পুনঃপঠন মৌলবাদ : তত্ত্ব

[মূল প্রবন্ধটির নাম ‘মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে’ যা চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত – প্রথম অধ্যায়ের নাম (১) “মৌলাব্দঃ তত্ত্ব” এবং যা আলোচ্য নিবন্ধের বিষয়বস্তু। বাকী তিনটি অধ্যায়ের নাম যথাক্রমে – (২) মৌলবাদঃ তথ্য, (৩) মৌলবাদঃ প্রেক্ষাপট, এবং (৪) উপসংহার। প্রথম অধ্যায় অর্থাৎ “মৌলবাদঃ তত্ত্ব” ছয়ভাগে বিভক্ত যথা – (ক) অর্থোৎপত্তি, (খ) উৎপত্তি, (গ) প্রতিপত্তি, (ঘ) সম্পত্তি, (ঙ) বিপত্তি ও (চ) নিষ্পত্তি]

“…এখানে ছাড়তে হবে সকল অবিশ্বাস; / এখানে ধ্বংস হবে সমস্ত ভীরু ভাবনার” – দান্তে / ডিভাইন কমেডি। (বিজ্ঞানের প্রবেশদ্বারে দান্তের এই কথা কয়টি লিখে রাখবার দাবী তুলেছিলেন মার্ক্‌স।)

(ক) অর্থোৎপত্তি

মৌলবাদ একটি বিকৃত মানবিক জীবননীতি। আগে যেভাবে সফল হওয়া গিয়েছিল, পরে ঠিক তেমনটি করবার যে নীতি তাকে মৌলবাদ বলে। এ হল, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘একই কর্ম্মের পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি’র নীতি। একে ‘পুরাতনের পুনরাবৃত্তি’, ‘আচারের পুনরাবৃত্তি’, ‘একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তি’ ইত্যাদিও বলা হয়ে থাকে। মূলের অনুগামী বলে, অর্থাৎ মূলানুগ বলেই এর নাম মৌলবাদ।

মৌলবাদ পূর্ব্ববিধানের সদাচারে বিশ্বাসী, আর সদাচার সর্ব্বদা সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে। যা ইতোপূর্ব্বে ঘটেনি তা সত্য নয়, যা ঘটে গেছে তাই সত্য। সত্য অতীত বলেই সে ‘পূর্ব্ববিধান’-এ পরিণত হবার যোগ্যতা ধরে। পূর্ব্বের ন্যায় করবার যে বিধান, তাই পূর্ব্ববিধান। সেইহেতু পূর্ব্ববিধান সব সময় ‘ন্যায়-সম্মত’। আর, মৌলবাদ পূর্ব্ববিধানের সদাচারে বিশ্বাসী বলে সেও ‘ন্যায়’-সঙ্গত বা ‘ন্যায়’শাস্ত্র-সম্মত। তাই মৌলবাদ আইনসঙ্গতও বটে।

ন্যায় ও সত্যের জোর থাকে অতীত ঘটনায়। তাই আইন অতীত দ্বারা শাসিত বা ভূতশাসিত। যা আগে ঘটেনি, তা কোনও কিছুর ‘ন্যায়’ নয় বলেই অ-ন্যায়। আর, আবিষ্কার নতুন বলেই কোনও কিছুর ‘ন্যায়’ নয়। তাই আবিষ্কার মাত্রেই অ-ন্যায়। মৌলবাদ অন্যায়কে মেনে নিতে পারে না। নতুনকে মেনে নিতে তার আপত্তি, কেননা নতুন ‘ন্যায়’-সঙ্গত নয়। কোনওরকম ঝুঁকি নিতে মৌলবাদ রাজি নয়। পূর্ব্ববিধানকে হুবহু মেনে চলাই তার নীতি। তাকে আংশিক বা সম্পূর্ণ অমান্য করবার স্বধীনতা সে কাউকে দিতে পারে না। যে খেলা ‘অব-লীলায়’ খেলা যাবে, সেই নিশ্চিত খেলাটাই মৌলবাদ খেলতে চায়। লীলাতে তার বড় ভয়।

‘পুরাতনের পুনরাবৃত্তি’র এই নীতি জীবনকে এক নিশ্চিত প্রবাহে প্রবাহিত করে, তা গড্ডলিকা প্রবাহ হলেও। জীবন প্রবাহকে কোনওভাবে বাধাগ্রস্ত হতে দিতে মৌলবাদ রাজি নয়। প্রবহমানতা বজায় রাখার ব্যাপারে কোনওরকম ঝুঁকি নিতে তার ঘোরতর আপত্তি। তাই সে একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির নীতিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। এই কট্টরতায় তার জিত, এতেই তার হার। জিত এইজন্য যে, প্রবাহকে অজানা ভবিষ্যতের কোনও মরুবালুরাশির ভিতর হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে সে বাঁচায়। হার এইজন্য যে, কালের প্রকোপে ও জগতের পরিবর্ত্তনশীলতার কারণে পরিবর্ত্তনহীন প্রবাহ একদিন ক্রমে গড্ডলিকা প্রবাহে পরিণত হয়ে নিজেই শুকোতে থাকে। থাকে না তাতে প্রাণের জোয়ার। নিষ্প্রাণ ভাটার টানে উবে যাওয়া তার ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়।

আগের কোনও কিছুই মানব না, এই গোঁয়ার্তুমিও একপ্রকার কট্টরতা এবং আর এক প্রকারের বিকৃত মানবিক জীবননীতি। এই নীতি কেবল জীবন বিরোধীই নয়, অবাস্তবও বটে। স্মৃতিবাহক জীব বলেই মানুষ অতীতকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে পারে না। এই নীতি মানলে প্রত্যেক মানুষকে পুনরায় সেই আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করতে হয়। তাই এ নীতি অবাস্তব। অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপ দেবার বাধাবন্ধহীন এই অসীম স্বাধীনতাকে নৈরাজ্যবাদ বলে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘একেবারে বুঁদ হয়ে যাবে, ভোঁ হয়ে যাবে, তারপর না হয়ে যাবে’।

অনন্ত অসীম স্বাধীনতা মানুষের দেহকেও অস্বীকার করে। কিন্তু মানুষ মাত্রেই তো দেহী। দেহহীন মানুষের অস্তিত্ব নেই। দেহী বলেই তাকে প্রকৃতিসিদ্ধ হতে হয়। নিয়ম ভাঙতে গেলেও তাকে নিয়মেরই সাহায্য নিতে হয়। নিয়মহীনতায় তার জীবনে ছেদ পড়ে, প্রবাহ নিশ্চিতরূপে ব্যাহত হয়। এইরূপ ছেদ, বিপরীতে গড্ডলিকা প্রবাহকে সমর্থন জোগায়। এ হল ‘নিন্দার ছলে কৃষ্ণভজনা’। তাই, মৌলবাদের নিন্দার ছলে মৌলবাদকে সমর্থন করার কৃতিত্ব শেষমেষ নৈরাজ্যবাদের কপালে জুটে যায়। বিশৃঙ্খলা যেমন শৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলে পরিণত করবার প্ররোচনা দেয়, নৈরাজ্যবাদও তদ্রূপ মৌলবাদকে আরও কঠোর এবং প্রতিশোধাত্মক হবার যুক্তি সরবরাহ করে থাকে। জীবনপ্রবাহে ছেদ পড়বার ভয়, প্রায়শই একই চালে চলবার গড্ডলিকা প্রবাহকে আদ্যোপান্ত গ্রহণ করবার মন্ত্রণা জোগায়। যুক্তি এই যে – তবুও প্রবাহ তো; ছেদ তো নয়। সুতরাং নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। এই কারণে নৈরাজ্যবাদকে আপাতদৃষ্টিতে মৌলবাদের বিপরীত পক্ষ মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে সে তা নয়। সে আর এক প্রকারের কট্টরতা এবং মৌলবাদের নামান্তর।

মৌলবাদের বিপরীত মতবাদ কী? আধুনিক বিশ্ব মৌলবাদের বিরোধিতায় মুখর হলেও মৌলবাদের বিপরীত শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। মৌলবাদের বিকৃত জীবননীতির বিপরীতে যে চিরন্তন মানবিক জীবননীতি বিদ্যমান, তাকে ‘ন্যাচারাল পারফেকশান’ বা ‘স্বাভাবিক বিশুদ্ধি’ (শিবতা)-র নীতি বলে। এই পৃথিবীর অস্তিত্বের সঙ্গে বিশুদ্ধির এই নীতি ওতপ্রোত। এই নীতি অনুসরণ করেই এ জড়জগৎ বিকাশ লাভ করে চলেছে; চিন্তকজীবরূপে মানুষের উদ্ভব যার অন্যতম প্রকাশ। এই বিশুদ্ধিবাদ বা শিবম্‌-নীতির প্রতি মনীষীদের সাধারণ পক্ষপাতিত্ব দেখতে পাওয়া যায়; যাকে ডারুইনদের আলোড়ন সৃষ্টিকারী তথ্যসমূহ ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি সরবরাহ করে চলেছে। আর, মানুষ প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বিধায় তার স্বভাবের মধ্যেই এই নীতি অনুসরণের স্বাভাবিক প্রবণতাও বিদ্যমান। অর্থাৎ বিশুদ্ধিবাদ বিষয়ে অচেতন থেকেও জন্মলগ্ন থেকে মানুষ তার জীবনসংগ্রামে এই মতবাদ বা নীতি অনুসরণ করে আসছে, জ্ঞানজগতে আরও অনেক তত্ত্বোৎপত্তির ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায়। কর্ম্ম থেকে এ জ্ঞান বিচ্ছিন্ন হয়নি।

স্বাভাবিক বিশুদ্ধির নীতিতে পূর্ব্ববিধান অস্বীকার্য নয়, কিন্তু স্বাধীনতার দাবিও স্বীকার্য্য। এই নীতি অনুসরণ করলে কর্ম্মক্ষেত্রে ‘পূর্ব্ববিধান ও স্বাধীনতার দ্বৈরাজ্য’ (-রবীন্দ্রনাথ) চলে। পূর্ব্ববিধান যেখানে যতখানি অক্ষম, স্বাধীনতা সেখানে ততখানি নববিধানের উদ্ভাবন করে বসে। উভয়ে মিলে মিশে নতুন বিধান প্রসূত হয়, পরবর্ত্তী কার্য্যক্ষেত্রে সেটাই পূর্ব্ববিধানের ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। স্বাধীনতার সুযোগে, প্রয়োজনে, পুনরায় নববিধানের জন্ম হয়; চক্রটি চলতে থাকে। ফলত কর্ম্মনীতি ও কর্ম্মফলে নিত্যবিশুদ্ধিও চলতে থাকে। মানুষ আরও সঠিক, আরও নিখুঁত, আরও সুন্দরের টানে এগোতে থাকে।

