অমরাবতীর তীরে ছোট্ট ছনের ঘরের উঠোনে বৃষ্টি পড়লেই কাদা জমে যায়। প্লাবনের জল ঢুকে পরে ঘরে। নদী আর নদীর পাড় আলাদা করে চেনা যায় না। বানের জলে ভেসে যায় কতশত গাছ আর পশু। সবাই কেঁদে কেঁদে উঠে, ক্ষমা করো অমরাবতী, ক্ষমা কর। সেই ঘরের এককোণায় বসে হুক্কায় দম নিতে নিতে লোকটা ভাবে তার ছেলের কথা। বানের জলে সাপ ঢুকে পড়েছিলো ঘরে। ছেলের বয়স বা কত? ১৪/১৫ বছর হবে? বিরক্তির সাথে সাপটা সরাতে গিয়েছিলো। কে জানতো, সাপটা তখন বিষের জ্বালায় অস্থির! পরপর তিনবার ছোবল দেয় ছেলেটার হাতে। বাঁধন পড়াবার সময়টুকুও পাওয়া যায়নি। শুধু একবার বাবা বলে ডাক দিয়েই এলিয়ে পরে। সারারাত আগলিয়ে রেখেছিলো ঠা-া শরীরটা। একই ঘরে তিনজন, একি বিছানায়। সাপটা সারারাত ধরে ফোঁস ফোঁস করেছে, হয়তো রাগে, নাকি দুঃখে! লোকটা এগুলো চিন্তা করতে করতে বানের পানি নেমে যায়। জল নামতেই সাপটাও আস্তে আস্তে বেড়িয়ে পরে। যাওয়ার পথে কি একবার পিছনে ফিরে দেখলো মনে হয়।
সাপে কাঁটা মড়া!!!
পোড়ানোর নিয়ম নেই, ভাসিয়ে দিতে হবে। পড়শীরা ভেলা সাজিয়ে দিয়েছে। লোকটার লখিন্দরের কথা মনে পরে যায়। লখিন্দরের ভেলাটা কি এমন ছিলো? আচ্ছা, লখিন্দরের ভাসানের সময় কি চাঁদ সওদাগর কি কেঁদেছিলো? কান্নার কথা ভাবতেই লোকটার নিজের স্ত্রীর কথা মনে পরে। বেঁচে থাকলে খুব ভালো হতো, অন্তত কাঁদত সে ভাসানের সময়। যেভাবে ছেলেটা কেঁদেছিলো তার মায়ের মৃত্যুতে। অসহ্য হয়ে ওঠে সময়টা। তবুও ভীড় থেকে দুয়েকটা গোঙানির আওয়াজ শোনা যায়। অভ্যাসের বসেই দুয়েকজন ঢুঁকরে ওঠে।
রাত নামতেই বোঝা যায় আজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমার চাঁদটা আজ বেশ বড় মনে হচ্ছে? কি পূর্ণিমা আজ? কি ভয়ংকর হলুদ! উঠোনে জমে থাকা কাদাগুলোও চকচক করছে। ছেলেটা কতদূর গেলো এখন? মায়ের সাথে দেখা হয়েছে তো? শ্মশান ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়? ঠাকুর এই গ্রামে এসেছিলো অনেক আগে। লোকটা ছোট থাকতে দেখেছিলো মিশমিশে কালো ঠাকুরের তখন যৌবন। সারাদিন শ্মশানের চাতালে বসে ধ্যান করে। বসে থাকার চেয়েও তার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলো লোকটা।
আহা! পূর্ণিমার কি আলো!!
অনেককাল আগে সিদ্ধার্থ এমন কোনো পূর্ণিমায় ঘর ছেড়েছিলো। কিসের আশায় যেনো? নির্বাণ নাকি অমরত্ব? অমরত্ব!!! লোকটা আপনমনে বলে উঠে। হাজার বছর বেঁচে থাকতে কেমন লাগবে? পৃথিবীর সব জ্ঞান, রূপরস সবকিছু উপভোগ করলে?
শ্মশানে পৌঁছে লোকটা দেখে ঠাকুর ধ্যানস্থ। পরপর তিনদিন তিনরাত পর ঠাকুর চোখ খুলে!
-কি চাই?
-অমরত্ব! দ্বিধাহীনভাবে জবাব দেয় লোকটা।
-অমরত্ব কি বাজারে পাওয়া যায়? চাইলেই পাবি মনে হচ্ছে?
