পুনঃপঠন ভাষায় ঔপনিবেশিকতা : প্রাচীন ভারতে ম্যানেজমেণ্ট ও বাৎস্যায়ণের কামসূত্র

ভাষায় ঔপনিবেশিকতা : প্রাচীন ভারতে ম্যানেজমেণ্ট ও বাৎস্যায়ণের কামসূত্র

এক

‘শাস্ত্র’ শব্দের অর্থ ‘শাষনসাধন’, অর্থাৎ যাহার দ্বারা শাষন করিবার কাজটী সাধন করা যায়, অর্থাৎ কিনা ‘শাস্ত্র’ মানে শাষনের হাতিয়ার। ভারতীয় কোষকারগণ জানাচ্ছেন যে, শব্দের এইপ্রকার অর্থ কাহারো স্বকপোলকল্পিত নয়, শব্দটীর ভিতরেই তাহা পাওয়া যায়। যে সকল বর্ণকে নিয়ে শব্দটী গড়ে ওঠেছে, তাহারাই ঐরূপ অর্থ ধারণ করে রেখেছে। শব্দের ব্যুৎপত্তি থেকে সে কথা আমরা জানিতে পারি। কোষকারগণ তাই শব্দের অর্থ প্রদান কালে প্রথমেই ব্যুৎপত্তি উল্লেখ করে থাকেন। এইক্ষেত্রে যেমন ‘শাস+ত্র(ষ্ট্রণ্)ণ শব্দ থেকে অর্থ নিষ্কাশনের এই বিধি অতি প্রাচীন এবং ভারত যক্ষণ এই বিধি প্রয়োগ করিতে শুরু করেছিল ইউরোপ তক্ষণো নোম্যাড রেস্ (Nomad)। সংস্কৃতের যোগ্য সন্তান হোয়ার/হ্ওয়ার সুবাদে কৃত্তিবাস কাশীরামের প্রাচীন বাঙ্গালাভাষাও এই বিধি দ্বারাই শাষিত ছিল। তাহা শ্রদ্ধেয় শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে যথারীতি প্রথমে ‘শাস্ত্র’ শব্দের ব্যুৎপত্তি দেখিয়ে, তাহারপর ‘শাষনসাধন’ অর্থটী সরবরাহ করেছেন। ব্যুৎপত্তির গোড়ায় থাকে একটী ক্রিয়া, এইক্ষেত্রে যেমন ‘শাস্’ ক্রিয়াটী, তাহারি ওপর ভিত্তি করে তিনি ঐরূপ অর্থ প্রদান করায় একে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ বলা যায়। ঐরূপ অর্থ নিষ্কাশন যে নতুন নয়, পূর্ব্বসূরীরাও এইরকমই করে গেছেন, তা দেখানোর জন্য অতঃপর তিনি পূর্ব্বসূরীদের মধ্যে ‘অমরকোষ’-এর উল্লেখ করেছেন; উপরোক্ত ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ নিষ্কাশন বিধি যেইখানে সম্পূর্ণ মান্য করা হয়েছে।

অবশ্য ইংরেজী গ্রীক জার্ম্মানী ইত্যাদি কোন ভাষাই এরূপ ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির দ্বারা শাষিত নয়। আধুনিক ভাষাজগতে কনভেনশনাল, অ্যাকসিডেণ্টাল বা প্রতীকী শব্দার্থবিধি মান্য করা হয়। তাহাতে যে কোন শব্দের অর্থ প্রথমবার কাহারো নিকট থেকে জেনে নিয়ে, তাহারপর সেই অর্থ স্মরণে রাখিতে হয়। শব্দের ভিতরে মাথা কুটিলেও সেইখান থেকে সরাসরি কোন অর্থ নিষ্কাশন করা যায় না। আধুনিক বাঙ্গালাসহ বিশ্বের প্রায় সমস্ত ভাষাই এই প্রতীকী শব্দার্থবিধি মান্য করে থাকে। কিন্তু প্রাচীন বাঙ্গালা ভাষার ক্ষেত্রে এই বিধি খাটে না। তাই বাঙ্গালা ভাষার বিশেষত্ব এই যে, সে দৃশ্যত একরম হলেও দুইরকম শব্দার্থবিধির দ্বারা শাষিত।

ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির দ্বারা শাষিত হলে, শব্দের ভিতর থেকেই তাহার বহুরৈখিক অর্থ বেরিয়ে আসে। এইক্ষেত্রে যেমন, যাহার দ্বারাই শাষন ক্রিয়াটী সাধন করা যাবে তাহাকেই বলা হৈবে ‘শাস্ত্র’। অর্থাৎ কিনা শাস্ত্র কোন নির্দ্দিষ্ট বস্তু নয়, উক্ত ক্রিয়াটী যেই সাধন করে সেই শাস্ত্র! সেইটী একটা বই না লাঠি তা বিচার্য্য নয়। যাথাতথ্য নয়, যাথাতত্ত্বের ওপর এই বিধির নিষ্পলক দৃষ্টি। তাই যুগে যুগে ‘শাস্ত্র’ শব্দের উদ্দিষ্ট বদলে গেছে, শব্দার্থও বহুরৈখিকতা থেকে ক্রমান্বয়ে একরৈখিকতায় অধঃপতিত হয়েছে। শ্রীযুক্ত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন— শ্রীধর স্বামীর মতে শ্রুতি স্মৃতি পুরাণাদি, মেদিনীকোষ মতে আগম এবং অন্য একমতে সাংখ্য যোগ তর্কপূর্ব্বোত্তরমীমাংসা সূত্র স্মৃতি কামন্দকাদি নীতিগ্রন্থগুলি ‘শাস্ত্র’ পদবাচ্য; অর্থাৎ ঐগুলির সাহায্যে বিশেষ বিশেষ কালে শাষন করিবার কাজটী সাধন করা যেত। এই নিরিখে পুরাণ কোরাণ সংবিধান সব গ্রন্থৈ শাস্ত্র পদবাচ্য সন্দেহ নেই।

শাষনের হাতিয়ার জিনিসটা, ব্যাবহৃত হৈবার আগে, কমপক্ষে দুইটী পূর্ব্বশর্ত্ত দাবী করে। তাহার চাই শাষক ও শাষিত, অর্থাৎ ঐ হাতিয়ার যিনি প্রয়োগ করিবেন তাঁহাকে এবং যাঁহার ওপর তা প্রযুক্ত হৈবে তাঁহাকে। আপনার আত্মশক্তি যদি বলবান হয়, আর সে যদি আপনার প্রবৃত্তির স্বভাববিরোধী হয়; অর্থাৎ আপনার অসংখ্য দেহকোষের দাবীগুলিকে শাষন করিতে চায়, সেই ক্ষেত্রে আপনি শাস্ত্রের প্রয়োগ করিতে পারেন। আবার কোন সমাজদেহের আত্মশক্তি (জাতীয়তাবোধ ও তাহার মোড়লগণ যদি বলবান হয় এবং সে যদি অসংখ্য সমাজ দেহকোষের (জনসাধারণের) দাবীগুলিকে শাষন করিতে চায়, সে ক্ষেত্রেও শাস্ত্রের প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাহা হৈলে দেখা যাছে, দৃষ্টিভঙ্গীটাই একরৈখিক নয়, বহুরৈখিক। মানবদেহ হোক আর সমাজদেহৈ হোক, তাহাদের শাষন করার ব্যাপার শাস্ত্রের প্রয়োগ প্রশস্ত। এক শাস্ত্রের সাহায্যে সকল দেহৈ শাষন করা যায়। যায় বলেই, ভারতবর্ষ বহু প্রাচীনকাল থেকে এক ঢিলে দুই পাখী মেরে আসিতেছে।

ইউরোপ এই জিনিসের সঙ্গে পরিচিত নয়। যাথাতথ্য তাহাদেরকে যতখানি গর্ব্বিত করেছে, ততখানি ধীমান করেনি। তাই মানবদেহ ও সমাজদেহকে এক সঙ্গে দেখিবার কৌশল তাহাদের অজানা। সেই কারণে সমাজদেহকে শাষন করিবার ব্যাপারে তাহারা প্রধানত অস্ত্রের ওপরেই নির্ভরশীল। আমাদের ‘অস্ত্র’-এর পাশাপাশি ছিল ‘শস্ত্র’, যাহার যথার্থ প্রতিশব্দ পর্য্যন্ত তাহাদের ভাষায় নেই, আর ‘অস্ত্রশস্ত্র’ আমাদের এমন উত্তরাধিকার যে আমরা কথায় কথায় শব্দটী ব্যাবহার করে থাকি। ‘শস্ত্র’বিদ্যা আমাদের অধ্যয়নেরেও বিষয় এবং তা বহু প্রাচীনকাল থেকেই। আর সেই সকল শস্ত্রের আধার বলেই উল্লিখিত গ্রন্থগুলিকে ‘শাস্ত্র’ বলা হয়ে থাকে। আমাদের প্রাচীন ভারতীয় মন্দিরকেন্দ্রিক সভ্যতার আদি আই-সি-এস প্রশাষকগণ ঐ গ্রন্থগুলির ওপর নির্ভর করে যে শাষন চালাতেন, তা জনসাধারণের দেহের চেয়ে তাহাদের মনের ওপর অনেক বেশী কড়া হয়ে এঁটে বসিত, কাজটা হৈত পাকা। অস্ত্রের শাষনে যদি পাকা করা হৈত, তাহা হৈলে তাহার মধ্যে দাসত্বের অবমাননা থাকিত এবং ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহের চেষ্টা কক্ষণোই থামিত না[1], যা ইউরোপের বৈশিষ্ট্য। আধুনিক ভারতে দেরাদুনে আমাদের হবু সিভিল সার্ভেণ্টগণ যে সকল গ্রন্থের ওপর নির্ভর করে ভারতের জনসাধারণকে শাষন করিবার কৌশল রপ্ত করেন, সেগুলিই এই যুগের শাস্ত্র বা শাষনের হাতিয়ার। সেইখান থেকে শস্ত্র চালনার কায়দা-কসরত শিখে, তদনুযায়ী তাঁহারা তাঁহাদের কলম চালান; কেমন চালান সেকথা আমরা সবাই জানি; আর কে না জানে কলম তরবারির চেয়ে বেশী শক্তিশালী? ভারত একটা প্রাচীন দেশ, অসংখ্য মৌলিক আবিষ্কারগুলির পাশাপাশি, কলম দিয়ে নিঃশব্দে খুন করিবার বিদ্যাও সে আবিষ্কার করেছিল বহু প্রাচীনকালে এবং সেই বিদ্যাও হয়েছিল শাস্ত্র পদবাচ্য। আর ঐরূপ শাষনের হাতিয়ার বলেই জনসাধারণ ওইগুলিকে কক্ষণো সৎ-শাস্ত্র বলেনি। ‘সচ্ছাত্র’ বলেছে ‘শ্রুতিস্মৃতিবিরোধী শাস্ত্র’[2]-কে। সেই সচ্ছাত্রের ‘দদাতি প্রতিগৃহ্ণাতি’[3] [ = to the people and from the people[4] = দিবে আর নিবে ] নির্দ্দেশ যদি মান্য করি, তবে এইকথা বলিতেই হয় যে, জনসাধারণের মতে বেদবিরোধী শাস্ত্রই যে সৎ শাস্ত্র হয়, এতদিন সেকথা আমরা খেয়াল করিনি।

