
একদা ছিলেন রাজা ভোজের দুহিতা।
পান্ডুর বিধবা আজ। পান্ডবজননী।
কুন্তী নামে পরিচিতা তিনি ত্রিভুবনে।
তাঁর পুত্র ধনঞ্জয়- তোমার অনুজ-
যাকে শুধু শত্রু ভেবে কাটালে জীবন।
এ কী! কেন ছেড়ে দিলে রথের লাগাম!
দাঁড়াও দাঁড়াও বন্ধু… আমি হাতে নিই!
সত্যের সম্মুখে এসে অবশ হয়েছ!
তোমার কাছে তো সেটা প্রত্যাশিত নয়!
কর্ণ : সুযোধন ঠিক বলে, মিথ্যাচারী তুমি।
যুদ্ধের কামনা ওই অন্তরে রেখেছ-
অথচ এসেছ এই হস্তিনানগরে
যেন তুমি শান্তি আর কল্যাণ এনেছ।
আমার জীবনে কোন বিষ ঢেলে দিতে
তুমি এই রথে আজ আমন্ত্রণ দিলে?
জারজ সন্তান আমি! এ বৃদ্ধ বয়সে
এটুকু শোনাই বুঝি বাকি রয়ে গেছে?
এভাবে কি পান্ডবের জয় হবে ভাবো?
কর্ণকে বিভ্রান্ত করে কৌরবের পিঠে
ছুরি মেরে কোন শান্তি পৃথিবীকে দেবে?
কৃষ্ণ : পৃথিবীকে শান্তি দিতে আসিনি তো আমি।
আমি বৃদ্ধ কাল, যাতে লোকক্ষয় হয়
অধুনা সংহারে তাই প্রবৃত্ত হয়েছি।
পৃথিবীর ভার আজ সহ্যের অতীত।
সামান্য জনতা যারা- ক্ষত্রিয়ের তাপে
হয়ে আছে পর্যুদস্ত- মুক্তি পাক তারা।
ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা- ভয়ানক নাম
এঁদের প্রতাপ থেকে মুক্তি পাক মাটি।
সেই মুক্তি শান্তি নয়- জীবনের দাবী।
শান্তি শুধু শ্মশানেই শোভা দিতে পারে,
যুদ্ধ- সে তো জীবনের অমোঘ নিয়ম।
যুদ্ধ হল কর্মযোগ- করে যেতে হবে।
কর্ণ : ওসব বচন তুমি পার্থকে শুনিও।
দুর্বল চরিত্র তার। ওসব কথায়
সহজেই মন তার গলাতে পেরেছ।
সব ধর্ম ত্যাগ করে তোমার শরণ
ওই ব্যক্তি বহুকাল নিয়ে বসে আছে।
যুধিষ্ঠির, ভীম আছে। তাদের শোনাও।
কৌরব-পান্ডব নয়, যাদবের জয়
এই তুমি চাও কৃষ্ণ। এই তুমি চাও।
তোমাকে মার্জনা করি এত উদারতা
আমি আর সম্ভবত দেখাতে পারিনা।
কৃষ্ণ : মনে হচ্ছে দুর্যোধন দু-বাহুই নয়
তোমার জিভেরও আজ মালিক হয়েছে।
এ তোমার তমোগুণ। আর কিছু নয়।
সত্তগুণে তুমি হলে শ্রেষ্ঠতম দাতা।
রজোগুণে পৃথিবীর অদ্বিতীয় বীর।
অসীম মেধাবী তুমি বেদে পারঙ্গম।
ধনুক নিজের তেজে অর্জন করেছ।
ব্রাহ্মণের জ্ঞান আর ক্ষত্রিয়ের তেজ-
একাধারে যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন।
ভীমের অমিত বল ধরেছ শরীরে
নকুলের মতো তুমি সুদর্শন নর।
সহদেবতুল্য তুমি শাস্ত্রজ্ঞান রাখো।
পাঁচ পান্ডবের তুমি একাই সমান।
এবং কুন্তীর তুমি প্রথম সন্তান।
তোমার সমস্ত গুণ তোমার ভ্রাতারা
অংশত পেয়েছে বটে, পুরোটা মেলেনি।
কর্ণ : ক্ষমা করো এ বৃদ্ধের ক্ষণিক আক্ষেপ।
নিজেকে সংযত রাখা অসম্ভব ছিল।
বিশ্বাস তোমাকে আমি করিনা কেশব।
তোমার আরেক নাম রণত্যাগী, জানি।
অনেক কৌশলে আজ এই মহারণ
তুমিই ঘটালে সে তো সকলেই বোঝে।
শান্তির অছিলা সে যে মস্ত এক ভান-
এইমাত্র নিজমুখে স্বীকার করেছ।
লোকক্ষয় যদি হয় উদ্দেশ্য তোমার
তবে তুমি তাই করো! পান্ডব সহায়।
আমার জন্মকে কেন কলঙ্কিত করো!
