প্রবন্ধ শিব ও দক্ষ কিংবা বিদ্যা ও অবিদ্যা

ইংরেজী ‘education’ ল্যাটিন শব্দ ‘educare’ থেকে এসেছে, যার অর্থ লালন করা, পরিচালনা করা, গড়ে তোলা। সেটা নৈতিক, মানবিক ও বুদ্ধিভিত্তিক অর্থে বুঝায়।

বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘সাস্’ ধাতু থেকে। এর অপর একটি অর্থ হলো ‘বিদ্যা’। সংস্কৃত বিদ্ ধাতুর অর্থ জ্ঞান আহরণ করা।

বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ মতে, ‘বিদ্যা’ হল যাহার দ্বারা বিদিত হওয়া যায়, তাহার আধার, যাহার দ্বারা জ্ঞান আহরণ করা যায়।

বস্তুর প্রকৃতিতে বা স্বভাবে যে ক্রিয়া চলে, যার কারণে বস্তুটি তদ্বস্তু রূপে বর্ত্তমান, সেই ক্রিয়ার সহজাত বিচ্ছুরণকে বিদ্য বলে। এই বিদ্য এর আধারস্বরূপ যে জ্ঞান, সাধারণভাবে বিদ্যা বলে। লাটিন ভাষায় vide যেটা থেকে ইংরেজী video এসেছে তার অর্থও বস্তুর স্বরূপ দর্শন। নরওয়েজিয়ান শব্দ vitem, বিদ্, vide এসবের একই মানে/Money/অর্থ!…

পুরাণ থেকে জানা যায়, শিবগুণসম্পন্ন বা প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতাসম্পন্ন উদ্ভাবক মানুষ বিদ্যমান এর বিদ্যকে জানার চেষ্টা করতেন, আপন অস্তিত্বের কথা বিদিত করতে পারতেন অনেকেই। তাঁরা একে নাম দেন বিদ্যা। একে তত্ত্ববিদ্যাও বলে।… সেই বিদ্যা শিখে নিয়ে মানুষ যখন নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে তখন সেটাকে বলে অবিদ্যা কিংবা কর্ম্মময়ী বিদ্যা। পুরাণাদি অনুসারে এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল— মানুষ তত্ত্ববিদ্যাতেই তার অবস্থান চালিয়ে যাবে, নাকি কর্ম্মময়ী অবিদ্যাকে তার অস্তিত্বের ভিত্তি করে নিবে? শিব ছিলেন তত্ত্ববিদ্যার পক্ষে আর দক্ষ ছিলেন কর্ম্মময়ী অবিদ্যার পক্ষে। শেষপর্য্যন্ত (দক্ষযজ্ঞের মাধ্যমে) দক্ষযুগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং এ বিদ্যা নিয়ে মানুষ সভ্যতায় প্রবেশ করে।…

একালের আমরা যে বিশাল যন্ত্র সভ্যতার উপর নির্ভর করে বেঁচে আছি তা সবটাই কর্ম্মময়ী অবিদ্যা থেকে প্রসুত যা মানুষের দৈহিক সুখের ব্যবস্থা করে। আর তত্ত্ববিদ্যা হলো মানসিক সুখের ব্যবস্থা করে তাহলে বিজ্ঞান হল বিদ্যা আর প্রযুক্তি হলো কর্ম্মময়ী অবিদ্যা। এই অবিদ্যা চর্চ্চায় মানুষ পশুত্ব লাভ করে। এর মানে, চকমকি দিয়ে আগুন জ্বালানোর নাম (কলা আবিষ্কার) ছিল বিদ্যা। তবে একে মানুষের প্রয়োজনে যাচ্ছেতাই ব্যবহারই অবিদ্যা।

আগেরকার মানুষ মনুষ্যত্ব অর্জ্জন করাকে মূখ্য শিক্ষা ভাবত… পশ্চিমের দিকে তাকালেও ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকে ধীরে ধীরে যন্ত্রযুগে মানুষ প্রবেশ করে, তখন অবিদ্যা চর্চ্চা শুরু হয় সর্ব্বত্র। এমনকি ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের আগেও এই ধারা বলবৎ ছিল।

প্রাচীন গ্রীসের এ্যাথেন্সের শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল জ্ঞানকেন্দিক। ব্যক্তির পূর্ণতা ও মুক্তি লাভের উপায় ছিল শিক্ষা। তার উদ্দেশ্য ছিল সুকুমার বৃত্তির চর্চ্চা। পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করা। শিশুকে সুনাগরিক হিশেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিল্প, সাহিত্য অনুশীলনের উপর জোর দেয়া হত। কিন্তু এর মানে এই নয় যে কর্ম্মময়ী শিক্ষার প্রয়োজন ছিল না। স্পার্টায় সামরিক শিক্ষার উপরও জোর দিত তা দেশ রক্ষার জন্য।