সত্যম-শিবম্‌-সুন্দরমের এই চক্রটিকে মৌলবাদ চলতে দেয় না। নববিধান উদ্ভবের সুযোগ স্বরূপ যে স্বাধীনতা, তাকে সে খর্ব্ব করে। নিত্য নতুন উপায় আবিষ্কারের পথ সে রুদ্ধ করে। তখন জীবনপ্রবাহ আর দুর্ব্বার বেগবতী থাকতে পারে না, ওঠে না তাতে আর প্রাণের জোয়ার। বস্তুত বিশুদ্ধিবাদ পূর্ব্ববিধানকে প্রয়োজন মতো অমান্য করবার স্বাধীনতা দেওয়ার ঝুঁকি না নেওয়ার মধ্যে হিতাকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। তাই সে ‘গৃহছাড়া-লক্ষ্মীছাড়া’ করার ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। স্বাভাবিক বিশুদ্ধি ঐরূপ হিতাকাঙ্ক্ষার মধ্যে প্রীতির অভাব ও কৃপা দ্যাখে, যা অনুগ্রহের নামান্তর। বিশুদ্ধিবাদের যুক্তি হল, ‘যেখানেই অনুগ্রহ আসিয়া সকলের চেয়ে বড় আসনটা লয়, সেইখান হইতে কল্যাণ বিদায় গ্রহণ করে’, তাছাড়া ‘হিত করা অথচ প্রীতি না-করা – মানুষকে সকলের চেয়ে নত করবার সেই তো উপায়।’ – (রবীন্দ্রনাথ)। এর কারণ হল, অনুগ্রহ মাত্রই অনুগ্রহকারী ও অনুগৃহিত উভয়কে পরস্পরের বিপরীতে সমান অনুপাতে অহঙ্কারী ও গ্লানিযুক্ত করে থাকে। কেননা মানবিক মূল্যবোধও অজ্ঞাত কারণে নিউটনের তত্ত্বকেই অনুসরণ করে থাকে।

‘চিরদিন যা চলে আসছে’ তার সঙ্গে মৌলবাদ আপনাকে জুড়ে দেয়। ‘প্রচলিতের স্রোতের টানে সে হালছাড়া ভাবে আত্মসমর্পণ করে, তাই সে পরাসক্ত’। ‘চিরাভ্যাসের গণ্ডী’র বাইরে সে চলে না, চলতে দিতেও রাজি নয়। কিন্তু ‘পরাসক্তি থেকে আত্মকর্তৃত্বে’ যাওয়ার যে ‘স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি’, তাকে ‘চিরাভ্যাসের গণ্ডী’র মধ্যে আবদ্ধ করলে, মানুষের ‘মনুষ্যত্বের একেবারে মূলে ঘা লাগে’। নিত্য নতুন জ্ঞানের সংযুক্তিকে এইভাবে আটকে রাখলে, মানুষের জ্ঞানের দিকের গোড়াটা কাটা পড়ে। আর ‘জ্ঞানের দিকের গোড়াটা কাটা পড়িলেই কর্ম্মের দিকের ডালপালা আপনিই শুকাইয়া যায়, তখন আর বেশী কিছু করিতে হয় না, শূদ্রের (মানুষের) মাথা আপনিই নত হইয়া ব্রাহ্মণের (মৌলবাদীর) পদব্রজে আসিয়া ঠেকে’। – (রবীন্দ্রনাথ / কালান্তর)।

আত্মাভিমান-মদমত্ত মৌলবাদ চিরাভ্যাসের গণ্ডীতে আবদ্ধ করে মানুষকে ‘পশু’-তে পরিণত করে এবং সেই ‘পশুর কানে গায়ত্রীমন্ত্র’ জপ করতে থাকে। তখন সে মানুষ আর প্রশ্ন করে না, কেবল ‘অবিশেষে দেখে’। ক্রমে সে ‘উত্তম পশু’ [‘যে নিত্য নিত্য দুর্গাপূজা শিবপূজা বিষ্ণুপূজা অবশ্যই করিয়া থাকে তাহাকে উত্তম পশু কহে’। (‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়)] -তে পরিণত হয়, যে একই রুটিনে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। সে তখন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্য্যন্ত একটা রুটিন ও Job-Chart ভক্তি সহকারে রূপায়ণ করতে থাকে। যেন দু-হাজার বছর আগে যিশু অথবা দেড় হাজার বছর আগে হজরত কিংবা কোনও অত্যাধুনিক ফ্রেণ্ড-ফিলজভার-গাইডের নামে মৌলবাদ ওই Chart ছকে দিয়ে রাখে। সেই ছকে মানুষ মাত্রকেই জীবন কাটাতে হবে। জন্মলগ্ন থেকেই সে ওই ছকের নিকট দায়বদ্ধ। মানুষের জীবনটা তার নিজের নয়। ছিনতাই হওয়া ট্যাক্সির মতো তার ‘জীবন-যাত্রা’ হিতাকাঙ্ক্ষী মৌলবাদের ইচ্ছানুসারে চলে, বিনা ভাড়ায়। বর্ত্তমান ভুতের (=অতীতের) বেগার খাটতে থাকে। তখনও নিজের জীবনটা মানুষ নিজেই কাটায় বটে, কিন্তু নিজের ইচ্ছানুসারে নয়, নিজের বুদ্ধিতেও নয়; তার জীবনরথে অধিষ্ঠিত মৌলবাদের ইচ্ছানুসারে। সেই মৌলবাদ নির্দ্দেশ দেয় – ‘শক্তি চালিয়ো না, বুদ্ধি চালিয়ো না, কেবল ঘানি চালাও। …প্রবুদ্ধমিব সুপ্ত…’। যে শুয়ে আছে সেই বুদ্ধিমান।

টীকাঃ তথ্যসূত্র ও অন্যান্য

‘শিবের শিবত্ব কী? মুনিগণের এই প্রশ্নের উত্তরে বায়ু কহিলেন – “স্বাভাবিক বিশুদ্ধির নাম শিবতা”। -(দ্রষ্টব্য – শিবপুরাণ / বায়বীয় সংহিতা / ৪-র্থ অধ্যায় / শ্লোক-২০)।

একই রক্তসম্পর্কে বিয়ে করলে ক্ষতি হয়, একথা আধুনিক বিজ্ঞান জেনেছে সম্প্রতি। কিন্তু মানুষের সভ্যতা সেকথা বুঝে গিয়েছিল বহু আগেই।

‘পশু’ শব্দের অর্থ জানার জন্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ খুললে অবাক হতে হয়। কেননা তাতে ‘পশু’ শব্দে ‘অ্যানিম্যাল’ বোঝানো হয়নি। বলা হয়েছে ‘যে অবিশেষে দেখে’ সেই-ই ‘পশু’। এই ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি বর্ত্তমানে বিস্মৃত। সে বিধি কী্রূপ, সেকথা পরে। এখন প্রশ্ন, ‘অবিশেষে দেখা’ কেমন দেখা? ইংরেজিতে vide শব্দটি গেছে আমাদের ‘বিদ্‌’ থেকে, যদর্থ ‘বিদিত হওয়া’। (ল্যাটিনে videre=দেখা, to see। videre-এর imperative ‘vide’ অর্থাৎ ‘দেখ’।) এই ‘বিদ’ই ‘বেদ’-শব্দের ভিত্তি। vide থেকে vision হয়। বেদ বিভাজন বা জ্ঞান বিভাজন করে দিলে মানুষ ‘অবিশেষে দেখে’। এ একপ্রকার অন্ধত্ব। তাই de-vision আর visionless একই ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ক্যামেরা অন্ধ হইয়া দেখে’। এইরূপ অবিশেষে দেখতে বাধ্য করা হয় শ্রম-বিভাজন করে। তাতে জ্ঞানও বিভাজিত হয়ে যায়। আধুনিক যুগের অস্ত্র কারখানায় অস্ত্র বানানোর এই পদ্ধতিটি খুব স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। যাতে গোটা অস্ত্রটি কেউ বানিয়ে ফেলতে না পারে, তাই প্রত্যেক কর্ম্মচারীকে কেবল নির্দিষ্ট অংশবিশেষ বানাতে কাজে লাগানো হয়।

(খ) উৎপত্তি

একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির মৌলবাদী নীতি অনুসরণ করলে মানুষ নিপুণ বা দক্ষ (=স্পেশালিস্ট বা বিশেষজ্ঞ) হয়ে ওঠে, যদিও ‘সঙ্কীর্ণ অভ্যাসের কাজে বাহ্য নৈপুণ্য বাড়ে, আর বদ্ধ মন ঘানির অন্ধ বলদের মতো অভ্যাসের চক্র প্রদক্ষিণ করতে থাকে।’ (-রবীন্দ্রনাথ / চরকা)। একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে একই জ্ঞানের পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে, মানুষের অবগতি smile emoticon

অব-গতি=নিম্নগতি=খণ্ডজ্ঞান= Knowledge through reductionism) বাড়ে এবং মানুষ ‘জ্ঞানী’ হয়ে ওঠে। নববিধানোদ্গমের সুযোগ না থাকায় আর ‘বেদই কর্ম্মের অন্ত’ [একথা গার্গীর ‘কর্ম্মের অন্ত কোথায়’ প্রশ্নের উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন। এর অর্থ, কর্ম্মান্তে কর্ম্মলব্ধ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা সঞ্চিত-জ্ঞান-ভাণ্ডারে বা ‘বেদ’-এ জমা পড়ে; এই হল স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু মৌলবাদ তা হতে দেয় না। তাই শোনা যায়, আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সরকারী উন্নয়ন্মূলক কর্ম্মের উপর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে থিসিস করা ছাত্রদের জন্য আজও নিষিদ্ধ করে রাখা আছে।) হয় না। ফলত ‘বেদ আর সৃজনশীল না থাকিয়া উপদেশদাত্রীর স্তরে অধঃপতিত হয়’। (কথিত আছে যে অত্রি প্রজাপতির সময় থেকে বেদের এই দুর্দ্দশা চলছে)।

একই জ্ঞানের পুনরাবৃত্তিকারী কর্ম্মবিচ্ছিন্ন জ্ঞানী এবার শিক্ষক বা গুরুতে পরিণত হয়; অগ্নি রূপান্তরিত হয় অঙ্গারে।[1] বসে বসে কর্ম্মবিচ্ছিন্ন জ্ঞানের অঙ্কুরোদ্গম হয়, শিকড় গজায়, সামাজিক মাটি ভেদ করে যে জ্ঞানবৃক্ষ (=educational institution) একদিন মাথা তোলে। তাতে ফল ফলে, ‘জ্ঞানবৃক্ষের ফল’। প্রারম্ভিক কালে, কর্ম্মজগৎ থেকে পলাতক কর্ম্মবিচ্ছিন্ন জ্ঞানীদের দ্বারা সৃষ্ট এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞান ফল আহরণ নিষবিদ্ধ থাকে। কিন্তু অধঃপতনের প্রথম ধাপে সমাজ যখন দক্ষনীতি বা মৌলবাদকে একবার স্বীকার করে নেয়, দ্বিতীয় ধাপে নামার স্বাভাবিক অধোগতির হাত থেকে তার পরিত্রাণের পথ থাকে না। তখন শত নিষেধ সত্ত্বেও কর্ম্মী-জনগণ (=ইভ্‌=সতী) কথা শোনে না। আধুনিক ইংলিশ-মিডিয়াম-আকুলতার মতো, তারা সেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল-প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন আর ‘বিদ্যাদির দ্বারা উপার্জ্জন’[2]-কে ঠেকানো যায় না। শুরু হয়ে যায় ‘প্রজাসৃষ্টি’।[3]

সমাজ যখন সাধারণভাবে একই জ্ঞান ও একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তিজনিত মৌলবাদী নীতিকে স্বীকার করে নিয়ে আত্মস্থ করে ফেলে তখন, একমাত্র তখনই আমরা চাষী-তাঁতি-কামার-কুমোর ইত্যাদি, শিক্ষক-বিচারক-বৈদ্য-মন্ত্রণাদাতা ইত্যাদি, গায়ক-নায়ক-অভিনেতা-কবি ইত্যাদি এবং তাদের ক্রমবিভাজিত রূপে ৬৪ কলায় নিপুণ ৬৪ প্রকার দক্ষপ্রজাতি[4]-কে উপস্থিত পেয়ে যাই। যে চাষ করে, নিজের কাপড়টা বুনে নেয়, লাঙল ও তার ফলাটাও বানিয়ে ফেলে, পূর্ব্বপুরুষের স্মৃতিচারণের গানও গায় – তেমন সর্ব্বকর্ম্মক্ষম মানুষকে আর আমরা পাই না। সমাজ যেন টোটাল ফুটবল (সবাই সব পজিসনে খেলে) নীতি পরিত্যাগ করে যে যে বিশেষ বিশেষ অবস্থানে খেলবার নীতি গ্রহণ করায় এখন ব্যাক, স্টপার, ফরোয়ার্ড ইত্যাদির মতো চাষী, তাঁতি, শিক্ষক, বৈদ্য, গায়ক, কবিদের পাচ্ছি। এখন চাষী ধান নিয়ে, তাঁতি কাপড় নিয়ে, গুরু বিদ্যা নিয়ে, অর্থাৎ যে যার কর্ম্ম বা ধর্ম্ম নিয়ে থাকে বটে, কিন্তু তারা মানুষ বলেই তাদের প্রত্যেকেরই ধান কাপড় বিদ্যা সবই প্রয়োজন হয়। ফলে সৃষ্টি হয় বিনিময়ের পরিবেশ, ‘pores of the society’ (Marx) বা Aperture অর্থাৎ উপরিচরের[5] বা অবকাশের। তখনও যে যার কর্ম্ম বা ধর্ম্ম নিয়ে থাকে ঠিকই, এমনকি কেউ কারও কর্ম্মে বা ধর্ম্মে নাক গলায় না বলে ধর্ম্মনিরপেক্ষ বা কর্ম্মনিরপেক্ষ[6] থাকে বটে; কিন্তু লেনদেন না হলে যে আর প্রাণ বাঁচে না। সুতরাং ডাক পড়ে নিষ্কর্ম্মার – যার কোনও কর্ম্ম বা ধর্ম্ম নেই অর্থাৎ যে কোনও কিছুই উৎপাদন করে না তেমন অনুৎপাদকের; নিষ্কর্ম্মা জন্মায়। শুরু হয় ‘অধর্ম্মের দ্বারা ধনের আগম’[7]। এবার চাষী-তাঁতির চেয়ে ফড়ে-দালাল, উৎপাদকের চেয়ে অনুৎপাদক, শক্তিশালী হতে থাকে। এই অনুৎপাদক অধর্ম্মজীবীর (=পণ্যজীবীর) হাত দিয়ে ক্রমে একদিন ‘মহৎ-অধর্ম্মের-মর্য্যাদা’[8] প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। সমাজ অনুৎপাদক কর্ত্তৃক উৎপন্ন-বিনিময়কে (=ব্যবসাকে) গৌরবজনক বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়। উৎপাদন নীতি পদ্ধতিতে, জীবননীতিতে মৌলবাদী দক্ষপন্ধী হবার ফল ফলতে থাকে, একে একে, ক্রমান্বয়ে – সমাজের রোগগ্রস্ত হবার সমূহ লক্ষণ ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকে।

টীকাঃ তথ্যসূত্র ও অন্যান্য

[1] কেউ যখন জ্ঞান ও কর্ম্মের (theory and practice) যোগ সাধনের মাধ্যমে কর্ম্মরত হয়, তখন তাকে ‘শিখা বহনকারী’ (অর্থাৎ- শি=শিখা, ব=বহনকারী / =শিব=উদ্ভাবক=ব্রাহ্মণ=যে অধঃপতিত হলে শিখাধারী থেকে টিকিধারীতে পরিণত হয়) অগ্নি বলে। কর্ম্মবিচ্ছিন্ন হলে সেই অগ্নি অঙ্গারে পরিণত হয়। (শব্দটি ইংরেজিতে anger ইত্যাদি হয়ে গেছে) তার উত্তরসূরী নিষ্কর্ম্মারা শিক্ষক বা বিদ্যাব্যবসায়ী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরা know-how ব্যবসায়ীও বটে। তাই অগ্নিপুরাণে অগ্নি থেকে অঙ্গিরা এবং অঙ্গিরা থেকে আঙ্গিরসগণের জন্ম কথা বলা হয়েছে।

[2] সমাজের আদিতে ‘বিদ্যা-বিক্রয়-রোগ’ থাকে না। একদিন ‘বিদ্যাদির আগম বিধায়’ সমাজ অধঃপতিত হয় (আধুনিক মতে বিকশিত হয়)। এই সাক্ষ্য মনুসংহিতার।

[3] ‘প্রজা’ শব্দের অর্থ ‘প্রকৃষ্টরূপে জাত’ অর্থাৎ শিক্ষিত, যাদেরকে ভদ্রলোকও বলা হয়। তাই প্রাচীন ভারতীয় সমাজ যখন শিক্ষিত শ্রেণীর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়ে গেল, তখন থেকেই ভারতে প্রজাসৃষ্টির পালা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘এই ভারতবর্ষকে আমরা ভদ্রলোকের ভারতবর্ষ বলিয়াই জানি’। ‘ভদ্র’ শব্দের মানে ‘৬৪ কলায় নিপুণ ৬৪ পেশার দক্ষ ও গৃগুগণ’। তন্ত্রে এদের অনুগামীদেরই ৬৪ যোগিনী বলা হয়েছে।

[4] পুরাণে ‘দক্ষোৎপত্তি’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

[5] এই ‘Aperture’ হল মহাভারতের ‘উপরিচর’-এর অনাবাসী ভারতীয় উত্তরসূরী। এই উপরিচরই হলেন মৎস্যগন্ধ্যা বা আমি-আমি-গন্ধের বা আমিষগন্ধের অর্থাৎ মালিকানার গন্ধের জনক। আর যে-অবকাশে হত্যা করা যায়’, তার সংবাদ পাওয়া যায় মধুকৈটভ বধে।

[6] এ যুগের সেকুলার-ধর্ম্মনিরপেক্ষতা হল ঐ কর্ম্মনিরপেক্ষতার অতি দূর উত্তরসূরী। একে বুঝে নেবার জন্য একটি আধুনিক উদাহরণের শরণাপন্ন হওয়া যাক। ‘মাফিয়া ডন রশিদ খানের বেআইনি বাড়ী কলকাতায় আছে কি না, তা পুলিশ বিভাগ দেখবে কেন, কর্পোরেশন বুঝবে।’ – বক্তব্যটি আনন্দবাজারে প্রকাশিত কর্পোরেশনের এক মুখপাত্রের। অর্থাৎ কিনা, বিভাগীয় ধর্ম্ম / কর্ম্মনিরপেক্ষতার ফাঁকে অধর্ম্মাচারী রশিদ খানের অস্তিত্ব যেমন নিশ্চিত হয়, আদি কর্ম্মনিরপেক্ষতার অবকাশে তেমনি নিশ্চিত হয় আদি আধর্ম্মচারীর (বা বেনিয়ার) উদ্ভব। তেমনি আধুনিক রিলিজিয়াস-ধর্ম্মনিরপেক্ষতার ফাঁকে নিশ্চিত হয় রিলিজিয়নকে রাজনীতির হাটে বেচাকেনায় ব্যস্ত অধর্ম্মাচারীদের উদ্ভব ও বাড়বৃদ্ধি।

[7] ভাগবতে / মনুসংহিতায় ‘অধর্ম্মের দ্বারা ধন ও বিদ্যাদির আগম বিধায়’ সত্যযুগ থেকে মিধ্যাযুগে অধঃপতন সূচিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

[8] মানুষের সমাজে সর্ব্বপ্রথম পণ্যবিনিময়ের সূত্রপাত হয় লুকিয়ে চুরিয়ে। সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বিনিময়কে বহুকাল অপেক্ষা করতে হয়েছিল, অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছিল। অবশেষে একদিন পণ্যবিনিময় যখন সামাজিক স্বীকৃতি পেল, তখন বলা হল, ‘অধর্ম্মের মর্য্যাদা প্রতিষ্টা’ হয়েছে। দেবীপুরাণে বিষয়টিকে উল্লেখ করা হয়েছে – ‘মহৎ-অধর্ম্মের-মর্য্যাদা’ প্রতিষ্ঠা বলে।

(গ) প্রতিপত্তি

একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির বিকৃত জীবননীতি বা মৌলবাদী নীতি গ্রহণ করলে এইভাবে প্রথমে (খণ্ড) জ্ঞানের (=অব-গতির) মর্য্যাদা ও পরে অধর্ম্মের বা বিনিময়ের মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। জ্ঞানজীবী (=বেদজীবী) ও পণ্যজীবী (=ব্যবসায়ী) সমাজের উপরিতলে উঠে আসে। কিন্তু এরপর এখানেই সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে না। একবার বিপথে হাঁটা শুরু করলেই তার আর থামার উপায় থাকে না। সদাচারভিত্তিক সত্যযুগের থেকে ক্রমান্বয়ে মিধ্যাযুগের দিকে গড়াতে গড়াতে (আধুনিক ভাষায় ‘বিকশিত হতে হতে’) একসময় যন্ত্রযুগে বা কলের যুগে অর্থাৎ কলিযুগে১ এসে হাজির হয়। প্রশ্ন হল কীভাবে?

একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে কর্ম্মবিভাজন বা শ্রমবিভাজন এবং জ্ঞানবিভাজন বা বেদবিভাজন সমান তালে এগোতে থাকে। জ্ঞানী (=অঙ্গিরা=অধঃপতিত শিব=শঙ্কর) ও কর্ম্মীর (=একই নির্দ্দেশকের প্রতি অনুরক্ত জনসাধারণের=সতীর) প্রেমবন্ধন পরিত্যক্ত হয়। প্রেমের যে দুটি দিক, প্রেমভাব (=মদন=কর্ম্মোন্মাদনা) ও প্রেমকর্ম্ম (=রতি=কর্ম্মসম্পাদনা), তার ভিতর প্রেমভাবকে ভস্ম করে ফেলা হয় অর্থাৎ মদনভস্ম করে ফেলা হয়। কারণ কর্ম্মীর মধ্যে কর্ম্মোন্মাদনা (=কাম=মদন) থাকলে, সে কর্ম্মফল কামনা করতে পারে।

অতএব আগের কালের মতো, জ্ঞানী আর কর্ম্মীর সঙ্গে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কর্ম্মযজ্ঞে লিপ্ত হয় না। দেখা দেয় চুক্তির বন্ধন২। তখন শিব-সতীর প্রেমবন্ধনের যুগ পেরিয়ে শঙ্কর-পার্ব্বতীর বিবাহবন্ধনের যুগের সূত্রপাত হয়। কর্ম্মী (=স্ত্রী) এবার চুক্তি (=বিবাহ) বন্ধনে আবদ্ধ মজুর (=দাসী)। সে আসে যায়, জ্ঞানীর হুকুম মতো কাজ করে, পায়সা পায়; কর্ম্মফলে তার অধিকার নেই, উৎপাদন (=সন্তান) এখন জ্ঞানীর (=স্বামীর)৩।

যে আবেগের সম্পর্ক জীবপ্রজাতির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সম্পদ, যার সাহায্যে চরজীবী বানর মানুষে উত্তীর্ণ হয় শ্রেষ্ঠ জীবরূপে, জ্ঞানীর ‘অহঙ্কার’৪ সেই আবেগের সূত্রগুলিকে কট্টর নির্ম্মম নিষ্ঠুরতায় কেটে রাখে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে। এরপরও জ্ঞানী-কর্ম্মী (স্বামী-স্ত্রী) কর্ম্মে রত বটে, তবে কর্ম্মোন্মাদনা ধ্বংসের বা মদনভস্মের পর ‘কাম’-হীন নিষ্কাম প্রেমের রতিবিলাপের যান্ত্রিকতা ছাড়া আর কীই বা অবশিষ্ট থাকতে পারে। সেই যান্ত্রিক রতিবিলাপের নৈপুণ্যে পুণ্য নেই, জমে ওঠে পাপের৫ পাহাড়। সেই পাপ স্খালনের জন্য এবার প্রয়োজন হয় গঙ্গার৬, যে গঙ্গার তীর্থে থীর্থে (বাজারে বাজারে) ‘অবগাহন’৭ করলে সব পাপ বিদেয় হয়। পণ্যস্রোতে ভেসে যায় সমস্ত ‘পালকের পালয়িতা'(পাপ)। পরিবর্ত্তে পাওয়া যায় ‘পুণ্য’ বা ‘পবিত্রতা-সম্পাদক’ পদার্থ’। আর অচিরে অনুভূত হয়, ‘গো প্রভৃতি পবিত্রতা-সম্পাদক পদার্থের মধ্যে সুবর্ণই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক পবিত্রতা-সম্পাদক পদার্থ’ (দ্র- মহাভারত / কালিপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ)। আদিম সাম্যবাদী পণ্যহীন সমাজ এইভাবে পণ্যবাহী সমাজে পরিণত হয়ে যায়। নিরামিষাশী (=ব্যক্তিমালিকানাহীন) মানুষ তখন কেবল আমিষাশী (=ব্যক্তিমালিক) হয়েই ক্ষান্ত দেয় না; ‘বৃথামাংস’৮ ভোজন করতে শুরু করে।

বেদজীবী জ্ঞানী ও পণ্যজীবী জ্ঞানীর সঙ্গে শ্রমজীবী কর্ম্মীর দাম্পত্য সম্পপর্কের এই পরিণতি এবার মানসিক দূষণ সৃষ্টি করতে থাকে। দম্পতির দম (=যাকে দমন করার হয়= dame, damsel) যত অবদমিত হয়, তাকে দমনের অপরাধের গ্লানিতে অ-দম (=Adam=আদ্‌মি) সেই অনুপাতে নিউটনিয় নিয়মে অধঃপতিত পতি হতে থাকে। ফলত ক্রমে একদিন ‘স্ত্রী’র৯ (=কর্ম্মীর) কাছে পুরুষের (=জ্ঞানীর) কোনও জবাবদিহি থাকে না — স্ত্রীর (বা কর্ম্মীর) সহিত সম্বন্ধে পুরুষ (বা জ্ঞানী) সম্পূর্ণ কাপুরুষ হইয়া দাঁড়ায়’ (রবীন্দ্রনাথ / লোকহিত)। তখন সেই পুরুষ তার ঘরের চারদিকে দেয়াল তোলে, মনের চারদিকে দেয়াল তোলে; আবেগের যে দু-চার গাছি সূত্র তখনও বিদ্যমান, সেগুলি তখন সে কেটে ফেলে; নিজেকে করে তোলে সত্যগোপনকারী গুহাবাসী। অতঃপর আপনাকে সুরক্ষিত করার নিষ্ফল চেষ্টায় একটার পর একটা আইনের প্রাচীর বানিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করা ছাড়া তার আর কোনও উপায় থাকে না।

টীকাঃ তথ্যসূত্র ও অন্যান্য

১। কল-ই যেখানে সমাজের ‘যুগ’ বহন করে=কল-ই যুগ=কলিযুগ=যন্ত্রযুগ। যুগ=জোয়াল / দ্রষ্টব্য- ‘যুগন্ধর’, দ্রষ্টব্য- বুদ্ধের বাণী।

২। চুক্তির বন্ধন=বিবাহবন্ধন। বিবাহের=বিশেষ বহনের=carry out-এর। contract=বন্ধন।

৩। আইনানুসারে কারখানার বা জমির উৎপন্ন মালিকের, মজুরের নয়। অর্থাৎ সন্তান আইনানুসারে পিতার, মাতার নয়। আজকাল এই আইনের কিছু কিছু পরিবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে। সাধারণ জ্ঞান সন্তানকে মাতাপিতার যৌথ সন্তান বলে মনে করলেও অন্য উৎপন্নের ক্ষেত্রে তেমন কথা ভাবতে ভরসা পায় না। তাছাড়া আইনানুসারে উৎপাদনের উপায় অর্থাৎ কারখানা জমি মজুর স্ত্রী ইত্যাদি যতদিন ‘কারও’ হবে, ততদিন উৎপন্নও তারই হবে। তাই অদ্ভুত হলেও সত্য হচ্ছে এই যে, জমিবিষয়ক আইনের সঙ্গে স্ত্রী-স্বাধীনতার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। বলতে কি, যে দেশের আইনে জমি যতখানি বন্ধনমুক্ত, সেদেশে ততখানি নারী-স্বাধীনতা অর্জ্জিত। ব্যাপারটি অদ্ভুৎ, কিন্তু ব্যাপারটি সত্য। একটু গবেষণা করলেই এই সত্য জানা যায়।

৪। ‘অহং কার’ বা ‘আমিই করেছি, অতএব আমার’, এরকম ভাবনা যৌথসমাজে নিন্দনীয় ছিল। কিন্তু জ্ঞানের মর্য্যাদা বা জ্ঞানের মালিকানা (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটের আদি রূপ) প্রতিষ্ঠার পর, একদিন ক্রমান্বয়ে এরকম ‘আমিই করেছি’ বলা আর নিন্দনীয় রইল না। তাই অহঙ্কারের উদ্ভব সবার আগে। একথা প্রায় সব পুরাণেই বলা হয়েছে।

৫। ‘পাপ’=পালকের পালয়িতা=ধান গম গরু ঘোড়া পুত্র কন্যা প্রভৃতি যা ‘প্রতিপালক’কে (=পা) ‘প্রতিপালন করে’ (=প)=পাপ।

৬। গঙ্গা=গম্‌+গ> gang way > ganiza>গঞ্জ>বণিকপথ =পণ্যপ্রবাহ =commodity flow ।

৭। অবগাহন=উল্টো গান=’দাও দাও’ গান হল ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক সমাজের সোজা গান, খালি ‘দাও দাও’। আর উলটো গান হল – নাও নাও, নিন বাবু নিন, নিয়ে যান, খুব সস্তা, একেবারে টাটকা, সেরা, ‘নিয়ে যান, নিয়ে যান’ – এইরূপ গান।

৮। প্রয়োজন নেই, তাও অর্থ উপার্জ্জন করাকে বা ‘ম’-এর অংস (দ্র- বঙ্গীয় শব্দকোষ) গ্রহণ করাকে পুরাণাদিতে ‘বৃথামাংস ভক্ষণ’ বলা হয়েছে। ব্যক্তিগত পুঁজির পাহাড় গড়ে তোলা আর নিরন্তর বৃথামাংস ভক্ষণ করতে থাকা একই ব্যাপার। যদিও আধুনিক পণ্ডিতগণ শব্দবন্ধটির এরূপ অর্থ জানেননা। যদিও সবাই জানেন, ভারতসমাজে বহুকালাবধি বৃথামাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধে আছে।

৯। ‘স্ত্রী’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ‘যেখানে গর্ভ সংহত হয়’। এই অর্থ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া। শব্দার্থ বিষয়ে এই গ্রন্থে প্রায় সব ক্ষেত্রে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ই অনুসৃত হয়েছে। পরে আর তা পৃথক করে উল্লেখ করা হবে না।

‘যেখানে গর্ভ সংহত হয়’ তাকেই ‘স্ত্রী’ বলা হয় বলেই নারী, জমি, কর্ম্মী, ছাত্র, প্রজা, শ্রমিক ইত্যাদি সবাইকেই ‘স্ত্রী’ শব্দে সনাক্ত করা যায়। ‘স্ত্রী’ শব্দের ভিত্তিতে ‘স্ত্যৈ’ ধাতু বিদ্যমান। এটি সংহত বা গঠিত করার কাজটিকে উল্লেখ করে থাকে। এই স্ত্রী শব্দের এক রাশিয়ান উত্তরসূরী হল ‘পেরেস্ত্রৈকা’ বা ‘পরবর্তীকালের স্ত্রৈকা’ অর্থাৎ ‘পুনরায় গঠন’ বা পুনর্গঠন’। আর ইংরেজদের দেশে Str-যুক্ত সমস্ত শব্দই স্ত্রী শব্দের সুদূর উত্তরসূরী, যথা – strike, construction, destruction ইত্যাদি। আর পুরুষ শব্দের ভিত্তিতে যে পুর্‌ থাকে, তাই দিয়ে গড়ে ওঠে পুরি, পুরোডাশ (=product) ইত্যাদি। কিন্তু ‘উৎ-পাদন’ উপর দিকে পা তোলার কারণে কেবলমাত্র অকৃষিজ উৎপন্ন মাত্রকেই শনাক্ত করে থাকে। এটি আধুনিক ভাষাতত্ত্বের অজ্ঞাত থাকায় বহু কিছুকে চেনা যায়নি। যথা হরপ্পার সিলমোহরের উপর দিকে পা তোলা নারীর ‘উত্তানপাদ’ প্রতিকৃতি। …এখন এই সুবাদে সেটাও জানা হয়ে গেল।

(ঘ) সম্পত্তি

কিন্তু সমাজটা তো প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মানুষের। স্বাভাবিক বিশুদ্ধির (=শিবতার) প্রতি অনুরাগ যে তার জন্মগত স্বভাব। পরিস্থিতিও তার পক্ষে চলে যায়। বাইরের তাড়ায় ভিতরে সাড়া জাগে। একদিকে মৌলবাদ-সৃষ্ট অজস্র সামাজিক ব্যাধির প্রকোপ থেকে মুক্তির অপ্রতিরোধ্য প্রয়োজন দেখা দেয়, অন্যদিকে কালের অগ্রগতির ও জগতের পরিবর্তনশীলতার কারণে মৌলবাদী জীবনপ্রবাহের গড্ডলিকা শুকিয়ে আসে। অর্থাৎ মৌলবাদী কর্ম্মজ্ঞান ও কর্ম্মপদ্ধতি এতই সেকেলে হয়ে যায় যে, জীবনসংগ্রামের ক্রমবর্দ্ধমান কঠোরতা মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।

অগত্যা অনন্যোপায় মৌলবাদ রূপ বদলায়, বহুরূপী হয়ে ওঠে। দৃশ্যত বহুধা বিভক্তও হয়ে যায়। তখন রঙ-বেরঙ-এর মৌলবাদ পরস্পরকে ‘মৌলবাদী’ বলে গালি পাড়তে লাগে এবং প্রত্যেকে নিজেকে ‘মৌলবাদ-বিরোধী’ বলে প্রমাণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। এমন কি, কখনও বা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাও করে বসে। কিন্তু ভবি ভোলে না। একদিন অবশেষে মৌলবাদ ও স্বাভাবিক বিশুদ্ধির বিরোধ সামাজিক দ্বন্দ্বরূপে দেখা দেয়। সেই যুদ্ধে মৌলবাদের হার সুনিশ্চিত, তাই সে হারে; কিন্তু হেরেও সে জিতে যায়। যে সম্পত্তির১ জোরে মৌলবাদ তার প্রতিটি পরাজয়কে অতঃপর বিজয়ে রূপান্তরিত করে, সেটিই তার বহুরূপিতার ভিত্তি। সে ঘোষণা করে – তাহলে তোমাদের এই নতুন নীতি-পদ্ধতিই আমার হোক, এখন থেকে এরই পুনরাবৃত্তি চলুক। নববিধান অবশেষে পূর্ব্ববিধানের স্বীকৃতি ও মর্য্যাদা পায় বটে, কিন্তু ততক্ষণে সে মৌলবাদে পরিণত হয়ে গেছে।