যেটুকু আশ্রয় এই জীবনে পেয়েছি
তাকেও বিনষ্ট করে কী লাভ তোমার?
কৃষ্ণ : আজ তুমি বৃদ্ধ বৃষ, আর কতদিন?
যুদ্ধে হোক রোগে হোক শেষ সন্নিকট।
সত্য পরিচয় থেকে দূরে রয়ে যাবে?
যাও আজ প্রশ্ন করো পিতাকে মাতাকে।
বলো বাসুদেব এই সংবাদ দিয়েছে।
কর্ণ : আজই যাব। আজই আমি নিজগৃহে গিয়ে
জেনে নেবো জনার্দন সত্যবাদী কত।
কিন্তু আমি প্রাণ দেব কৌরবের হয়ে।
কুন্তীর সন্তান যদি কবচে কুন্ডলে
শোভিত হয়েই থাকে আমার সদৃশ-
সে হবে অপর কেউ। আমি তো সে নই।
এমন কবচ আর এমন কুন্ডল
হতে পারে এ জগতে আরো কেউ কেউ
অঙ্গে নিয়ে জন্ম নিল। যোদ্ধারূপে তারা
কোনোদিন নিজেদের করেনি প্রকাশ।
কৃষ্ণ : কিছুক্ষণ আগে বন্ধু নিজেই বলেছ
অমন কবচ এই পৃথিবীতে শুধু
একজন জন্মসূত্রে ধারণ করেছে।
কর্ণ : আমার পিতার নাম অধিরথসূত।
রাধা মা-কে আমি শুধু মাতা বলে জানি।
আর কেউ নিতে পারে এঁদের আসন
সেই সম্ভাবনা কৃষ্ণ কিছুমাত্র নেই।
কৃষ্ণ : আর যদি সত্যি হয় যে কথা বলেছি?
সম্মুখে যে মহারণ, কার পক্ষ তুমি
নেবে হে বিজয় ধারী? কৌরবের হয়ে
সহোদর ভ্রাতাদের বধ করে যাবে?
আমি নিজে ক্ষত্রিয়ের পুত্র, তবু বলি-
ক্ষত্রিয়ের অবসান প্রয়োজন হল।
পৃথিবী অস্থির আজ অত্যাচার সয়ে।
সাধারণ মানুষের জীবনের দাম
কিছুমাত্র নেই আজ রাজদরবারে।
দুর্যোধন রাজা হলে মরে যাবে ওরা।
তুমি পারো একমাত্র ত্রাণ এনে দিতে।
প্রথম যৌবনে সেই পন নিয়েছিলে
ধনুকের অধিকার যদি তুমি পাও
সামান্য লোকের হয়ে যুদ্ধ করে যাবে।
পরশুরামের শিষ্য তুমি বসুষেণ।
ক্ষত্রিয়ের চিরশত্রু তোমার শিক্ষক।
অঙ্গরাজ কর্ণ সেই যুবকের চেয়ে
বহুদূরে চলে গেছে- যেন সে অচেনা!