আর্য্য ঋষিরা যেমন বলেন—
“অবিদ্যয়া মৃতুংতীত্বা বিদ্যয়াহমৃত্তমশ্নতে”। অবিদ্যার প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য। বিদ্যার প্রয়োজন অমরতার জন্য। প্রাচীন মিশরেও ব্যক্তিকে গড়ে তোলা হত সমাজের প্রয়োজনে। চীনের শিক্ষা ব্যবস্থাও তাই ছিল। জোর দেয়া হত কৃষ্টি ও ঐত্যেহ্যের শিক্ষার উপর। কিন্তু উপনিবেশিক আমল থেকে অবিদ্যাই যেন প্রধান হয়ে উঠল আর বিদ্যা গৌণ। এতে সমাজে দূষণ, লোভ, অপরাধ, দুর্নীতির জন্ম নিল। কনজিউমার ওয়ার্ল্ড সবকিছুকে পণ্য মনে করল। আর তার সাথে হাত মেলাল বিপণন বাজার, যেটাকে ইউভাল নোয়া হারারি ‘পূজিবাদী রাক্ষস’ বলে অভিহিত করেছে।

রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাপারটা বহু আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিল না। উঁনার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল “মিলিবে এবং মেলাবে”। তবে মেকলে যখন গভর্নর হয়ে আসে ভারতবিদ্যা সম্পর্কে উন্নাসিক ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন সারা প্রাচ্যের জ্ঞান ইয়োরোপের একটি বইয়ের তাকের সমান। তখন মেকলে শিক্ষায় তার বিখ্যাত চুঁইয়ে পড়া নীতি ‘downfall filtration theory’ পেশ করেন। তিনি বলেন ভারতবর্ষে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে এমন এক শ্রেণী তৈরি করা যারা চামড়ায় হবে ভারতীয়, কিন্তু মন-মানসিকতায় হবে ইউরোপীয়। শিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে উচ্চতর শ্রেণীকে। এদের মাধ্যমে শিক্ষা নীচু শ্রেণীতে চুঁইয়ে পড়বে। বিদ্যার বিষয়বস্তু হয় পাশ্চাত্যবিদ্যা। শহীদুল্লার ভাষায় পাঠশালা হয়ে ওঠে স্কুল। ভারতবর্ষের আত্মা থেকে শিক্ষার বিচ্ছেদ ঘটে।

বঙ্কিমচন্দ্র পরে দুঃখ করে বলেন, ‘শিক্ষিতে, অশিক্ষিতের হৃদয় বুঝে না।’ মানে পরগাছা শ্রেণীর ইংরেজদের কেরানী হতে থাকে। শিক্ষার এই অন্তঃসারশূন্যতা রবীন্দ্রনাথ আগেই বুঝতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ “শিক্ষার হেরফের” প্রবন্ধে বলেন— মেকলের উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের কেরানী তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথের এখানেই আপত্তি ছিল। এ শিক্ষা মানুষকে সমাজ, প্রকৃতি ও শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে যা আমরা উপলদ্ধি করছি।

রবীন্দ্রনাথ এ শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলেন—
“ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দেবার কল। মাস্টার হল এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘন্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। চারটার সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন; ছাত্ররা দুইপাতা কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যা যাচাই হইয়া তাহার উপর মার্কা পড়িয়া যায়”।

এভাবে একটা ভোগবাদী, চাকুরীর প্রার্থী এই কলে তৈরি হয়, মানুষ তৈরি হয় না। সময় এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকবোধ, মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তোলার নীতিমালা প্রণয়ন করার। এইসব প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেটা শুধু ভোগের উপকরণ বাড়ায়, এই প্রযুক্তিকে লাগাম টেনে ধরা দরকার।…

উল্লেখ্য, বিজ্ঞান মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটন তথা মানবকল্যানমুখী, পরিবেশবান্ধব হওয়া উচিৎ। আইনস্টাইনের শক্তির নিত্যতার সূত্র পরমাণুর ভেতরের জগৎকে জানতে সাহায্য করেছিল। তবে এই বিদ্যাকে ব্যবহার করে যে পারমাণবিক মারণাস্ত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়েছে, সেটা কারো অজানা নয়।

অতএব, শিক্ষাব্যবস্থা এরকম নম্বর বা গ্রেইডমুখী না হয়ে জ্ঞানমুখী হওয়া উচিৎ, পরিপূর্ণ একজন মানব যেন প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়, সেজন্য কারিকুলামে সেই বিষয়টার উপর বেশী জোর দেয়া দরকার। শিশুদের অনলাইন থেকে সরিয়ে প্রকৃতির কাছাকাছি আনা হোক। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি গড়ে তোলার পাশাপাশি পাঠ্য অভ্যাস যেন গড়ে ওঠে সেজন্য পরিবার, সমাজেরও দায়িত্ব বর্ত্তায়।…

আমরা হয়ত জানি, স্কেন্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে বইপড়ার অভ্যাস অনেক বেশী। সেজন্য, অপরাধ প্রবণতাও কম। মানবউন্নয়নের হারও ভাল। মনে রাখা দরকার, কোটি কোটি বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করে পৃথিবীর মানুষকে মঙ্গলগ্রহে পাঠানোর চেয়ে পৃথিবীকে মঙ্গলময় করার জন্য বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবী।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, শিব ও দক্ষ কিংবা বিদ্যা ও অবিদ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *