(সাহিত্য পাঠ এবং সাহিত্য অনুধাবন দুটো আলাদা ব্যাপার।)
সাহিত্যের অতি সাধারণ পাঠকের মুখ থেকে অনায়াসে ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের কথা শোনা যায় না। ইংরেজী Hermeneutics (বাংলা হের্মেনেত্য, বাখ্যা বা দ্বিভাষিকতার বিজ্ঞান) বলতে, সাধারণত লিখিত শব্দ থেকে মর্ম্মার্থ বের করা বোঝায়। ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়ার সাথে ঠিক কীভাবে অর্থ জ্ঞাপন করা হচ্ছে, এবং কীভাবে, ইতিপূর্ব্বে অর্থ আদান প্রদান হত, আমরা আমাদের তরফ থেকে কেমনে বুঝি তা অন্তর্ভুক্ত।
Hermeneutics শব্দটির একটি আপাতগ্রাহ্য উৎপত্তি প্রাসঙ্গিক এবং মজাদার। হারমেস ছিলেন গ্রীক দেবতাদের বার্ত্তাবাহক। মানুষের বুদ্ধিসুদ্ধি যেহেতু দেবতাদের পর্য্যায়ের নয়, হারমেসের দায়িত্ব ছিল দেবতাদের স্বর্গীয় ভাষণ মানুষের কাছে বোধ্যগম্য করে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু হারমেসকে মিথ্যেবাদীদের পৌরাণিক পৃষ্ঠপোষক বলা হয়। পায়ে পাখাওয়ালা লোকটী যা বলে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। গল্প উপন্যাসও তো এমন— মনগড়া। অতএব, প্রশ্ন ওঠে, গল্প উপন্যাস কি গাদাগুচ্ছের মিথ্যা নাকি উচ্চতর সত্য?
সাহিত্য কর্ম্ম কি অর্থ প্রকাশ করে, এবং কীভাবে করে?
ব্যাখ্যা বিজ্ঞান অনুসন্ধান করে, কোথায় অর্থ নিহিত? আমাদের মনে যেখানে বোধের তৈরী হয় সেখানে? দর্শনের একটি শাখা ফেনোমেনলজী (মানুষের অনুভূতি, চিন্তা, এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করে) তা-ই বলে। অথবা, অর্থ কি টেক্সটের ভেতরেই নিহিত? প্রধান প্রধান ধর্ম্মসমূহ এবং প্র্যাকটিক্যাল ক্রিটিসিজমের মতবাদ এরকমই। নাকি (মার্শাল ম্যাকলুহান যেমন মত পোষণ করেন), অর্থ মাধ্যম বা পাঠকের মধ্যে নিলীন? অথবা অর্থ কি বিভিন্ন সামাজিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে, (যেরকম করে জুরিরা কোন বিষয়ে রায় দেওয়ার জন্য অধিকাংশের সম্মতির ওপর নির্ভর করেন,) গঠিত হয়?
সাহিত্যের কি একক কোন মর্ম্মার্থ আছে, অথবা মন যত সম্ভব অর্থ তৈরী বা গ্রহণ করে? কীভাবে ইতিহাসের একটা সময়ে (১৯৩০-১৯৫৯) ডি এইচ লরেন্সের লেডী চ্যাটার্লিজ লাভার-কে অশ্লীল হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি এই বই সংগ্রহে রাখাও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, আবার একই বই অন্য সময়ে (১৯৮৩) নির্দোষ হিসেবে বিবিসি ‘বুক অ্যাট বেডটাইম’-এ সম্প্রচার করছে?
সময় কি আমাদের কম, বা বেশি জ্ঞানসম্পন্ন করে?
ধরেন, আপনাকে এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিনে মাত্র একটা রিটার্ন রাইড দেওয়া হল। আপনাকে বলা হল, হ্যামলেট নাটকটি ভালোভাবে বোঝার জন্য রাইডটি ব্যবহার করতে। আপনি কি :
১. টাইম মেশিনে চড়ে হাজার বছর পরের ভবিষ্যতে যাবেন যেখান সর্ব্বশেষ শেকস্পিয়র সমালোচক নাটকটি নিয়ে শেষ মন্তব্য করছেন?
২. নাকি টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে ফিরে যাবেন? ১৬০১ সালে। লন্ডনের সাউদ ব্যাংকে গ্লোব থিয়েটারে হ্যামলেটের প্রথম মঞ্চাভিনয়ে। ভিড় ঠেলে, গন্ধ সহ্য করে, জ্যাকোবিন সময়ের মঞ্চে, আলোকসজ্জায়, পোশাকে জেমস্ বারবেজের কথা শুনবেন? কিন্তু তখন তো এই নাটকের কোন সমালোচনাই ছিল না।
সাহিত্যের অধিকাংশ পাঠকেরাই ভবিষ্যতে যাওয়ার চাইতে অতীতের সময়ে ফিরে যেতে চাইবেন। কিন্তু কেন?
ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের অ-সাহিত্যিক উৎপত্তি
সাহিত্য সমালোচনার চেয়ে, ব্যাখ্যা বিজ্ঞান উৎপত্তি অনুসারে বরং দর্শনসমন্ধীয়। ব্যাখ্যা বিজ্ঞান অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাইবেলের জার্মান ভাষ্যকারদের দারুণ আগ্রহের বিষয় ছিল। পবিত্র গ্রন্থ কি আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে, না প্রতীকিভাবে? পবিত্র গ্রন্থের মর্ম্মার্থ কি তর্কসাপেক্ষ? সালমান রুশদী বুঝেছেন যেখানে স্বর্গ রচিত গ্রন্থ জড়িত, এমনি আজকের দিনেও, সেখানে এই জাতীয় প্রশ্ন তোলা মানে জীবন-মৃত্যু নিয়ে টানাটানি করা।
ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের আপার্তবৈপরীতা
ব্যাখ্যা বিজ্ঞান অনেক কূটাভাস সৃষ্টি করে, যার মধ্য একটি হার্মেনিউটিক সার্কেল নামে পরিচিত। ব্যাপারটা একই বৃত্তে অবিরাম পাক খাওয়ার মতন। সমস্যাটির মূল এরকম : আমি হ্যামলেট নাটকের একটা অংশ বুঝতে পারি না, যদি না পুরো নাটকটি সম্পর্কে আমি জানি। আবার, প্রথমে আলাদা আলাদাভাবে নাটকের অংশগুলি না বুঝলে পুরো নাটকটি আমি বুঝতে অক্ষম। অতএব, আমি নাটকটা কখনোই বুঝতে পারবো না। কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকব।
আরো অনেক আপার্তবৈপরীতা এবং ধাঁধা আছে। ধরা যাক, লেখকের মৃত্যুতে ডিকেন্সের শেষ উপন্যাস Edwin Drood অথবা নভোকবের শেষ উপন্যাস The Original of Laura, অর্দ্ধেক হয়ে গেল, কেউ কি এই খন্ডিত অংশটুকু বুঝতে পারবেন? যদি একটা গাড়ির কার্বুরেটর খুলে নেওয়া হয়, গাড়িটা কি চলে?
এই কূটাভাস অনুযায়ী, রল্যা বার্থ প্রথম পাঠ, এবং দ্বিতীয় পাঠ (পরবর্ত্তীতে আরো অনেক অনেক পাঠের) একটি সুত্রের কথা বলেন। প্রথম পাঠে, আমরা সাধারনত, বার্থ যেটাকে হারমেনিউটিক কোড বলেন, তাতে সামনোযোগী হই। যেমন, আগে কী ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে পরবর্ত্তীতে কি ঘটবে, এসব। আমরা সংস্কারহীনভাবে তথ্য একত্রিত করি, জানি না কোন তথ্য গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা গুরুত্বহীন। দ্বিতীয় পাঠে আমাদের সাড়া আরো বেশী অবস্থাগত। আমরা আরো বেশি যাতে মনোযোগী হই বার্থ তাকে বলেন সিম্বলিক কোড। বালজাকের গল্প সারাসিন-এর বিশ্লেষণে তিনি সিম্বলিক কোডের চমৎকার প্রয়োগ দেখান। গল্পটা এভাবে শুরু হয়: গল্পকথক জানালায় বসে আছেন। নিবিষ্টভাবে তাঁর পিছনের বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের ভুবন, এবং একই সাথে তাঁর সামনে প্যারিসের জাঁকালো নাচঘর অবলোকন করছেন। গল্পে সারাসিন নামক এক ভাস্কর লা জামবিনেলা নামক এক অপেরা শিল্পীর প্রেমে পড়েন। সারাসিন যেটা বুঝতে পারেন না (আসলে মর্ম্মান্তিকভাবে দেরীতে বোঝেন) যে, তিনি যার প্রেমে পড়েছেন উনি নারী নন, নারীর মত এক পুরুষ। তাঁর প্রেয়সী একজন ক্যাসট্রাতো— নারী কন্ঠবিশিষ্ট পুরুষ যে কখনো তার অবস্থার দরুণ পরিপক্কতায় পৌঁছায়না। গল্পটা এতো চাতুরতার সাথে বলা যে, প্রথমবার পড়ে পাঠকেরাও বুঝতে পারেন না।
প্রথম পাঠে, জানালা একটি নিরপেক্ষ দৃশ্য। দ্বিতীয় পাঠে, জানালা নতুন তাৎর্প্য বহন করে। জানালার স্বচ্ছ পর্দ্দা দিয়ে বাইরের আর ভেতরের দুনিয়া দেখা যায়। আমরা গল্পের নায়ক/নায়িকার লিঙ্গগত দ্ব্যর্থতা বুঝি— সে আসলে নারী বা পুরুষের মাঝামাঝি একটা জানালার মত অবস্থান করে।
বার্থেসিয় এই পদ্ধতি চমৎকারভাবে স্পষ্ট করে বিধিসম্মত সাহিত্য আসলে কোথায় সংশ্লিষ্ট। আমরা মহান সাহিত্যকর্ম্মসমূহ বারবার পড়ি; অথবা এগুলো সম্পর্কে আগে থেকে কোন কিছু না জেনেই প্রথম বার পাঠ করি। ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের মোদ্দা কথা হচ্ছে, সাহিত্য পাঠ এবং সাহিত্য অনুধাবন প্রকৃতপক্ষে দুটো আলাদা ব্যাপার।
[ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের লর্ড নর্থক্লিফ ইমেরিটাস প্রফেসর, লেখক, এবং কলামিস্ট জন এন্ড্রু সাদার্ল্যাণ্ডের 50 Literature Ideas You Really Need to Know অবলম্বনে লিখিত।]
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
হাসিব উল ইসলাম রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য, ব্যাখ্যা বিজ্ঞান