ফিরে এসো বসুষেণ। নিজ পরিচয়ে।
তোমার সাম্রাজ্য এই হস্তিনানগর।
সম্রাট পান্ডুর তুমি প্রথম সন্তান-
শাস্ত্রমতে যুধিষ্ঠির তোমার অনুজ।
হস্তিতুল্য ভীম হবে তোমার সেবক।
ধনঞ্জয় সেনাপতি। বাকি দুই ভাই
একনিষ্ঠ ব্রত নেবে তোমার অধীনে।
বীরপ্রসবিনী কুন্তী তোমার জননী।
কর্ণ : যদি কৃষ্ণ সত্যি হয় তোমার কথাই
তবু বলি একান্তই অপারগ আমি
পুত্রঘাতী নারীটিকে জননী হিসেবে
রাধার আসনে কোনো স্থান করে দিতে।
দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী যদি ভ্রাতা হয়ে
আমাকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে-
তবে সেই আগুনের কী হবে কেশব?
সে যদি না জ্বলে থাকে, নিভে যাব আমি।
কৃষ্ণ : পুত্রঘাত নয় বৃষ। বলিদান বলো।
ওই বলিদান তাঁকে মহৎ করেছে।
পশুও তো ভালোবাসে সন্তানের মুখ!
পরমা মানবী পারে পুত্রবলি দিতে।
আর যদি পাঞ্চালীর প্রসঙ্গ তুলেছ-
দ্রৌপদীকে তুমিও তো ভার্যারূপে পাবে!
সে তোমার অধিকার। অন্যথা হবেনা।
কর্ণ : হাস্যকর কথা কেন শোনাও কেশব!
পাঞ্চালী জীবনে সেই শূন্যতা আমার
যা আমাকে প্রতিক্ষণে জাগিয়ে রেখেছে।
যদি সেই শূন্যতাটি ছেড়ে চলে যায়-
তবে কোনো সিংহাসন যথেষ্ট হবেনা।
নারী কারো অধিকারে কখনো আসেনা।
কেবল দ্রৌপদী নয়, যে কোনো রমণী
অধিকার তুচ্ছ করে- সম্পত্তি সে নয়।
প্রতিটি নারীর বুকে আগুন রয়েছে-
বেশ্যা হোক, রানী হোক- আমারই মতন।
যুদ্ধ হবে- যুদ্ধ হোক। আমিও প্রস্তুত।
পৃথিবীর ভার আজ সহ্যের অতীত।
সামান্য জনতা যারা- ক্ষত্রিয়ের তাপে
হয়ে আছে দিশাহারা- মুক্তি পাক তারা।
ভীষ্ম, দ্রোণ, জয়দ্রথ- ভয়ানক নাম
এঁদের প্রতাপ থেকে মুক্তি পাক মাটি।
এ হবে আরেক রূপ, গুরুদক্ষিণার।
পরশুরামের শিষ্য আমি বাসুদেব-
নিঃক্ষত্রিয় করেছেন উনি পৃথিবীকে
এক নয়, দুই নয়- একুশটি বার-
এ বিষয়ে একমত হতে বাধা নেই।
যদি চাও দিয়ে দেব আত্মবলিদান।
কিন্তু আমি প্রাণ দেব কৌরবের হয়ে।
কৃষ্ণ : যাতে না লোকের মুখে অপযশ হয়-
রাজ্য দিল দুর্যোধন, কিন্তু কর্ণ তাকে
ত্যাগ করে চলে গেল সাম্রাজ্যের লোভে?
