আচ্ছা স্যার, মানুষ এতটা অসুখী হয় কেন? সবাই সুখী হতে চায়, তবে সবাই হয় না কেন?
— বলল বদরুল।
স্যার কিছুক্ষণ মৌন থেকে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল—
আমরা নিজের নয় অন্যের সুখেই অসুখী হই বেশী। আসলে মহাবিশ্বে এমন কোন উপাদান নেই যা সুখী বা অসুখী করে। সবই সাইকোলজিক্যল রিয়েকশন।
দেখ বদরুল, প্রকৃতি শূন্যতা পরিহার করে…
মনে হয় এরিস্টটল বলেছেন।
তবে প্রকৃতি মূলতঃ শূন্যতা ব্যালেন্স করে। সংখ্যারেখার অঙ্কের মত।
যেমন—
+১ +২ -১ -২ = ০
এটা জগত ও জীবনেরও সমীকরণ।
তুমি জগত থেকে সব অন্ধকার, ধ্বংস, দুঃখ, দূর করতে পারবে না।
পৃথিবীতে আনন্দ, সুখ, স্বপ্ন যেমন থাকবে তেমনি থাকবে দুঃখ, নিরাশা এবং স্বপ্ন ভঙ্গের হতাশা।
তবুও মানুষের ডিএনএ… এতেই থেমে থাকার কোন জিন নাই। মানুষ নিরন্তর ছুটবে। মিথ অব সিসিফাসের রাজার মত।
(কবি অডেনের রেফারেন্স দিয়ে)
স্যার আরো বলতে লাগলেন—
“মানুষ একটা পারফেক্ট সমাজের জন্য প্রয়াস চালাবে, তবে পারফেকশন অধরাই থাকবে।”
বদরুল আরেক কাপ চা দিয়ে বলল—
স্যার, কঠিন কথার সাথে চা খেতে খুব ভাল লাগবে।
স্যার কানটিনিউ করল—
স্টিফেন’র “থিওরি অব এ্যাভরিথিং” এ আছে, মহাবিশ্বে প্রতিনিয়ত কণা ও প্রতিকণা উদ্ভব হচ্ছে আর পরস্পরকে বিলীন করছে। এটাকে কোয়ান্টাম ফ্লাকচ্যুয়েশন বলে।
আমরা যেটা শূন্য দেখছি তাও পজিটিভ ও নেগেটিভের খেলা, আমাদের জীবনের মতই।
নদীর একপাড় ভাঙে, অন্যপাড় গড়ে— এই খেলা।
বদরুল বলল— তাহলে বলা হয় যে, দারিদ্রকে যাদুঘরে পাঠাবে। পৃথিবীতে অভাব, অনটন, বৈষম্য থাকবে না।
স্যার চায়ে জোরে চুমুক দিয়ে রেখে বলল—
এই যে শ্লোগান দেয়া হয় Al(কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা), বায়োটেকনোর সাহায্যে একসময় দারিদ্র্য,
বৈষম্যকে যাদুঘরে পাঠানো হবে,
এটাও নিও লিবারেলিজমের একটা ফাঁদ বলে চিহ্নিত করেছেন MIIT এর ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি।
বরং ইউভাল নোয়া হারারি তার
‘‘Twenty one lessons for 21st Century” বই-এ
চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন ভবিষ্যতের যুদ্ধ কোন রোবট আর মানুষের মাঝে হবে না।
বরং স্বল্প সংখ্যক মানুষ
(যারা Al, biotechnology-এর সাহায্যে বিদ্যা, বুদ্ধিতে সুপারহিউম্যান হবে) আর দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, বিক্ষিপ্ত জলবায়ুর শিকার বিশাল অঙ্কের মানুষের মাঝে।
এর মানে দাঁড়াল, জীবনকে দেখতে হবে বোধের গভীর থেকে।
একটা দর্শন থাকা চাই।
সুখ, দুঃখে বিচলিত না হবার। সবকিছু জীবনেরই অংশ ভেবে দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়া। প্রাচীন গ্রীসদের এই গুণ ছিল। এটাকে Stoicism বলে। তারা দুঃখে, দুর্দ্দশায় ধ্যানমগ্ন থাকত।
এটাকে ‘Dignified silence’ বলে।
সেক্সপিয়ারের চরিত্রের মাঝেও এটা পাওয়া যায় যেটাকে ‘Negative Capability’ বলে।
বদরুল শূন্যের বিশাল একটা মহাত্ম আছে।
যেমন:-
যেকোনো সংখ্যার সাথে শূন্য গুণ করলে ফলাফল শূন্য(০)। কিন্তু কেন?