বস্তুত আদিম সাম্যবাদী সমাজের হাত ধরে যে বহুরৈখিক প্রাচীন সংস্কৃতের উদ্ভব, পণ্যবাহী সমাজের হাত ধরে সে ক্রমান্বয়ে এগোচ্ছিল একরৈখিক আধুনিক বাঙ্গালা ভাষার দিকে। আর সেই সময়, একদিন ব্রিটিশের আগমন ঘটে ও বাঙালীর ভাষার ভিতরেও সে উপনিবেশ স্থাপণ করে, যাহার অনিবার্য্য ফলশ্রুতি ঘটে বাঙ্গালা ভাষার আত্মাবদলে। সেইজন্যেই কেরী সাহেব থেকে সুনীতি চাটুজ্জে সাহেব পর্য্যন্ত ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত সাহেবদের কাছ থেকে আমরা যক্ষণ বাঙ্গালা ভাষাটা নতুন করে শিখিলাম, ততক্ষণে সেই অফিসিয়াল সাহেবী বাঙ্গালার আত্মা বদলে গেছে এবং শরীরেও হাত পড়েছে, প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষার মত বাঙ্গালা ভাষার ভিতর থেকেও ভারত-আত্মার বিদায় পর্ব্ব সমাধা হয়েছে এবং ইউরোপীয় আত্মার অনুপ্রবেশ ও অধিষ্ঠান সাঙ্গ হয়েছে। অর্থাৎ কিনা, ইউরোপ কেবল ভারতেই উপনিবেশ স্থাপণ করেনি, ভারতীয়ের জীবনের সর্ব্বত্র, তাহার ভাষায় আচারে ব্যবহারে জীবিকায় মনে শিল্পে সাহিত্যে এককথায় সমগ্র জীবনযাত্রায় উপনিবেশ স্থাপণ করেছিল।

বাঙ্গালা ভাষার দেহে ইউরোপীয় আত্মা ঢুকে পড়ার পর বাঙ্গালা শব্দাবলীর ভিতর তাহাদের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থগুলিকে অর্থাৎ ভারতাত্মাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই ‘শাস্ত্র’-এর ভিতর ‘শাষনসাধন’কেও পাওয়া যায়নি; পাওয়া গেছে ‘স্ক্রিপচার’রূপে ইউরোপীয় আত্মাকে; অর্থাৎ কিনা, আমরা ইউরোপীয় ‘স্ক্রিপচার’ বা ‘রিলিজিয়াস বুক’-এর বাঙ্গালা প্রতিনিধিরূপে অতঃপর ‘শাস্ত্র’কে পেয়েছি। মাঝ থেকে শাষনসাধন বা শাষনের হাতিয়ার যে শাস্ত্র, সে হয়ে গেল আরাধনার হাতিয়ার বা ধর্ম্মপুস্তক। এইভাবে প্রায় প্রতিটি শব্দের ক্ষেত্রে, সমগ্র বাঙ্গালাভাষার ক্ষেত্রে আত্মাবদল প্রক্রিয়া সাঙ্গ হৈল।

উদাহরস্বরূপ উল্লিখিত ‘ধর্ম্ম’ শব্দটীর কথাই ধরা যাক। আত্মাবদল প্রক্রিয়ার চাপে ‘ধর্ম্ম’ ও তাহার বহুরৈখিক (ক্রিয়াভিত্তিক) অর্থ হারিয়ে Religion-এর প্রতিশব্দ মাত্র হয়ে গেল। অথচ কোথায় ‘ধর্ম্ম’ আর কোথায় Religion! ‘ধর্ম্ম’ হৈল ‘লোকধারক, শাস্ত্রানুশাষন বৈধকর্ম্ম, ন্যায়, নীতি, স্বভাব, প্রকৃতি, বিশেষ লক্ষণ ইত্যাদি, আর Religion হ’ল ‘human recognition of a personal God entitled to obedience’। বাঙ্গালা ধর্ম্ম ও ইংরাজী Religion তো আদৌ এক বস্তু নয়। যেমন কিনা, বস্তুর-ও ধর্ম্ম হয়, ধর্ম্মের গ্লানিও হয়, কিন্তু বস্তুর Religion হয় না, Religion-এর গ্লানিও হয় না। ধর্ম্ম ও Religion-এর মধ্যে এই যে বিশাল পার্থক্য ছিল, আত্মাবদল প্রক্রিয়ায় তাহার বিলোপ ঘটানো হৈল । কীভাবে?

‘ধর্ম্ম’-এর মত বাঙ্গালা শব্দগুলির বর্ণ ও ধ্বনিগুলি যে ক্রিয়াভিত্তিক (বহুরৈখিক) অর্থধারণ করে, সে তো বলিতে গেলে এক একটা জমিদারী, অন্য দিকে Religion-এর মত ইংরাজী শব্দগুলির ধ্বনি ও বর্ণগুলি কোন অর্থৈ ধারণ করে না; কিন্তু তাহাদের প্রত্যেকের বর্ণসমষ্টি একটা করে একরৈখিক অর্থ ধারণ করে, সেই বিচারে তাহারা বস্তুতই তাঁবুবাসী। তাই আত্মাবদল প্রক্রিয়ার কালে, যেহেতু ইংরেজ শাষক এবং যেহেতু তাহাদের ভাষার শব্দগুলি তাঁবুবাসী, বাঙ্গালা ভাষার শব্দগুলিকেও তাহাদের জমিদারী কেড়ে নিয়ে তাঁবুবাসী করে দেওয়া হৈল; এমনকি তাহাদের শরীরেও হাত পড়িল— ‘ধর্ম্ম’ হয়ে গেল ‘ধর্ম’। বর্ণবিপর্য্যয় হয়ে গেলে যে অর্থবিপর্য্যয় ঘটে যায়, বাঙ্গালা শব্দের এই স্বভাবের কথা বর্ণার্থ-অজ্ঞদের মাথায় আসেনি। কেননা, তাহাদের মাথায় ছিল উভয় ভাষার মধ্যে একপ্রকার সাম্য, ভাব বিনিময়ের জন্য যেটা ছিল জরুরী; আর বাঙ্গালাভাষার মত প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষার শব্দগুলিকে ইংরেজী শব্দের মত তাঁবুবাসী করে দিয়ে সেই সৎকার্য্যটী সুসম্পন্ন করা হয়। ফলে, বাঙ্গালাভাষা বাস্তবিকভাবে তাহার সাম্রাজ্য হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে আধুনিক বাঙ্গালাভাষায় পরিণত হয়ে গেল। বাঙালীকে উদ্বাস্তু করে যত ক্ষতি করা হয়েছে, তাহার ভাষাকে উদ্বাস্তু করে তাহার চেয়ে কম ক্ষতিসাধন করা হয়নি।

আসলে, পাঠকেরও যে শ্রেণীবিভাগ সম্ভব, এবং সমগ্র পাঠককুলকে শ্রেণিবিভক্ত করে রাখা যেতে পারে, ইউরোপ তেমন ব্যাপার কল্পনাও করিতে পারে না। ইউরোপীয় ধারণায় গ্রন্থপাঠ যে করে সেই পাঠক। বস্তুর ভর যেমন সর্ব্বত্র একি পরিমাণ থাকে, গ্রন্থের বিষয়বস্তু-ও সকল পাঠকের নিকট একি প্রকারে পৌঁছে দেওয়া হয়। কেননা, তাহাদের ধারণায়— একটা শব্দ বোঝাবে একটা বিষয় বা বস্তুকে, একটা বাক্য থেকে বেরিয়ে আসিবে একটাই মানে। ব্যতিক্রম যদি কোথাও ঘটে, সেটা ব্যতিক্রম মাত্র। সাধারণভাবে একটা কথার দশরকম মানে হৈবে, দু’রকম পাঠক তাহার তিনরকম অর্থ বুঝিবেন— এইসব তাহাদের বাস্তববুদ্ধির সঙ্গে আদৌ মেলে না। ভাষা মাত্রেই তাহাদের বিচারে একরৈখিক অর্থবহনকারী, যেহেতু, তাহাদের নিজেদের ভাষা সেইরকম। দেহভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিকশিত জাতিরূপে ইংরেজ সব ব্যাপারকেই দেহের দিক থেকে বুঝিতে স্বস্তি বোধ করে, আত্মার দিক থেকে নয়। আধেয়ের চেয়ে আধারের দিকে, কণ্টেণ্টের দিকে তাহার স্বাভাবিক নযর। তাই ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারেও একরৈখিক (প্রতীকী) ভিন্ন অন্য কোন রকমের ব্যাবস্থার কথা ভাবা সম্ভব ছিল না তাহাদের পক্ষে। তাছাড়া, একরৈখিক ভাষার প্রতি পণ্যবাহী সমাজের স্বাভাবিক আস্কারা থাকে, কারণ সেটা তাহার ক্ষেত্রে অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কিন্তু আমাদের দেশে শাসকের ভাষাব্যাবহারের ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। ভারতে যেমন সমুদ্র মন্থন করে কেউ পেত অমৃত, কাহারো ভাগ্যে জুটত শুধুই বিষ; তেমনি আমাদের শাস্ত্রমন্থনেও ছিল অধিকারীভেদ— উত্তম অধিকারী ও নিম্ন অধিকারী। শাস্ত্রগুলি সব লেখা হয় বহুরৈখিক অর্থ সমন্বিত ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায়, ইংরেজীর মত একরৈখিক অর্থসমন্বিত প্রতীকী ভাষার নয়। যাহার মেধা কুলোয় কিংবা যাকে দীক্ষান্তে উপায়গুলি বলে দেওয়া হয়, সে বহুরৈখিক অর্থ গ্রহণ করে হয়ে যেত শাস্ত্রাধিকারী। আর যাহার মেধায় কুলোয় না, সে যে কোন একরৈখিক অর্থ গ্রহণ করে থেকে যেত নিম্ন অধিকারী হয়ে। পাঠককূল তাই আমাদের শাস্ত্রানুসারে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। তন্মধ্যে নিম্ন অধিকারীর সঙ্গে ইংরেজের ঘনিষ্ঠতার কারণ প্রধানত দুইটা!।