মৌলবাদ এবার আগের তুলনায় কঠোর হয়, কখনো বা প্রতিশোধাত্মক হয়ে ওঠে। প্রায় প্রত্যেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও আবিষ্কারককে উত্তরসূরীর সঙ্গে এইরূপ ‘মোগল ঘরানার পিতাপুত্র ব্যবহার’ চালাতে দেখা যায়। তবে বিজয়ী হলেও পুত্রকে কখনও প্রতিশোধাত্মক হতে দেখা যায় না, কিন্তু পিতাকে প্রতিশোধাত্মক হতে দেখা যায়। অন্যথায়, মৌলবাদ তার একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তিকে জগতের নিষ্ঠুরতম আইনরূপে ‘বংশানুক্রমিক পুনরাবৃত্তি’তে পরিণত করত না। এই সেই হেতু, যার থেকে নির্ম্মম বর্ণাশ্রম ধর্ম্মটি আমরা হাতে হাতে পেয়ে যাই। মৌলবাদ কর্ত্তৃক গৃহীত এই সিদ্ধান্ত ফ্যাসিবাদরূপে তার সর্ব্বোচ্চ রূপকে প্রকাশ করে।

ফলত, মানুষ এবার বংশানুক্রমিকভাবে সুবিধাভোগী ও দলিত হয়ে যায়। তারপর থেকে তাঁতী জন্মজন্মান্তর ধরে মাকড়সার মতো কাপড় বুনতে থাকে, চাষী তার বলদটির মতোই বংশপরম্পরা লাঙল টানতে থাকে, গুরু বংশানুক্রমে তার ঘণ্টার ধ্বনির মতো একই শব্দ উচ্চারণ করতে থাকে; দেখা দেয় ‘এক হীন উদ্ভিদসূলভ জীবন, এক নিষ্ক্রিয় ধরনের অস্তিত্ব যা অবস্থার প্রভুরূপে মানুষকে উন্নত না করে তাকে বাইরের অবস্থার পদানত করে।’২

প্রত্যেক আবিষ্কারককেই যে পরবর্ত্তীকালে মৌলবাদী হতেই হবে, এমন অলঙ্ঘনীয় বাধ্যবাধকতা নেই। তবে পরিস্থিতি তাকে মৌলবাদী হতেই প্ররোচিত করে থাকে। তা-সত্ত্বেও অনেকেই ভবিষ্যতের জন্য পথ খোলা রাখেন, স্বাধীনতার গলা টিপে ধরেন না। উত্তর পুরুষের সৃজনশীল উদ্ভবকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে তাঁরা ঘোষণা করেন – ‘I do not agree with a word you say, but will defend to the death your right to say it.’ এই বাণী মহামতি ভলতেয়ারের। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের এই হল মৌল ভিত্তি; তবে সে ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে।

কিন্তু পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, প্রারম্ভে প্রত্যেক আবিষ্কারক বা উদ্ভাবককে স্বাভাবিক-বিশুদ্ধির নীতিতে বিশ্বাসী হতে বাধ্য হতে হয়। নইলে তার উদ্ভাবন বাঁচে না। উদ্ভাবিত বা আবিষ্কৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, সে বিষয়ের প্রচলিত জ্ঞান, কর্ম্ম, কর্ম্মপদ্ধতি ও আচারের অন্তত আংশিক বিরোধিতা না করে তার উপায় থাকে না। স্বভাবতই সে মৌলবাদবিরোধী হয়ে যায়। অবশ্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে, স্বীকৃতি পেতে পেতে আবিষ্কারকের জৈব জীবনের ইতি ঘটে। তখন তার হয়ে কাজ চালায় তার ভাবমূর্ত্তি কখনও বা আবিষ্কারকের জীবৎকালেই ভাবমূর্ত্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন বহুক্ষেত্রেই আবিষ্কারককে তার নিজের ভাবমূর্ত্তির ক্রীতদাস হয়ে দিন গুজরান করতে হয়। তিল তিল করে মানুষ এ ভাবমূর্ত্তি সংশ্লিষ্ট মানুষদের মনে গড়ে তোলে, সেই ভাবমূর্ত্তি তখন তাকে তাড়া করে বেড়ায় — ‘তুমি না এরকম!’ সুতরাং অন্যরকম হওয়া চলে না, করা চলে না তার। তাই, কত ভালো মানুষই তো ভাব্মূর্ত্তির তাড়া খেয়ে অবতার হয়ে গেলেন। নেতাজীর ভাবমূর্ত্তি কি তার প্রেমিক সত্তাকে আত্মগোপন করতে বাধ্য করেনি? কে বলতে পারে বিশ্বকবির ভাবমূর্ত্তি তার সমাজপ্রেমী দার্শনিক সত্তাকে কতখানি আঘাত হেনেছিল?

কারণ উদ্ভাবকের ভাবমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর থেকেই মৌলবাদের কেরামতি শুরু হয়ে যায়। সে ওই মূর্ত্তিটা দুভাবেই বানিয়ে ফেলে, যা আর বদলাবে না। উদ্ভাবক যদি দলবদ্ধ একটি শক্তি হয়, প্রাচীন ভারতের যৌথসমাজে যা স্বাভাবিক ছিল, তবে তার ক্রিয়ানুসারী ভাবমূর্ত্তির আদলেই মৌলবাদ সেই শক্তির (যথা শিব, দুর্গা, কালী ইত্যাদি) প্রতিমা বানায়; বানিয়ে প্রতিমা ও ভাবমূর্ত্তি উভয়কে সে অপরিবর্তনীয় বলে ঘোষণা করে, আর আবিষ্কারক যদি ব্যক্তিবিশেষ হয়, তবে তার প্রতিমা বানানোর জন্য প্রকৃত ভাস্কর্য্য বিদ্যার পরিশ্রমটা বাঁচে, যে পরিশ্রম দলবদ্ধ শক্তির প্রতিমা বানাতে খরচ করতে হত ঃ এখন ওই ব্যক্তিবিশেষের জৈব চেহারার কপি করলেই চলে! আর ভাবমূর্ত্তি? সে তো যার প্রতিমা বানানো হবে, সেই আবিষ্কারকই জনমনে গড়ে দিয়ে গিয়েছেন। প্রয়োজন কেবল তাকে অপরিবর্তনীয় বলে ঘোষণা করা। এবার চলুক সেই প্রতিমার পূজা ও তার আবিষ্কৃত নীতি-পদ্ধতির অনুবর্তন।

আবিষ্কারককে অনড় অপরিবর্তনীয় বানানোর এই বিদ্যাটি প্রয়োগ করে মৌলবাদ তার মহিমা হরণ করে। ফলত যার মূর্ত্তি বানিয়ে পূজা করা হয়, এবার তার সত্যি সত্যিই মৃত্যু হয়। গান্ধীকে গুলি করেই নিষ্ক্রিয় করা যেত না। তাঁকে যে পূজা করেই মেরে ফেলা হবে, তা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন – ‘আমার বন্ধুরা আমাকে সবচেয়ে বেশী সম্মান দিতে পারেন, যদি তাঁরা আমার কর্ম্মসূচীকে পুরোপুরি গ্রহণ করেন ঃ কিংবা যদি এসব কর্ম্মসূচীকে বিশ্বাস না করেন তাহলে এগুলির বিরোধিতা করেন। যে যুগে কর্ম্মই ধর্ম্ম, সে যুগে অন্ধভক্তির কোনই মূল্য নেই, অনেক সময়ই তাতে বিব্রত হতে হয় আর তা বেদনাদায়কও বটে।’ (দ্রষ্টব্য- ‘মহাত্মা গান্ধীর বাণী’) তাঁর ইত্যাকার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর মূর্ত্তি বানিয়ে পূজা করে এবং অথচ তাঁর নীতি অমান্য করেই কেবল তাঁকে মেরে ফেলা সম্ভব হয়েছে। ‘পূজা করে মেরে ফেলা’র এই বিশুদ্ধ ভারতীয় বিদ্যা ‘গোড়া কেটে আগায় জল দেবার’ এবং ‘বড় শত্রুকে উঁচু পিঁড়ি দেবার’ ভারতীয় বুদ্ধিরই বিকশিত রূপ মাত্র। যেহেতু হিংসায় হিংসা বাড়ে, এই বিদ্যা প্রয়োগ করে মৌলবাদ সেই পরিস্থিতি অতিক্রম করে যায়।

তা সে যাই হোক, আবিষ্কারক যত বড় যুগপুরুষই হোন না কেন, তাঁর সীমাবদ্ধতা থাকেই। কালের প্রকোপ ও জগতের পরিবর্তনশীলতা সেই সীমাবদ্ধতাকে ক্রমান্বয়ে বড় করে তোলে। ফলে একদিন সৃষ্টি হয় সেই পরিবেশ, পরবর্ত্তী যুগপুরুষের আবির্ভাবকে যে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। অন্যদিকে প্রচলিতের স্বার্থচিন্তা মৌলবাদকে ওই বিষয়ে সতর্ক করে। তখন পূর্ব্ববর্ত্তী যুগপুরুষকে কেবল পূজাই নয়, কেবল অপরিবর্তনীয়ই নয়, আরও আরও মহান বলে তুলে ধরে উৎসব৩ লাগিয়ে দেওয়া হয়। এমন যে, উৎসবের নিত্যতায় কণ্টকিত ক্যালেণ্ডারে ফাঁকা তারিখ পাওয়া কঠিন হয়; অবকাশ থাকে না পরবর্ত্তী যুগপুরুষের ডাক শুনবার। Status Quo নিশিন্ত হয়। পূজা ও উৎসবের মৌলবাদী সংস্কৃতি বিজয়গৌরবে অনুশীলিত হতে থাকে।

(প্রশ্ন উঠতে পারে – তাহলে কি পূর্ব্বপুরুষ ও বিগত মনীষীদের শ্রদ্ধা জানানো যাবে না, স্মরণ করা চলবে না তাঁদের মহান কীর্তিগুলি? শ্রদ্ধা জানানোর সহজ ও শ্রেষ্ঠ পন্থা হল তাঁদের আরব্ধ কাজ সমাপনের চেষ্টা করা, এবং সেই উদ্দেশ্যে তাঁদের সীমাবদ্ধতা, অক্ষমতা, পরিকল্পনা ও পরিকলপনার সাফল্য ও ব্যর্থতার বিষয়ে অনুসন্ধান ও স্মৃতিচারণ করা তো অবশ্যই জুরুরী। সুতরাং, শ্রদ্ধা জানানো বা স্মরণ করা যাবে না, এ কেমন কথা! বক্তব্য হল, উদ্দেশ্যহীন স্মৃতিচারণ ও পূজা করা কেবল অন্য উদ্দেশ্যময়তাকে প্রকট করে। শ্রদ্ধাব্যাকুলেরা কেন শ্রদ্ধাস্পদের আরব্ধ কাজে হাত লাগায় না? কেবল পূজা করে মনীষীর গৌরবকে আত্মসাত করতে লাগে কেন? কিন্তু এসব কথা এখন থাক)।