যদি তুমি প্রাণ দাও কৌরবের হয়ে
কর্ণ খল, কর্ণ কূট – এইসব কথা
চিরকাল কিছু লোকে বলে যাবে তবু।
আমার চরিত্র নিয়ে অপবাদ কিছু
কম নয় বসুষেণ তুমি সেটা জানো।
কিছু আগে নিজমুখে উত্তেজনাবশে
তার কিছু অংশ তুমি উদ্ধৃত করেছ।
সকলের চোখে ভালো, এমন মানুষ
পৃথিবীতে কোনোকালে কোনো দেশে নেই।
তুমি-আমি বহুক্ষেত্রে বহুভাবে এক।
আমিও তোমার মতো ক্ষত্রিয় মাতার
গর্ভে জাত তবু দ্যাখো পালিত হলাম
যশোদার গৃহে গিয়ে কৈশোর অবধি।
আমাকে গোয়ালা বলে ব্যঙ্গ করে লোকে-
তোমাকে সারথী বলে যেমন অনেকে।
তোমার মাতার নাম স্নেহময়ী রাধা-
আমার প্রিয়াকে আমি ছেড়ে চলে আসি-
জীবনের পথে তাকে সঙ্গে নিতে পারি
সেই অধিকার এই সমাজে মেলেনি।
তার নামও রাধা ছিল। ছিল বিবাহিতা।
এ-দুজন জীবনের প্রেরণা দিয়েছে-
আমাদের নামে তাই যুক্ত তারা আজ-
তোমাকে রাধেয় বলে, আমি রাধানাথ।
তোমার মানসী দ্যাখো- সেও বিবাহিতা।
তুমি-আমি ভাগ্যবান- শুধু এক নন
আমাদের রয়েছেন দুই-দুই মাতা!
ব্রাহ্মণের ক্ষত্রিয়ের আর শূদ্রের গৃহের
জল-আলো-বায়ু নিয়ে বর্ধিত হয়েছি।
যে শূন্যতা তুমি আজ বুকে নিয়ে ঘোরো,
তার ভাগ আমাকেও দিয়েছে জীবন-
কিছু কম নয় কর্ণ- দিল সমমাপে।
কর্ণ : শূন্যতার পরিমাপ হয়না মাধব।
কৃষ্ণ : হয়না যদি তা হয় ব্যক্তিগত ফাঁক।
ব্যক্তিগত শূন্যতাটি সমাজের বুকে
নিম্নচাপ হয়ে যদি বৃষ্টি ডেকে আনে-
সমাজের লাভ হয়, অন্যথায় জেনো
ভয়াল তুফান আসে, বহু হানি হয়।
অর্থলোভ যশোলোভ রমণীর লোভ-
শক্তিমান মানুষের জন্য এরা নয়।
আজ বহু নিম্নচাপ একত্রে মিলেছে-
দিগন্তে দিয়েছে দেখা আসন্ন সমর।
তুমি-আমি গড়া কর্ণ সেই শূন্যতায়-
শুধু তুমি পথহারা, আমি অবিচল।
অস্তিত্বের গর্তটিতে যেই উঁকি দিলে-
ত্রস্ত হয়ে সরে এলে- ভয় পেলে কেন?
মরণের ভয় নয়- জীবনের ভয়?
জীবনের মধ্যে থেকে যুদ্ধ করো বীর।
ধনঞ্জয় কিছু নয়, শত্রু যদি কোনো
তোমার জীবনে থাকে, সে স্বয়ং তুমি।
নিজের ‘আমি’-কে আজও জয় করা বাকি।
অর্জুন দুর্বল ঢের তোমার সম্মুখে-
কিন্তু তুমি নিজে কর্ণ? তুমি কি সক্ষম
জীবনের মুখোমুখি খোলা চোখ নিয়ে
অস্ত্র হাতে ঋজু হয়ে দৃষ্টিপাত করো?
কর্ণ : জীবন ফুরিয়ে এল। বৃথা বাক্যব্যয়।
অর্জুনের হাতে আমি বীরগতি পাব,
অথবা নিধন তাকে করে তারপর-
বীভৎস অসুখে কোনো বিছানায় শুয়ে
সামান্য পশুর মতো চলে যাব আমি।
স্বর্গে যাব, কিংবা হয়ত ঠিকানা নরক।
কৃষ্ণ : বীরগতি বলে বটে, আসলে তো লয়!