প্রথমত, যেহেতু শাস্ত্রের উত্তম অধিকারিগণৈ শাষনাধিকারীতে পরিণত হৈতেন, সমাজমনের শাষনের ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থায় এইযাবৎ বিশেষ ছেদ পড়েনি। এমনকি মোগল যুগের শেষ দিন পর্য্যন্ত সেই ব্যবস্থাই কার্য্যত বলবৎ ছিল। নবাগত শাসকের সঙ্গে ওই শাস্ত্রাধিকারিগণের অসহযোগিতা ছিল প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। যেই নিয়মে রামচন্দ্র বালীর চেয়ে সুগ্রীবকে কোল দেওয়া যুক্তিযুক্ত ঠাওরেছিলেন, সেই নিয়মেই নবাগত শাষক ইংরেজ নিম্ন অধিকারীকে কোল দেওয়া যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করেছিল। এইরূপ সুবিধাবাদী প্রশ্রয়ের কারণে নিম্ন অধিকারিগণ নতুন শাষনাধিকারী রূপে ‘জজ পণ্ডিত’ পর্য্যন্ত বনে যান এবং উত্তম অধিকারিগণ ক্রমশঃ বাদ পড়ে যান, কেউবা নিম্ন অধিকারীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন[5]। নিম্ন অধিকারী ও নবাগত ইংরেজের ঘনিষ্ঠতার অন্য কারণটী ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট যে উভয়ের ভাষা ব্যাবহার পদ্ধতি একরৈখিক হ্ওয়ায় তাহাদের মনের মিল হৈতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। বহুরৈখিক সংস্কৃত ও বাঙ্গালা ভাষা থেকে একরৈখিক অর্থগ্রহণের নিকৃষ্টতাহেতু এতদিন নিম্ন অধিকারী ছিল অপাংক্তেয়, এক্ষণ সেই সর্ব্বেসর্ব্বা হয়ে উঠিল। ইংরেজ তাহারি কাছ থেকে সংস্কৃত ও বাঙ্গালায় লিখিত গ্রন্থগুলি জেনে বুঝে নিল— যা অগত্যা একরৈখিক হৈতে বাধ্য ছিল। রাজা যেভাবে বোঝে, নিজেদের ভাষাকে সেইভাবে কেটে ছেঁটে তাহার নিকট উপস্থাপণ করার ব্যাপারে সে সময় কেমন প্রতিযোগিতা হয়েছিল, তা আমরা সবিশেষ জানি না, তবে সেই স্রোতে একসময় উত্তম অধিকারিগণের অনেকেই যে নিম্ন অধিকারীদের দলে নাম লিখিয়েছিলেন, তা প্রায় হৈলফ করে বলা যায়। ব্রিটিশ-ভারতের আদি আইন শাস্ত্র ‘জন্তু কোড্’ নামটুকু থেকেই তা প্রমাণ করে দেওয়া যায়।

যাই হোক, এর ফলে নিম্ন অধিকারী যে কেবল সর্ব্বেসর্ব্বা হয়ে উঠিল তাহাই নয়, তাহারো তাহার নতুন প্রভুর একরৈখিক অর্থসমন্বিত প্রতীকী ভাষা পদ্ধতিই দুনিয়ার একমাত্র ভাষা পদ্ধতি রূপে ঘোষিত হয়ে গেল। বহুরৈখিক ভারতীয় ভাষাগুলির কেবলমাত্র একরৈখিক অর্থ গৃহীত হৈতে লাগিল, এবং এইভাবে গৃহীত হৈতে হৈতে একদিন সমগ্র বাঙ্গালা ভাষাই ইংরেজীর মত প্রতীকী ভাষায় পরিণত হয়ে গেল। আর আমরাও ধীরে ধীরে ভারতীয় বাঙ্গালার বদলে, বলা ভাল, ইউরোপীয় বাঙ্গালায় অভ্যস্ত হয়ে উঠিলাম এবং আমাদের আদি বাঙ্গালাভাষা যাহা বহুরৈখিক অর্থসমন্বিত ক্রিয়াভিত্তিক ভাষারূপে আবির্ভূত হয়েছিল সেইকথা আমরা একদিন বেমালুম ভুলে গেলাম। এক্ষণ, আমাদের দেশ থেকে ইংরেজ চলে গেছে, কিন্তু আমাদের ভাষা থেকে তাহার বিদায়পর্ব্ব সমাধা হৈতে সম্পূর্ণই বাকী। বলিতে কি, আমাদের ভাষা বিশেষজ্ঞ ও নিম্নাধিকারী সাহিত্যিকদের কৃপায় বাঙ্গালা ভাষার ভিতর ইংরেজের ঔপনিবেশিক সিংহাসন বহাল তবিয়তে বি-রাজ করিতেছে এবং তাহার শাষন চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা ছদ্মবেশী বাঙ্গালা ভাষা নিয়ে ঘর করিতেছি, যে বাঙ্গালা ভাষার রয়েছে বঙ্গীয় দেহ ও ইউরোপীয় আত্মা। তাই নিয়েই আমরা বড়াই করিতেছি, দাবী-দাওয়া করিতেছি, একি দুরবস্থায় ভুক্তভোগী হিন্দী ভাষার সঙ্গে ঘরোয়া কোন্দল করিতেছি। কেউ বা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি এমন বাঙ্গালারূপী ইংরেজী শেখার চেয়ে বরং সরাসরি ইংরেজী শেখাই ভাল।

তা সে যাই হোক, ইংরেজের উপনিবেশের প্রারম্ভকালে বাঙ্গালা ভাষার ঐরূপ আত্মাবদল প্রক্রিয়া সাঙ্গ হৈবার পর, ইংরেজের সঙ্গে আমাদের ভাষাবিনিময়ের পথটা সুগম হৈল ঠিকি। কিন্তু বহুরৈখিক অর্থসমন্বিত ক্রিয়াভিত্তিক সংস্কৃত ও বাঙ্গালা ভাষার ব্যাবহার ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হ্ওয়ায় আমরা আমাদের অতীত থেকে, ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। সমগ্র পৌরাণিক সাহিত্যের কেবলমাত্র একরৈখিক অর্থ বোঝা হৈতে লাগিল। আমরা শিখিলাম আমাদের পূজ্যপাদ হনুমান মানে নিকৃষ্ট এক জানোয়ার monkey, দেবতাকে জানিলাম God বলে, নাগ ও সর্পকে চিনিলাম Serpent-এর অনুরূপে, সীতাকে বুঝিলাম হেলেন অফ ট্রয়ের অনুকরণে [ হায়! কোথায় অযোনিসম্ভবা সীতা, আর কোথায় হেলেন! ], কুরুক্ষেত্রকে জানিলাম ওয়াটার্লুর সমগোত্রীয় বলে, রামায়ণ-মহাভারতকে বলিলাম mythology, কামসূত্রকে বলিলাম Sexology[6]। আর, আমাদের নিজেদের ভালমন্দ বোধ দিয়ে নয়, খ্রীষ্টান বৃটিশের ভালমন্দ বোধের মাপকাঠিতে ঐগুলিকে বিচার করিতে বসিলাম, যেহেতু ব্রিটিশ-ই রাজা, এবং অতএব, তাহার সবি শ্রেষ্ঠ, আর আমাদের ধারণাতেও ততদিনে তাহার উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত। ফলত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমাদের বিশাল পৌরাণিক ইতিহাসের অমৃত কলস পরিণত হয়ে গেল এক ঘড়া গঙ্গাজলে, পবিত্র এবং দূষিত, আমাদের সর্ব্বনাশ হয়ে গেল, আমরা আত্মপরিচয়হীন হয়ে গেলাম। মার্ক্স ও রবীন্দ্রনাথ, এই দুই মনীষীই, এই ‘আত্মবিচ্ছেদ’কেই ভারতবাসীর সমস্ত দুর্দ্দশার কারণ বলে চিহ্নিত করে গেলেন[7]।

এতদিন পরে সে ‘আত্মবিচ্ছেদের ছিন্নসূত্রগুলি’ জোড়া দেবার সুযোগ এসেছে আমাদের হাতে। পাওয়া গেছে বেদপুরাণাদির বহুরৈখিক অর্থগ্রহণের উপায়ের সুলুক-সন্ধান, যাহার সাহায্যে ঐ ছিন্নসূত্রগুলি এক এক করে ধীরে ধীরে জোড়া সম্ভব এবং আমাদের আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়া সম্ভব। এর ফলে বাঙ্গালা ভাষার সাথে সাথে সমস্ত ভারতীয় ভাষায় ভারতাত্মার পুনরাধিষ্ঠান যেমন সম্ভব হৈবে, ইউরোপীয় আত্মার ভূত বিতাড়ন-ও সম্ভব হৈবে, ভাষাকে মুক্ত করা যাবে ঔপনিবেশিকতার হাত থেকে। বাঙ্গালাসহ সমস্ত ভারতীয় ভাষা এইভাবেই প্রকৃতার্থে স্বাধীন ও মুক্ত হৈতে পারিবে। ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে এইভাবেই একটা জাতিকে তাহার নিজস্বতা নিয়ে উঠে আসিতে হয়। ঋষি বঙ্কিমের একটা বিধানকে এইক্ষেত্রে আমরা যুগোপযোগী করে বলিতে পারি, ‘একমাত্র এইভাবেই, বিশ্বের জাতিসমূহ সর্ব্বার্থে স্বাধীন ও মুক্ত হয়ে পরস্পরকে বুঝতে ও প্রভাবিত করিতে পারে, এবং সম্মিলিত ভাবে বিশ্বশক্তিগুলিকেও প্রভাবিত করিতে পারে। অন্যথায় মানব জাতির কোন আশা নেই।’[8]

সুতরাং ‘আত্মবিচ্ছেদের ছিন্নসূত্রগুলি’ এবার জোড়া দিতে হৈবে। কিন্তু কাজটা একজনের নয়, এক দিনেরেও নয়। এক একটা বিষয় নিয়ে কাজ করিতে হৈবে। সব মিলিয়ে, সেই এক সুবিশাল কাহিনী। এর মধ্যে, ‘হাওয়া ৪৯’-এর সম্পাদক আমাকে বলেছেন, বাৎস্যায়ণের কামসূত্রের প্রকৃত স্বরূপটীকে আজকের ভাষায় ভাষান্তর করে দিতে। তাহা হৈলে, ‘কামসূত্র’ কেমন Sexology, সেই ‘আত্মবিচ্ছেদের ছিন্নসূত্র’ এবার জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।

দুই


আমার ছিল দুইবস্তা ধান, আপনার একটা গরু। আমরা বিনিময় করিলাম। শাস্ত্রমতে, এই বিনিময় আমি আপনি করিনি। আপনার ছিল ধানের প্রতি কামনা, আমার কামনা ছিল গরুর প্রতি। কাম ছিল আমার অন্তরে, কাম ছিল আপনার অন্তরেও। অর্থাৎ ‘কাম’ আমার আপনার দুজনের অন্তরে বিদ্যমান থেকে ঐ লেনদেন ঘটিয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় মনীষা এইরূপ আত্মাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গীতেই দেখিতে অভ্যস্ত ছিল। তাই শাস্ত্র বলেন— ‘কে দিয়েছে? কে নিয়েছে? কামৈ দিয়েছে। কামৈ নিয়েছে।’— (ঋগ্বেদ)। আর বিনিময়যোগ্য ঐ বস্তুগুলি আমাদের মনে ‘কাম-উদিত’ করে বলে তাহারা কামোদিতি (>commodity) পদবাচ্য। উদিত কামকে না হয় চেনা গেল, কিন্তু রতি কৈ?

ধরা যাক, আপনি কর্ম্মজগৎ সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ এবং নতুন এক পরিকল্পনার আবিষ্কারক। আর আমরা কয়েকজন আপনার পরিকল্পনার কথা শুনেছি এবং তাহা কাজে রূপায়িত করিলে কীরূপ অবাকফসল উৎপাদিত হৈবে তাহার স্বপ্নে বিভোর। এই ক্ষেত্রে আপনার যদি আমাদের কর্ম্মশক্তির প্রতি এবং আমাদের যদি আপনার পরিকল্পনার প্রতি কামনা জন্মায়, তাহা হৈলে সরল লেনদেনের মাধ্যমে এইরূপ কামচরিতার্থ হোয়ার/হ্ওয়ার কোন উপায় নেই। তাহার জন্য আপনার সঙ্গে আমাদেরকে কর্ম্মে রত হৈতে হৈবে। যে নিয়মে ‘গত হৈতে থাকা’কে ‘গতি’ বলায় হয়, সেই নিয়মেই ‘রত হৈতে থাকা’কে ‘রতি’ বলে। অর্থাৎ কিনা, এইরূপ কামের ‘জ্ঞানাংশ’ ও ‘কর্ম্মাংশ’ দুইটিই বিদ্যমান, যাহাদের যথাক্রমে ‘কামোন্মাদনা’ বা ‘কর্ম্মোন্মাদনা’ এবং ‘কামসম্পাদনা’ বা ‘কর্ম্মসম্পাদনা’ বলে। বস্তুত ‘কামে’ আর ‘কর্ম্মে’ কোন প্রভেদ নেই বলেই ভারতের বেশীরভাগ প্রাদেশিক ভাষায় কর্ম্মের প্রতিশব্দৈ কাম। কর্ম্মোন্মাদনাই (=প্রেমভাব) ‘মদন’ এবং কর্ম্মসম্পাদনাই (প্রেমকর্ম্ম) ‘রতি’ শব্দে পরিকীর্ত্তিত হয়েছে। যাঁহারা জীবনে অন্তত একবারো কোন নতুন পরিকল্পনা রূপায়নের জন্য কিছু লোকলস্কর বন্ধুবান্ধব নিয়ে কর্ম্মোন্মাদনায় মত্ত ও রত হয়েছে, এই ব্যাপার তাঁহাদের পক্ষে অনায়াস বোধগম্য সন্দেহ নেই।

কিন্তু এই যে আপনার সঙ্গে আমরা প্রেমে (প্রেমভাব ও প্রেমকর্ম্ম দুইটাতেই) মত্ত বিভোর হয়ে কাম চরিতার্থ (Job Satisfaction লাভ) করিলাম, এর ফসলের মালিক কে হৈবে? আগেভাগেই তাহা হৈলে আমাদের সঙ্গে আপনার একটা চুক্তি বা Contract হোয়ার/হ্ওয়ার প্রয়োজন ছিল। আমরা তো জানি যাকে ‘Carry out’ করিতে হয় বা বহন করিতে হয় তাহাকে ‘Contract’ বা ‘বিবাহ’ই বলে। তবে এরূপ বিবাহের বা Contract-এর রূপায়ণ সম্ভব হয় কেবল তক্ষণি যক্ষণ ‘গার্হস্থ্য বিধানে ক্রিয়ানুষ্ঠান’ চলে। পুরাণাদি সাক্ষ্য দেয় যে কেবলমাত্র দক্ষযজ্ঞ প্রতিষ্ঠিত হৈবার পরবর্ত্তী কাল থেকে ভারত সমাজে এইরূপ ‘স্ত্রী পুরুষ ধর্ম্মানুসারে গার্হস্থ্য বিধানে ক্রিয়ানুষ্ঠানের প্রচলন হয়।’[9] কারণ তাহার আগে সমাজের ‘অর্দ্ধাংশ নারী’ (স্ত্রী, কর্ম্মিজনগণ) ও ‘অর্দ্ধাংশ পুরুষ (জ্ঞানী, পরিচালক) মূর্ত্তি ধারণ’ করেনি। তাই গার্হস্থ্যবিধানে ক্রিয়ানুষ্ঠানেরেও উপায় ছিল না, আর তাই বিবাহেরেও প্রচলন হয়নি। কারণ বিবাহের বা চুক্তির প্রচলন তক্ষণি হ্ওয়া সম্ভব, যক্ষণ বেদের মর্য্যাদা বা জ্ঞানের মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে’; অর্থাৎ কিনা জ্ঞানীই জ্ঞানের মালিক এইকথা সমাজ স্বীকার করে নিয়েছে। আধুনিকভাষায় একে ইণ্টেলেকচুয়াল প্রপার্টী রাইটস বলা হয়ে থাকে। পুরাণাদি সাক্ষ্য দেয় দক্ষযজ্ঞের পর থেকে বিবাহের সূত্রপাত অর্থাৎ চুক্তি করে লোকজন নিয়ে কাজকর্ম্ম করার শুরু তক্ষণ থেকেই।

তা সে যাই হোক, আপনার জ্ঞানের মালিক আপনিই, সমাজ নয়, এই আদি ব্যক্তি মালিকানা অর্থাৎ ইণ্টেলেকচুয়াল প্রপার্টী রাইটস সমাজ স্বীকার করে নিয়েছে বলে আপনিই এক্ষণ ‘শঙ্কর’তুল্য। এক্ষণ কর্ম্মী জনগণের সঙ্গে চুক্তি (বিবাহ) বন্ধনে যাওয়ার আগে আপনাকে প্রথমেই ‘মদনভস্ম’ করে ফেলিতে হৈবে, তাহার পরে আসিবে বিবাহের কথা, তাহারো পরে বিবাহোত্তর কামচর্চ্চার কথা এবং উৎপাদিত ফসলের মালিকানার কথা।

আগেই বলা হয়েছে, কাম দুই প্রকার, কর্ম্মোন্মাদনা বা ‘মদন’ এবং কর্ম্মসম্পাদনা বা ‘রতি। এই মদনকে অর্থাৎ কর্ম্মোন্মাদনাকে জ্বালিয়ে ছাই করে দিতে হৈবে। অর্থাৎ কিনা প্রেমভাব থাকিবে না, কিন্তু প্রেমকর্ম্ম থাকিবে, রতি থাকিবে। কী করে আপনি আমাদের কর্ম্মোন্মাদনা(মদন)কে ভস্ম করিবেন? খুব সহজ। সব পরিচালকৈ করে থাকেন। আপনি শুরুতেই ঘোষণা করিবেন— ‘তোমরা আসিবে, যেমন কাজ করিতে নির্দ্দেশ দেব, করিবে, কী হচ্ছে না হচ্ছে তাহা তোমাদের ভাবিতে হৈবে না; পরিকল্পনা আমার, আমিই বুঝিব তাহার ভালমন্দ; পরিকল্পনাকে ভালবেসে কর্ম্মোন্মাদনায় তোমাদেরকে মত্ত হৈতে হৈবে না, খাটিবে, পয়সা নেবে, চলে যাবে।’ এই আর কিছুই নয়, কেবল ‘মা ফলেষু কদাচন’ বলা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘কর্ম্ম থেকে ফলাকাঙ্ক্ষা উপড়াইয়া লইলে কর্ম্মের বিষদাঁত ভাঙিয়া দেওয়া হয়’[10]। আপনি কেবল সেটুকু করিবেন। ব্যাস, দেখিবেন ‘মদনভস্ম’ হয়ে গেছে। বেঁচে থাকিবে কেবল ‘রতিবিলাপ’। কর্ম্মী জনগণ এরপর আসিবে, খাটিবে, মজুরী নেবে, চলে যাবে। পরিচালকের প্রতি, তাহার পরিকল্পনার প্রতি, তাহাদের প্রেমভাব নেই, এক ধরণের যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠিতেছে। উৎপাদিত ফসলের প্রতি তাহার দাবীর কথা বলার কোন উপায়-ই নেই তাহার হাতে। ‘মদনভস্ম’ করে তাহার গোড়া মেরে দেওয়া হয়েছে। এই জন্য বিবাহের আগেই আপনাকে ‘মদনভস্ম’ করে ফেলিতেই হৈবে। তাহার পরে হৈবে বিবাহ, তাহার পরে হৈবে কামচর্চ্চা। অন্যথায়, পরে উৎপাদিত বস্তুর ওপর থেকে তাহাদের অধিকারের দাবীকে নাকচ করা আপনার পক্ষে মুশকিল হৈবে।

মার্ক্স সাহেব পণ্য উৎপাদনের আদি রহস্য খুঁজিতে খুঁজিতে অবশেষে প্রাচীন ভারতে পৌঁছে যান এবং দেখিতে পান যে, ‘In the Primitive Indian Community there is social division of labour without production of commodities’[11]। কিন্তু Social division of labour বলিতে যে জ্ঞানী কর্ম্মী বিভাজন করা এবং তাহারপর ‘মদনভস্ম করাতেই যে সত্যিকারের পণ্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল, সেই তথ্য তিনি জানিতেই পারেননি। কারণ তাঁহার জানা ছিল না, ভারতে প্রেম ছিল দুই প্রকার— সকাম প্রেম ও নিষ্কাম প্রেম। সকাম প্রেম হৈল সেই বস্তু যেইখানে মদন ও রতি উভয়েই বিদ্যমান। আর নিষ্কাম প্রেম হৈল যেইখানে মদন ভস্মীভূত, অস্তিত্ব কেবল রতি বিলাপের। কামহীন নিষ্কাম প্রেমীর ক্লান্তিকর যান্ত্রিক রতিবিলাপের অনিবার্য্য ফসল হৈল পণ্য। পরিকল্পনাকারী-পরিচালক-জ্ঞানী যাহার মালিক। এই সেই কারণ, যেই জন্য ভারতের শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে সকাম প্রেমের ঝুড়ী ঝুড়ী নিন্দা এবং নিষ্কাম প্রেমের গৌরব বিঘোষিত হয়েছে। অথচ, এইকথা বুঝতে কাহারোই অসুবিধা হয় না যে, যে প্রেমে মদন নাই কেবল রতির অস্তিত্ব আছে, সে ত একপ্রকার অশ্লীল এক যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া মাত্র, যাহাতে পাত্র-পাত্রীর পরস্পরের প্রতি কোনরূপ মানসিক আকর্ষণ থাকে না। কর্ম্মী আসে কাজ করে চলে যায়, মালিককে বা পরিচালককে কিংবা তাহার পরিকল্পনাকে ভালবাসে না, ভালবাসতে চাইলেও তাহার উপায় নেই, তাই সে নিস্পৃহ। আর মালিক বা পরিচালক-ও কর্ম্মীদের ভালবাসে না, ভালবাসিতে চাইলেও তাহার উপায় নেই— উৎপন্নে ভাগ চেয়ে বসে যদি, তাই সেও নির্ব্বিকার থাকে। ফলতঃ কাহারোই কাম চরিতার্থ (Job Satisfaction) হয় না। অথচ জ্ঞানের মালিকানা মেনে নিলে, ব্যাক্তি মালিকানার দিকে হাঁটিতেই হয়, পণ্য উৎপাদনের জন্য নিষ্কাম প্রেমের চর্চ্চা করিতেই হয় এবং Job Satisfaction-এর আশা ছাড়িতেই হয়। জীবিকা থেকে তক্ষণ কেবল রসদ-ই বাহির হয়, রস বাহির হয় না। ফলে এক অদ্ভুত পণ্যসম্পন্ন বিপন্ন জীবনের উপলব্ধি ঘটে মানুষের। তাহার থেকে পরিত্রাণের প্রত্যাশায় বর্ত্তমান যুগের কোন কোন ম্যানেজমেণ্ট আবার মদনকে না চিনেই ‘মদন’কে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করিতেছেন। এবং হয় ত সেইটাই হৈবে ভবিষ্যতের একমাত্র পথ।

অথচ এতদিন যে আমরা জানিতাম, নিষ্কাম প্রেম মানে রতি ব্যাপারটাই বাদ, তাহার অর্থ কী? তাহার অর্থ এই যে, স্ত্রী (কর্ম্মিজনগণ)-কে বোঝানো, যে সন্তানের (উৎপাদনের) প্রতি তাহার যেন কোন কামনা না থাকে, সন্তান (উৎপন্ন) কেবল স্বামীর (পরিচালকের)। কিন্তু এর ফলে স্ত্রীর (কর্ম্মিগণের) কামচর্চ্চার ইচ্ছা উবে যাবে, কেননা এই ত সরাসরি মদনভস্ম, প্রতারণা। ঠিক এই জন্যেই একদিন ভারতে (কর্ম্মী জনগণের) কামচর্চ্চা বিষয়ক গ্রন্থ লিখিতে হয়, মন্দির গাত্র ভরিয়ে ফেলিতে হয় সঙ্গমমুদ্রায়। ঠিক যেভাবে শিবকে মেরে শিবপূজা, নারায়ণকে মেরে নারায়ণ পূজা, গান্ধীকে মেরে গান্ধী পূজা ও তাঁহাদের মূর্ত্তি ও তৎসংক্রান্ত ডিসকোর্সে সমাজকে ভরিয়ে ফেলে পুরোহিততন্ত্র, সেইরকম। তবে ভারতবর্ষে ‘অনঙ্গরঙ্গ’, ‘কন্দর্পচূড়ামণি’, ‘রতিরহস্য’, ‘পঞ্চসায়ক’, ‘রতিরত্নপ্রদীপিকা’, ‘কামসূত্র’ ইত্যাদি নামে যত গ্রন্থ পাওয়া যায়, সেগুলির বিশেষত্ব এই যে, যে গ্রন্থ যত অর্ব্বাচীন তাহাতে তত বেশী মানবদেহ বিষয়ক কামচর্চ্চা প্রকটিত হয়েছে, অর্থাৎ, বহুরৈখিক পদ্ধতিতে লিখিত আদি কামশাস্ত্র ক্রমান্বয়ে একরৈখিক দিকে এগিয়েছে। সেইজন্যই প্রতীকী ভাষা পদ্ধতির এই যুগে ওইগুলোকে Sexology বিষয়ক গ্রন্থ বলে ভ্রম হয়। তা হোক, এক্ষণি সেই সব বিষয়ে আমরা যাব না। কারণ, এক্ষণো বিবাহকার্য্য সমাধা হৈতে বাকী।

বিবাহের আগে আপনাকে দেখে নিতে হৈবে কন্যা কামকলা কী কী জানে? দেখিতে হৈবে সে ৬৪ কলা পারদর্শী কিনা, তাহার মধ্যে ‘কর্ম্মাশ্রয় চতুর্ব্বিংশতিকলা’ ছাড়াও অন্তর্নিবিষ্ট ৫১৮ কলা জানার ব্যাপার আছে যাহার ভিতরে “কর্ম্মাশ্রয় ও দ্যূতাশ্রয় কলাগুলি প্রায়শৈ একটু ‘আগপাশ’ গিয়াছে” তাহার খবরো জানিতে হৈবে। উদাহরণস্বরূপ, যেমন কামশাস্ত্রমতে আপনাকে দেখিতে হৈবে কন্যা (= যে সকল কর্ম্মীকে নিয়ে আপনি কর্ম্মে রত হৈবেন, তাহারা) যন্ত্রমাতৃকা জানে কিনা, দেশভাষাবিজ্ঞান জানে কিনা, বৃক্ষায়ুর্ব্বেদযোগ জানে কিনা, ধাতুবাদ জানে কিনা, বাস্তুবিদ্যা-তক্ষকর্ম্ম-তক্ষণকর্ম্ম ইত্যাদি জানে কিনা। যন্ত্রমাতৃকা জানা মানে— রথ শকট ঘানিযন্ত্র আখপেষাই যন্ত্র রণতরী রক্ষিতরী ব্যোমযান পূষ্পকরথ আগ্নেয়রথ বানরধ্বজরথ গর্দ্দভযান পুষ্করযান বিধ্বংসিনী তরণী— ইত্যাদির নির্ম্মাণবিধি জানা (Mechanical); বৃক্ষায়ুর্ব্বেদযোগ জানা বলিতে, বৃক্ষের রোপণ-পুষ্টি এবং চিকিৎসা করিতে জানা (Agro Science)। আর ধাতুবাদ মানে ক্ষেত্রবাদ অর্থাৎ সেইটা মৃত্তিকা প্রস্তর রত্ন ও ধাতু প্রভৃতির পাতন ঢালাই শোধন মেলন ইত্যাদি (Metallurgy & Mining)। বাস্তুবিদ্যা হৈল গৃহনির্ম্মাণকার্য্য (Civil Engineering)। আর তক্ষকর্ম্ম হৈল বয়নকৌশল, কার্পাস থেকে সূতা কাটা ইত্যাদি এবং তক্ষণ হৈল কার্পেণ্টার বা ছুতোর মিস্ত্রীর কাজ। হ্যাঁ। শাস্ত্রানুসারে আপনাকে বিবাহের আগে দেখে নিতে হৈবে যে কন্যার সঙ্গে (যে সকল কর্ম্মীর সঙ্গে) বিবাহ (চুক্তি) হৈবে তারা ইত্যাকার ৬৪ কলা জানে কি না।

কী বিপজ্জনক! এই কামসূত্র অনুসারে সত্যিই যদি এ যুগের বিয়ের পাত্রী খুঁজিতে হয়, তাহা হৈলে ত পাত্রীই পাওয়া যাবে না। কেননা তাহা হৈলে ত ছুতোরের কাজ থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং পর্য্যন্ত সবি জানিতে হৈবে পাত্রীকে। তাহা কি কক্ষণো সম্ভব? এই যুগের যেই সকল পণ্ডিত ও সাহিত্যিকগণ বাৎস্যায়ণের কামশাস্ত্রকে কেবলমাত্র Sexology-র গ্রন্থ ভাবিতে অতি ব্যাকুল, তাঁহারা একবারো কেন যে এই প্রশ্ন তোলেন না, বোঝা মুশকিল। অথচ, প্রশ্নটী তুলিলেই তাঁহারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পারিতেন যে এই ‘কন্যা’ শব্দটী কর্ম্মী জনগণকে বোঝাচ্ছে এবং এই কামসূত্র মূলতঃ কাজকামের সূত্র।

ধরা যাক, ঐরকম ৬৪ কলা জানা কন্যা অর্থাৎ কর্ম্মী জনগণ পাওয়া গেল। এবার বিবাহ (=চুক্তি) সম্পাদন করিতে হৈবে। কিন্তু কোন মতে বিবাহ হৈবে? কৌটিল্যের যুগে এসে আট প্রকার বিবাহ বিধির কথা পাচ্ছে।

(১) ব্রাহ্মবিবাহ— ‘যেই বিবাহে কন্যাকে অলঙ্কৃত করিয়া বরের হস্তে প্রদান করা হয়’ অর্থাৎ কর্ম্মী জনগণের সমস্ত দায়িত্ব পরিচালকের, সমাজ বসে এইভাবে নির্দ্দেশ দিয়ে ভাগ করে এক-এক-জন পরিচালকের হাতে বাকী জনগণকে সম্প্রদান করে। এই প্রথা অতি প্রাচীন ও আদি। যৌথ সমাজের শেষ পাদে এইরূপ বিবাহের প্রচলন হয়। এতে উৎপাদন বণ্টনে বৈষম্য নেই।

(২) প্রাজাপত্য বিবাহ— ‘এই বিবাহে কন্যা ও বর একসঙ্গে মিলিত হৈয়া ধর্ম্মাচরণ করিবে বলিয়া প্রতিশ্রুত হৈয়া পরিণীত হয়’ অর্থাৎ কর্ম্মী জনগণ স্বেচ্ছায় এইরূপ চুক্তি করে। এইটীর সূত্রপাত দক্ষ প্রজাপতির প্রতিষ্ঠা লাভের কালে, যক্ষণ সতী শিবের বারণ সত্ত্বেও দক্ষযজ্ঞে সামিল হয়। সমাজ বিকাশের দ্বিতীয় পর্য্যায়ে এইরূপ সামাজিক চুক্তির প্রতিষ্ঠা।

(৩) আর্য্য বিবাহ— ‘যে বিবাহে বরের দিক হৈতে দুইটা গাভী গ্রহণ করিয়া কন্যা প্রদত্ত হয়’ অর্থাৎ সমাজ বিকাশের তৃতীয় পর্য্যায়ে এইরূপ সামাজিক চুক্তির প্রতিষ্ঠা যক্ষণ, কর্ম্মী জনগণ আর মুক্ত নয়, কাহারো না কাহারো এখতিয়ারভুক্ত। যাহার এখতিয়ারভুক্ত সেই পিতামাতা।

(৪) দৈব বিবাহ— ‘যে বিবাহে যজ্ঞবেদী মধ্যে স্থিত ঋত্বিকের নিকট কন্যা প্রদত্ত হয়’ অর্থাৎ যক্ষণ পরিচালক উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে তক্ষণ সেই অবস্থায় যে কর্ম্মী জনগণকে তাহার নিকুট সরবরাহ করা হয়, আধুনিক ভাষায় এইরূপ কন্যার পিতাকে ‘লেবার-সাপ্লায়ার’ বলে।

(৫) গান্ধর্ব্ব বিবাহ— ‘যে বিবাহে বর ও কন্যা স্বেচ্ছায়, পিতামাতার অভিমত না লইয়া, একে অন্যকে গ্রহণ করে’ অর্থাৎ এইরূপ সামাজিক চুক্তি সম্ভব হয় তক্ষণ, যক্ষণ ভূমিদাস পালায়, পালিয়ে হাজির হয় সহরে, কাহারো এখতিয়ার সে মানে না তক্ষণ। গান্ধর্ব্ববিবাহ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যাবস্থার ভিত্তি।

(৬) আসুর বিবাহ— ‘যে বিবাহে বর কন্যার পিতাকে বা কন্যাকে শুল্কধন দিয়া কন্যা গ্রহণ করে’ অর্থাৎ এইরূপ সামাজিক চুক্তিকেই দাসপ্রথা বলে।

(৭) রাক্ষস বিবাহ— ‘যে বিবাহে বলাৎকারে কন্যা গ্রহণ করা হয়’ অর্থাৎ আরেক প্রকারের কঠোর দাসপ্রথা।

(৮) পৈশাচ বিবাহ— ‘যে বিবাহে সুপ্ত কন্যাকে হরণ করিয়া বিবাহ করা হয়’— এ এমন এক দাসপ্রথা যা আফ্রিকার নিগ্রোদের সঙ্গে ইউরোপ বহুদিন করেছে।

এই আট প্রকার চুক্তির মধ্যে কোন এক প্রকার চুক্তি সেরে ফেলিতে হৈবে কর্ম্মীদের সঙ্গে। তাহারপর কর্ম্মে রত হোয়ার/হ্ওয়ার পালা, ফসল উৎপাদনের পালা, নিষ্কাম প্রেমচর্চ্চার পালা। — না না, নতুন কিছু আপনি করিতেছেন না; ভারত সরকার এক্ষণো আট রকম contract form-ই ব্যাবহার করে থাকে।

প্রকৃতবিচারে সামাজিক উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞের রীতি পদ্ধতিই সমাজের কাঠামো কেমন হৈবে তাহা নির্দ্ধারণ করে। সেই রীতি-পদ্ধতিতে নিষ্কাম প্রেমচর্চ্চাই ব্যাক্তিমালিকানা ভিত্তিক সমাজ সৃষ্টির মূলে। মদনভস্ম করে ফেলার পর যে কামহীন নিষ্কাম প্রেম, তাহার খপ্পরে পড়া অর্থাৎ রতিবিলাপের আবর্ত্তে পড়ে যাওয়া, যে কতখানি নির্ম্মম কঠোর একৈ কর্ম্মের পুনরাবৃত্তিমূলক ক্লান্তিকর মৌলবাদী যান্ত্রিক প্রক্রিয়া, তাহা কেবল মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করিতে পারেন কারখানা শ্রমিক, কিছু সরকারী কর্ম্মচারী, প্রেম খোয়ানো দম্পতি, বেশ্যা এবং আরো অনেকেই যারা একৈ কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির নিগড়ে এমনভাবে আবদ্ধ যে, সৃষ্টিশীল কোন কিছু করার সুযোগ বা অধিকার তাঁহাদের হাতে নেই। কারণ, এতে পরিচালক (স্বামী/পুরুষ) ও কর্ম্মী জনগণের (স্ত্রী’র) পরস্পরের প্রতি কোন রকম মানসিক আকর্ষণের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট থাকে না। বলিতে গেলে, এরূপ নিষ্কাম প্রেমচর্চ্চার আদর্শ স্থান বেশ্যালয় ও সমস্ত সরকারী সংস্থা। বলিতে গেলে, অবিরাম রতিবিলাপ-ই সরকারী সংস্থাগুলির লোকসানের মুখ্য কারণ। সেই জন্যই কোন কোন দেশের ম্যানেজমেণ্ট এক্ষণ ‘Hire and fire’ নীতি অনুসরণ করে থাকে। খ্রীষ্টিয় ভাবনার দিক থেকে ভাবিলেও নিষ্কাম প্রেমের চেয়ে অশ্লীল শব্দ আর কিছু হৈতে পারে না। তথাপি সত্য এই যে, ভারতবর্ষকে একদিন নিষ্কাম প্রেমের চর্চ্চা করিতে হয়েছিল। অন্যথায় কর্ম্মী জনগণ (স্ত্রী) পরিচালকদের (পুরুষের) সঙ্গে প্রাজাপত্য বিবাহের দ্বারা মিলিত হয়ে যেই উৎপাদন যজ্ঞ করিত, সেই যজ্ঞ ফলের প্রতি তাহার অধিকার তাহারা ছেড়ে দিত না, জ্ঞান ও জ্ঞানীর, বেদ ও বেদীর (পুরুষের) মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠিত হৈত না, পণ্য সৃষ্টি হৈত না, ব্যক্তিমালিকানা ভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি হৈত না, তথাকথিত ‘বর্ব্বর’ যুগ অতিক্রম করে সমাজ ‘সভ্য’যুগে পাড়ি জমাতে পারত না। আজো ভারতীয় আইনে সন্তান কেন পিতার, মাতার নয়, সে রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু এখানেই। শুধু তাই নয়, নিম্নাধিকারীর হাতে শাস্ত্রানুশাষন চলে যাওয়ায়, পরিচালক ও কর্ম্মীগণের সম্পর্কের সমস্ত উত্তর-দায়িত্ব এক্ষণ বহন করে মরছে প্রায় প্রতিটী ভারতীয় দম্পতি। কাহার পাপ, কে তাহার বোঝা বইছে! যেই আচার সমুদয় পালন করার কথা ছিল পরিচালক ও কর্ম্মিগণের, সে আচার পালন করে চলেছে স্বামী-স্ত্রী।[12]

তিন


Productivity Council, Export Promotion Council ইত্যাদি নামে ভারত সরকারের কয়েকটী সংস্থা আছে। সংস্থাগুলি উৎপাদন-বৃদ্ধি, ও রপ্তানী-বৃদ্ধির কাজ করে থাকে। কেবলমাত্র ভোগের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধি করিলেই চলে না। তাছাড়া সেরূপ উৎপাদন পণ্য পদবাচ্য নয়। রপ্তানী বৃদ্ধির জন্য ‘যে যায়’ (‘গো’/বঙ্গীয় শব্দকোষ দ্রষ্টব্য) উৎপাদকের ভোগের নিমিত্ত পড়ে থাকে না, তেমন পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিই প্রয়োজন, অর্থাৎ কিনা ‘গো’-বর্দ্ধন প্রয়োজন। আর ঐরূপ গোবর্দ্ধনের জন্য গোপ গোপী গোপালদের শ্রীবৃদ্ধি হ্ওয়া জরুরী, অন্যথায় গোবৎস্য উপাদন বাড়িবে কী করে! তবে হ্যাঁ! স্বয়ং নগদ-নারায়ণ যদি Black Money (শ্রীকৃষ্ণ) রূপে গোবর্দ্ধনধারী হয়ে যান, তাহা হৈলে প্রজাদের কেবল হর্ষবর্দ্ধন হয় না, তাহাদের রাজ্যশ্রীও ফিরে আসে। ভারতবর্ষে একদিন সেইরূপ যথার্থ গোবর্দ্ধন (Industrial Revolution) থেকে রাজ্যবর্দ্ধন (Imperialism), হর্ষবর্দ্ধন ও রাজ্যশ্রীর জন্ম হয়েছিল। সেই বৌদ্ধযুগে গোবৎস বৃদ্ধির যেই বিদ্যা, তাহার চর্চ্চা করার জন্য যে Productivity Council ছিল, তাহারি নাম বাৎস্যায়ণ। বর্ত্তমান Productivity Council-এর যেমন গ্রন্থপত্র বিধান নিদান রয়েছে, বাৎস্যায়ণেরো ছিল। তবে এই council-এর আধুনিক চেহারায় নয়, ক্রমান্বয়ে পেছন পানে হেঁটে হেঁটে ঐরূপ সংস্থার আদিরূপ পৌঁছে তবেই বাৎস্যায়ণকে জানিতে বুঝতে হৈবে। আদি রূপ পৌঁছে যাহাদের সাক্ষাৎ মেলে, তাহাদের অন্তত একজনকে হাজির করা যাক।

West Bengal State Electricity Board বা WBSEB-কে সবাই চেনেন। এর একেবারে নীচে খালাসী, তাহার পরের স্তরে ওয়্যারম্যান ইলেক্ট্রিসিয়ান, তাহার ওপরের স্তরে সুপারভাইজার, ক্লার্ক অব ওয়ার্ক্স, তাহার ওপরের স্তরে অ্যাসিষ্ট্যাণ্ট ইঞ্জিনীয়ার এবং সবশেষে চীফ্ ইঞ্জিনীয়ার। কর্ম্মী সংখ্যা নীচের দিকে যত বেশী, ওপরের দিকে তত কম এবং শিখরে একজন মাত্র। সংস্থা বা সঙ্গঠন মাত্রেরই এই চেহারা– বড় স্তরের পর ছোট আকারের স্তর, তাহার ওপর আরো ছোট স্তর। স্তরে স্তরে বা পর্ব্বে পর্ব্বে এইরূপে বিন্যস্ত বলে প্রাচীন ভারতে সংস্থা মাত্রকেই ‘পর্ব্বত’ বলা হৈত। WBSEB সেই হিসাবে একটা পর্ব্বত মাত্র। কিন্তু যেহেতু সে বিহার ওড়িশা ডিভিসি থেকে বিদ্যুৎ কেনে এবং আমাদেরকে বিক্রী করে থাকে, তাই তাহার দুইটা পক্ষ আছে— বিদ্যুৎ বিক্রেতা পক্ষ, যাহাদের কাছ থেকে সে কেনে; এবং বিদ্যুৎ ক্রেতা পক্ষ, যাহাদেরকে সে বিদ্যুৎ বিক্রয় করে। প্রাচীন ভারতেও পর্ব্বতদের একসময় দুইটা করে পক্ষ বা ডানা গজায়। আদিম সাম্যবাদ থেকে আদিম সমাজতন্ত্রে অধঃপতিত হৈবার পর ঐ ‘পর্ব্বত’গুলির সৃষ্টি হয়। কিন্তু কিছুকাল পরে যক্ষণ ব্যক্তিমালিকানার বিকাশ ঘটে, ব্যবসায়ীরা ঐ ‘পক্ষ’গুলির কাছে সরাসরি কেনাবেচা শুরু করে। তাই কাহিনী এইরূপ যে ইন্দ্রস্ত্রী (Industry)-পতি ইন্দ্র ঐসকল পর্ব্বতের ডানা কেটে দেন। বাৎস্যায়ণের মত সংস্থার আবির্ভাব সেইরূপ পর্ব্বতেরই উত্তরাধিকার।

বৎস্যবৃদ্ধির চিন্তাই যেহেতু বাৎস্যায়ণের অস্তিত্বের ভিত্তি, তাহার কামসূত্র গ্রন্থটিতে উৎপাদনশীল কাজকর্ম্মে লিপ্ত হৈবার সূত্রগুলি একে একে পাওয়া যায়। বিশেষ বিশেষ ধরনের উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞে পরিচালক (পুরুষ) ও কর্ম্মিগণ (স্ত্রী) কীভাবে কর্ম্মরত হৈবে, সে সকল বিষয়ে নির্দ্দেশ উপদেশগুলি জানিতে পারা যায়। চুক্তির আগে পরিচালক ও কর্ম্মিগণের করণীয়, চুক্তি করার পদ্ধতি, চুক্তি রূপায়ণ, ইত্যাদি ম্যানেজমেণ্ট ও লেবার-ল’ সংক্রান্ত বহু তথ্যই তাহাতে আলোচনা করা হয়েছে । তবে যেহেতু বাৎস্যায়ণের কাল বৈদিক যুগের সূত্রপাত থেকে অনেক পরে, এতে আত্মাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী কিঞ্চিৎ ক্ষীণকায় হয়ে এসেছে এবং দেহভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী সবে তাহার শৈশবে পা রেখেছে। বস্তুত বাৎস্যায়ণের যুগ হৈল ‘অবস্থান্তর প্রাপ্তির যুগ’। তাই তাহার কামসূত্রে সমাজদেহের কামচর্চ্চা ও মানবদেহের কামচর্চ্চা একৈ বর্ণনায় না সেরে কোথাও কোথাও পৃথক বর্ণনায় সারা হয়েছে । মোট কথা, এই গ্রন্থে বহুরৈখিক বর্ণনা একরৈখিক বর্ণনায় পর্য্যবসিত হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে। কারণ, বাৎস্যায়ণের নিকট থেকে ঐ কামসূত্র বা কামকাজের নিয়মাবলী যক্ষণ আমরা পাচ্ছি, ততদিনে ভারতসমাজের বিস্তর বদল ও বিবর্ত্তন ঘটে যায়। সেই বিবর্ত্তন কতখানি তাহার বর্ণনা বাৎস্যায়ণের নিকট থেকেই শোনা যাক।

“যে সকল আচার্য্য ধর্ম্মাদির আচার নিজে করিয়াছেন, পরকে ব্যাবহার করাইয়াছেন এবং তাহার সঞ্চয় করিয়া গ্রন্থাকারে আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন, সেই সকল আচার্য্যকে নমস্কার। সেইজন্য এই শাস্ত্রে তাঁহাদিগের সম্বন্ধ আছে। আগম প্রসিদ্ধি এইরূপ যে, প্রজাপতি আদিকবি ব্রহ্মা প্রজাসকল সৃষ্টি করিয়া তাহাদিগের স্থিতিনিবন্ধনের জন্য প্রথমে একলক্ষ অধ্যায়াত্মক ত্রিবর্গসাধন (ধর্ম্ম-অর্থ-কাম সাধন) বিশদভাবে বলিয়াছিলেন। তন্মধ্যে— কামশাস্ত্রকে পৃথক করিয়া এক সহস্র অধ্যায়ে বিশদভাবে বলিয়াছিলেন মহাদেবের অনুচর নন্দী। ঔদ্দালকি শ্বেতকেতু তাহাই পাঁচশত অধ্যায় দ্বারা সংক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিলেন। তাহাই আবার পাঞ্চাল দেশীয় বভ্রুপুত্র বাভ্রব্য একশত পঞ্চাশ অধ্যায়ে কন্যাসম্প্রযুক্তক, ভার্য্যাধিকারিক, বৈশিক, পারদারিক, সাম্প্রয়োগিক ও ঔপনিষদিক— এই সাত অধিকরণে বিভাগপূর্ব্বক সংক্ষেপে একখানি সংগ্রহগ্রন্থ প্রণয়ণ করিয়াছিলেন। তাহার ঐ বৈশিক অধিকরণকে— করিয়াছিলেন। এইরূপভাবে বহু আচার্য্য সেই বাভ্রব্য সংগৃহীত শাস্ত্রের এক এক ভাগ অবলম্বন করিয়া খণ্ড খণ্ড আকারে প্রণয়ন করিতে থাকিলে, বাভ্রব্যোক্ত শাস্ত্রের কিছু কিছু করিয়া অল্পে অল্পে ধীরে ধীরে প্রায় উৎসন্ন হৈয়াছিল। তাহার মধ্যে দত্তকাদি প্রণীত গ্রন্থ সেই শাস্ত্রের এক একটা অবয়ব বলিয়া একদেশ বিধায় এবং বাভ্রবীয় শাস্ত্র অতীব বিশাল আয়তন বলিয়া অধ্যয়নের দুঃখকরত্ব বিধায়, সংক্ষেপে সমস্ত বিষয় অল্পগ্রন্থ দ্বারা কামসূত্র আমি প্রণয়ন করিয়াছি”। — বাৎস্যায়ণ।

কামসূত্র গ্রন্থটীর উত্তরাধিকার সম্পর্কে এই হৈল বাৎস্যায়ণের বিবরণ। অর্থাৎ, আদিম সাম্যবাদী সমাজের শেষপাদে জ্ঞানজীবীদের যে আদি সঙ্গঠন (ব্রহ্মা) গড়ে ওঠেছিল, তাহার থেকে শুরু করে, বৌদ্ধযুগের মধ্যাহ্নকাল পর্য্যন্ত যত জ্ঞানী গুণী মনীষীরা এই বিষয়ে চর্চ্চা করেছেন, তাঁহাদের সকলের কথার কিছু না কিছু এই গ্রন্থে পাচ্ছি। এরপর আবার এই বাৎসায়নের কামসূত্র গ্রন্থটী কী কী উপায়ে আজ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ শ্রীযুক্ত মহেশ্চন্দ্র পাল মহাশয়ের সম্পাদনায় গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগরের বঙ্গানুবাদের বর্ত্তমান সংস্করণটীতেই পাওয়া যায়।

কামসূত্রের এই সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক যাত্রাপথের আদি থেকে অন্তিমে পৌঁছে আমরা দেখিতে পাচ্ছি যে বহু অর্থবাচক কামসূত্র অর্থকরী দিক থেকে হাল্কা হৈতে হৈতে ক্রমে শেষ পর্য্যন্ত একার্থবাচক হয়ে গেছে। বলিতে গেলে আদিতে যা ছিল জ্ঞানী-কর্ম্মীর মধ্যেকার সম্পর্কের সূত্রাবলী, অন্তিমে তাই মানব-মানবীর মধ্যেকার সম্পর্কসূত্রে পর্য্যবসিত হয়েছে। তবে বাৎস্যায়ণের কালখণ্ডটী যেহেতু ‘অবস্থান্তর প্রাপ্তির যুগ’, তাঁহার রচিত কামসূত্রের ভিতর অতীতের ধ্যান-ধারণার বেশ কিছু অংশকে আমরা সজীব পেয়ে যাই। তবে বহুরৈখিকতার থেকে ভারতীয় ভাষা দৃষ্টিভঙ্গীর যে ক্রমাগ্রগতি (বা ক্রমাধঃপতন), যাহা কিনা সনাতন যুগ থেকে বৈদিক-বৌদ্ধ-হিন্দু-মোগল যুগ পেরিয়ে ব্রিটিশের ভারত অধিকারের পর সম্পূর্ণ হয়েছে, সেই ক্রমাগ্রগতি কার্য্যত কামসূত্রের সমাজদেহ বিষয়ক ভাবনাকে শেষ পর্য্যন্ত কোথাও কোথাও মানবদেহ বিষয়ক ভাবনায় অধঃপতিত করে ছেড়েছে। এইকথা প্রায় সকল প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রের ক্ষেত্রে কমবেশী প্রযোজ্য। এই সেই কারণ, যেজন্য ভারতীয় কামশাস্ত্রকে কেবলমাত্র Sexology-র গ্রন্থ বলে ভ্রম হয়। সন্তান উৎপাদন ও পণ্য উৎপাদন, সব উৎপাদন ও উৎপাদন সম্পর্ককে একৈ তত্ত্বের মধ্যে বেঁধে বর্ণনা করাই ছিল প্রাচীন ভারতীয় রীতি।

কিন্তু আত্মাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী ও বহুরৈখিক ক্রিয়াভিত্তিক ভাষাবোধ খুইয়ে আমরা তাহাকে কেবল সন্তান উৎপাদনের তত্ত্ব বলে বুঝেছি এতকাল। মাঝ থেকে, পণ্য উৎপাদন সংক্রান্ত বিধি (করণীয়) নিষেধ(অকরণীয়)গুলিকে সন্তান উৎপাদন সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ বলে ভারতীয়রা মান্য করে চলেছে। এই দেশে দাম্পত্যজীবনের বহু বিড়ম্বনার উৎস এখানেই।

তবে বাৎস্যায়ণের কামসূত্র পাঠের আগে যেই সকল শব্দ ব্যাবহার করে গ্রন্থটা লিখিত হয়েছে, সেগুলির অন্তত দুই-একটাকে একটু নাড়াচাড়া করে শব্দগুলির স্বভাব চরিত্র কীরূপ এবং সেগুলিতে আমাদের কীরূপ অধিকার তাহা জানিলে বা বুঝলে, আমরা ঐ বিড়ম্বনার ভাষাতাত্ত্বিক উৎসটিকে চিনিতে পারব।

পতিব্রতা = পতির (মালিকের) ব্রতৈ (Planning & Programming) যাহার ব্রত। মালিক বা পরিচালক যা চায়, যে ঠিক সেই রকমটাই করে, তেমন কর্ম্মীই পতিব্রতা। কামিনী = কামিন্, মজুর। মেয়ে দিনমজুরদের মেদিনীপুরের গ্রামাঞ্চলে ‘কামিন্’ বলা হয়।

পরিণয় = < পরিণমন > পরিণাম = ‘প্রস্তুত প্রয়োজনের সাধনরূপে প্রসিদ্ধ বস্তু আরোপ বিষয়ের সহিত অভেদ ভাবে পরিণত হৈয়া প্রকৃত বিষয়ের উপযোগী হৈলে পরিণাম হয়’। পরিণামদর্শী = ‘কর্ম্মের ফল যিনি দেখিতে পান’। ত্রিকালদর্শী = বস্তু আগে কেমন ছিল, এক্ষণ কীরূপে আছে, ভবিষ্যতে কীরূপ বস্তুতে পরিণত হৈবে– বস্তুর এই তিনকাল যিনি দেখিতে পান। ‘প্রস্তুত (প্রস্তাবিত) প্রয়োজনের সাধনরূপে প্রসিদ্ধ বস্তু’ = কাঁচামাল। ‘আরোপ বিষয়ের সহিত অভেদভাবে পরিণত হৈয়া’ = ‘Know how’-যুক্ত শ্রম নিষিক্ত হৈয়া। ‘প্রকৃত বিষয়ের উপযোগী হৈলে পরিণাম হয়’ = product হয়।