পূজা ও উৎসবের মৌলবাদী সংস্কৃতির মোহজাল ছিন্ন করে এবার যে আসে, সে আবির্ভূত হয়েই মূর্ত্তি ও পূজা ধস করবার দাবী তোলে। যেহেতু সম্মুখসমরে পরাজয়ই মৌলবাদের ভবিতব্য, একসময়ে সে পথ ছেড়ে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই সে ওই মূর্ত্তি-পূজা-বিরোধীর পূজা শুরু করে দেয় – ব্যক্তিপূজা বা personality cult-এর সঙ্গে এবার সাক্ষাত হয় সমাজের। এবার মূর্ত্তি আর পূজা দুটোই দেখা যায় না, অথচ দুটোই চলতে থাকে সগৌরবে, এমনকি বংশপরম্পরায়। যেমন, দুশ্চিন্তা যখন সমস্ত বিপত্তির মূল, তখন দুশ্চিন্তার হাত থেকে পরিত্রাণের দুশ্চিন্তায় দিন কাটে; দুশ্চিন্তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। তেমনি পূজার হাত থেকে পরিত্রাণ পায় না সমাজ, এখন থেকে পূজা-বিরোধী-পূজার যুগের সূত্রপাত হয়। যুগপুরুষের মূর্ত্তি গড়তে যেহেতু যুগপুরুষ নিজেই মানা করে গেছেন এবং সেই নিষেধের কথা সবাই জানে; সেহেতু তাঁর মূর্ত্তি গড়া না হয় এখন বাদ থাকুক, তাঁর চুল নিয়ে, চাদর নিয়ে, পাগড়ি নিয়ে, চিতা বা চিতাভস্ম নিয়ে, কিংবা কবর নিয়ে এক নতুন ধরনের মণ্ডপ মন্দির দরগাহ্‌ সৌধ গড়ে ফেলা যাক – ‘মূর্তিহীন প্রতিমা দেখুন’। এখন আবার মৌলবাদ-বিরোধী-মৌলবাদের বিজয়ডঙ্কা বাজতে থাকে।

মৌলবাদ-বিরোধী-মৌলবাদের বহুরূপ, খণ্ড ও অখণ্ড। সাধারণত মনীষী বা যুগপুরুষের মৃত্যুর পর ‘স্মারক কমিটি’ বানান থেকে ওই মৌলবাদী প্রক্রিয়ার শুরু হয়, শেষ হয় বিশালকায় ধর্ম্মতন্ত্রে, ধর্ম্মপ্রতিষ্ঠানে, এমনকি বিধান (=আইন=ধর্ম্ম) সভায়। খ্রিস্টান, মুসলমান, হিন্দু, শিখ, কমিউনিস্ট, সেকুলার পর্য্যন্ত সবাইকে মৌলবাদ এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে মৌলবাদ-বিরোধী-মৌলবাদে পরিণত করে থাকে। তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রে মৌলবাদ আজ অত্যন্ত কট্টর কঠোর এমনকি বংশানুক্রমিকও বটে। অতীত হওয়া যুগপুরুষের মূর্ত্তি গড়ে পূজা করাটাই যা কেবল বাদ যায়। সমগ্র আবহ ও পরিমণ্ডল সহ গোটা অতীতটাই অনুবর্তিত হতে থাকে, বর্তমানের বুকের উপর দিয়ে অতীত (=ভূত) গড়াতে থাকে। সে দৃশ্য দেখা যায় বড়দিনে, দেখা যায় মহরমের মিছিলে, দেখা যায় নানকের জন্মদিনে, দেখা যায় ‘মে-দিবসের’ প্রভাতে, দেখা যায় স্বাধীনতা দিবসেও। সেকুলার মৌলবাদীর অতীতপিয়াস ব্রিটিশ প্রধান্মন্ত্রীকে (হায়রে! তাকে তাড়িয়েই তো ভারতের স্বাধীনতা) ডেকে এনেই শান্তি পায় না, কলকাতার ৩০০ বছর পূর্ত্তির নামে জব চার্নককেও ডাকে।

টীকাঃ তথ্যসূত্র ও অন্যান্য

১। ‘যাহা দ্বারা সম্পন হয়’ তাকে ‘সম্পত্তি’ বলে। দ্র- বঙ্গীয় শব্দকোষ।

২। এই উদ্ধৃতিটি কার্ল মার্কসের ‘ভারতে ব্রিটিশ সাসন’ নামক নিবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাপারের আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘অবস্থার প্রভুরূপে মানুষকে উন্নত করা’-কে ‘আত্মকর্ত্তৃত্বে মানুষকে উন্নত করা’ বলে।

৩। উৎসব হল সেই ঘটনার স্মৃতি কণ্ডূয়ন, যে ঘটনা প্রচলিতের গণ্ডী অতিক্রম করে প্লাবিত করেছিল বা উৎসেক ঘটিয়েছিল; যে কারণে ওই উৎসব। উৎসেক=’আধার অতিক্রম পূর্ব্বক প্লবন’;। দ্র-বঙ্গীয় শব্দকোষ।

(ঙ) বিপত্তি

শিক্ষাবিভাগ, কৃষিবিভাগ, পূর্তবিভাগ, এইরূপ এক একটি বিভাগের যিনি হর্ত্তাকর্ত্তাবিধাতা, তাঁকে দিকপাল বা দিগ্‌গজ১ বলে। কারণ তিনি সমাজের একটি দিক রক্ষা করেন। এইসব ‘বিগ-গাই’দের হিন্দিতে আজও ‘হস্তী’ বলা হয়। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে সব হস্তীর এক স্বভাব ধরা হয়; তা সে সংসার অরণ্যের হোক হিংবা প্রাকৃতিক অরণ্যের হোক। হস্তীযূথের নিয়ম এই যে, পুরুষ শিশু জন্মালেই পালের গোদা তাকে মেরে ফেলে। সেই কারণে গর্ভিনী হস্তিনী দলছুট হয়ে সন্তান প্রসব করে। মেয়ে শিশু জন্মালে সরাসরি দলে ফেরে; অন্যথায় সে পালায়; আর পালের গোদা তাকে খুঁজতে থাকে। সুযোগ পেলে বাচ্চাটিকে সে মেরে ফেলে। আর যদি কোনওভাবে ওই হস্তী শিশুটি সেই বিপাক কাটিয়ে বেঁচে যায়, দাঁতাল হবার পর সে ফেরে এবং এক নির্ম্মম যুদ্ধান্তে ওই নবযুবক নতুন দলপতি হয়২।

মৌলবাদের অনুগামিনী ইন্দ্রস্ত্রীর ব্যবহার ওই হস্তিনীর মতো। কিন্তু ইন্দ্রস্ত্রীকে আধুনিক বাঙলা ভাষাভাষীগণ চেনেন না। সুতরাং আগে তার বিষয়ে দু-চার কথা বলে নিতেই হয়। বেদপুরাণাদির পাঠকেরা তো ইন্দ্রকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। পাওয়া যায়নি। নানারকম কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। নিজেদের সভ্য আধুনিক ভাবার অহঙ্কার থেকে প্রথমেই ভেবে নেওয়া হয়, অতীতের নামী কেউ কি আর যুদ্ধবাজ বর্ব্বর ন হয়ে যাবে। ইন্দ্রকে তাই ‘সর্দার’ মনে করার জন্য ইউরোপকেই পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। ভারত যে কলিযুগ বা যন্ত্রযুগে পৌঁছে তারপর বহু জ্বালায় সব অগ্রগতি স্তব্ধ করে দিয়ে পশ্চাতে আগমনকারীদের প্রত্যাশায় বসে বসে ‘অর্দ্ধসভ্য-অর্দ্ধবর্ব্বর’ হয়ে গেছে, সেকথা তরুণ ইউরোপ জানবে কী করে? অথচ এককালে ইন্দ্রস্ত্রীপতি ইন্দ্রের৩ রপ্তানিকৃত পণ্যই ওই দেশগুলিতে ইন্দ্রের পণ্য বা ইন্দ্রিয় পণ্য নামে পরিচিত হয়েছিল বলেই ভারত আদ্যিকাল থেকে বিদেশে ইন্‌ড্রিয়া বা ইণ্ডিয়া নামে পরিচিত হয়ে যায়। ‘ঈশীয়’ দেশের নিকট থেকে তখন ‘ইষ্ট’ লাভ হত বলেই ‘Asia’ তাদের নিকট (East) রূপে চিহ্নিত হয়েছিল; আর এঁরা ‘অরি-অন্ত করে ইষ্টলাভ’ করেছিলেন বলেই তাদের চোখে ছিলেন ‘Orientalist [অরি-এন্তা-৯(লি)-ইষ্ট]’। কেশ (=case) শব্দের ইতিহাস সন্ধান করতে করতে ‘ইন্দ্রলুপ্ত’তে পৌঁছনোর পরও সে তথ্য জানতে পারে যায়। যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে। এখন বরং আগের কথায় ফিরে আসা যাক।

মৌলবাদের অনুগামিনী ইন্দ্রস্ত্রীর বা Industry-র অবস্থা ওই হস্তিনীর মতো। মৌলবাদী সভ্যতার সে অতি ঘনিষ্ঠ অঙ্গ। হলে কী হবে, নিত্য নতুন আবিষ্কার না হলে ইন্দ্রস্ত্রীপতি (=Industrialist) ইন্দ্রের চলে না। সে সদা শঙ্কিত এই বুঝি তার ইন্দ্রত্ব চলে গেল। কে কোথায় তপস্যা (=শ্রম /বঙ্গীয় শব্দকোষে শ্রম শব্দটি দ্রষ্টব্য) করছে, নতুন কী আবিষ্কার করছে, বলা যায় না। নতুন পণ্যটি যদি রাতারাতি বাজারে চলে আসে? তাহলে সবই একদিন নবাবিষ্কারকের হাতে চলে যাবে। মার্কেট বেহাত হয়ে যাবে, ইন্দ্রত্ব থাকবে না। সুতরাং, তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানো চাই ঃ অথবা আত্মসাৎ করতে হবে তপস্যার ফল। তাই দিয়ে উৎপন্নের ও উৎপাদনের উপায়গুলির নিত্যবিকাশ জরুরী, কেননা নিত্যবিকাশই সারপ্লাস ভ্যালুর (=সরের) জন্মদাতা, অপ্‌-সরা (বা অপ্সরা)-দের গন্ধর্ববিদ্যার ভিত্তি। ইন্দ্রের অস্তিত্বের সঙ্গে নিত্যবিকাশ এইভাবে জড়িয়ে যাওয়ায়, ইন্দ্রস্ত্রীপতি Industrialist-রাই স্বাভাবিক বিশুদ্ধির নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে বসে। আর এই প্রশ্রয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একরাশ বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার দার্শনিক গণিতবিদ প্রভৃতি শৈবাচারীদের জন্ম হয়ে যায়।