-কিভাবে পাবো তা বলে দাও।
-আমিও সঠিক জানি না। তবে তুই দেবতাদের খুশি করে দেখতে পারিস।
-দেবতারা কিসে খুশি হয়?
-কর্মে, যজ্ঞে, ধ্যানে…
-কি করবো আমি?
-ধ্যানস্থ হও…
ঠাকুর আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। আবার কতদিন পর সে চোখ খুলবে তা কেও জানে না। হয়তো তিনদিন অথবা তিনমাস।
ধ্যানস্থ হবো???
লোকটা হাঁটতে শুরু করে। অমরাবতীর তীরে এসে সে বসে পরে। ধ্যান করবো? কিভাবে? তবুও পদ্মাসনে বসে পরে লোকটা। অর্ধনিমিলিত চোখ একমনে দেখে যায় অমরাবতীর জল। জলেরা যাচ্ছে! কোথায় যায় এতো জল? সমুদ্রে, তারপর? হাওয়া এসে তরঙ্গ সৃষ্টি করছে জলে। একি ভাবে নিঃশ্বাসও তরঙ্গ সৃষ্টি করছে বায়ুম-লে। নিঃশ্বাসের রঙ নীল মনে হচ্ছে! সাপের বিষের মতো!! আর কিছুই চোখে পরে না তার।
আজ কতোকাল কেটে গেছে?
সামনে এগুলো কি?
শুকনো ফুল! এক ঘটি জল!! সময়কাল মনে করতে পারছে না লোকটা। কতোদিন হলো আমি ধ্যানে?-আপনমনেই বলে লোকটা। জল খেয়ে অমরাবতীতে নেমে পরে লোকটা। চুলে জল দিতেই খেয়াল করে চুলে জট পরেছে। হেসে ফেলে সে। অনেককাল হলো তবে? আরো জল খেয়ে আবার ধ্যানমগ্ন হয়ে পরে।
এতো আলো!!!
কিসের আলো এতো? চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।
চোখ খুলতেই সৌম্য চেহারার এক যুবকের দিকে দৃষ্টি পরে তার।
-কে তুমি?, লোকটা জিজ্ঞাসা করে।
-আমি দেবদূত। দেবতাদের নির্দেশে এসেছি তোমার কাছে, উত্তর দেয় যুবক।
-অমরত্ব দিতে?
-হাসালে ধ্যানী। না, জীবিত কোন মানুষের অমরত্ব পাওয়ার নিয়ম নেই। তোমার সাধনায় দেবতারা খুশি হয়েছে। তাই আমাকে পাঠিয়েছে।
-এতো বছরের ধ্যান কি তবে মিথ্যা হয়ে যাবে? আমার এতো বছরের সাধনা? অমরত্ব ছাড়া আর কি চাওয়ার আছে?
-ভুল বুঝ না ধ্যানী। আমি তোমায় বর দিতে এসেছি দেবতাদের নির্দেশে। তুমি অমরত্ব ছাড়া অন্যকিছু চাও।
-আমাকে তবে হাজার হাজার বছরের পরমায়ু দাও। আমি যেন এই পৃথিবীর রূপরস, গন্ধ, জ্ঞান সব জানতে পারি। পৃথিবীর সব রহস্য আমার আয়ত্ব হোক।
-ভেবে বলছো তো?
-হ্যাঁ, আমাকে এই বর দাও।
-তবে তাই হোক, তথাস্তু!!! দেবদূত অন্তর্ধান হলো।
কতকাল চলে গেল সাধনায়? জটায় হাত দিয়ে দেখে জটা আরো বড় হয়েছে, দাড়িগুলোও। আজ আর ধ্যান নয়। আজ একটু বিশ্রাম চাই। ক্লান্ত শরীর টেনে টেনে অমরাবতীতে স্নান করে সে। নদীর তীরে গাছ থেকে ফল পেড়ে আহার সারে। আজ একটু ঘুম দরকার। খুব শান্তির ঘুম।
এ কোথায় আমি?
