ভীতু বাঙালী, ‘থিতু’ বাঙালী, হুজুগে বাঙালী, সাম্প্রদায়িক, পরশ্রিকাতর, কখনও ধর্ম্মপ্রবণ তো অপরাধপ্রবণ। একদিকে যেমন অতিথিপরায়ণ, আবার অকৃতঘ্নও বটে। মানুষের বিপতে (বিপদে) এগিয়ে যায়, আবার ভাই ভাইয়ের, প্রতিবেশীর রক্ত ঝরাতেও দ্বিধাবোধ করে না। বাঙালীর এই চিন্তার মানসপট বুঝতে হলে হাজার বছর পিছনে যেতে হবে।
প্রাচীন এই বাংলায় অবস্থান করত সর্ব্বপ্রাণবাদী আদি অস্ত্রাল কৌম সমাজ। পরবর্ত্তী সময়ে দ্রাবিড় এবং ইউরোপীয় আলাপীয় ইউরোপীয়েড মহাজাতির জনগোষ্ঠী আদিম কৌম সমাজের সাথে মিশে এক মিশ্র বাঙাল জাতিসত্তার সৃষ্টি। এই প্রাক-আর্য্য লৌকিক সমাজের জ্ঞানতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জৈন, আজীবিক ও বৌদ্ধ ধর্ম্ম।
বাংলাদেশে এরপর নতুন ‘‘Episteme” জ্ঞানতত্ত্বের সূত্রপাত হয় বৈদিক ব্রাহ্মণত্ব প্রতিষ্ঠার ফলে। তখন ‘জাত-পাত’কেন্দ্রিক ব্রাহ্মণতন্ত্রের তত্ত্ব ও মন্ত্র দিয়ে সমাজকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করা হয় ব্রাহ্মণদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এরই মাঝে দ্বাদশ শতক থেকে বাংলায় ইসলাম ধর্ম্ম ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। ইসলাম ধর্ম্মের শরিয়তকেন্দ্রিক মৌলিক দর্শন, মারফেতকেন্দ্রিক সুফিতত্ত্ব এবং আউল-বাউল-সহজিয়া মতবাদের মিশ্রণে নতুন এক ‘‘episteme’’ জ্ঞানতত্ত্বের আবির্ভাব হয় যেটা ব্রাহ্মণ্যবাদী ‘‘episteme” এর সাথে binary opposite ‘‘যুগ্ম বৈপরীত্য’’ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তবে উনিশ শতকে এসে বড় একটা পরিবর্ত্তন হয় বঙ্গীয় হিন্দু রেনেসাঁসকে কেন্দ্র করে। তখন পাশ্চাত্যের আধুনিক ‘‘episteme’’ জ্ঞানতত্ত্বে ও বাঙালী জাতীয়তাবাদে গড়ে ওঠে বঙ্গ সমাজ। এই দুই মুসলিম ও হিন্দুর ভিন্ন জ্ঞানতত্ত্বটাকেই ‘divide and rule’ নীতিটাকে প্রয়োগ করে ইংরেজরা। তখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। তবে কিছুদিনের ভিতরই বাঙালীরা বুঝতে পারে দ্বিজাতিতত্ত্বের মৌলিক ভুল এবং ১৯৭১ সালে এক মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
তবে রক্তের ভিতর যে ভিন্ন ভিন্ন episteme হাজার বছর ধরে মিশে আছে। তাই এখনও পাওয়া যায় সেই ধরনের উকিল, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, আমলা যারা একঅংশ প্রগতিশীল আরেক অংশ চিন্তা চেতনায় মধ্যযুগীয়, উগ্র, সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল।
এখনও আমরা আত্মপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত। এখনও প্রশ্ন করি আমরা বাঙ্গালী? নাকি বাংলাদেশী? বাঙালী মুসলমান? মুসলিম বাঙালী?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্ন করলে খুব কমই উত্তর দিতে পারব। আমরা সাম্যবাদের কথা বলে বুর্জোয়ানীতিই পছন্দ করি। আমাদের সুনির্দিষ্ট কোন ‘episteme’ জ্ঞানতত্ত্ব দাঁড় করাতে না পারায় আমরা চিন্তা, চেতনায় সদাপরিবর্ত্তনশীল একটি জাতি, হীনমন্যতায় ভুগি। অন্যকে অন্ধঅনুকরণ করি।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ অর্থনীতিক, রাজনীতিক, সামাজিক মুক্তির জন্য ১৯৭১ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই বাঙালী চেতনা ভুলে পূজিবাদী ‘consumer world’-এর ভোগবাদ দর্শনে মত্ত হয়ে গেছে।
এ থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী-বেসরকারী দপ্তর মুক্ত নয়। এ যেন মিশেল ফুকোর “Discipline and Punishment’’ বইয়ে বর্ণিত প্যান অপটিক্যাল কারাগার।
স্কুলগুলো বইয়ের চাপ বাড়াচ্ছে, ফেল করলে বহিস্কার। অতএব কৌচিং কর। ইউনিভার্সিটী বলছে, এই দল কর, সীট পাবে।
আমাদের প্রবাদ শেখানো হয় “লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে”। ফলস্বরূপঃ আত্মকেন্দ্রিক, উচ্চবিলাসী, দেশপ্রেমেবিবর্জ্জিত, লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ, অপরাধপ্রবণ জাতিতে পরিণত হচ্ছি।
সূত্রঃ বাঙালীর ইতিহাস— নীহাররঞ্জন রায়, মিশেল ফুকো পাঠ ও বিবেচনা— সম্পাদনা : পারভেজ হোসেন। কিছু বাক্য, ফ্রেইজ লেখকের হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে
মাহবুবুল ইসলাম রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, হাজার বছরের বাঙালী