আসলে মরণ হয় কুকুরের মতো।
বাহুবলে অন্ধ হয়ে কোনো নরপশু
যুদ্ধক্ষেত্রে মরে যদি সে কি বীর নাকি!
যোদ্ধার মৃত্যুতে যদি চিরস্থায়ী লাভ
সমাজের হয় তাকে বীরগতি বলি।
মরণে সার্থক যদি হয় কোনো লোক-
তবে পায় অমরত্ব! তার কমে নয়।
কর্ণ : অমরত্ব তুমি নাও। আমি রয়ে যাই
নিষ্ফল হতাশ কিছু মানুষের ভিড়ে।
তবে কথা দিয়ে যাই, তোমার সংবাদ
সত্য যদি হয় তবে এটা জেনে রেখো
ভ্রাতার শোনিত আমি হাতে লাগাবনা।
অর্জুনের বধ আর বসুষেণ নয়
অন্য কেউ যদি করে, তবে সেটা হবে।
সে কাজে সক্ষম কেউ এই পৃথিবীতে
আছে বলে জানা নেই। অতএব তুমি
ফিরে যেতে পারো আজ নিশ্চিন্ত হয়েই।
পরাজিত হবে পার্থ আমার হাতেই-
কিন্তু তাকে জয় নয়, ত্রাণ দেব আমি।
আছে সেই অভিশাপ পরশুরামের-
দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ আমি ভুলে যাব ঠিক
যখন আসন্ন হবে সংকটের কাল।
আরো আছে শাপ এক- তুমি তো তা জানো
রথের চাকাটি গিলে নেবেন পৃথিবী-
অস্ত্রহীন রথহীন একা অসহায়-
অর্জুনের হাতে মৃত্যু- হার নয়- বধ-
কৃষ্ণ : তোমার বাহিরে কোনো অভিশাপ নেই।
তুমি অভিশপ্ত শুধু নিজের চেতনে।
অভিশাপ সে তো এক মানস ঘটনা-
তুমি জানো শপ্ত তুমি- সেই তার বল।
সে তোমার অন্তর্গত অপরাধবোধ-
গুরুকে ছলনা করে- শাস্তি নিতে চাও।
কর্ণ : হত্যার নাটক হবে। উপভোগ কোরো।
আসলে তো পার্থ নয়, গান্ডীব তোমার-
তোমার উদ্দেশে এই প্রাণ দিয়ে যাব।
অবশ্য যদি না আজ সূত অধিরথ
তোমার মিথ্যার কথা ফাঁস করে দ্যান।
কৃষ্ণ : আমি সদা চিন্তাহীন জেনো বৈকর্তন।
ফলের প্রত্যাশা আমি কখনো করিনি।
যেটুকু কর্তব্য আছে পৃথিবীর প্রতি
সেটুকু সমাধা হলে তোমার মতোই
এই বিশ্ব চিরতরে ত্যাগ করে যাব।
সম্মুখে যে মহারণ- তার মধ্যে আমি
মৃত্যুর কারন হব অনেক বীরের।
আমি খুব নাট্যপ্রিয়, তুমি তো তা জানো।
যদি দ্যাখো, তাঁরা আজ মৃত সকলেই-
ধনঞ্জয় শুধু হবে এক অভিনেতা।
যুদ্ধের নাটকে তার ভূমিকাটি নেবে।
আমার মৃত্যুও আমি ভেবেই রেখেছি।
এই যুদ্ধে হবে না তা, কিছুকাল পরে
পশুর মৃত্যুই জেনো বরণ করেছি-
ব্যাধরূপে মৃত্যু এসে বধ করে যাবে।
যাদব বংশে তো কিছু ক্ষয় লেগে আছে-
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত- কলহ, বিবাদ-
তার ধ্বংস অনিবার্য- আমি বুঝে গেছি।
জন্মের রহস্য জেনে দুঃখ পেলে খুব।
কিন্তু দ্যাখো দেবব্রত ভীষ্ম যার নাম-
তাঁর মাতা গঙ্গা নন- ওটা রূপকথা-
শান্তনুর রূপে মুগ্ধ গাঙ্গেয় যুবতী।
দ্রোণের মাতার নাম ঘৃতাচী অপ্সরা-
ভরদ্বাজ পিতা, কিন্তু বিবাহিত নন।
মাটিমাখা বীর্য যদি কলসীতে রেখে
পুত্র হত তবে কেউ জারজ হতনা।
পঞ্চপান্ডবের জন্ম নিয়োগ প্রথায়-
দেবতার নাম নিয়ে একেক ব্রাহ্মণ
জন্ম দিল পান্ডুপুত্র প্রতিটি বীরের-
সেই দেবতার নামে ধন্য হল ওরা।
তুমিও তো সূর্যপুত্র- কম কী গৌরব!