এই তালিকা দীর্ঘ করার উপায় নেই, একটা আন্দাজ দেওয়া গেল মাত্র, এক্ষণ বাৎস্যায়ণের কামসূত্র থেকে কয়েকটি বাক্য পেশ করা যাক, যেগুলি আমাদেরকে ম্যানেজমেণ্ট ও লেবার-ল’ সংক্রান্ত কিছু প্রাচীন তথ্য সরবরাহ করে।

১. ‘‘স্পর্শ বিশেষকে লক্ষ্য করিয়া আভিমানিক সুখে অনুবিদ্ধ ফলবান বিষয়বোধৈ প্রধান কাম’ ১২/২৮ [স্পর্শ < স্পৃশ্ = আমর্শন = পরামর্শ, মন্ত্রণা] স্মর্তব্য যে আদিতে ‘স্পর্শ হৈতে সন্তান উৎপাদন হৈত’, বিবাহের প্রয়োজন ছিল না।

২. ‘কামসূত্রের অধ্যয়ণ বা নাগরিকজনের সমবায় হৈতে সেই কাজের বিষয় জানিয়া লইবে’। ১৩/২৯

৩. ‘আচার্য্যগণ বলিয়া থাকেন— তির্য্যগ যোনিতেও [‘যাহাদের আহার সঞ্চার তির্য্যগ’ অর্থাৎ বাঁকা। অর্থাৎ কিনা প্রচলিত সমাজনীতি অনুসারে জীবিকা নির্ব্বাহ না করে যারা বাঁকা পথ ধরে’। নিম্ন-অধিকারিগণ এই শব্দের অর্থ করে ‘পশুপাখী’। ফল যতখানি হাস্যকর হ্ওয়া সম্ভব তাই হয়]। কাম স্বয়ংই প্রবৃত্ত হয় এবং উহা আত্মার একটা নিত্য ধর্ম্ম; সুতরাং কামাববোধার্থ শাস্ত্রের কোন প্রয়োজন নাই’। ১৭/৩১

৪. ‘পুরুষ [executive] ধর্ম্মবিদ্যা অর্থবিদ্যা ও অঙ্গবিদ্যার কাল অনুরোধ না করিয়া কামসূত্র ও তাহার অঙ্গবিদ্যার অধ্যয়ন করিবে’। ১/৫২

৫. ‘অভ্যাস ও প্রয়োগের যোগ্য চাতুঃষষ্টিক যোগ [যাহার মধ্যে Engineering, mining, metallurgy] সবই পড়ে] কন্যা নির্জন প্রদেশে একাকিনী বসিয়া নিজে নিজেই অভ্যাস করিবে’। ১২/৫৬

৬. কর্ম্মীসংগ্রহ বিষয়ে মতামত— ‘চতুঃষষ্টি কলায় বিচক্ষণ ব্যক্তি কন্যাগণ কর্ত্তৃক অনুরাগত বীক্ষমান হৈলেও সমাগম ব্যতীত সম্প্রয়োগ হয় না; এই জন্য তাহার সমাগমোপায়— আবার বলা যাইতেছে। যেই উপায় অবলম্বন করিলে স্ত্রী সমাগম লাভ করা যায় তাহাকে আবাপ বীজবিকিরণ বলে। তাহার মধ্যে উদ্বাপ [সমাগমলাভের শ্রুয়মান বৈধ ও অবৈধ উপায়] আটটা বিবাহ …’। এই বক্তব্য বাৎস্যায়ণের কামসূত্রের টীকাকারের।

৭. বাৎস্যায়ণ বলেন— ‘অর্থলাভ, অনর্থপ্রতিঘাত এবং প্রীতিই অভিগমনের কারণ। প্রীতিদ্বারা অর্থের বাধ হৈতে পারে না; কারণ অর্থেরই প্রাধান্য’। ৯/১৯৪

৮. অন্যের কর্ম্মীবাহিনীকে দিয়ে নিজের কার্য্যোদ্ধার করার উপায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘পরদারে গমন করিতে হৈলে প্রথমএইগুলির পরীক্ষা করিবে— সাধনের যোগ্য কি না, নিরাপৎ কিনা, সেইটী আয়তিকর [গৌরবজনক] কিনা এবং তদ্বারা বৃত্তিলাভ সম্ভবপর কিনা’। ২/২৫০

৯. কর্ম্মীদের ওপর কীভাবে administration চালানো হৈবে, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে,— ‘শব্দাদি(?) বিষয় অবলম্বন করিয়া কর্ম্মের বারংবার অনুষ্ঠানবশত যে প্রীতি বহির্ম্মুখী হয়, তাহাকে আভ্যাসিকী প্রীতি কহে। যেমন মৃগয়াদি কর্ম্মের বারংবার অনুষ্ঠানে সুখলাভ হৈয়া থাকে’। ৩৭/৩২৯

১০. ‘শাস্ত্র নির্দ্দিষ্ট এইসকল প্রীতিকে শাস্ত্রানুসারে বিবেচনা করিয়া, তাহাকে সেইভাবেই প্রবর্ত্তিত করিবে’। ৪১/৩৩০

১১. ‘পূর্ব্বাচার্য্যগণ সম্প্রয়োগের অঙ্গ চতুঃষষ্টি (৬৪) প্রকার বলিয়া থাকেন; কারণ সম্প্রয়োগৈ চতুঃষষ্টি (৬৪) প্রকারময়। … দশমণ্ডলাত্মক ঋকে দশাবয়ব সম্প্রয়োগ যে চতুঃষষ্টি, ইহা নাম করিয়া বলা হৈয়াছে’।

যাই হোক, কামসূত্রের যে সারকথা, মানব-মানবী রাজা-প্রজা পুরুষ-প্রকৃতি জ্ঞানী-কর্ম্মী পরিচালক-পরিচালিত সকলের কাম চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে যে কথাটী প্রযোজ্য, এক্ষণ সে কথাটী উল্লেখ করা যাক— ‘যেইখানে পরস্পর পরস্পরের সুখের অনুভব করিয়া আনন্দক্রীড়ায় নিমগ্ন হয়, পরস্পর পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যাবহার করিয়া থাকে, সেখানে সেই সম্বন্ধই প্রশস্ত’। ২০/১২৬। আধুনিক ম্যানেজমেণ্ট তত্ত্ববিশারদগণ, যাঁহারা পুনরায় কর্ম্মিজনগণের মধ্যে কর্ম্মোন্মাদনা জোগানোর চেষ্টা করিতেছেন অর্থাৎ মদনকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করিতেছেন work-culture ইত্যাদি নামে, তাঁহারা কামসূত্রের এই বাক্যটীতে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করিলে বহু সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবেন, আশা করা যায়। তাহা হৈলেই তাঁহারা মদন বাঁচিয়ে তোলার পথ পেতে পারেন। আর মদনকে না বাঁচিয়ে আধুনিক বিশ্বের পরিত্রাণ নেই।

শেষ কথা এই যে, বলা হয়েছে — জগতের যা কিছু অহিত তাহার কারণ হৈল পুরুষপ্রকৃতির মধ্যে ‘ভোগ্যা-ভোক্তৃ’ সম্পর্ক সৃষ্টি। রাজা-প্রজা, জ্ঞানী-কর্ম্মী, পরিচালক-পরিচালিত, জীব-জড়, এই যে পুরুষ-প্রকৃতির নানা রূপ, এদের মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়ে ‘ভোগ্যা-ভোক্তৃ’ সম্পর্ক হয়ে গেছে। পুরুষ ভোগ করিতেছে, প্রকৃতি ভুক্ত হচ্ছে। বলা হয়েছে — এমনটা হ্ওয়া সভব হয়েছে ‘অবিদ্যা’ বা ‘অবিবেকের’ জন্য। তবে কপিলের সাংখ্যে নিদান দেওয়া হয়েছে যে, যে কারণেই ঐরূপ ‘ভোগ্যা-ভোক্তৃ’ সম্পর্ক সৃষ্টি হোক না কেন, তাহার উচ্ছেদই পুরুষার্থ।
‘… তদুচ্ছিত্তিঃ পুরুষার্থস্তদুচ্ছিত্তিঃ পুরুষার্থ’।

উপসংহার


কেবল বাৎস্যায়ণের কামসূত্রৈ নয়, আমাদের সমগ্র প্রাগাধুনিক ডিসকোর্সৈ যেইখানে ছিল সেখানেই পড়ে থেকে গেছে। সেইখান থেকে আমাদের আধুনিক ডিসকোর্স গড়ে উঠবার সুযোগ-ই পেল না। তাহার আগেই, আমাদের ঐ প্রাগাধুনিক ডিসকোসের দেহে ইউরোপের আধুনিক ডিসকোর্সের আত্মা ঢুকে পড়ে জন্ম দিয়েছে এক ঔপনিবেশিক দোআঁশলা ডিসকোর্সের। এক্ষণ আমরা তাহাতেই অভ্যস্ত আছি। এখান থেকে আমাদের বেরুতে হৈবে, তবে পেছন দিকে হেঁটে নয়; সামনে এগিয়ে। অতীতের অর্জ্জনগুলিকে রহস্যমুক্ত করে সংগ্রহ করে নিয়ে, বর্ত্তমান প্রাপ্তিগুলিকে তাহার সঙ্গে মিলিয়ে যথাযথভাবে বিন্যস্ত করে গুছিয়ে নিয়ে, আমাদেরকে সামনে পা ফেলে হেঁটে যেতে হৈবে।

[1] ‘শূদ্রধর্ম’, কালান্তর : রবীন্দ্রনাথ।
[2] ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ : হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
[3] ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’ : জগদীশ্চন্দ্র ঘোষ।
[4] মাও সে তুঙের রচনা থেকে।
[5] ‘জজ পণ্ডিতের কথা’ : পূর্ণেন্দুনাথ নাথ [ ‘দেশ’ – ১৯.০৯.১৯৯২ ]
[6] ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের সাহায্যে জানা গেছে হনুমান, দেবতা, নাগ, সর্প প্রভৃতি যথাক্রমে Monkey, God, Serpent, Snake নয়, আদৌ নয়।
[7] দ্রষ্টব্য ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ : মার্ক্স; ও ‘সভ্যতার সঙ্কট’ : রবীন্দ্রনাথ।
[8] মীর মোশাররফ হোসেনের ‘আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই মন্তব্য করেন।
[9] দ্রষ্টব্য : ‘হরিবংশ পুরাণ’।
[10] ‘নববর্ষ’ : রবীন্দ্রনাথ।
[11] Marx : ‘Capital’ – Vol.1 : Page- 49
[12] এই বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে লেখকের ‘দিশা থেকে বিদিশায় – নতুন শতাব্দীর প্রবেশ বার্ত্তা’ গ্রন্থের অন্তর্গত “লক্ষ্মীর পাঁচালী : ওয়েলফেয়ার ইকনমির ভূত ভবিষ্যৎ” শীর্ষক নিবন্ধে।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত পুনঃপঠন, ভাষায় ঔপনিবেশিকতা : প্রাচীন ভারতে ম্যানেজমেণ্ট ও বাৎস্যায়ণের কামসূত্র — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *