গল্প টক, টাক, টুকটাক

বৈশাখ মাস, গাছভর্ত্তি কাঁচা আম। তন্ময় আর তার চাচাতো ভাই তমাল এসেছে কাঁচা আম পাড়ার জন্য, বিজলী আপু কাঁচা আমের ভর্ত্তা খেতে ভালবাসে। কাঁচা আম কুঁচিকুঁচি করে কেটে রসুন কাঁচামরিচ লবন সর্ষে তেল মেখে এমন ভর্ত্তা বানায়, কেবল খেতেই মন চায়। পালদাদা কোথা থেকে আসছিল, কাঁচা বড় আমটি ঠিক গিয়ে টুক করে পড়ল পালদাদার মাথায়, বেচারার মাথায় চুল নেই পুরোই টাক। পালদাদা বকতে গিয়েও থেমে চলে গেল। কিন্তু তমালের বেদম হাসি দেখে কে! তন্ময় হাসতে গিয়েও হাসল না। সে ধারাবাহিকভাবে বিষয়টা ভাবছে। টক আম টুক করে পালদাদার টাক মাথায় পড়ল। পড়ল মানে ঠকাস করে বা ঠাস করে আঘাত করল, বিষয়টা বুঝতে হবে। কাঁচা আমের ঝুড়িটা নিয়ে তন্ময় সোজা গল্পদাদুর ঘরে, পিছু পিছু তমাল ডেকে চলেছে, তন্ময়ের সেদিকে খেয়াল নেই।

গল্পদাদু সেদিনের পত্রিকা পড়ছিলেন। তন্ময়কে দেখে হাসলেন, “কী দাদু, কেমন আছ? ঝুড়িতে কাঁচা আম? ওগুলো খেতে বেশ টকটক লাগবে।”।

“দাদু টক নিয়েই তো সমস্যা, টক থেকে টাক টাকা কেমনে হয়?”

দাদু তন্ময়কে ইশারায় বসতে বললেন, “ট-এর গল্প তাহলে তোমাকে বলি।” দাদু পানদান থেকে এক খিলি পান মুখে পুরে দিয়ে শুরু করেন।

“ট বর্ণ হল টঙ্কার। টঙ্কার অর্থ শব্দ, আওয়াজ, আবার বিশেষ কিছুর শব্দকেও টঙ্কার বলে, যেমন ধনুকের ছিলার শব্দ। কোনকিছুর আওয়াজ হলে আমরা বলি ঠাস করে আওয়াজ হল, ঠাস করে চড় দিল। কোন কিছুতে আঘাত করলে যে শব্দ হয় তাকে ট বর্ণ প্রকাশ করে, নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। ট মানেই হল টঙ্কার করা, আর যে টঙ্কার করে সে হল টক।”

“কী রকম?” তন্ময় প্রশ্ন করে।

দাদু একটা আম হাতে নেন। “এই যে আম, এটা কাঁচা, এটাকে মুখে নিয়ে যেই কামড় দিবে টকাস করে শব্দ হবে, কিংবা তুমি যে কোন টক খাবার মুখে দাও, জিহ্বা এক ধরনের শব্দ করবে। বিপরীত নিয়মে দেখলে যা কিছু কট করে এসে লাগে, তাই টক। এই টক বিভিন্নভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয়। অনেক সময় তরকারী বাসী হলে টক টক লাগে, সেটা জিহ্বায় লাগে; ফল পাকলে বলি টকটকে লাল, সেটা চোখে লাগে। টক আর মিষ্ট একসাথে হলে আমরা বলি অম্লমধুর। একই সাথে টক আর মিষ্টি। টক-কে অম্লও বলে। মানুষের কথা যেমন মিষ্টি হয়, তেমনি টকও হয় সেজন্য বলে অম্লমধুর কথা। তোমার ওঘরের দাদু যখন চাটনী বানায়, কেবল খেতেই ইচ্ছে করে। কারণ জান?”

তন্ময় না-সূচক মাথা নাড়ে।

“কারণ হল চাটনীতে তোমার দাদু যতখানি টক দেন ততখানি মিষ্টি গুড় দেন। এটা খেতে বেশ হয় তখন।”

“তাহলে টক মানে অম্ল?”

“শোন, ট বর্ণটি সংস্কৃতে ছিল না। সংস্কৃত তক্র হল আমাদের টক। ট বর্ণ মধ্যযুগের বাংলাভাষীদের নিজস্ব আবিষ্কার। টক-কে অম্ল বলে অম্ হল কোন অস্তিত্ব যখন সঙ্কোচিত হয়ে লালিত হয় তখন তা অম্ল বা টক হয়। এই অম্ল রোগের কারণও হয়। ছোট শিশুদের পায়খানায় অনেক সময় টকটক গন্ধ করে, বড় মানুষেরাও অনেক সময় টক ঢেঁকুর ছাড়ে, বমিতে টকটক গন্ধ থাকে। এটা হয় অম্লের কারণে। আগের মানুষেরা টক দিয়ে রান্না তরকারীকে অম্লল বলতেন।”

“দাদু, কোন খাবার খেতে টক হতে পারে, কিন্তু কথা কেমনে টক হয়? বা মিষ্টি হয়? ওতো খাওয়া যায় না।”

দাদু হাসেন, “বেশ বলেছ, আমাদের জিহ্বা হল দুটো। একটা হল দেহের জিহ্বা, যা দিয়ে কোন কিছুর স্বাদ বুঝতে পারি। আরেকটা হল মনের জিহ্বা, যা দিয়ে আমরা কোন বস্তুর রস মনে মনে আস্বাদন করি। এই যে কাঁচা আমের ঘ্রাণটা আমরা পাচ্ছি, এ কিন্তু খেয়ে আমরা পাচ্ছি না কিন্তু নাক দিয়ে পাচ্ছি। কাজেই আমরা পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহা্য্যে টক বা অম্লের রস আস্বাদন করি।”

দাদু একটু থেমে গ্লাস থেকে পানি নেন। এক ঢোকে তা পান করে আবার শুরু করেন।

“টকের সাথে মিষ্টির বন্ধুত্ব আছে, সেটা এমন যখন তুমি তোমার বোনের সাথে দুষ্টুমী কর, কোন মজার খাবার তুমি দিবে না এ নিয়ে তুমুল খুনসুটি; কিন্তু আসল ব্যাপার তাকে রেখে তুমি মোটেও খাবে না, দেখা গেল তুমি বেশীটাই তাকে দিয়ে দিচ্ছ। এটা হল হ্যাঁ কিন্তু না কিংবা না কিন্তু হ্যাঁ। টকের মধ্যে এ বিষয়টি থাকে।”

তন্ময় তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে। দাদু আবার বলতে থাকেন, “টক থেকে টাক। কারও মাথায় টাক হলে তার মনের ভেতর টকটক ভাব হয়, মন খারাপ হয়। লোকের ধারণা টাক থাকলে টাকা হয়। টক যখন সম্পূর্ণ উল্টে যায়, তখন টুক হয়। টুক হল যা পরিমাণে অল্প। টুক ও টাক মিলে হয় টুকটাক যার অর্থ সামান্য, অল্প পরিমাণ। আবার ঘড়ি টুকটাক চলে, আর অল্প অল্প জিনিস ধরে টুকরীতে যা হল ছোট ঝুড়ী। অনেক বড় অংশকে টুকরো টুকরো পরিমাণ নিয়ে টুকরী ভর্ত্তি করে।”

“এত্ত দাদু”!

“আরও আছে, আজ এ পর্য্যন্তই, তোমার কাঁচা আমের টুকরীটা নিয়ে বোনের কাছে দাও, টক আমের ভর্ত্তা খেতে মন চাইছে।”

তন্ময় আর দেরী করে না, টুক করে আমভর্ত্তি ঝুড়িটা নিয়ে দৌড় দেয়।

 

 

 

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, টক, টাক, টুকটাক — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *