প্রিয় কমরেড
বাঙলা ভেঙে আলাদা হল কত আগে!
সে কোন্ রাজনীতির জয়? বল যদি— বিপর্য্যয়!
প্রিয় কমরেড! তুমি ওপার-বাংলায়
আমি এপার-বাংলায়—
কেবলমাত্র একটি স্বরবর্ণের দূরত্ব নিয়ে
আমরা বেঁচে থাকছি
বর্ডারের দুপাশে তথাপি কাছাকাছি—
জাতীয়তার বুলেটে ক্রমাগত
এতটাই জর্জ্জরিত
তবুও সমগ্রকে ধারণ করে
হয়ে উঠছি বিশ্বনাগরিক!
প্রিয় কমরেড, উত্তরপাড়ার উদ্দেশে
আমার হাওয়াই চিঠি
বয়ে নিয়ে যাবে যে আগন্তুক
তার নাম উলিয়ানভ।
সে ধারণ করে থাকবে আমার নৈঃশব্দ্যলিপি।
তাকে তোমার অপেক্ষার উত্তরীয়টুকু
উপহার দিও।
স্বাধীনতা
বাসষ্টাণ্ডে বসে লোকটা কোরাণ পাঠ করছিল
আমি কাছে গিয়ে বললাম— সুন্দর।
সে হেসে বলে—
আমি বাইবেলও পাঠ করতে জানি, খানিকটা গীতা এবং ত্রিপিটকও।
আমি বললাম— বাতাসে আপনার চাদর উড়ে যাচ্ছে …
সে বলল, চাদর নয়, তোমার মন উড়ছে।
— মনকে শান্ত করব কীভাবে?
— নিত্য আর অনিত্যের সীমা পেরুলে,
আনন্দ আর অনিন্দ্যের উর্ধ্বে উঠতে জানলে,
মনকে শান্ত করা যায়।
এতটুকু বলে সে অদৃশ্য হল, দৃশ্যের উপসংহার থেকে বহুদূরে বয়ে চলেছে এশার আজান।
আমি ফের রাস্তায় নামলাম।
রবীন্দ্র সরণীর ওপর দিয়ে
নির্ভার এক পাখী উড়ে যায়। আমি তাকে ‘স্বাধীনতা’ নামে ডাকলাম।
ভ্যানগগের মস্তিষ্ক
পরের জন্মে অবশ্যই মানুষ হয়ে নয়
টিনের চালে বৃষ্টি হয়ে জন্ম নিতে চাই,
কিংবা চার্লস ডারউইনের স্পর্ধা নিয়ে জেগে থাকা কালপুরুষ
পরের জন্মে আমি হব
অখণ্ড বাঙলার কোন আখ্যানধর্ম্মী উপন্যাস
এবং এর শেষ যতিচিহ্নের ওপর
অজ্ঞাত পাঠিকার কান্না।
শাহবাগ থেকে কলেজষ্ট্রীটের দিকে
উড়ে যাওয়া সীমান্তহীন ঘুড়ী
অথবা ব্রক্ষ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া
কাগজের নৌকা
আর যাই হোক অন্তত মানুষ নয়
কার্ল মার্ক্সের কলম হব, হব ভ্যানগগের মস্তিষ্ক।
গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপ এবং জীবিকার বংশগতি
উপসংহারে গবেষণা,
তার আগে ব্যাংকিং ব্যবসা এবং কৃষিকার্য্য।
তারও আগে তারও আগে শিকার এবং ফলমূল সংগ্রহ।
এই হল উর্ধ্বক্রমে আমাদের জীবিকার বংশগতি।
এদের মধ্যেই বহু আগে মৃত বৃষের হাড় থেকে
আচমকা এক সঙ্গীতযন্ত্র বানিয়ে ফুঁ দিয়েছিল কোন নিভৃতচারী।
আমি তার নিঃসঙ্গ জিন বহন করে চলেছি।
কোন্ সূচনাবিন্দু থেকে শুরু এই অন্ধ বিবর্ত্তন?
তথাপি
কী বর্ণাঢ্য এই মানবজীবন!
উপান্তে এইসব কথা আমি ভাবি।
তখন তুচ্ছ হয় প্রেম, বাৎস্যায়ন শাস্ত্র। শাক্যমুনী এবং নির্ব্বাণ।
সময় একটা মিথ্যা কথা
আমি তাকে বললাম সময়ের ছবি আঁকুন।
তিনি আঁকলেন ঘড়ী।
বললাম ঘড়ী নয়, সময়ের ছবি আঁকুন। তিনি আঁকলেন এক মৃত পিতার মুখ।
বললাম এটা তো সময়ের ছবি নয়, অতীত, সময়ের ছবি আঁকুন।
তিনি আঁকলেন ঢেউ পর্ব্বতমালা, ফেলে আসা প্রেমিকার হাসি…।
তারপর ক্যানভাসটা এক ধাক্কায় সরিয়ে বললেন, সময় একটা মিথ্যা কথা।
আমি সময় আঁকি না।
সিণ্ডারেলার বয়েস বাড়ে না
সিন্ডারেলা তুমি কেমন আছ
সেই যে উৎসব থেকে ফেরার পথে
ভুল করে ফেলে এসেছিলে কাঁচের জুতো
ওর ভেতরে আমার হৃৎপিণ্ডটা
আজও হাঁপরের মত ছটফট করছে।
তোমার নাম উচ্চারণ করা মাত্র।
আজও কি এক নিঃশব্দ হাহাকারে
কেঁপে ওঠে বক্ষকিনারা, গ্রীবা।
ওয়াল্ট ডিজনির স্কেচখাতা পেরুতেই
আমার শৈশব বড় হয়ে গেল
সিন্ডারেলা তোমার তো বয়েস বাড়ে না…
শিবলী শাহেদ
সমকালীন কবিতার উল্লেখযোগ্য নাম। সেইসব বিরলপ্রজ কবিদের একজন, যাঁরা মেঘের চাইতে মানুষে বিশ্বাস বেশী রাখেন। তাঁর এই মানুষপ্রবণতার পাঠ কিছুটা মার্ক্স, বাকীটা ওশো, আর প্রায় পুরোটাই প্রকৃতি আর জীবনের কাছ থেকে নেয়া। পৃথিবী ভ্রমণের প্রায় তিন দশক পেরোনোর পরেও, এই কবী, মানুষেই রাখেন আশা, আর ভালোবাসার বিরল বিশ্বাস। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ ‘শব্দগুলো জ্যামিতিক’ [শুদ্ধস্বর প্রকাশনী]
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{স্বাধীনতা ও অন্যান্য কবিতা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}
শিবলী শাহেদ রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত কবিতা, স্বাধীনতা ও অন্যান্য কবিতা