এতো অমরাবতীর তীর। কত চেনা নদীটা। নিজের স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায় তার। মরার পর চিতার ছাই এই নদীতেই বিসর্জন দিয়েছিলো ছেলেটা। আর ছেলেটার মৃত্যুর পর এই নদীতেই ভাসান দিয়েছে সে। কতদিন হলো? নদীর পাড় ধরে একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ায় সে।
শরীরটা এমন কেনো লাগছে? আমিতো ঘুমিয়ে ছিলাম। পা’দুটো এতো শক্ত হয়ে আসছে কেনো? শরীরটাও? শরীরের লোমকূপে কে যেনো একগাদা বিষ ঢেলে দিয়েছে। এতো যন্ত্রণা হচ্ছে কেনো? এতোবছর ধ্যানে থেকে এমন অনুভূতিতো হয়নি কখনও। পা দুটো জোড়া লেগে যাচ্ছে মনে হচ্ছে? হাত দুটো বেড়ে যাচ্ছে কেনো? শরীরের লোম সব আরো বড় হয়ে যাচ্ছে? নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠে সে! কি হচ্ছে এসব?
চিৎকার দিতেই ঘুম ভেঙে যায় তার। কিন্তু চিৎকারের কোনো আওয়াজ বের হয় না তার মুখ থেকে। টের পায় সে, বিশাল হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। হাত দুটো আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছে। শরীরের লোম, মাথার চুল, দাড়ি সব পরিণত হচ্ছে সবুজে। এই কি তবে হাজার বছর বেঁচে থাকার উপায়? আমিতো এমনটা চাইনি। তাই কি, দেবদূত আমায় ভেবে দেখতে বলেছিলো? এসব চিন্তা করতেই তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। না, অশ্রুতো আর নেই। কষ হয়ে ঝড়ছে তার শরীর বেয়ে। কারা আসছে এদিকে? ছোট ছোট পায়ে? কষের লোভে কি আসছে তারা? তাদের পিছনে কে ও? পিচ্ছিল শরীরটা নিয়ে এঁকেবেঁকে আসছে। ছেলেটা যে সাপটা কামড় দিয়েছিলো সে নয়তো? হাতে এসে বসলো কারা? ছোট ছোট পা দিয়ে কারা নাচে?
-আমরা সবাই এসেছি। তোমাকে পৃথিবীর সব রহস্যের কথা বলবো। কিন্তু হায়! এইসব রহস্য আমরা যেমন প্রকাশ করতে পারি না মানুষের কাছে, আজ থেকে তুমিও পারবে না। এভাবেই জ্ঞান যুগ যুগ ধরে ধরা দেয় শুধু ধ্যানীদের কাছে। তুমি কি জানো, পৃথিবী প্রতিনিয়ত ঘুরছে? তবে শোনো পৃথিবী প্রতিদিন গড়ে… ফিসফিস করে বলে যায় সবাই, একসাথে।
চাষে যাওয়ার আগে প্রতিদিন কৃষক প্রণাম করে যায় ধ্যানীকে। প্রতিদিনের অভ্যাস তার। ফুল আর জল দিয়ে পূজো দেয় সে। প্রতিদিনের মতো সে এসেছিলো পূজো দিতে। কখনও সে ধ্যানীকে চোখ খুলতে দেখেনি। আজও নিশ্চয় ঠাকুর ধ্যানে থাকবে? এই ভাবতে ভাবতে সে ধ্যানীর কাছে যেয়ে দেখে ধ্যানী নেই। বরং ধ্যানী যেখানে বসে সাধনা করতো সেখানে একটা বিশাল গাছ। কই গতকালওতো এই গাছটা এখানে ছিলো না? হঠাৎ সে বুঝতে পারে সব। সে দৌড় দেয় গ্রামের দিকে চিৎকার দিতে দিতে, ঠাকুর গাছের ভেতর অন্তর্ধান হয়েছে, তোমরা দেখে যাও, দেখে যাও সবাই! গ্রামের সবাই শাঁখ, ঢোল আর উলুধ্বনী দিতে দিতে এগিয়ে যায়। “গাছঠাকুর! গাছঠাকুর!!” বলে লাল একটা কাপড় বেঁধে দেয় তার শরীরে। পূজো করে গড় প্রণাম করে তাকে। তারপর থেকেই নিয়ম করে প্রতি শীতে মেলা বসে গাছঠাকুরকে ঘিরে।
আজও অমরাবতীর তীরে গেলেই গাছঠাকুরের দেখা পাবেন। আজও মেলা হয়, প্রতি শীতেই। মহাকালের স্বাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে সে। যদি তার কাছে যান, শুনবেন সে কিছু বলতে চাচ্ছে বাতাসের মাধ্যমে। আপনিও কথা বলতে পারেন তার সাথে। মানুষের সঙ্গ তিনি পছন্দ করেন খুব, একসময় মানুষ ছিলেন যে!!
ঈশান বড়ুয়া রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, গাছঠাকুর — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।