কর্ণ : কিংবা আমি মুনিপুত্র। ইশারা বুঝেছি।
কৃষ্ণ : তুমি-আমি ভ্রাতা কর্ণ। নিকট আত্মীয়।
তোমার রক্তের রং যুধিষ্ঠির ভীম
দেহে নিয়ে বেঁচে আছে। এবং অর্জুন।
বহু শাস্তি পেল ওরা। অনেক যাতনা।
ত্রাণ দাও। মুক্তি নাও। সময় হয়েছে।
কর্ণ : রথ নিয়ে চলো কৃষ্ণ হস্তিনানগরে।
যত শীঘ্র পারি আজ গৃহে যেতে হবে।
এখন লাগামখানি তোমার হাতেই।
তবে দেখো ভুল করে পান্ডব শিবিরে
যদি আজ চলে যাও, সব খেলা মাটি।
বসুষেণ বন্দী হলে যুদ্ধ তো হবে না।
বুড়ো কৃষ্ণ লোকক্ষয়ে ব্যর্থ হবে, আর
শান্তির ওজন তাকে হাহুতাশ দেবে।
রথ হাঁকো। তার আগে আলিঙ্গন দাও।
কৃষ্ণ : কথা শুধু কথা নয়, অমোঘ আয়ুধ।
কথাকে বিফল করে সমান শক্তির
অন্য এক কথা তার দিব্য শক্তি দিয়ে।
আমাদের এই সব কথা চিরকাল
বিভিন্ন কবির মুখে ভিন্ন-ভিন্ন রূপে
প্রচারিত হবে কর্ণ বলে দিচ্ছি আমি।
বেদব্যাস তাঁর মতো বর্ণনা দেবেন।
সেই বিবরণ কিন্তু সকলের মনে
সমান আশ্রয় পেয়ে টিকে থাকবে না।
কারো হয়ত প্রিয় হবে সখা ধনঞ্জয়।
কর্ণ কারো পাত্র হবে সহানুভূতির।
দুর্যোধন যোগ্য রাজা- যুধিষ্ঠির নন,
একথা বলার লোক ঢের পাবে তুমি।
কেউ বলবে কৃষ্ণ খল, কেউ দেবে পূজা।
আমার পরেও কোনো কৃষ্ণ যদি আসে
মাঝে হয়ত কেটে যাবে সহস্র বছর-
হয়ত এই দেশে নয়, অন্য কোনো দেশে-
লোকে তাকে শূলে গেঁথে মৃত্যু দিতে পারে।
বর্ষগুলি চলে যাবে হাজার-হাজার।
অন্য এক কবি এলে আজকের দিন
অন্য এক আলো পড়ে উদ্ভাসিত হবে।
এসো বন্ধু, এসো ভাই, আলিঙ্গন করি।
অনুপম মুখোপাধ্যায় রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত কাব্যনাটক, কর্ণসারথি : একটি পুনরাধুনিক কবিতা — লেখক নির্দ্ধারিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।