ধরি,
দুইটি সংখ্যা ৩ ও ২. এদের গুণফল আমরা বের করব।
৩ কে ২ দ্বারা গুণ করা মানে হচ্ছে ৩ টা ২-কে যোগ করা বা ২ টা ৩ কে যোগ করা।
অর্থাৎ 3 x 2 = 2 + 2 + 2 = 3 + 3 = 6
একইভাবে,
কোন সংখ্যা a কে শূন্য(০) দিয়ে গুণ করা মানে হচ্ছে a সংখ্যক শূন্য(০) কে যোগ করা।
ধরি, a = 10
তাহলে, 10 x 0 মানে হচ্ছে ১০ টি ০ যোগ করা বা ০ টি ১০ যোগ করা।
একটু আগে আমরা দেখলাম যে,
০ + ০ = ০। অর্থাৎ ১০ টি শূন্য(০) এর যোগফল-ও শূন্য। আবার, ০টি ১০ এর যোগফল-ও শূন্য।
কেননা ০ টি ১০ মানে, কোন ১০ নেই।
অতএব,
10 x 0 = 0। আর, এই কারণেই যেকোনো সংখ্যা (a) x 0 = 0
বদরুল বলল— স্যার, আরেককাপ চা নিন। সকাল সকাল মাথাটা আওলায় দিলেন। তয় শুনতে ভালো লাগছে।
স্যার তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললেন—
শূন্যের সাইজটা দেখছ? গোল, প্রায় বৃত্তাকার। এটা কিন্তু ভারতীয়দের আবিষ্কার।
এর পিছনেও দর্শন আছে ভারতীয়রা মানে ইন্দো-ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করে সময় বৃত্তাকারে চলে …
একই আবর্ত্তে ঘুরে …
মানে ঘুরে ফিরে এক জায়গায়। জম্ম, মৃত্যু, আবার পুনর্জ্জন্ম …
অধূনা কোয়ান্টাম ফিজিক্সও তা-ই বলে।
আমরা একটা ইনফিনিট ইউনিভার্স এ আছি যার শুরু বা শেষ নেই, শুধু বৃত্তাকারে পরিভ্রমণ।
অভিশপ্ত রাজা সিসিফাসের একই কাজের রিপীটিশন আর কিছু না, মানুষের নিরর্থক, একই কক্ষে শূন্যের গলিতে পরিভ্রমণের এক শাশ্বত প্রতীক।
বদরুল স্যারকে থামিয়ে বলল— এক মিনিট, এতক্ষণ বললেন সব শূন্য। এখন বলছেন অন্য কথা।
স্যার চায়ে চুমুক দিয়ে বলে— হা হা হা… এটাই শূন্যের বড় গুণ।
কিছুক্ষণ আগের অঙ্কটা দেখলে না এতো সংখ্যা রাশি। অথচ ফলাফল শূন্য।
আসলে, দিনশেষে জীবন হলো +১ -১ = ০ এ-ই সমীকরণ। ওই যে বলে না, “কী ঘর বানাইমু শূন্যের মাঝার।”
বদরুল বলল— স্যার, আযান দিয়ে দিল।
স্যার বলল— হ, আজ এটুকুই …………………………………
মাহবুবুল ইসলাম রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, শূন্যের সমীকরণ — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।