তবে সর্ব্বপ্রকার অবিষ্কারেই ইণ্ডাস্ত্রিয়ালিস্টের অর্থকরী সুবিধা হবে – এমন নয়। সমাজের পক্ষে বহু হিতকর আবিষ্কারও ইণ্ডাস্ত্রিয়ালিস্টের পক্ষে লাভজনক নাও হতে পারে। সেইরূপ আবিষ্কার সমূহ ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের প্রশ্রয়ের প্রত্যাশায় তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও অনেক সময় প্রত্যাখ্যাত ও পরিত্যক্ত হয়। এই সেই হেতু, যে কারণে লো-কস্ট্‌ আবিষ্কারগুলি কল্কে পায় না। উদাহরণ স্বরূপ, স্বাস্থ্যবিভাগে হোমিওপ্যাথি, পূর্তবিভাগে লো-কস্ট স্ট্রাকচার ইত্যাদির উল্লেখ করা যেতে পারে। উৎপাদনের প্রায় সমস্ত বিভাগে উৎপন্নকে আরও সস্তা করার উপায় আছে, না থাকলে সেগুলি আবিষ্কার করা সম্ভব। কিন্তু অলাভজনক বলেই সেগুলি পরিত্যক্ত বা অবহেলিত হয়। বিপরীতে শিল্পপতির পক্ষে লাভজনক আবিষ্কারগুলির এভারেস্ট আরোহন ঠেকানো যায় না। এ হল স্বাভাবিক-বিশুদ্ধির একপেশে বিকাশ। আর বিস্ময়ের কথা এই যে, হস্তিনীর ওই সন্তানের মতো, স্বাভাবিক-বিশুদ্ধির এই একপেশে বিকাশই মৌলবাদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে বসে এবং দেখতে না দেখতে একদিন স্বাধীনতার দাবীকে গণতন্ত্রের নামে প্রতিষ্ঠা করে দেয়।

অঙ্গহানি হয় মৌলবাদের, তবে তার প্রাণশক্তি প্রায় অক্ষুন্নই থাকে। সে তার ‘পুরাতনের পনরাবৃত্তির’ ও ‘একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির’ নীতির সাহায্যে সমস্ত আবিষ্কারকে গলাধঃকরণের চেষ্টা চালায়। …যারা জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে ভুগেছে, ভুগছে, অধর্ম্মের মর্য্যাদা প্রতিষ্টিত হওয়ায় যারা আত্মমর্য্যাদা খুইয়েছে, যারা মূর্ত্তি ও পূজা ধংস করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে – বহুকাল ক্রমাগত সেই শতরূপা শক্তিকে মৌলবাদ আত্মসাৎ করে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে। তাদের সেই শক্তি বা ‘তেজকে সমাজের (অর্থাৎ তাদেরই) বেড়ী গড়বার জন্য প্রবল বেগে খাটাতে থাকে’ মৌলবাদ। সে তাদের ‘স্বভাবের এমনই বিকৃতি ঘটায়’৪ যে ‘সর্বাগ্রে ছুটে চলার’ পরিবর্তে ‘তারাই পথের মধ্যে প্রাচীর তুলবার জন্য সবচেয়ে উৎসাহের সঙ্গে লেগে থাকে। প্রাণের জোয়ারে কাজ করবার জন্য তাদের জন্ম, কিন্তু (মৌলবাদ) সেই পথ রুদ্ধ করায়, তারা বন্ধ করার কাজেই কোমর বেঁধে উঠে পড়ে লাগে।’৫ তখন পৌত্তলিকতাবাদী বা পৌত্তলিকতা-বিরোধীরাই কেবল কট্টর মৌলবাদীরূপে প্রতীয়মান হয় না, জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে ‘ভাবমূর্ত্তি-পূজা-বিরোধী’ সাম্যবাদীরাও কট্টর মৌলবাদী হয়ে ওঠে। আর মূল থেকে ওই মৌলবাদীদের দূরত্ব যত বাড়ে, কট্টরতাও সেই অনুপাতে বাড়তে থাকে। এই জন্যই দেখা যায়, ভারতের বৌদ্ধধর্ম্ম জাপানে, আরবের ইসলাম ভারতের প্রান্তসীমায়, জার্ম্মানির মার্কসবাদ চীনদেশে কট্টর হয়ে যায়। ‘মূল থেকে দূরত্ব’ কথাটা স্থান ও কাল উভয় ক্ষেত্রেই কমবেশী খাটে।

এই কট্টরতার কারণটিও এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করে যাওয়া যাক। বস্তুত ‘খুল যা সিম সিম’ কিংবা ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রের প্রকৃত রহস্য কেবল জানা থাকে উদ্ভাবকের। প্রয়োজনে সেই তার মন্ত্রটাকে এমনভাবে বদলে নিতে সক্ষম, যাতে তার পরিবর্তিত মন্ত্রেও তখন সৌভাগ্যের দরজাটা খুলবে। কিন্তু, যে কোন know-how কেনে, দেখে কিংবা শুনে শেখে এবং তাই দিয়ে নিজের জীবন সুরক্ষিত করতে চায়, সে জানে – একটু ইতর বিশেষ হলেই দরজাটা আর খুলবে না। সুতরাং মন্ত্রটা (থিয়োরিটা) তাকে অবিকল নকল করে যেতে হয়, যেতে হবে। অন্যথায় অভিযোগ শোনা যাবে – তোমাদের ভক্তিতে ফাঁক ছিল, তোমরা শোধনবাদী; তাই ভাগ্যের দরজা খোলেনি।

এরপরও আছে। মৌলবাদ তার ‘গোড়া কেটে আগায় জল দেবার’ বিদ্যাটি ব্যর্থ হতে দেখলে নতুন উপায় অবলম্বন করে। বঙ্গীয় লোকভাষায় তা হল – ‘যার শিল যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’। যাকে হত্যা করা হবে, হত্যার উপায়টি তারই বাড়ী থেকে সংগ্রহ করার জন্য রোম্যাণ্টিক কবি রবীন্দ্রনাথকে এমন ফুলিয়ে দেওয়া যে, মৌলবাদী-বিরোধী রবীন্দ্রনাথকে প্রায় দেখাই যায় না। দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে যান। বিদ্রোহী কবি নজরুলকে ফাঁপিয়ে নজরুলের বাকী সত্তাটিকে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়।

কোনও উপায়গ্রহণ করতে না পারলে, মৌলবাদ হিংসার আশ্রয় নেয়। এই তার আদি ও অন্তিম রূপ। তখন পাকা মৌলবাদীরা কাঁচা বা খোকা মৌলবা্দিদেরকে অহিংস হবার উপদেশ দেয়। সেইসব উপদেশের বহর দেখে এমনকি স্বভাবত বিশুদ্ধবাদীরাও ঠকে, ভাবে ওই উপদেশ দাতাটিও বুঝিবা মৌলবাদ-বিরোধী। ক্রমে একদিন তার বহুরূপী কৃকলাস-বৃত্তি শেষ পর্য্যন্ত ধরা পড়ে। তখন তার ফিরে যাওয়ার পালা, তার আদি উৎসে; যেখানে সে শায়িত থাকবে সুদূর ভবিষ্যতে আবার জেগে উঠবার জন্য। স্থিতি তার নাম। এই জগতে যতদিন গতি থাকবে, ততদিন স্থিতিও থাকবে। এই রূপে সে হয়তো গতির মতই অমর।

টীকাঃ তথ্যসূত্র ও অন্যান্য

১। দিগ্‌গজ=দিক্‌রক্ষক হস্তী, দিক্‌বারণ, দিক্‌পতি, দিক্‌পাল ইত্যাদি। এদের সংখ্যা পুরাণাদি অনুসারে দশ। কেননা দশদিক রক্ষা করার ব্যাপার। রামের পিতা দশ-রথ, এবং রাবণের দশ মাথা সেকারণেই। পুরাণগুলিতে, বিশেষত বিষ্ণুপুরাণে, দিগ্‌গজদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। সেই বিবরণে ‘দ্বীপ’,’পর্ব্বত’ (বানান ঠিক এইরকম নাহলে অর্থ বদলে যায়) ইত্যাদি নিয়ে বহু কথা আছে। সেই সব কথাকে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে না বুঝে ভারতের নকশা বানানোর সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাপারে শ্রীদুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয়ের আসুরিক পরিশ্রম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। বস্তুতু দ্বীপ অর্থে নির্ব্বাচিত একদল সমাজ পরিচালকদেরও বোঝায়, যাদের চারদিকে জনসাধারণ (=জল) বিদ্যমান। বলা হয়েছে প্রত্যেক দ্বীপে সাতটি করে পর্ব্বত (=administrative body) বিদ্যমান, যা পর্ব্বে পর্ব্বে (=rank and file-এ) বিন্যস্ত। তার দশটি দিক (দ্র- ‘উত্তানপাদ হইতে দিক্‌ হইল’- ঋগ্বেদ) দশ জন আমলার হাতে, অর্থাৎ দশটি বিভাগীয় প্রধানই দশ দিগগজ। যেমন দক্ষিণ (দক্ষিণা, দান ইত্যাদি) দিকের দিক্‌রক্ষক ধর্ম্মাবতার যম (=কোর্ট)। এখন এর বিভাজন আরও বেড়েছে বলেই আইনমন্ত্রী, আইনসচিব, সর্ব্বোচ্চ বিচারপতি, এঁরা পৃথক ব্যক্তি।

২। ঘাটশিলার জঙ্গল থেকে এমনি এক হস্তিনী পালিয়েছিল পার্শ্ববর্ত্তী চুকরিপাড়া গ্রামে, শিশু-সন্তানকে শুঁড়ে তুলে বিপজ্জনক খরস্রোতা নদী সাঁতার দিয়ে পেরিয়ে। সেই ঘটনার কার্য্যকারণ ব্যাখ্যা করেন গ্রামবাসীরা। লেখকের সেই অভিজ্ঞতা। এ বিষয়ে হস্তীবিশেষজ্ঞদের মতামত লেখকের অজ্ঞাত।

৩। বিষয়টি পরে বিস্তারিতি ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে লেখকের ‘শব্দের বর্ডার ক্রসিং’ শীর্ষক নিবন্ধে, যা সঙ্কলিত হয়েছে লেখকের ‘আত্মহত্যা থেকে গণহত্যা ঃ আসমানদারি করতে দেব কাকে’ নামক গ্রন্থে।

৪। কট্টর জাতীয়তাবাদ বা ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি সেই বিকৃতির উদাহরণ। ‘আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি’ এইরূপ বিকৃতি।

৫। দ্রষ্টব্যঃ ‘বিবেচনা অবিবেচনা’, – রবীন্দ্রনাথ।

(চ) নিষ্পত্তি

সুতরাং মৌলবাদ আত্মস্বরূপে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা যতই চেষ্টা করুক, শেষরক্ষা হয় না।

এই পৃথিবী তো কেবল জ্ঞানবৃক্ষের চাষই করেনি, তাকে ধ্বংস করার জন্য প্রচুর কাঠখড় মঠ মন্দির মসজিদ গির্জ্জা শিক্ষানিকেতনও জ্বালিয়েছে, পড়িয়েছে। জ্ঞানের সু ও কু উভয় প্রকারের ফল ও ঐতিহ্যের ধারক এই সমাজ অবশেষে সিদ্ধান্ত করে – জ্ঞানচর্চ্চা ভালো, কিন্তু জ্ঞান বিক্রয় ক্ষতিকর। সবচেয়ে অহিংসবাদী মনীষীর মুখ দিয়ে তাই ঘোষিত হয় – ‘দৈহিক শ্রম করতে হবে দেহের তৃপ্তির জন্য, এবং মানসিক শ্রম (=জ্ঞানচর্চ্চা) করতে হবে আত্মার তৃপ্তির জন্য… …মানসিক শ্রমের কোনও দাম হওয়া উচিত নয়’১। ‘ঐক্যমূলক যে সভ্যতা মানবজাতির চরম সভ্যতা (অর্থাৎ সাম্যবাদ), ভারতবর্ষ চিরদিন ধরিয়া বিচিত্র উপকরণে যাহার ভিত্তি নির্ম্মাণ করিয়া আসিয়াছে’২, ফিরে আসে সেই ঐক্যমূলক সভ্যতার সিদ্ধান্ত – ‘মূর্খের চেয়ে পড়ুয়া, পড়ূয়ার চেয়ে স্মৃতিধর, তার চেয়ে প্রয়োগকারী শ্রেষ্ঠ। সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সেই যে জ্ঞান (=থিয়োরি) ও কর্ম্মের (=প্র্যাকটিসের) সমুচ্চয় ঘটায়’৩। সমাজ বুদ্ধিজীবীকে শ্রমজীবীতে৪, কিংবা শ্রমজীবীকে বুদ্ধিজীবীতে পরিণীত করবার বৃথা চেষ্টায় কালক্ষেপ করে না; উভয়কে পুনরায় জ্ঞান-কর্ম্ম-যোগীতে উন্নীত করে মানুষকে ‘মহান’৫ করে তোলার পথ খোঁজে। এবং এভাবেই জ্ঞানী-কর্ম্মী, বুদ্ধিজীবী-শ্রমজীবী, নর-নারী, পুরুষ-প্রকৃতি, আত্মা-দেহের বহুকালক্রমাগত দ্বন্দ্বের সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। যার ফলে একদিন ‘প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা মানুষ শুধু অনুভব নয়, উপলব্ধিও করবে (দূষণ সচেতনতার আধুনিক উদ্ভব স্মর্তব্য), … …অসম্ভব হয়ে উঠবে মানস ও বস্তু, মানুষ ও প্রকৃতি, দেহ ও আত্মার মধ্যে বিরোধের ধারণা …'(এঙ্গেলস); যখন জ্ঞান ও কর্ম্মকে আর পৃথক করা যাবে না, কর্ম্মক্ষেত্রগুলি একাধারে উৎপাদনক্ষেত্র ও শিক্ষাক্ষেত্র হয়ে যাবে; প্রতীয়মান হবে যে, কর্ম্মক্ষেত্র থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ‘লেখাপড়া না শিখলে জীবন বৃথা, এটা একটা কুসংকার মাত্র’ (মহাত্মা গান্ধী) – এই সেই পরিস্থিতি! শিক্ষার নামে ছেলেমেয়েদের কাঁচা খেয়ে ফেলার চেয়েও মন্দ ও হিংস্র যে ব্যবহার শিক্ষিকশ্রেণী ও অভিভাবকেরা উত্তসূরিদের সঙ্গে বর্তমানে করে থাকেন, একমাত্র এই পরিস্থিতিতেই তার থেকে সমাজ তাঁদের মুক্তি দিতে পারে, দেয়। বর্ত্তমান ভূতের (=অতীতের) হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে।

মৌলবাদের এই পরিণতি হবেই, কেননা তার শেষরক্ষা হবার নয়। কেন নয়?

এক মিথ্যার পিছনে শত শত মিথ্যার সমর্থন জুগিয়েও তাকে বাঁচানো যায় না। মিথ্যার পাহাড় একদিন হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ে। মৌলবাদের সৃষ্ট পাপের পাহাড়ও একদিঙ ভেঙে যায়। একই কর্ম্ম ও একই জ্ঞানের পাহাড়ও একদিন ভেঙে যায়। একই কর্ম্ম ও একই জ্ঞানের পুনরাবৃত্তিকারী শেষ দক্ষ ও শেষ ভৃগু যথাক্রমে (সৃজনশীলতাহীন) ইঞ্জিনিয়ার ও (সৃজনশীলতাহীন) বিজ্ঞানীরা সমাজের সাধারণ জ্ঞানের উপত্যকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশেষজ্ঞতার চরম শিখরে পৌঁছে নিজেরাই টলে পড়ে। অত্যন্ত জটিল ও বিপুলাকায় গবেষণা সংস্থাগুলি একে একে ঝাঁপ ফেলে (আমেরিকার নাসার পরিণতি স্মর্তব্য)। সর্ব্বাধুনিক, ‘মোস্ট সফিস্টিকেটেড’, অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য কম্পিউটারও পূর্ব্ববিধানের সীমা টপকে লীলাবতী হতে পারে না (কোনও কম্পিউটারই মানুষের মতো আন্দাজ করতে পারে না), তাদের সমস্ত কাজ হয় অব-লীলায়। কোনো কোনও প্রযুক্তির প্রতিক্রিয়া সেই সেই প্রযুক্তির সুবিধার চেয়ে এত বড় হয়ে দেখা দেয় যে, সেই সেই প্রযুক্তি বর্জ্জন করাই যুক্তিযুক্ত হতে থাকে। (খণ্ড) জ্ঞান বা অব-গতি৬ তখন কেবলমাত্র মানুষের ‘নীচে নেমে দাঁড়ানো’ বা under-standing মাত্র নয়, সম্পূর্ণরূপে মানুষের ‘বোঝা’র (load-এর) ব্যাপার। পড়তে পড়তে (=reading / falling ) বই-তে বইতে সেই বোঝা বাড়ে বই কমে না; অবগতির চূড়ান্ত হয়। তদুপরি বিভাজিত অবগতি বা জ্ঞান তার শাখা-প্রশাখা উপশাখা পেরিয়ে তার এত দূর অতি-উপশাখায় পৌঁছে যায় যে, সেখান থেকে কাণ্ডটাকে আর দেখাই যায় না; সেইখানে পৌঁছে যাওয়া বিশেষজ্ঞ-জ্ঞানীদের স্বভাবতই ‘কাণ্ডজ্ঞান’ থাকার উপায় থাকে না। ফলে, সেই সকল দক্ষ-ভৃগুর পাপস্বরূপ জ্ঞানবৃক্ষ, অধর্ম্ম, বর্ণাশ্রম, ধর্ম্মনিরপেক্ষতা, মূর্ত্তি, পূজা, ভাবমূর্ত্তি-পূজা ইত্যাদির ফলিত প্রয়োগের পাহাড়প্রমাণ বোঝা বহন করতে বসুমতী৭ অপারগ হয়। তখন ভূ-ভার হরণের জন্য আবার যুগপুরুষের ডাক পড়ে। তখন ঝিঁঝি পোকার কান্নার মতো, (সে তো কান্না নয়, দয়িতের জন্য ব্যাকুল চিৎকারের প্রতিযোগিতা) অজস্র কণ্ঠে সেই ডাক ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে; কেউ সুরে কেউবা বেসুরে তাতে গলা মেলায়। খোকা মৌলবাদ বিকট শব্দে সেই গলা টিপে ধরে। ধাড়ি মৌলবাদ তাকে বকাঝকা করে – ওরে ছাড়, ছাড়। কিন্তু ততক্ষনে সেই বিকট শব্দে যুগপুরুষ জেগে ওঠেন। প্রচলিতের পাপ যে রক্ত ঝরায়, তাই দিয়ে ইতিহাস সেই যুগপুরুষের শরীর নির্ম্মাণ করে। তিনি আদিতে আসতেন সত্তারূপে। মাঝে তাঁর আগমণ ব্যক্তিরূপে। শেষে আবার তিনি আসেন সত্তারূপে। তিনি এলে, সব মৌলবাদ অন্তর্হিত হয়। যুগ যুগান্তরে চলে যায়।

টীকাঃ তথ্য ও অন্যান্য

১। দ্রষ্টব্যঃ ‘আমার ধ্যানের ভারত’ / মহাত্মা গান্ধী।
২। দ্রষ্টব্যঃ ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ / রবীন্দ্রনাথ।

৩। মনুসংহিতার একটি শ্লোকার্থ যৎসামান্য পরিবর্তিত করে এটি লিখিত হল। মনু স্বয়ং এই নীতির বিরোধী হলেও পূর্ব্বসূরীর ভাষা যেমন ত্যাগ করতে পারেননি, পূর্ব্বসূরীর কিছু কিছু নির্দ্দেশ তাঁর আইনশাস্ত্রে রেখে দিয়ে গেছেন। এটি তারই একটি। তবে ‘সমুচ্চয়’ কথাটি নেওয়া হয়েছে বৃদ্ধ হারীসংহিতা থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন -“যেমন অশ্বহীন রথ নিশ্চল, ও রথহীন অশ্বও গতিহীন হয়, সেইরূপ তপো(কর্ম্ম)হীন জ্ঞানও বিকল, অতএব তপস্যা (কর্ম্ম) ও ব্রহ্মজ্ঞান উভয় মিলিত (সমুচ্চিত) হইলেই সংসার রোগের ঔষধ হয়।’ …মহাভরতে জ্ঞান ও কর্ম্মকে ‘হংসের দুটি ডানা’ বলা হয়েছে।

৪। শোনা যায়, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পর স্তালিন ও মাও-সে-তুঙ দুজনেই নাকি ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও একসময় দিনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা কায়িক শ্রম করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তা রূপায়ন করারও চেষ্টা করেছিলেন; যাতে পার্টির অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরাও তা করে।

৫। আদিম সাম্যবাদ কিংবা ভবিষ্যতের সাম্যবাদ – দুটোই ঐক্যমূলক সভ্যতা। রবীন্দ্রনাথের মতে, “ঐক্যের আদিম অর্থ জন্মগত ঐক্য, তার চরম অর্থও তাই।’ (দ্র-‘সমস্যা’)। জন্মগত ঐক্যে যেখানে নীতি বা ধর্ম্মের বিশ্বাস নেই, ঐক্যের কোনও প্রচেষ্টা সেখানে কখনও সফল হতে পারে না। স্মর্তব্য যে প্রাচীন ভারতীয় আদিম সাম্যবাদী সমাজের মানুষদের ‘মহান’ বলা হত। এ ব্যাপারে সব পুরাণই সাক্ষী। বিস্তারিতি ব্যাখ্যা পরে।

৬। হাউই চলে যায় ছাই পিছনে ফেলে। কর্ম্ম হয়ে যায়, থেকে যায় অভিজ্ঞতা। সেটাই পরিণত হয় জ্ঞানে। কর্ম্ম থেকে বিযুক্ত এই যে গতি,সেটাই অব-গতি।

৭। আদিম সাম্যবাদী সমাজে নিয়ম ছিল ‘বসালিপ্ত তৃণ’কে কেউ ‘আমার’ বললে, তাকে হত্যা করা হবে। তৃণ শব্দের অর্থ ধান্য বা নীবার। ধান্য থেকে ধন এবং নীবার থেকে নীবী (=বণিকের মূলধন) হয়। বসা বা চর্ব্বি হচ্ছে সামাজিক ‘অবশেষ’ (>abscess=পুঁজ), সেই পুঁজ জমে জমে একদিন পুঁজি হয়। প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ক্যাপিট্যালকে এই নজরেই দেখত। সেই বসা নিয়ে যাঁদের প্রথম কারবার প্রাচীন ভারতে তাঁরাই বসুদেবগণ। (কোথাও বা তাঁদেরকে পিতৃদেবগণ বা পিতৃগণ বলা হয়েছে। এঁরা আদি ব্যবসায়ী। এঁদের উত্তসূরিরা আজও ‘বসু’ পদবী ধারণ করেন। তবে, তাই বলে সবাই তো এখন আর ব্যবসা করেন না। যাই হোক, এখানে ‘বসুমতী’ শব্দের পৌরাণিক অর্থটুকু বোঝা চাই। তর মানে এখানে ‘বসুমতী বলতে earth বোঝানো হচ্ছে না। যে জগত ব্যবসায়ীদের অভিমত অনুসারে চলে, তাকে ‘বসুমতী’ বলে। আর ব্যবসায়িদেরকে যে জগত ধারণ করে রাখে, তার নাম হল ‘বসুধা’।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত পুনঃপঠন, মৌলবাদ : তত্ত্ব — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *